শেষ বিদায়

আজকে সেই দিন যেদিন সবাই আমার কারনেই সবাই একত্রে মিলিত হয়েছে। মিলিত হয়েছে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে। কিন্তু এখন আমি সম্পূর্ণ স্থবির আর শান্ত। বাড়িঘর সব ভড়ে গেছে একের পর এক চেনা জানা এবং অচেনা অনেক লোকের ভীড়ে। উজ্জ্বল দিবালয়ে, অথবা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে অশান্ত হৃদয়ে কেহ কেহ লাল নীল জামা পড়ে মাথায় টুপি পড়ে, কেহ আবার হাতে তসবিহ নিয়ে মুখে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে হাহুতাশ করছে, কেউ চোখের জলে বুক ভাসিয়ে জ্ঞান হারাচ্ছে, কেউ আবার মনে মনে যার যার মিশ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। কেহ কেহ আমাকে কোথায় দাফন করবে, কে বা কারা সে দাফনের নিমিত্তে কোথায় আমার কবরখানা রচিত হবে এই ব্যস্ততায় এদিক সেদিক ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ আমাকে পেয়ে হারালো, আবার কেউ আমাকে না পেয়েই হারালো। কেউ কেউ আবার অধিকার নিয়ে মনে মনে ছক কষে অশান্ত রুপ ধরিয়া বিলাপ করবে, কেউ আবার অধিকার পুনরুদ্ধার হবে এই আশঙ্কায় প্রহর গুনবে। কারো জন্য আমার এই প্রস্থান হবে মর্মান্তিক আবার কারো জন্য হবে অতীব সুখের।

এদিনে সমস্ত সিডিউল মোতাবেক সব ঠিক থাকলেও আমার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করবে না। প্রতিদিনের ব্যস্ততার ক্যালেন্ডারটি আর আগের মতো সরব হয়ে উঠবে না। ঘরির কাটায় কমবেশি হলেও তাতে কিছুই যাবে আসবে না আজ আমার, আজ আমার কোনো কিছুতেই তাড়াহুড়াও থাকবে না। সারাবিশ্ব যেইভাবে চলতেছিলো ঠিক আগের মতোই এ জগতের সব কিছুই চলবে। এক মুহূর্তের জন্যও দিনের সময়কাল পরিবর্তিত হবে না, না চাঁদ তার উদিত হবার বা ডুবে যাবার কোনো ব্যতিক্রমী নিদর্শন প্রকাশ করবে। না নদীর জোয়ার ভাটার কোনো দিক বা গতি পরিবর্তন হবে। না সুর্য এক সেকেন্ড পরে বা আগে উত্থিত হবে। পাখিরা সময় মতোই নিজের নীড় হতে খাদ্যানেসে বের হয়ে যাবে, রাখালগন তাদের গরূ বাছুর নিয়ে ভাটিয়ালী গান গাইতে গাইতে কোনো এক মেঠো পথে হারিয়ে যাবে। এমনটিই তো হয়ে এসছে বরাবর প্রতিটি মানুষের জীবন সায়াহ্নে।

যে সম্পদ আমি আমার সারাজীবন ধরে আহরন করেছি, যা প্রতিনিয়ত রক্ষা করবার জন্য চারিপাশে সতর্ক দ্রিস্টি দিয়া পাহাড়া দিয়াছি, তা ওইদিন অন্য কারো হাতে চলে যাবে। সেটা নিয়ে বা কে নিলো, কেনো নিলো এই নিয়ে আমার কোনো কিছুই করবার থাকবে না। আমাকে যারা কখনোই ভালোবাসে নাই, যারা আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্টে দেখার পায়তারা করত, তাদের উদ্ধত চাহনী কিংবা দ্রিস্টিভঙ্গি আমাকে আর কোনোভাবেই আজ আহত করবে না। না আমি তাদের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ করবো। যে তর্কে জিতবার জন্য আমি খন্ড খন্ড যুক্তি প্রকাশ করে আত্মতৃপ্ত হয়ে হাসিমুখে চারিদিকে বীরের মতো চলমান থাকতাম, সেই তর্ক এখন আর আমার কোনো কিছুই আনন্দ দান করবে না। আমার প্রতিদিনের জরুরি মেইল কিংবা টেক্সট ম্যাসেজের প্রতি আমার আর কোনো তাড়াহুড়া থাকবে না। যাদের বিরুদ্ধে আমার কতইনা রিগ্রেটে ছিলো, জিদ ছিলো, প্রতিশোধের আগুনে যা আমি বহুকাল নিদ্রাবিহিন রাত কাটিয়ে দিয়েছি, সেটার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে না, না আমার মনের মধ্যে এইসবের কোন প্রভাব ফেলবে।

আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে, আমার ওজন বেড়ে যাবে এই ভেবে আমার রোজকার দিনের খাদ্যাভ্যাসে কোন পরিবর্তন কিংবা আমার সাদা চুলে কালো করবার বাসনা এসব কিছুর আর কোনো প্রয়োজন হবে না, না এসব আমাকে আর বিচলিত করবে। আমার ব্যবসা, আমার সম্মান, আমার প্রতিপত্তি যার জন্য আমি প্রতিনিয়ত ভাবিয়া ভাবিয়া, নিদ্রাবিহিন কষ্ট করেছি, কিংবা কিভাবে কি করলে আমার সব কলেবর বৃদ্ধি হবে ইত্যাদির জন্য প্রানপন চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম, সেই ব্যবসা, সম্মান কিংবা প্রতিপত্তি আজ হতে রহিত হয়ে তা অন্যের হাত ধরেই চলতে থাকবে। ছোট কিংবা বড় যতো বড়ই অনুশোচনা হোক না কেনো, ক্লান্তি কিংবা কষ্ট যাই হোক না কেন, তাহা আজ আর কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করবে না। না আমাকে আর রাত জাগাইয়া তা নিয়া ভাববার কোন অবকাশ দিবে। জীবনের রহস্যময়তা, কিংবা মৃত্যুর উদাসিনতা যা আমার মন বহুবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, তা আজ এক নিমিষের মধ্যেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। জীবন কি, মৃত্যু কি, জিবনের পরে মৃত্যুর কি গন্তব্য যা নিয়া আমি বহুবার তর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম, যুক্তি খুজেছিলাম, আজ সব কিছুর সঠিক তথ্য আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। ঈশ্বর কি, ঈশ্বর আদৌ আছেন কিনা, ধর্ম কি, এ জগত কি, কিসের উপর এই বিশ্ব ভ্রমান্ড দাঁড়িয়ে আছে, কি তার রহস্য, কি তার পরিচালক, আমার জীবনের মুল কি উদ্দেশ্য ছিলো যার জন্য এই প্রিথিবীতে আসা, আজ সব কিছু আমার কাছে দিনের আলোর মতো ফকফকা হয়ে যাবে।

আমার অনেক অসমাপ্ত কাজ যা করবার জন্য আমি জল্পনাকল্পনা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, তা আজ সব কিছুর ইতি টানিয়া আমাকে নিয়ে যাবে কোনো এক সুদুর অজানা একস্থানে যা আমি এর আগে একবারের জন্যও বিচরন করি নাই।

আজ এই শান্ত শরীরে আমার চারিপাশের সবাইকে যেনো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করতেছে কিন্তু আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে, আমার কণ্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে গেছে, আমার বাহু, আমার পা, আমার চোখ, আমার যাবতীয় ক্ষমতা আজ রহিত হয়ে একটি ছোট খাটিয়ায় আমি এমন করে পংগু বোবা হয়ে শুয়ে আছি যা অবশ্যই হবে বলে আমি একদা জানতাম কিন্তু ইহা যে আজই তা আমি কখনো মনে মনে কিংবা শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ আমার এই দিনের জন্য একবারের মতোও কি প্রস্তুতু নেয়া দরকার ছিল না? বা আমার কি কি করনীয় ছিলো সেই ব্যাপারে আমি কখনোই নিজেকে তৈরী করি নাই কেনো? যে সব সম্পত্তি, যশ, সম্পদ অথবা লোভ যাই বলি না কেনো, সেইসব  কারনে আজকের দিনের কোনো প্রুস্তুতি  আমার নেয়া হয় নাই, অথচ এইসব সম্পত্তি কিংবা সম্পদের বিনিময়েও আজ আমি এই পরিস্থিতি হইতে মুক্ত হতে পারছি না, পারবোও না।

যে ঘরটিতে একচ্ছত্র আমার অধিকার ছিলো, যার প্রতিটি কোনায় কোনায় আমার হাতের স্পর্শ, আমার পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছিলো, তার থেকে আজ আমাকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে আমি জুতা মাড়িয়ে, সিগারেট ফুকে পায়ে দলিয়া পিছনে ফেলে ফেলকনি খাটে বসে আরাম করে বসতাম, আজ সেই ফেলকনি খাট আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে ওই জুতা মাড়ানো স্থানটিই আমার জন্য বরাদ্ধ হয়ে রয়েছে। আমি আমার নামটিও আজ হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে আর কেহই আমার সেই প্রিয় নামটি ধরে, কিংবা আমার ছোট মেয়ের অতি আদরের ডাকটি ধরে আমাকে গলা জড়িয়ে সম্বোধন করবে না। আমি নিতান্তই একটি লাশের নামে পরিচিত হয়ে এই উজ্জ্বল নীলাকাশ সমৃদ্ধ প্রিথিবী হতে সবার আড়ালে চলে যাবো।

অফিসে যাবার প্রাক্কালে যে সুন্দরী বউটি বারবার জিজ্ঞাসা করত কখন আবার বাসায় ফিরবো, কিংবা আজ অফিস হতে ফিরতে দেরী হবে কিনা, অথবা বিদেশে যাত্রাকালে মেয়েদের এই আবদার, ওই আব্দারের লিস্ট সম্বলিত দাবীনামার মতো আজ আর কেহই আমাকে কিছুই জিজ্ঞেসা করবে না, কখন আবার বাসায় ফিরে আসবো, কিংবা কেহ আমার সাথে যাবার জন্যও বায়না ধরবে না। ইহা এমন এক যাত্রা যেথায় কেহই কাহারো সাথী হতে ইচ্ছুক নহে।

যারা আমাকে অনেক ভালোবেসেছে, আর যারা আমাকে ঘৃণা করেছে, তাদের উভয় পক্ষই আজ আমার এই শেষ যাত্রায় হয়ত শামিল হয়ে যার যার ভাবনায় লিপ্ত থাকবেন। পাড়া প্রতিবেশিরা অনেকেই বিলাপ করে, কেউ আবার ফিস ফিস করে কত অজানা তথ্য নিজ থেকে মনগড়া কাহিনী বলে আত্মতৃপ্তি পাবেন, যার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আমার আর থাকবে না। অনেক মনগড়া কাহিনী সুর আর তাল হয়ে বাতাসের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে আবার অনেক বীর বাহাদুরের মতো অনেক কল্পকাহিনীও তার সাথে মুখে মুখে প্রচারিত হবে, হয়ত তার কোনোটাই আমার প্রাপ্য নয়। মজার ব্যাপার হলো যে, দিনের আলো অন্যান্য দিনের মতোই সঠিক নিয়মে তার সিডিউল চলতে থাকবে, পাখিরা সন্ধ্যায় যার যার নীড়ে ফিরে আসবে, পথিক তার নিজ গন্তব্যে সঠিক সময়েই ঘরে ফিরে যাবে, শুধু আমার বেলায় আর কোনো কিছুই আগের মতো চলবে না। এক সময় সবাই আমাকে কাধে করে, ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে কোনো একস্থানে মাটির তলে পুতে এসে চা চক্রে লিপ্ত হবেন। এক সময় রাত ঘনিয়ে আসবে, চাঁদ উঠবে, হয়ত বৃষ্টিও হতে পারে। আমি বৃষ্টির পানিতে গলিয়া যাওয়া মাটির সাথে মিশিয়া একাকার হয়ে যাবো। তখন হয়ত কেউ টিভির সামনে বসে কোনো এক আনন্দঘন সিরিয়াল দেখতে দেখতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়বেন। আর আমি একা অন্ধকার একটি মাটির গর্তে সারা জীবিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকবো। সময়ের আবর্তে এক সময় আমি যে ছিলাম এই পৃথিবীতে সেটা সবার মন এবং মস্তিস্ক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। এটাই যদি হয় জীবন, তাহলে কিসের নেশায় আমি এতো মসগুল? সব কিছুই ভুল এই পৃথিবীর। একাই এসেছি, একা যাওয়ার জন্যই এসেছি। মাঝে যাদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, তারাও একাই এবং তারা আমার মতোই একদিন ভুলের ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাবেন।  

আমি জানি আমি তোমাদেরকে আর কিছুই বলতে পারব না। যদি ইহাই হয়ে থাকে, তাহলে আজ আমার জীবনের শেষ বার্তাটুকু তোমাদের বলে যাই, আর ক্ষমা প্রার্থনা করি যে, যদি কারো মনে, অন্তরে, শরীরে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, স্বার্থের কারনে বা বিনা স্বার্থে আমার অগোচরে কোনদিন আঘাত করে থাকি, যদি আমার দ্বারা এমন কোনো কাজ হয়ে থাকে যা উচিত ছিলো না, যা অধিকার খর্ব হয়েছে বলে মনে হয়, কিংবা আমার দ্বারা জুলুম হয়েছে বলে মনে মনে অনেক অভিশাপ দিয়াছেন, আমাকে সবাই খাস হৃদয়ে অনুশোচনাপূর্বক ক্ষমা করে দিবেন। আমিও আপনাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। আমি আমার দায়িত্ত কতটুকু পালন করতে পেরেছি,, সেই বিশ্লেষণ আমার উত্তরসুরী, আমার পরিবার, আমার সমাজের উপর। আমার পরিবার, আমার সমাজ আমাকে কতটুকু দিয়াছিলো সেই বিশ্লেষণ আমার কাছে আর নাই তবে আমি আপনাদের সহিত ভালো একটা সময় কাটিয়ে গেলাম এটাই আমার জন্য অনেক ছিলো। 

যুগে যুগে এই প্রিথিবীতে আমার মতো সব উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, রাজা বাদশা, হুজুর কামেল কিংবা দস্যু সবাই খালি হাতেই কেউ ভালবাসায় সিক্ত হয়ে কেউ আবার করুনার জল নিয়েই এই অসীম নীলাকাশ, গভীর সমুদ্র কিংবা পাহারের ঘন শ্যামল সুন্দর ছবি বুকেই নিয়া একাই সব ছেড়ে চলে গেছেন। এই শ্যামল ভালোবাসা, সম্পদ, সম্মান, কিংবা যশের জন্য কোনো রাজা, সম্রাট কিংবা শাসক কখনোই আর ফিরে আসে নাই। আমিও আর তোমাদের এই সমাজে ফিরবো না। তবে জায়গাটা ছেড়ে যেতে আজ আমার বড্ড মায়া আর কষ্ট হচ্ছে। ভালো থেকো তোমরা।