আমার ড্রাইভার ছিলো রুস্তম। একবার রুস্তম আমারে বল্লো যে, ওর কাছে যদি ৩ লাখ টাকা থাকে তাহলে ওর জীবন নাকি সে বদলিয়ে ফেলবে। খুব ভালো কথা। বললাম, ৩ লাখ টাকা যদি পাস, তাহলে কি করবি? রুস্তম বল্লো যে, সে ২টা পুরানো সিএনজি কিনবে। একটা নিজে চালাবে আরেকটা ভাড়ায় চালাবে। তাতে প্রতিদিন সে পাবে ১২০০ টাকা। তারমানে মাসে ৩৬ হাজার টাকা। ওর খরচ লাগে মাসে ১৬ হাজার টাকা। তারমানে মাসে সে ২০ হাজার সেভ হবে। বছরে সেভ হবে আড়াই লাখ টাকা। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়া সে আরেকটা পুরানো সিএনজি কিনবে। এভাবে ২/৩ বছর পর সে গাড়ি কিনবে। যদি গাড়ি কিনে, তাহলে ওর প্রতিদিন লাভ হবে ২ হাজার টাকা। এভাবে সে হিসাব করে দেখলো যে, ৫ বছর পর তার হাতে আসবে প্রায় ২০ লাখ টাকা, ৩ টা সিএনজি আর একটা গাড়ি। হিসাবটা একদম ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু শুধু একটা জায়গায় হিসাবটা শুরু করা যাচ্ছিলো না। প্রাথমিক ৩ লাখ টাকা সে পাবে কোথায়?
রুস্তম আমার অনেক দিনের ড্রাইভার। প্রায় ৭ বছর। এই বছর গুলিতে আমি এমনো হয়েছে যে, ব্যবসার জন্য কোটি কোটি টাকাও ওকে দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছি। ফ্যাক্টরীর সেলারী আনার সময় কিংবা সাব কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরীতে ইমারজেন্সী ভাবে টাকা অয়াঠানোর জন্য। কোনোদিন রুস্তমের মধ্যে কোনো গড়বড় দেখি নাই। কিন্তু একদিন-সে আমার ব্যাগ থেকে ৩ লাখ টাকা চুরি করে পালালো।
চুরি করার পর এক মাস পালিয়ে পালিয়ে থাকলো। অনেক খুজাখুজি করেছি, ওর গ্রামের বাড়ি, ওর বর্তমান শশুর বাড়ি, কিংবা ওর প্রাক্তন শশুড় বাড়িতেও। কিন্তু রুস্তমের কোনো হদিস পাওয়া যায় নাই। অগত্যা মনের রাগ মিটানোর জন্য ওর নামে একটা চুরির মামলাও করেছিলাম। কোথাও না পেয়ে আমি ওকে খোজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম এই কারনে যে, রুস্তম যদি ঐ ৩ লাখ টাকা কাজে লাগিয়ে কিছু করতে পারে, তাহলে করুক। ব্যাপারটা নিয়ে আমি আর কোনো আক্ষেপ বা রাগ রাখতে চাই নাই।
অতঃপর প্রায় ৫ মাস পরে একদিন আমি একটা বিশাল চিঠি পেলাম। ২২ পাতার চিঠি। চিঠিটা আমি পড়তে চাইনি কিন্তু চিঠিটার প্রথম লাইনেই যে কথাটা লিখা ছিলো, তার জন্যই আমি পুরু চিঠিটা পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। আর সে লাইনটা ছিলো- “যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন”।
যেদিন আমি চিঠিটা পাই, তার প্রায় ৪ দিন আগে রুস্তম তারের কাটা গলায় ফাসি দিয়ে আত্তহত্যা করেছিলো। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি যে, যদি রুস্তম সাহস করে আবার আমার কাছে আসতো, আমি ওকে আবার রাখতাম আমার ড্রাইভার হিসাবে। আমি ওরে ক্ষমা করে দিছি। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা ওকে ঠেকাতে পারে নাই। এটা আমার ব্যর্থ তা নাকি ওর ভীরুতা আজো আমি বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এটা ওরও ব্যর্থতা।
রুস্তম মাঝে মাঝে খুব ভালো কবিতা লিখতো। আর ড্রাইভিং করার সময় আমাকে মুখস্ত ওর লেখা কবিতা শুনাতো। আমি অবাক হতাম, রুস্তম খুব ভালো কবিতা লিখে। প্রথম প্রথম ভাবতাম, সম্ভবত রুস্তম কারো কবিতা চুরি করে, কিন্তু পরে বুঝেছি- রুস্তম আসলেই লিখে।
রুস্তমের লেখা ২২ পাতার চিঠির কিছু চুম্বক অংশ আমি তুলে ধরি।
জীবনে সেসব মানুষের সাথে কখনো লুকুচুরী, মিথ্যা, ছলচাতুড়ি, কিংবা কল্পকাহিনী বলে সাময়িকভাবে ভুল বুঝানো উচিত না যারা আমাদের সুখের জীবনের জন্য নিসসার্থভাবে তাদের অনেক মুল্যবান সময়, পরিশ্রম আর অর্থ দিয়া সাহাজ্যের হাত বাড়ায়। যদি পথ চলতে গিয়ে কিংবা তাহাদের নির্দেশনা মানতে গিয়ে কিংবা কোনো লোভে পড়ে নিজের অজান্তে ভুল করে ফেলে, হয়তো সেটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব কিন্তু যদি সেই ভুল হয় ইচ্ছাকৃত, তাহলে সেটা হবে পাপ, অপরাধ এবং ক্ষমার অযোগ্য। যারা আমাকে ভালোবেসে, স্নেহ করে অথবা আমাদের দরিদ্র মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের পাশে এমনভাবে দাঁড়ান যা হয়তো তাদের দাড়ানোর কোনোই প্রয়োজন ছিলো না, তবুও দাড়ান। তাহাদের সাথে এরূপ কোন ইচ্ছাকৃত অপরাধ আমাদের সারা জীবনের জন্য এমন মারাত্তক হুমকী হয়ে দারায় যা কোনো কিছুর বিনিময়েও আর আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়া সম্ভব না। এই মারাত্তক ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য যদি কেউ ক্ষমাও করে দেন, তারপরেও বিশ্বাসের যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তা দগদগে ঘায়ের থেকেও বেশী। তখন তাদের প্রতিনিয়ত মনে হবে, এই মানুষ উপকারের কথা বুঝে না অথবা সে নির্বোধ অথবা সে উপকারীর জন্য অনেক হুমকীস্বরূপ। এই বিবেচনায় কোনো হিতৈষী যদি আমাদের পাশ থেকে নিঃশব্দে সরে যায়, তাকে আর কোনো কিছুর শপথের মাধ্যমেও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা যায় না। তখন যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, নিজের উপর নিজের রাগ, অভিমান আর কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ। এই সময় যা হয়, তা হচ্ছে, হতাশা ক্রমশ বাড়তে থাকে, আর এই হতাশা যখন বাড়ে, তাহার সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা। দুসচিন্তা থেকে জন্ম নেয় নিজের উপর নিজেকে ঘৃণা। আর একবার যখন নিজেকে নিজে ঘৃণা করতে কেউ শুরু করে, তখন তার আর বেচে থাকার কোনো লোভ থাকে না। চারিপাশের কোনো মানুষকেই আর ভালো লাগে না, নীল আকাশ ভালো লাগে না, রংগীন আলো ঝলমলের শহরকে তখন বড় অচেনা মনে হয়। মানুষ তখন আত্মহননের দিকে ঝুকে যায়। অথবা সে এমন পথ বেছে নেয়, যা সমাজের চোখে বড়ই অসুন্দর আর কুৎসিত। সব কুতসিত জীবনের কাহিনী প্রায় একই। কোনো না কোন সময়ে তাদের সুযোগ এসেছিলো কিন্তু তারা না বুঝবার কারনে সে সুন্দর জীবন হাতছাড়া করেছে। পাপ কাজ করে কেউ কখনো বড় হতে পারে নাই, আর হয়ও না। তাদের হয়তো টাকার পাহাড় থাকতে পারে কিন্তু তাদের জন্য সমাজ দুঃখবোধও করে না। তারা সারাজীবন সমাজের একটা কালো মানুষ হিসাবেই বেচে থাকে।
স্যার, আমি এই মুহুর্তে ঠিক সে রকম একটা কাল পার করছি। টাকাগুলি আমার কোনো কাজে লাগে নাই। মদ খেতে খেতে কখন বেহুস ছিলাম বুঝি নাই, যখন হুস হয়েছে, দেখলাম সবগুলি টাকা আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। কে নিয়েছে, কখন নিয়েছে সেই জ্ঞানটুকুও আমার ছিলো না। আমি আপনার থেকে এখন অনেক দূরে। পরিচিতজন মানুষের আশেপাশেও আমি নাই। ড্রাইভিং চাকুরী করতে পারতাম, কিন্তু করতে সাহস করি নাই। কখন আবার আমি আপনার সামনে পড়ে যাই, তাই। প্রতিটা ক্ষন আমি পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি। কখনো ক্ষুধা পেটে কোনো এক পরিত্যাক্ত বিল্ডিং এর মশাদের সাথে, কখনো কোনো গাজার আসরে, কখনো একেবারে একা কোনো এক নদীর ধারে সময় কাটিয়েছি। এমন কোনো একটা মুহুর্ত আমার যায়নি, যখন আপনার কথা আমার মনে পড়ে নাই। বারবার ভেবেছি- কি দরকার ছিলো এমনটা করার? যখন যা চেয়েছি, আপনার কাছ থেকে আমি পাইনি এমন ছিলো না। তারপরেও আমার এমনটা করার কোনো দরকার ছিলো না।
চিঠিটা পড়তে পড়তে আমারো খুব খারাপ লাগছিলো। অনেক বড় চিঠি। সব কিছু এখানে হয়তো লিখা সম্ভব নয়। ১৯ পাতার কিছু অংশে এসে আমি একদম নিসচুপ হয়ে গেলাম। রুস্তম লিখেছে-
স্যার, এ কয়দিন বারবার শুধু একটা কথাই আমার মনে হয়েছে। যখন আপনি গাড়িতে উঠতেন, প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, আমি খেয়েছি কিনা। আজ অবধি কেউ আমাকে এ কথাটা কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে নাই। আজ প্রায় ৩ দিনের উপরে পার হয়ে গেছে, আমি একটি দানাও খাই নাই। মুখ ভর্তি দাড়ি, গোসলের কনো জায়গা নাই, এলোমেলো মাথার চুল, নোংরা আমার জামা। আমার সাথে রাস্তার পাগলের মধ্যে কোনো তফাত নাই। যখন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিতাম, বলতেন- বাসায় গিয়ে রেষ্ট করো, সকালে নাস্তা খেয়ে চলে এসো। আজ আমাকে কেউ বলে না- সকালে চলে এসো। অথচ মনের ভিতরে অদম্য ইচ্ছা, যদি আবার আপনার কাছে চলে আসতে পারতাম? কোথাও আমার কেউ নাই। সম্ভবত আপ্নিই ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ যাকে আমি ভালোবাসতাম, আবদার করতাম, জিদ করতাম কিন্তু খুব পছন্দও করতাম। আপনার মেয়েরাও আমাকে খুব সম্মান করতো। কখনো ওরা আমাকে ড্রাইভার হিসাবে দেখে নাই। কি লক্ষী মেয়েগুলি। আংগকেল ছাড়া কখনো ডাকতো না। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে- ইশ, যদি আবার ফিরে আসতে পারতাম!! কিন্তু আমার মনের সাহস নাই, শরীরে বল নাই, আর আপনার সামনে দাড়াবার আমার কোনো জায়গাও নাই। এ কয়দিন মাথায় শুধু একটা জিনিষ ঘুরপাক খাচ্ছে- কি লাভ এ জীবন রেখে? কিন্তু মরার জন্যেও কিছু উপকরন লাগে। ফাসি দিতে হলে দড়ি লাগে, বিষ পান করে মরতে হলে বিষ কিনতে হয়, কিন্তু আমার কাছে বিষ কেনার ও পয়সা নাই। আর সাতার জানা মানুষ নদীতে ঝাপ দিলেও মরে না।
আমি রুস্তমের চিঠিটা পড়ছি, আর খুব ভয় পাচ্ছিলাম। রুস্তম তার চিঠির ২১ পাতায় লিখেছে-
জীবনকে ভালোবাসবার অনেক নাম আছে। কখনো এর নাম চেলেঞ্জ, কখনো এর নাম সততা আবার কখনো এর নাম বিশ্বাস। স্যার, সব হাসিই হাসি নয়। যেদিন আমি টাকাটা নিয়ে পালিয়েছিলাম, সেদিন আমি হেসেছিলাম আনন্দে। অথচ আজ আমি কাদতেছি কেনো আমি টাকাটা নিয়ে পালালাম। আসলে আমার এই কান্না কান্না নয়। এই কান্নার নাম হয়তো ভয়। আর সব ভয়ের চেহারা এক। যার নাম- আতঙ্ক। এই আতংকে মানুষ অসুস্থ হয়, মানুষের রুচী কমে যায়, এক সময় দেহ দেহ মন দুটুই ভেংগে যায়। দেহ ভাঙ্গার সাথে সাথে মানুষ মানসিকভাবে দূর্বল হয়, এক সময় পানির অভাবে যেমন কচি গাছের মরন হয়, তেমনি এই আতংকগ্রস্থ মানুষগুলিও মৃত্যু বরন করে। তাদের জন্য কেউ আর পিছনে তাকায় না। খুব কষ্ট আর ব্যথা নিয়ে স্যার আমি চলে যাচ্ছি। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এর গাছ পালা, আকাশ, নদী, পাহাড় সব সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন স্যার আপনি। আমি আপনাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবাসবো। খুব বাচতে ইচ্ছে করছিলো স্যার কিন্তু যারা সাহসী নয়, তাদের বেচে থাকবার কোনো প্রয়োজন নাই এই পৃথিবীতে। আমি আসতে চেয়েছিলাম আবার আপনার কাছে কিন্তু সম্ভব হলো না। যদি কখনো পারেন- আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যে তিন লাখ টাকায় আমার এতো হিসাব ছিলো, জীবন সুখের হবে, নিজের গাড়ি হবে, অনেক টাকা হবে, সেই তিন লাখ টাকাই আসলে আমার জীবন একেবারে পালটে দিলো। আপনার সাথে আমার জীবনটা তো ভালোই ছিলো। বিশ্বাস করেন স্যার, আজ ঠিক মৃত্যুর আগ মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আমি একটা জিনিষ শিখে গেলাম, জীবনে সব মানুষের সাথে ছল চাতুড়ি করতে হয় না, এই দুনিয়ায় টাকাই সব নয়। আপনার মতো এমন একটা মানুষের পাশে শুধু থাকলেই হতো। বট বৃক্ষের মতো ছিলেন।
------------------------------------------------------------------------------------
চোখ দিয়ে কখন যে পানি পড়ছিলো, বুঝি নাই। আমিও রুস্তমকে স্নেহ করতাম, ভালোবাসতাম। কিন্তু ওকি একবার সাহস করে আবার ফিরে আসতে পারতো না? আমি ওর শেষ ঠিকানাটা জানলে হয়তো নিজেই ডেকে নিতাম। ভুল তো মানুষ করেই। কিন্তু সেটা জীবন দিয়ে মাশুল দেয়ার মতো শাস্তিতে নয়।
(আমি রুস্তমের চিঠিটা ছিড়ে ফেলিনি। আজ আমার সব পরিত্যাক্ত কাগজপত্র ড্রয়ার থেকে পরিষ্কার করতে গিয়ে রুস্তমের সেই ২২ পাতার চিঠিটাও পেলাম। সেটা আজ আমি ছিড়ে ফেললাম।)