Categories
আমার ড্রাইভার ছিলো রুস্তম। খুবই ভালো একজন ড্রাইভার। বিয়ে করেছিলো কিন্তু রোস্তমের অভ্যাসের কারনে ওর বউ ওকে ছেড়ে দেয় কিন্তু ইতিমধ্যে ওদের একটা পুত্র সন্তান হয়ে যায়। ছেলেকে রেখেই রোস্তমের বউ রোস্তমকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড হয় যায়। রোস্তমের দোষ ছিলো রোস্তম প্রায়ই ডিউটি শেষে ওর বন্ধু বান্ধব্দের নিয়ে মদের আড্ডায় বসতো যা ওর বউ পছন্দ করতো না। বউ চলে যাবার পর ছেলেকে নানীর বাড়িতেই রেখে রোস্তম ছেলেকে পালতে শুরু করলেও মদের নেশাটা ছাড়তে পারলো না। বরং মদটা যেনো ওকে আরো পাইয়ে বসলো। আমি জানতাম না যে, রোস্তম মদ খায়। কারন আমার ডিউটি শেষ করার পর রোস্তম কোথায় গেলো আর কি করলো সেটা নিয়ে আমি মোটেই খবর রাখতাম না।
এভাবেই রোস্তম আমার কাছে প্রায় ৫ বছর ড্রাইভার হিসাবে কাজ করছিলো। বিস্তস্থতা আর কোয়ালিটি ড্রাইভার হিসাবে রোস্তমের উপর আমার কোনো সন্দেহ ছিলো না। মাঝে মাঝে বেতনের বাইরেও আমি ওকে টাকা দেই, যেটা রোস্তম ও জানে যে ফেরত দিতে হবে না। আমিও চাইতাম না। রোস্তমের উপর আমার বিশ্বাস এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরীর কোটি কোটি টাকাও একা ব্যাংক থেকে আনা নেয়া করাতাম। ভালোই চলছিলো। একদিন রোস্তম বল্লো যে, রোস্তম আসলে একা থাকে বলে ওর খাওয়া দাওয়ায় বেশ সমস্যা হয়, কাপড় চোপড় ধোয়াতেও সমস্যা হয়। ও বিয়ে করতে চায়। আমি ব্যাপারটাইয় সায়ই দিলাম। ওর বিয়ের একটা বাজেট হলো, প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। আমি বললাম, যে, আমিই ওর বিয়ের পুরু খরচটা দেবো। দিয়েও দিলাম। রোস্তম বিয়ে করে ফেল্লো। আমাদের বাসার পাশেই থাকে রোস্তম, সাথে ওর নতুন বউ। এবার একটা নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হলো। নতুন বউ ও নাকি রোস্তমের সাথে এডজাষ্ট করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশের মানুষ গুলিকে। যে জিনিষটা আমার কখনোই ভালো করে জানা হয় নাই সেটা আমার নজরে এলো। রোস্তম ডিউটি করে এসেই সারারাত মদের আড্ডায় থাকে। ফলে ৫/৬ মাস যেতে না যেতেই রোস্তমের সাথে এই দ্বিতীয় বউ ও তাঁকে ছেড়ে দিতে মনস্থ করলো। কিন্তু রোস্তম যে বাসায় থাকে সেটা রোস্তমের নতুন বউ এর ভাড়া করা বাসা।ফলে ওর বউ রোস্তমকে বাসা থেকে বের করেই ছাড়লো।
আমার দয়ার শরীর, তার উপরে রোস্তমকে ছাড়া আমি অচল। ভাবলাম যে, আমার বাসায় একটা গার্ডের রুম আছে, যেটায় কেউ থাকে না। এটাচড বাথ রুম। রোস্তমকে আমার বাসার ঐ গার্ড রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। একদিন যায় দুইদিন যায়, হটাত এক রাতে আমি দেখলাম যে, রোস্তম আমার বাসায় বসেই মদ খাচ্ছে। অনেক রাগারাগি করলাম, নিষেধ করলাম এবং সতর্ক করে দিলাম যে, আর যদি কখনো আমি ওকে মদ খেতে দেখি তাহলে আমি ওকে বাসা থেকে শুধু নয়, আমার ড্রাইভার হিসাবেও ওকে বাদ দিয়ে দেবো। রোস্তম আমার কাছে এক প্রকার প্রতিজ্ঞাই করলো যে, সে আর কখনো মদ খাবে না। কিন্তু মদের যার নেশা, সে মদ ছাড়ে কিভাবে? রাত যখন গহীন হয়, রোস্তম তার মদের বোতলের মুখ খুলে মদ পান করতে থাকে। একদিন আমিও বেশ গহীন রাতে ওর রুমে হটাত করে এসে দেখি, রোস্তম মদ খাচ্ছে। মাথা আমার ঠিক ছিলো না। আমি রোস্তমকে ঐ রাতেই আমার বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু চাকুরীটা বাদ করিনি। রোস্তম নরম্যালি আমার ড্রাইভার হিসাবে আবারো কাজ করতে থাকে। কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হলো না। এভাবেই প্রায় মাস খানেক চলে গেলো।
গাড়িতে থাকাকালীন আমি প্রায়ই রোস্তমের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এম্নিতেই কথা বলতাম। একবার রুস্তম আমারে বল্লো যে, ওর কাছে যদি ৩ লাখ টাকা থাকে তাহলে ওর জীবন নাকি সে বদলাইয়া ফেলবে। খুব ভালো কথা। বললাম, ৩ লাখ টাকা যদি পাস, তাহলে কি করবি? রুস্তম বল্লো যে, সে ২টা পুরান সিএনজি কিনবে। একটা নিজে চালাবে আরেকটা ভাড়ায় চালাবে। তাতে প্রতিদিন সে পাবে ১২০০ টাকা। তারমানে মাসে ৩৬ হাজার টাকা। ওর খরচ লাগে মাসে ১৬ হাজার টাকা। তার মানে মাসে সে ২০ হাজার সেভ হবে। বছরে সেভ হবে আড়াই লাখ টাকা। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়া সে আরেকটা সিএনজি কিনবে। এভাবে ২/৩ বছর পর সে গাড়ি কিনবে। তাতে ওর প্রতি দিন লাভ হবে ২ হাজার টাকা। এভাবে সে হিসাব করে দেখলো যে, ৫ বছর পর তার হাতে আসবে প্রায় ২০ লাখ টাকা, ৩টা সিএনজি আর একটা গাড়ি।
আমি ব্যাপারটা খুব সাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। আগে পিছে কিছুই ভাবি নাই। একদিন আমি রোস্তমকে নিয়ে আমার প্লাষ্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের বেতনভাতা নিয়ে গেলাম ফ্যাক্টরীতে। আমার ব্যাগে তখন দুই জায়গায় মোট ৫ লাখ টাকা ছিলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে অফিসে বসার পর আমার অন্যান্য ডাইরেক্টরদেরকে বললাম, আমার ব্যাগে ৫ লাখ টাকা আছে, সেটা নিয়ে আসো। বেতন দিয়ে দাও শ্রমিকদেরকে। সবাই বেতনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার গাড়িটা আমার অফিসের একেবারেই দরজার সামনেই পার্ক করা থাকে। আমার ডাইরেক্টররা গাড়ির কাছে এসে রোস্তমকে খুজে না পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, রোস্তম সম্ভবত গেটের দোকানে চা খেতে গিয়েছে। ওকে ফোন দিলাম, বল্লো, চা খেয়ে এখুনি আসবে। আসলে ব্যাপারটা ছিলো অন্য রকমের। রোস্তম আমার ব্যাগ থেকে এক পকেটে ৩ লাখ টাকা ছিলো, সেটা সে নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে কিন্তু আমাকে জানিয়েছিলো যে সে চা খেতে গেছে যেটা সে প্রায়ই চা খাওয়ার জন্য গেটের দোকানে যায়। ওর আসতে দেরী হ ওয়াতে আমি বারবার ফোন করতে থাকি। কিন্তু এক সময় দেখলাম রোস্তমের ফোন বন্ধ। আমার সন্দেহ হলো। দোকানে লোক পাঠালাম, রোস্তম সেখানে চায়ের জন্য বসেই নাই। বুঝতে বেশী দেরী হলো না যে, সে আমার ব্যাগ থেকে ৩ লাখ টাকা চুরি করে পালিয়েছে। ফ্যাক্টরীর আশেপাশে সব খানে খোজাখুজি করার পরেও যখন আর পেলাম না, তখন মীরপুর বাসা থেকে ডুপ্লিকেট চাবী এনে আমার গাড়ি খুলতে হলো, ব্যাগ চেক করলাম, এক জায়গায় রাখা তিন লাখ টাকা নাই, অন্য পকেটে রাখা ৩ লাখ টাকা আছে।
চুরি করার পর এক মাস পালাইয়া পালাইয়া থাকলো। কোনো সিএনজি, কিংবা কিছুই কিনলো না। প্রতিদিন মদ খাইতো রাতে। একদিন মদ খাওয়ার পর কিছু বন্ধু বান্ধব জেনে গেলো ওর কাছে বেশ কিছু টাকা আছে। এক রাতে মদ খাইয়া বেহুস। ওর সব বন্ধুরা টাকা গুলি নিয়া পালাইলো। রুস্তমের আর কিছুই নাই। খাওয়ার পয়সাও নাই। তারপর একদিন সে ভাবছে, আমার কাছে আবার ফিরে আসবে কিনা। কিন্তু আর সাহস পায় নাই। তারপর না খেয়ে খেয়ে পাগলের মতো অবস্থা। আবার এদিকে পুলিশের ভয়, আমার ভয়।
অতঃপর একদিন
একদিন একতা বিশাল চিঠি লিখলো আমাকে। পোষ্ট অফিসে গেলো চিঠি পোষ্ট করতে। চিঠি পোষ্ট করলো। ২২ পাতার একটা চিঠি। চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিলো- যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা কইরা দিয়েন। যেদিন আমি চিঠিটা পাই, তার প্রায় ৪ দিন আগে রুস্তম তারের কাটা গলায় দিয়ে ফাসি দিয়ে আত্তহত্যা করেছিলো। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি যে, যদি রুস্তম সাহস করে আবার আমার কাছে আসতো, আমি ওকে আবার রাখতাম আমার ড্রাইভার হিসাবে। আমি ওরে ক্ষমা করে দিছি। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা ওকে ঠেকাতে পারে নাই। এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এটা ওরও ব্যর্থতা।
এটা কেনো বললাম জানো?
কারন, যে যেই জীবন চায়, সে সেটাই পায়। কেউ জেনে শুনে পায়, কেউ না জেনেই পায়। তোমার লাইফ আমার কাছে যতোটা মুল্যবান, সেই জীবনটা তোমার কাছে কতটা মুল্যবান, তার উপর নির্ভর করবে তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ। আর এই পদক্ষেপ কেউ ঠেকাতে পারে না। যার জীবন, মাঝে মাঝে সেও ঠেকাতে পারে না।