বদি ভাই-এখন তিনি ছবি

১৯৬৮ থেকে ২০১৮, মোট ৫০ বছর।

এই পঞ্চাশ বছরের আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের মধ্যে যে ব্যক্তিটি আমাদের পরিবারের কেউ না হয়েও পরিবারে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা পালন করতে এক্যটু ও দ্নিবিধা করেন নাই, তিনি হচ্ছেন বদ্রুদ্দিন তালুকদার ওরফে বদি ভাই। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ কি বারো যখন আমি প্রকৃত পক্ষে এই বদি ভাইকে জ্ঞ্যানের মাধ্যমে চিনি। কিন্তু তার আগে থেকেই এই বদি ভাই আমাদের পরিবারের সাথে যুক্ত ছিলেন।

আমার বাবা কবে কিভাবে কি কারনে মারা গেলেন তা আমার কোনো ধারনা নাই। আমার বয়স তখনহয়ত ২ কি আড়াই হয়ত হবে। আমার বাবা ছিলেন অনেক ধনি মানুস, মাদবর মানুস। সমাজে তার গ্রহনযোগ্যতা ছিল অনেক অনেক বেশি। কিন্তু তার শত্রুও ছিল অনেক। বিশেষ করে আমাদের পরিবারের ভিতরেই অনেক শত্রু ছিল। আর তারা হচ্যাছেন আমার সতালু ভাই বোনেরা। বিশেষ করে তাজির আলি নামে যে ভাইটি ছিলেন, সে ছিলো চারিত্রিকভাবে একজন খারাপ মানুষ।  যাই হোক। বাবা মারা যাবার পর আমাদের যাবতিয় জমিজমার আধিপত্যতা এক সপ্তাহের মধ্যেই হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে ক্যাশ টাকা না থাকায় আমাদের পরিবার অনেক সমস্যার মধ্যে পরে। আমার বড় ভাই সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ইউনিভারসিটিতে ভরতি হয়েছেন। ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নাই, মাথার উপর কোনো অভিভাবক নাই এবং তার মধ্যে পাচ বোন এক ভাই এর বোঝা তার উপর। কিভাবে সংসার চালাবেন, কোথা থেকে টাকা আসবে কিংবা নিজেই কিভাবে চলবেন এই চিন্তাই আমার ভাইকে অতিস্ট করে তুল্লো। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর ভাবছেন কি করা যায়, কিভাবে করা যায়।

এই সময় কোনো এক কাকতালিয় ভাবে দেখা হলো এই বদি ভাইয়ের সাথে। তার জীবনটাও এই একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটেছে অথবা কাটছে। ওনাকে আর পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করে বেশি বুঝাতে হয় নাই। বদি ভাই চাকুরি করেন ওয়াব্দা অফিসে মাত্র সেক্সন অফিসার হিসাবে। অল্প আয়, বিয়ে করেন নাই। তিনিও একইভাবে তার ভাই বোন মাকে সাপোর্ট করছেন। থাকেন তিনি ১২৪ নং আগাসাদেক রোড। ছোট্ট একটা রুম, তাতে ইতিমধ্যে তিনজন গাদাগদি করে কোনো রকমে থাকেন আর এক বুয়া প্রতিদিন দুপুর আর রাতের জন্য যত সামান্য বেতনে তাদের ভাত তরকারি পাক করে দেন। বদি ভাই হাবিব ভাইকে ওই ১২৪ নং আগাসাদেক রোডে নিয়ে এলেন। সবাই বদি ভাইকে ভাই বলেন না, সম্মানের সহিত তাকে সবাই স্যার বলেন।

যারা এই রুমে থাকেন, তারাসবাই গ্রাজুয়েট এবং জীবন যুদ্ধে লিপ্ত। একে অপরের জন্য যত টুকু দরকার সাপোর্ট করেন। সবার রোজগার যেনো কম্বাইন্ড রোজগার। একসাথে থাকে সব টাকা, যার যখন যত টুকু দরকার সে ততো টুকুই নেন। কিন্তু হিসাব থাকে। আমার মনে আছে ওই একটা ছোট রুম থেকে বদি ভাইয়ের তত্তাবধানে প্রায় ১০/১২ জন গ্রাজুয়েট বের হয়েছেন যারা পরবর্তী সময়ে দেশের শিরশ স্থানে বসেছিলেন। কেউ ইউনিভারসিটির অধ্যাপক, ডিন, কেউ আরো বড়। দেশে এবং বিদেশে।

এভাবেই বদি ভাই হয়ে উঠেন এক কিংবদন্তি স্যার। সব প্রোটেনশিয়াল মেধাবি হেল্পলেস মানুসগুলিকে বুদ্ধি, যতসামান্য চাকুরির পয়সা দিয়েই এইসব মানুসগুলিকে সাহাজ্য করেছেন। বদি ভাই তার চাকুরি জিবনে ডেপুটি ডাইরেক্টর পর্যন্ত উঠেছিলেন। ওয়াব্দায় চাকুরি করলে দুই নম্বরি করলে ছোট কেরানিও কোটিপতি হয়ে যায় কিন্তু বদি ভাই তার জিবনে দুই নম্বরিতো করেনই নাই, তার দ্বারা দুই নম্বরি হবে এটাও তিনি করতে দেন নাই। ফলে একটা সময় এইসব চোর বাটপারদের আমলে চাকুরির পদবির সামনে এগুতে পারেন নাই। অবসর নিয়ে বাসাতেই ছিলেন।

গ্রাজুয়েট মানুষগুলি তাদের যোগ্যতা অনুসারে ধীরে ধীরে সবাই বেশ ভালো ভালো জায়গায় সেটেল হয়ে গেছেন। সবার সাথেই বদি ভাইয়ের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কাজের চাপেই হোক আর ব্যস্ততার কারনেই হোক ধীরে ধীরে এইসব যোগাযোগও কমে আসে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে অন্য একটি কারনে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগটা ছিলই। আর সেটা হচ্ছে আমার মা। আমার ভাই যখন উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ গেলেন, তখন আমার মাকে দেখভাল করার কোনো লোকই ছিলো না। আর এর ই মধ্যে আমারো ক্যাডেট কলেজের সুযোগ হ ওয়ায় আমার পক্ষেও মাকে কোন অবস্থায় ই কিছুই করার সুযোগ ছিলো না। আমার মাকে বদি ভাই খুব ই ভালো বাস্তেন। নিজের মায়ের মতো করেই দেখতেন। আমার মায়ের জন্য কোনো কাজ করতে বদি ভাইয়ের কখনো ক্লান্ত হন নাই। 

আমি ধীরে ধীরে ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ফেললাম, আর্মিতে গেলাম, আমি মাক্যের দায়িত্ত নিলাম। এই সময় বদি ভাই একটু অবসর পেলেন। ফলে এই দীর্ঘ প্রায় দেড় যোগ বদি ভাইয়ের সাথে আমাদের প্রয়োজনেই আমরা তার কাছ থেকে আলাদা হতে পারি নাই। এমন নয় যে বদি ভাইয়ের এখানে কোন স্বার্থ কাজ করেছে। হ্যা, একটা স্বার্থ কাজ করেছে অবশ্য ই। আর সেটা হচ্ছে, বদি ভাই ও তার ভাইদের থেকে অনেক আলাদা ছিলেন। তার পাশে কেউ আসলে ছিলো না। ঊনি ভাবতেন, আমি বা হাবিব ভাই বা আমরা ই তার আপন জন এবং আপদে বিপদে আমরাই তার পাশে আছি। কথাটা ঠিক। কিন্তু পরবর্তীতে যত টুকু আমাদের পাশে থাকার দরকার ছিলো, আমরা আসলে ততো টুকু পাশে থাকতে পারি নাই। এর কারনও হচ্ছে আমাদের বুঝাপড়ার তফাত। হয়ত এটাই এই স্বার্থপর পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মের একটি। 

বদি ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম মনোমালিন্য টা হয় আমার বিয়ে নিয়ে। এটা মানতে মানতে আমাদের মধ্যে একটা বিস্তর গ্যাপের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। কখনো নরমাল, কখনো আধা নরমাল, আবার কখনো মনে হয়েছে সব ঠিকই আছে। আরেকটা কারন ছিলো যে, হাবীব ভাইয়ের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিকতা। একবার এটা বলেন তো আরেকবার তার সিদ্ধান্ত বদলে অন্য আরেকটি বলা বা আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাওয়া। এইরুপ একটা পরিস্থিতিতে বদি ভাইও আর হাবীব ভাইয়ের ইপর নির্ভর করতে পারছিলেন না। 

একটা সময় চলে এসেছিল যে, আমরা যে যার যার মতো করেই চলছিলাম। ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, সাভাবিক অন্য দশ জনের সাথে আমরা যেভাবে চলি, ঠিক সেভাবেই চলছিলাম। সম্পর্ক খারাপ নয় কিন্তু আমরা খুব ঘনিস্ট কেউ আমরা। হাবীব ভাই বদি ভাইকে সব সময় ই শ্রদ্ধা করতেন এবং শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধাই করতেন। কিন্তু বদি ভাইয়ের জন্য হাবীব ভাইয়ের আরো অনেক কিছুই করার ছিলো। সেটা হয়ত হয় নাই। 

আজ বদি ভাইয়ের মৃত্যুতে একটা বড় অধ্যায় শেষ হলো। আমি তাকে মিস করবো সব সময়। যত কষ্টেই তিনি থাকতেন না কেনো, আমি যখন বদি ভাইয়ের কাছে যেতাম, আমি দেখতাম, তার মধ্যে একটা জীবনী শক্তি ফিরে আসতো। অনেক কথা বলতেন। অতীতের কথা, তার সাফল্যের কথা, তার দুঃখের কথা। আমিও শুনতাম। আজ আর তিনি নেই। তাকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুন।