অষ্টাদশ পার হইলে আমরা বলি আশি বা আশি পার হইয়া যাইতেছে এমন কিছু। কিন্তু যিনি নব্বই পার হইয়া শতায়ুর দিকে প্রতি মুহূর্তে একএক করিয়া প্রহর কাটাইয়া তাহার বয়স বিধাতা ক্রমাগত বাড়াইয়া চলিয়াছেন, তাহাকে আমরা আর যাহাই বলিয়া সম্বোধন করি না কেন, তাহার সঙ্গে ভালবাসিয়া মনের মাধুরী লাগাইয়া ছুটির দিন পরিত্যাগ করিয়া ঘটা করিয়া কোন এক শীতের সকাল কিংবা চৈত্রের কোন এক নির্জন দুপুর বরাদ্ধ করিয়া মনে আলপনা মাখিয়া কেহ তাহার সহিত গল্প করিতে ছুটিয়া আসিবেন তাহা হয়ত খুব স্বাভাবিক নয়। অথচ কোন একটা সময় ছিল, যখন এই শতায়ুর কাছাকাছি বৃদ্ধারও একটা যৌবন ছিল, তাহাকে দেখিবার জন্য কোন না কোন এক পুরুষের হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া লাগিয়াছিল, তাহাকে নিয়া হয়ত অনেকেই কতই না অপ্রকাশিত প্রেমের কবিতা লিখিয়া যাইত, সহপাঠীদের মধ্যে হয়ত কেউ কেউ আবার তাহাকে অতি আপনজন মনে করিয়া কিংবা মনে মনে শুধুই আমার নিজের সম্পত্তি মনে করিয়া গুনগুন করিয়া গানের কলি গাহিত কে বা জানে। আমি আজ এমনি একজন অতি বৃদ্ধার সামনে হটাত করিয়া বসিয়া আছি।
তাহার দেখিয়া বুঝা যায় অতি অল্পবয়সে তাহার গায়ের রঙ কাচা হলুদের মত ছিল, তাহার মুখের গড়ন, চোখের পাপড়ি, নাকের আকার দেখিয়া বুঝা যায় তাহার শৈশবকালে তাহার মাতাপিতা তাহাকে লোক চক্ষুর কুদৃষ্টির আড়াল হইতে বাচাইয়া রাখার জন্য কতই না প্রানান্ত চেষ্টা করিতেন হয়ত বা। এই শেষসময় আসিয়া প্রায় একশত বছরের আগের কোন এক রূপসীর মত দেখিতে ক্ষনসুন্দরের প্রতিক যুবার সহিত আমার দৈবাৎ দেখা হইয়া গেল। কিভাবে দেখা হইল সেটা আমি কিঞ্চিত খোলাসা করিয়া বলিতেও চাহি না। তবে ইহা নিতান্তই ঠিক যে, আমিও তাহাকে দেখিবার জন্য আমার মহামুল্যবান সময় নষ্ট করিয়া ছুটির দিন পরিত্যাগ করিয়া গাড়ি হাকাইয়া এতদূর অবধি আসি নাই। কোন এক সন্ধ্যা বেলা বউ বাচ্চা নিয়া অলস কিছু সময় কাটাইবার জন্য আমি আমার বন্ধু আলালের সঙ্গে তাহাদের গ্রামের একটি গৃহস্থালি বাড়ীতে বেড়াইতে আসিয়াছিলাম। আর ওইখানেই আমার সঙ্গে এই প্রউরার দেখা।
আমি যাহার সঙ্গে ঐ গ্রামের বাড়ীতে গিয়াছিলাম, ঐ আলাল, তিনি তাহারই মা। আলালও বয়স্ক মানুষদের মধ্যে একজন। তাহারও মুখের দাঁড়ি পাকিতে শুরু করিয়াছে, তিনিও কম হলে ষাট বছর ধরিয়া এই পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহন করিতেছেন। এখন তাহাকেও আর যুবক বলিয়া কেহই গননা করিবে না।
তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। গ্রামের চারিদিকে ঘনকালো অন্ধকার। রাস্তায় আশেপাশে কয়েকটা বাতি জ্বলিতেছে বটে কিন্তু ঐ ক্ষীণকায় বাতির আলোতে এত সুবিশাল বৃক্ষরাজীর অন্ধকার আলোকিত করিতে পারে এমন সাধ্য তাহাদের নাই, ফলে বড় বড় কৃষ্ণকলি গাছগুলো আশেপাশের লতাগুল্মের অযাচিত ভালোবাসার জড়াজড়িতে আলো অন্ধকারের ন্যায় এক ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে। এই অঞ্চলে খুব একটা জোনাকি পোকা দেখা যায় না, তাই জোনাকির ঝি ঝি শব্দটা কানে আসে না বলিলেই চলে, তবে আশেপাশের ছেলেমেয়েদের কিছু কিছু কলকাকলি শোনা যায় না এমন নয়।
এই আলো অন্ধকার ভুতুরে আবৃত গায়ের মেঠো পথ পার হইয়া আমরা আলালের বাড়ীতে পৌঁছাইলাম। বাড়িটা বেশ সুন্দর। প্রশস্ত উঠান, সেই মান্দাতা আমলের ধাঁচে করা সিঁড়ি সম্বলিত একটা স্কুল ঘরের মত পাকা বিল্ডিং। বিল্ডিং ঘরখানা পার হইয়া আরও একখান ছোট উঠান, সেই উঠান পার হইলেই চোখে পড়ে ঘোর কালো অন্ধকার। এই ঘোর অন্ধকার উঠানের চারপাশে কয়েকটি গাছ ঠায় অন্ধকারকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আকাশের তারাগুলিকে নিশানা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। হটাত করিয়া আলো হইতে আসিয়া যেন কালো অন্ধকার উঠানটিকে আরও কচকচে কালো রঙের মত সীমাহীন অন্ধকার বলিয়া মনে হইল, আর আমি ঠায় চোখে কিছু না দেখিতে পাইয়া দাঁড়াইয়া গেলাম। সামনে কিছুই দেখিতে পাইতেছিলাম না কিন্তু আমার বন্ধুটি অতি অনায়াশেই এই কালো অন্ধকার ভেদ করিয়া অতি সহজেই আরেকটি আধা পাকা বিল্ডিং এর দরজার সামনে আসিয়া হাজির হইয়া গেলেন। আমি কোন রকমে হামাগুড়ি দিবার মত ভঙ্গিতে পায়ে পায়ে টিপিয়া টিপিয়া এক কদম এক কদম করিয়া আগাইয়া আসিয়া তাহার কাছে পৌঁছলাম। বাড়ীর ভিতরে কেউ আছেন বলিয়া মনে হইল না। বারান্দায় একটি ছোট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলিতেছে। গ্রিল দেওয়া একটি ঘর। ঘরটির কাছে আসিয়া আমার ঐ বন্ধু আলাল 'মা' বলিয়া দুইবার ডাকিলেন। চারিদিকে কোন সারাশব্দ নাই, বেশ গরম পড়িয়াছে, কোন বাতাসও বহিতেছে না। আমার বন্ধুটি আবারো শব্দ করিয়া 'মা' বলিয়া ডাকিলেন।
রাত্রির নিস্তব্দতা ভাঙ্গিয়া, ক্যাচ করিয়া লোহার একখান দরজার খিল খুলিলে যেই ধরনের শব্দ হয় তাহার মত শব্দ করিয়া কোন একজন তাহার দরজা খুলিলেন। দরজা খুলিতেই দেখিতে পাইলাম, অতি বয়স্ক একজন মহিলা তাহার শরিরের কাপড় গুছাইতে গুছাইতে শরিরের ভারসাম্য রক্ষা করার নিমিত্তে কাপিতে কাপিতে দরজার হেসবলটি খটাশ করিয়া খুলিয়া ফেলিলেন। খুলিয়াই বড় আদরের সহিত অস্ফুট স্বরে বলিলেন, ও তুই বাবা? এত রাতে কথা হইতে আইলি?
বুকটা ধক করিয়া উঠিল যেন। আমার মাও থক এমন করিয়াই আমাকে সম্বোধন করিত। অনেক দিন হইয়াছে আমার মা প্রয়াত হইয়াছেন। মাকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। কিন্তু এই বয়সে আসিয়াও আমার মাকে আমি খুব কাছে থেকে মিস করি এই ভাবনা অনেকেই মানিয়া লইতে পারেন না। আমি মানিয়া লইয়াছি। কি মিষ্টি সেই সম্বোধন। মাকে নিয়া পৃথিবীতে এত বেশি গল্প রচিত হইয়াছে, এত গান, এত বায়স্কোপ, এত উপন্যাস রচিত হইয়াছে যে, তারপরেও মাকে নিয়া আরও হাজার হাজার কবিতা, হাজার হাজার উপন্যাশ রচনা করিবার অবকাশ রহিয়াছে। মায়ের কথার সুর আলাদা, তার চাহনি আলাদা, তাহার হাতের স্পর্শ আলাদা, তাহার শাসন আলাদা, তাহার আদরের ভাষা আলাদা। তাহার অনুপ্রেরনার শক্তি আলাদা, তাহার ভালোবাসার মহব্বত আলাদা। কোন কিছুই তাহার সহিত পারিয়া উঠিবে বলিয়া আমার মনে হয় না আর হইবেও না। আমার সামনে যিনি দাঁড়াইয়া আছেন, তিনি আলালের মা। আমারও মা।
আমাকে দেখিতে পাইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। ঘরের বাতির আলো হইতে বাহির হইলে স্বাভাবিক কারনেই বাহিরের অন্ধকার আরও বেশি ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া চোখে এমন ধাধার সৃষ্টি করে যে, বাহিরে কি আছে বা কাহারা আছে তাহা হটাত করিয়া চোখে না পড়ারই কথা। উম্মুক্ত দরজা ধরিয়া আমি আর আমার বন্ধু আলাল ঘরে ঢোকিলাম। বৃদ্ধা অনেক ধীরে ধীরে তাহার বিছানায় গিয়া উঠিয়া বসিলেন। আমরা তাহার পাশে অদুরে রক্ষিত দুইটা চেয়ার খরখর শব্দ করিয়া টানিয়া বসিলাম।
তাহার ঘরের মধ্যে অনেক আসবাবপত্র নাই তবে কমও নাই। একটা ড্রেসিং টেবিলের মত একটা টেবিল। তার কিয়ত অংশ জুরিয়া একটি ছোট আয়না। দেখিয়াই বুঝা যায় অনেক দিন এই আয়নায় কেউ দাঁড়াইয়া তাহার মুখখানা দেখিয়াছে কিনা সন্দেহ আছে। আয়নার ঠিক উপরে একখানা ছোট গামছা যার সারা শরীরব্যাপী অনেক ধুলা জমাইয়া ফ্যানের বাতাসে মনের আনন্দে একটু একটু ঘুরপাক খাইতেছে। বৃদ্ধার খাটখানা বেশ প্রশস্থ, তোষকের জাজিম, তাহার উপরে একখানা চাদর। মনে হইতেছে চাদরখানা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করিবার কারনে কিছুটা দুমড়ে মোচরে আছে। খাটের পাশেই পরপর দুইখানা কাঠের আলমারি সটান হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। উপরে একটি ফ্যান চক্রাকারে ঘুরিতেছে। খাটের একদম লাগোয়া ছোট একটি টেবিল রহিয়াছে। তাহার উপরে এবং নিচে কয়েকটি অতি পুরাতন টিনের অথবা ম্যালামাইনের বাসন, বাসনগুলির উপর কয়েকটি গ্লাস উপুড় করিয়া রাখা আছে। সম্ভবত এইসব বাসন আর গ্লাস বৃদ্ধার খাবারের জন্য ব্যবহৃত হয়। ঘরের আলমারি, খাট, টেবিল চেয়ার সবগুলিতেই ভ্রাম্যমাণ ধুলাবালিতে এক প্রকার দাগ পরিয়া আছে। কেহ তাহা পরিস্কার করিয়া দিবার নাই। আর পরিস্কার করিলেও দায়সারা ভাবে যে পরিস্কার করিয়াছে তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে। দেয়ালের একপাশে একটি মশারি তাহার দুই কোনা লোহার দুইটি প্যারেকের মধ্যে গাঁথিত হইয়া নৌকার পালের মত ফ্যানের বাতাসে ক্রমাগত একবার এদিক একবার ওদিক হেলিতেছে।
বৃদ্ধার সঙ্গে আমার গল্প করিতে খুব ইচ্ছা হইতে লাগিল। কিন্তু তাহার কোমরে ব্যথা বলিয়া বারংবার উল্লেখ করিতেছেন বলিয়া আমারও এক প্রকার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। সংকোচবোধ হইতেছিল এই কারনে যে, আমরা কি এই অসময়ে আসিয়া বৃদ্ধার বিশ্রাম নষ্ট করিয়া দিলাম? আমি তারপরেও তাহাকে অতি আপনজনের মত প্রশ্ন করিলাম, কিছু খাইয়াছেন কি? আমরা আসিয়া কি আপনাকে বিরক্ত করিলাম কিনা ইত্যাদি।
তিনি অতি বিচক্ষন মহিলা বলিয়া আমার মনে হইল। তিনি বলিলেন, আমি এখনো বাচিয়া আছি বলিয়াই তো তোমরা আসিলা। কেউ আসিলে আমার খারাপ লাগে না। বরং কিছুটা সময় কিছু মানুষের সঙ্গে কাটিয়া যায় বলিয়া আমার সস্থি লাগে। এখন তো আর কাহারো সময় নাই আমাদের মত মানুষের সঙ্গে সময় কাটাইবার। আজকাল যুগের ছেলেমেয়েরা, তাহাদের পিতা মাতারা স্নতান সন্ততিরা কেহই আর আগের দিনের পিতামাতার মত নয়। অতি অল্পতেই তাহারা ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে, বিরক্ত হইয়া উঠে, কোন কিছুতেই তাহারা সন্তুষ্ট নহেন। আদব কায়দার ধার ধারে না। সত্য মিথ্যার ধার ধারে না। লাভের হিসাবটা যেখানে বেশি, তাহাকেই তাহারা নীতি বলিয়া মানিয়া লইয়া আপাতত লাভের আশায় যাহা কিছু করিতে হয় তাহাই তাহারা করিতে ইতস্তত বোধ করে না।
-আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমরা কতই না আমাদের দাদা দাদিদের সঙ্গে গল্প করিতাম। ভুতের গল্প, সেই রাজরানির গল্প, পড়া ফাকি দিয়া কখন দাদুর কোলে মাথা রাখিয়া নাম না জানা পরীদের গল্প শুনিতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা ভুত আছে বলিয়া বিশ্বাস করে না কিন্তু ভুতের গল্প শুন্তেও ভয় পায়। আমাদের সময় আমরা পাশের বাড়ীর বরই গাছের আধাপাকা বরই, পেয়ারা, কচি কচি আম চুরি করিয়া আনিয়া দাদুর পানের বাটিতে লুকাইয়া রাখিতাম, আর এখনকার নাতি নাতকুরেরা দাদা দাদির পানের বাটি হইতে সুপারি পর্যন্ত না বলিয়া লইয়া যায়। ইহাকে চুরি বলে কিনা আমি বলিতে পারিব না কিন্তু যখন দেখি আমার আচলে রাখা কয়েকটা ছোট বড় নোট যখন কোথায় হাওয়া হইয়া অদৃশ্য হইয়া যায় তাহা যখন আর বুঝিতে পারি না, তখন মনে হয় সময়টা পাল্টাইয়া গিয়াছে, অথচ কাহাকেও কিছু বলিবার আমার যোগার নাই।
বুড়ি আরও গল্প করিতে লাগিলেন, যেন মনে হইল তিনি আস্তে আস্তে তাহার শৈশবকালে ফিরিয়া যাইতেছেন।
-আমি যেদিন এই বাড়ীতে বউ হইয়া আসি, তখন আমার কতইবা বয়স। হয়ত আট কিংবা নয়। স্বামী কি জিনিস, শাশুড়ি কি জিনিস, কিংবা ভাসুর, কিংবা শ্বশুর, কাহাকে কেমন করিয়া সামলাইতে হইবে আমরা কিছুই জানিতাম না। বাবার বাড়ীতে যে ছোট মেয়েটি সকাল অবধি ঘুমাইত, সেই ছোট বালিকাটি হটাত করিয়া শ্বশুর বাড়ীতে আসিয়া এক রাতের মধ্যে মহিলা হইয়া জন্মিল। যেন তিনি আর ছোট বালিকাটি নন। তাহার অনেক দায়িত্ত। স্বামীর দায়িত্ত, পরিবারের ঘর ঘুছানো , উঠোন পরিস্কার করা, গোয়াল ঘরে গরুর খাবারের জন্য গাদা গাদা পানি দেওয়া, শাশুড়ির জন্য শীতের দিনে ওজুর গরম পানি করে বদনা দিয়ে রাখা, কত কি। ঐ ছোট বয়সে আমার শরিরের থেকে দায়িত্তের পরিমান অনেক ঢের বেশিই ছিল, তারপরেও বাবাকে খুশি রাখিবার জন্য, মাকে আনন্দে রাখিবার জন্য আমার এই ছোট হাতগুলি দিয়া যতটুকুন পারিতাম সংসারের গুরু লঘু সব দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকিতাম। পাছে আমার শশুর কোন কাজ ঠিক মত হয় নাই, কিংবা কোন কাজ করিতে ভুল হইয়া গেছে এই লজ্জায় পড়ি, সেই ভয়ে নিজে দুপুরের খাওয়া, দিনের নাওয়া কোনকিছুই সময় মত করিতে পারিতাম না। দিনশেষে যখন একটু বিশ্রাম করিবার সময় হইত, আমার অতিপ্রিয় এই খাটের পাশে আসিয়া বসিতাম, তখন তোমাদের জামাই বাবুর মন জয় করিবার জন্য আমাকে আবার নতুন বউয়ের মত মুখে হাসি ফুটাইয়া, চোখে প্রেমের চাহনি দিয়া চাঁদনী রাতের আকাশের মত আমাকে রাঙ্গা বউ সাজিতে হইত। এভাবেই আমার দিনকাল কাটিয়া একদিন দেখিলাম আমি মা হইয়াছি। একে একে আলাল, জালাল, শাহিদা, রোকেয়া, সখিনা, সবাই আমার ঘর আলোকিত করিয়া আমার সংসার ভরিয়া তুলিল।
সংসার বড় কঠিন এক কর্মক্ষেত্র। স্বামীর মন যোগাইয়া, শাশুড়ির সব কাজ শেষ করিয়া, শ্বশুরের ঘর ঘুছাইয়া, দিনের কাজ সব শেষ করিয়া ছেলেপুলেদের সব হিসাব নিকাশ, আবদার মিটাইয়া যখন আমি প্রায় এক রকম অভ্যস্থ হইয়া দিনের কর্ম ব্যস্ততায় সময় কাটাইতেছি, তখন আমার বয়স গুনিয়া দেখিলাম, আমি নিজেও এখন শাশুড়ি হইবার সময় হইয়াছে। কিন্তু যাহার শশুর হইবার কথা তিনি সবাইকে তাক লাগাইয়া, গ্রামের সব প্রিয় বন্ধু বান্ধব্দের রাখিয়া আমাকে শ্রাবনের অজশ্র বারিধারার মত চোখের জ্বলে ভাসাইয়া তিনি এই পৃথিবীর সমস্ত বন্ধন শেষ করিয়া আমাদের হইতে অনেক দূরে চলিয়া গেলেন। কি তার অভিমান, কি তার কষ্ট, কি তার চাহিদা কিছুই আর অবশিষ্ট না রাখিয়া সংসারের সমস্ত দায়ভার আমার কাঁধে তুলিয়া দিয়া স্বার্থপরের মত আমাকে একা রাখিয়া বহুদুর চলিয়া গেলেন। আজ অনেকদিন পর মনে হইল, আমি শুধু এই বাড়ীর বউ হইয়াই আসি নাই, আজ মনে হইল, আমি আজ সংসারে মা আর তার উপর বাবার দায়িত্বও পালন করিতে এই সংসারে ঢুকিয়াছিলাম। শুধু তাই নয়, যে ননদিনীকে আমি আমার সই বলিয়া মনে করিতাম, আমি আজ তাহারও মা হইয়া বসিয়াছি। যে দেবরকে আমি আমার ছোট লক্ষি ভাই বলিয়া আদর করিয়া শাসন করিতাম, আজ আমি তাহার মা বলিয়া অনুভব হইতেছে। উহারা সবাই আমার অতিপ্রিয় সন্তানের মত আমাকে আরও নিবির করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিল। আমার আর কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা রহিল না। না বাপের বাড়ি, না পৃথিবীর মায়া কাটাইয়া আমার স্বামীর দেশে। আমি বাড়ীর প্রতিটি অংশ, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি প্রাণীর মা হইয়া গেলাম। চুলায় কখন আগুন ধরাইতে হইবে, কখন কাহাকে কোথায় পাঠাইতে হইবে, কখন ধান কাটার মৌসুম হইলে কোথা হইতে কতজন কামলা নিতে হইবে, মটরশুটি পাকিয়াছে কিনা, পাকিলে কখন কাটিতে হইবে, সব হিসাব আমাকেই রাখিতে হইত। বাড়ীর উঠোন কখন ঝারু দিতে হইবে, রাতে কাহাকে কখন কি ঔষধ খাওয়াইতে হইবে তার সবদিক আমাকে অতি সূক্ষ্মতার সহিত হিসাব করিয়া পালন করিতে হইতেছিল।
এই যে বাড়িটা দেখিতেছ? এখানে এত ঘর বাড়ি ছিল না। বড় একটা উঠান ছিল, পাশে হরেক রকমের গাছগাছালি ছিল। ঐ যে আমাদের দক্ষিন পাশটা আছে, সেখানে অতি মস্তবড় একখানা গাব গাছ ছিল। অতি গরমের সময় আমার স্বামী কড়া দুপুরে একখানা মাদুর বিছাইয়া হাতে একখানা তালপাতার পাখা লইয়া তাহার হরেক পদের ব্যবসার হিসাব লইয়া বসিত। আরও কত কি! তখন ক্যালকুলেটর ছিল না, বাঁশের কঞ্চিতে কালি মাখাইয়া দিস্তা কাগজের মোড়ায় একখানা খাতা লইয়া তাহার ব্যবসার লেনদেনের অনেক হিসাব কষিয়া লাভ ক্ষতির বিবরন লিখিয়া রাখিতেন। গাব গাছটার দিকে তাকাইলে আমার এখনো তাহার কথা মনে পড়ে। মনে হয়, এই বুঝি তিনি আসিয়া আমার কাছে পান আছে কিনা জিজ্ঞেসা করবেন। হয়তবা কোন এক পলকে আসিয়া বলিবেন, কই গো শুনছো, আমি একটু বাজার হইতে ঘুরিয়া আসি। কিছু আনিতে হইবে কি? আমি অপলক দৃষ্টিতে ঐ গাব গাছটির দিকে তাকাইয়া থাকি আর তাহার কথা মনে করি। গাছের কোথা বলিবার ভাষা নাই। থাকিলে হয়ত আমাকে প্রশ্ন করিত, কি গো তাহার কোথা মনে পরিতেছে? আমার ও তাহার কথা মনে পরিতেছে। মন তা খারাপ হইয়া যায়। সে আমাক্র কথা হয়ত ভাবে না, হয়ত বা ভাবেও।
আমি তাহার গল্পের বর্ণনা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, তিনি এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও তার ঐ সময়ের সব স্মৃতি দিনের আলোর মত ফকফকা হইয়া তাহার চোখে পরিতেছে আর তিনি ঐ দৃশ্য অনাবিল ভঙ্গিতে আজ এই ঘনকালো অন্ধকারের মধ্যে অকপটে বলিয়া যাইতেছেন। আমি যেন তাহার চোখের এই দিবাকালিন অতীত বর্তমানের বর্ণনা নিজের চোখে দেখিতে পাইতেছি। তাহার গল্প শুনিতে আমার বড় ভাল লাগিতেছিল।
আমি বলিলাম, তারপর কি হইল?
তিনি আমার প্রশ্ন শুনিতে পাইলেন কিনা আমি বুঝিতে পারিলাম না, কিন্তু তিনি তাহার গল্পের কোন ছেদ না করিয়াই বলিতে লাগিলেন, এরই মধ্যে আমার এই আলালের বিয়া হইয়া গেল। আমাদের সংসারে কোন অভাব ছিল না কিন্তু আমার স্বামীর অন্তর্ধানের পর অনেক হিসাব কিতাবই আর আগের মত চলিতেছিল না। যাহাদের কাছে আমরা টাকা পয়সা পাইতাম, তাহারাও আর আগের মত বন্ধুসুলভ নাই, আবার যাহারা আমাদের কাছে টাকা পয়সা পাইত, তাহারও আমাদের দয়া করিয়া যে ছাড় দিবে তাহাও হইল না। ফলে একদিকে প্রাপ্য টাকা না পাইয়া হাত শুন্য হইয়া বসিয়া আছি, অন্যদিকে ঋণগ্রস্থ হইয়া আমাদের সংসারে একটু ভাটা পরিল বলিয়াই আমার মনে হইল। আলাল কোন রকমে একটা সরকারি চাকুরী সন্ধান করিয়া সংসারের হাল ধরিলবটে কিন্তু তাহাকে সোজা করিয়া দাড়া করাইয়া রাখা যেন কঠিন হইতে কঠিনতর হইয়া উঠিল। অনেক ঈদ পর্বন, অনেক মেলা, অনেক শখের আহ্লাদ আমাদের আর আগের মত করিয়া উৎযাপন করিতে পারি নাই। মনে হইয়াছে ছেলেমেয়েরা বড় হউক, একদিন আমার এই সব দুঃখের দিন শেষ হইবে। তখন নায় নাতকুর লইয়া আবার আমি আগের মত হই চই করিয়া বেড়াইব, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লইয়া আনন্দে গ্রাম ঘুরিয়া বেড়াইব। কত কি?
এই বলিয়া বুড়ি অনেক্ষন চুপ থাকিলেন। মনে হইল আজ এত বছর পর তাহার সমস্ত ইতিহাস, সমস্ত কাহিনী তাহার মনের অতি গোপন স্থান হইতে উকি দিয়া জনসম্মুখে প্রকাশ হইবার জন্য এক লম্বা লাইন ধরিয়া আছে। বৃদ্ধার গলা ধরিয়া আসিতেছিল, তাহার চোখের কোনা হয়ত ভিজিয়া আসিতেছিল, তিনি আর বেশিক্ষন আবেগ ধরিয়া রাখিতে পারিতেছেন না। আমার বন্ধু আলালের চোখেও একটু একটু অশ্রুর রেখা দেখা যাইতেছিল। রাতের এই ছোট পাওয়ারের আলোতে হয়ত আমি পুরু চোখ দেখিতে পাইতেছিলাম না তবে এইটুকু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আলালের আধাপাকা দাঁড়ি গড়াইয়া তাহার চিবুক ঘেঁষিয়া হয়ত কয়েক ফোঁটা জল পরিয়া থাকিবে। বৃদ্ধার গল্প থামিবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল এখানে হটাত আলো থামিয়া গিয়াছে, এখানে ভাষা থমকে দাঁড়াইয়াছে, শুধু উপরে ফ্যান খানা নীরস যন্ত্রের মত চারিদিকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ঘোরপাক খাইতেছে।
আলালের বউ যখন আমাদের বাড়ীতে আসিল, আমার সেই ছোট বেলার বউ সাজিবার সবঘটনা মনে পরিতে লাগিল। লাল টুকটুকে শাড়ি, হাতে মেন্দি, মাথায় সব সময় বড় বড় ঘোমটা, আরও কত কি। আমি কোথায় কোথায় কি অসুবিধার মধ্যে পরিয়া কি কি কারনে মনে কষ্ট পাইতাম, কি করিয়া আমি আবার ঐ মনের কষ্ট দূর করিবার জন্য কি করিতাম, সব মনে পরিতে লাগিল। আলালের বউয়ের কার্যকলাপ দেখিয়া মাঝে মাঝে আমি খিল খিল করিয়া হাসিতাম, আবার মাঝে মাঝে খুব লক্ষির মত তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিতাম, আমরা মেয়ের জাত, সংসার আমাদের ধর্ম, ইহাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া স্বামীর ভিটায় লাশ হইয়া বাহির হইতে পারিলেই আমাদের মেয়ে জীবন সার্থক। আর যদি ইহার কোথাও কোন ব্যত্যয় ঘটে, তখন আর কোন কাজেই আসিবে না। এইরূপ, এই যৌবন একদিন শেষ হইয়া যাইব। সংসার ছাড়া মেয়েদের আর কিছুই নাই। ইহাকে আপন করিয়া ধরিয়া রাখ।
আলালের বউকে পাইয়া আমি যেন আবার আমার সেই ছোট বেলার একজন সাথী পাইলাম এমন একজন মানুষ হইয়া গেলাম, আবার আমি তাহার শাশুড়ি এই কথাটাও ভুলিয়া গেলাম না। আলালের বউ যখন ভুল করিত, আমি তখন মনে মনে হাসিয়া ভাবিতাম, আহারে, আমিও কি তোমার মত এই ভুলগুলি করি নাই? করিয়াছি তো। কখনো কৃত্রিম রাগবর্ষণ করিয়া ভতরসনা করিতাম কিন্তু অধিক রাগ করিতাম না। ক্রমেক্রমে ও আমার একজন ভাল বন্ধু হইয়া উঠিল। সরকারী চাকুরী, আলালকে তাই কখনো অনেক দুরের শহরে থাকিতে হয়। আবার কখনো দুই একদিনের জন্য বাড়ীতে আসিতে হয়। নতুন বউ, আমি বুঝিতে পারিতাম তাহাদের মনের আকুতির কথা, তাদের মনের কথা। কিন্তু বাস্তব যখন ঘরের কাছে আসিয়া নিজের পেটের ক্ষুধার কথা স্মরণ করাইয়া দেয়, তখন প্রেমের কথা আর বেশি করিয়া মনে করিয়াও কোন লাভ হয় না। বিরহ তখন নিত্যদিনের সঙ্গি হিসাবে মানিয়াই নিতে হয়। এখনকার দিনের মত যুগ ছিল না তখন যে মন খারাপ হইয়াছে তো একখান মোবাইলে টিপ দিলেই মনের মানুষের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা আলাপ করিয়া মনের কথা বলিয়া একটু সস্থি পাওয়া যাইবে। তখন পোস্ট অফিস ছিল, আবার হাতে লিখিয়া চিঠি পাঠাইতে গেলেও অনেক সময় লোক মারফত চিঠি পোস্ট করিবার লোক পাওয়া যাইত না, নিজে হাটিয়া গিয়াও চিঠিখানা পোস্ট করিবার উপায় ছিল না। তাই যোগাযোগটাও ছিল বেশ কঠিন আর যখন একবার দেখা হইত, তখন প্রেমের কথা বলিবার চেয়ে সংসারের সমস্যা সমাধানের জন্যই সময়টা কাটিয়া যাইত বেশি। যেদিন আলাল তাহার বউকে নিয়া তাহার কর্মস্থলে যাইত কিছুদিন থাকিবার জন্য, আমার বড্ড মন খারাপ হইত। একা একা বোধ হইত। মনে হইত কি যেন আমার সঙ্গে নাই, কে যেন আমার কাছ হইতে হারাইয়া গিয়াছে।
এইবার বৃদ্ধা নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন। মাথা একটু উচু করিয়া আমাদের দিকে তাকাইয়া মুচকি হাসিয়া বলিলেন, একদিন আলাল মিষ্টি লইয়া বাড়ীতে আসিয়া আমার হাতে মিস্টির একটি প্যাকেট দিয়া বলিল, তোমার বৌমা অসুস্থ। আমি হচকচিয়ে উঠিলাম, একটু ভয়ও পাইলাম। ওমা, কি রে কি হইয়াছে? লাজুক আমার আলাল কিছুই না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়া উঠানের গাব গাছটির তলায় গিয়া সবার কাছ হইতে যেন পালাইয়া বাচিল। আলালের বউ সঙ্গে আসিয়াছিল। কাছে তানিয়া বুকে লইয়া জিজ্ঞাস করিলাম, কি হইয়াছে তোমার? শিক্ষিত নেয়ে, অবুঝ নয়, মুচকি হাসিয়া যাহা ইঙ্গিত করিল, বুঝিলাম, আমি দাদি হইতে চলিয়াছি। আমার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। ঘরের প্রতিটি কাপ, গ্লাস, জানাল দরজা যেন খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। আমার উঠানের গাছগুলিও যেন বাতাসের দোলায় নাচিয়া বলিতে লাগিল, তুমি আরও এক ধাপ আগাইয়া জিবনের আরেক দায়িত্ব পালনে তৈরি হইয়া যাও। আমার বড় ভাল লাগিল।
সময় বড় নিষ্ঠুর, সে সবার সাথে চলিয়া বেড়ায় বটে কিন্তু কাহারো সঙ্গে সে সখ্যতা করে না। সে কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। তাহার তারা নাই কিন্তু তাহার দেরি করার সময়ও নাই। সে কাহারো হাত ধরিয়া সামনে আগাইয়া চলে না, সে তাহার নিজ গতিতে বহমান। তাহাকে তুমি বশ করিতে পারিবে না। সে কাহাকেও বশ করে না। তাহার সহিত কেহ চলতে চাহিলে সে তাহার সহিত যুগযুগ ধরিয়া একত্রে চলিতে পারে আবার কেহ যদি তাহার সহিত চলিতে না পারে, তাহাতে তাহার কোন বিপত্তি হয় হয় না। সে একাই আপন গতিতে চলিতে থাকে। আর এই বহমান সময়ের স্রোত ধরিয়া আলালের ঘরে সোমা আসিল, রুবেল আসিল, জালালের ঘরে তিন্নি, মিন্নি সবাই আসিল, আর ঘর হইতে আমার সব প্রিয় মেয়েরা অন্য পুরুষের স্ত্রী হইয়া চোখের জ্বলে নিজেরা ভাসিয়া আর আমাকেও কাদাইয়া যে যার যার সংসারে চলিয়া গেল।
এখন তাহারা যার যার সংসার লইয়া, নিজেদের পরিকল্পনা লইয়া, শহর বন্দর খুজিয়া খুজিয়া নিজেদের আশ্রয়স্থল লইয়া নিজ নিজ সংসার পাতিয়া বসিয়াছে। একটি ঘর হইতে দুইটি, দুইটি হইতে চারটি, ঘর বাড়িয়াছে। বাড়ি বাড়াইতে গিয়া অনেক গাছ গাছালির জীবন দিতে হইয়াছে। আগের গোহাল ঘর সরাইয়া আরও দূরে লইয়া যাইতে হইয়াছে, এক বাড়ীর সীমানা আলাদা করিবার জন্য আরেক বাড়ীর সীমানা প্রাচির তৈরি হইয়াছে। ভাইয়ে ভাইয়ে আলাদা আলাদা প্রাচির ঘেরা বাড়ি বানাইয়া একে অপরের হইতে অনেক কিছু গোপন রাখিয়া দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিতেছে। তাহারা আর আগের মত এক সঙ্গে নদীর ধারে গলাগলি করিয়া গোসল করিতে যায় না, ঐ গাব গাছের তলে বসিয়া গল্প করে না। আগে এক হাঁড়িতে ভাত পাক করিলে সবাই মিলিয়া কাড়াকাড়ি করিয়া খাইয়া ফেলিত, কখনো তরকারীর জোগান কম হইয়া যাইত, আবার কখন মেহমান আসিলে শেষে যিনি খাইতে বসিতেন তাহার ভাগে কমই জুটিত। তারপরেও আনন্দ ছিল অঢেল, হাসি ছিল অফুরন্ত। এক ঘরে জায়গা না হইলে ছেলেরা মেয়েরা ভাগাভাগি করিয়া শুইয়া পরিত। নিজেদের মধ্যে মারামারি, খুন্টুশি যে হইত না তাও নয়, কিন্তু তাহাও ছিল এক আনন্দের অফুরন্ত ভান্ডার। আজ সবার সংসার হইয়াছে, সবার হাঁড়িপাতিল আলাদা। কেহ মুরগীর তরকারি খাইয়া ঢেকোর তুলিতেছে, কেহ আবার নিছক শাকপাতা খাইয়া পেটের পীড়ায় ভুগিতেছে। একজনের সন্তান দেশ বিদেশ ঘুরিতেছে, আরেক জনের সন্তান মাঠে কঠিন রোদে পুড়িয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া সারা বছরের ফসল ফলাইবার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা করিতেছে। বউদের যেমন সময় নাই, তাহাদের সন্তানদেরও সময় নাই। আমরা যারা আজ অনেক বুড়া হইয়া গিয়ছি, আমরা যখন আর আগের মত আর চলিতে পারি না, আমাদের দেখার জন্য তাহাদের হাতে ওত সময় কই?
আজ যখন দেখি সারা উঠোন গাছের মরা পাতায় এখানে সেখানে ছরাইয়া ছিতাইয়া এলোপাথাড়ি পড়িয়া আছে, হাটিবার রাস্তাটাও অনেক ময়লায় ভরিয়া আছে। তখন মনে হয়, আমার সংসার আলাদা হইয়া গিয়াছে, যার যার জায়গায় তারা শুধু গাছের পাতা, ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করিয়াই খালাস। আমার শাশুড়ি বলিতেন, সকাল বেলায় পরিবারের সদস্যরা ঘরের বাহির হইবার আগেই যে একবার ঘর বাড়ি উঠোন ঝাউ দিতে হয়, তা না হলে অলক্ষুণেরা ভর করে, সেই ভয়ে আজও আমি সকাল হলেই একটা ঝারু লইয়া সবার আগে ঘুম হইতে উঠিয়া সমস্ত বাড়ীটি কল্যাণময় করিয়া তুলি। এটা আমারই তো সংসার, তাহারা হয়ত নিজেদের জায়গা সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করিয়া আপন মনে করিয়া সাজাইয়া লয়াছে, কিন্তু এক সময় তো তাহারা সবাই একই হাঁড়ির ভাত খাইয়াছে, একই ছাদের তলায় গাদাগাদি করিয়া ঘুমাইয়াছে। তাহারা সবাই তো আমারই রক্তের মধ্য হইতে তিলে তিলে আজ এত বড় হইয়াছে। তাহার আমাকে মানুক আর নাই বা মানুক, তাহারা আমাকে যত্ন করুক আর নাই বা করুক। এটা তো আমার স্বামীর ভিটা। আমার দ্বিতীয় জন্মের বাড়ি। আমি তো আর তাহাদের আলাদা করিয়া ভাবিতে পারি না। আজকাল আমাদের নায়নাতকুরেরা আর আগের মত বড়দের সঙ্গে সম্মানের সহিত কথা বলে না, একে অপরের সহিত আদবের সহিত মন খুলিয়া কথা বলে না। কাহাকে আমি কি বলিব? আজ এত বছর পর আমার মনে হইতেছে, আমি এখানে আজ শুধু আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি। আমি অপেক্ষা করিয়া আছি কখন আমি আমার সেই প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে দেখা করিব। কখন আবার আমার সেই শাশুড়ি মা আমাকে জরিয়ায়া ধরিয়া বলিবে, হোরলে বাড়ি, আর পিরনে নারী। অর্থাৎ বাড়ি চিনিবে ঝারু দেওয়া দিয়া আর নারী চিনিবে তাহার পিরনের কাপড় দেখিয়া। তাই এখনো আমি এই বয়সে সবার মঙ্গলের কোথা ভাবিয়া সকালে সবার উঠার আগেই এক খানা ঝারু লইয়া আমার সব উঠোন পরিস্কার করিয়া লই, আর তাহাতেই আমার কোমর খানা প্রতিনিয়ত ব্যাথায় ভরিয়া উঠে। হয়ত আমাকে এই কাজ করিয়াই যাইতে হইবে আমার শেষ নিঃশ্বাস থাকা অবধি। এটা যে আমার বাড়ি, আমার স্বামীর বাড়ি। এখানে আমার শাশুড়ি শুইয়া আছেন, এখানে আমার শশুর ঘুমাইয়া আছেন। কি বলিব আমি যখন আমার সাথে তাহাদের দেখা হইবে? জানো তো একটা জিনিস, অনাদরে মানুষ বাচিলে তার একটা গুন আছে। আর তাহা হইল তাহাকে ব্যমোও ধরিতে আসে না। মরার সদর রাস্তা গুলি একেবারেই বন্ধ হইয়া যায়। সবার কাছেই তখন নিজেকে আপদ বলিয়াই মনে হয়। এই আমার আলাল তাহার সব টুকু শক্তি দিয়া আমাকে আগলাইয়া রাখিয়াছে বটে কিন্তু আর বাকি সব যে যাহার হিসাব লইয়া এত টাই ব্যস্ত হইয়া আছে যে তাহাদের ভবিষ্যৎ কি হইবে তাহারা আজ না বুঝিলেও হয়ত কোন একদিন আমার আজকের এই দিনের কষ্টটা হয়ত বুঝিবে। এই বলিয়া তিনি আলালের হাতটি ধরিয়া অনেক্কখন চুপ থাকিয়া বসিয়া রহিলেন।
অনেক রাত হইয়া গিয়াছে। বুড়ি আর কোন কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। আমি তাহার আরও কাছে গিয়া বসিলাম। তাহার গায়ে হাত রাখিয়া তাহাকে জরাইয়ায়া ধরিবার আমার খুব ইচ্ছা হইল। মনে হইল তিনি ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাদিতেছেন। কেহই তাহাকে বকা দেয় নাই, আমারাও তাহাকে এমন কোন কথা বলি নাই যাহাতে তাহার মন খারাপ হইতে পারে, কিন্তু জিবনের সব পাওয়া যখন নিরাশায় পতিত হয়, যখন এত কষ্টের পরিশ্রমে গড়া নিজের সংসার আর নিজের আয়ত্তে থাকে না, যখন সেই সব ছেলেমেয়েদের লইয়া কোন একদিন ভবিষ্যতের সুখের জন্য আজিকার সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়া এতগুলি বছর পার করিয়া জিবনের বেলাশেষে হিসাব নিকাশ করিয়া কোন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না বলিয়া মনে হয়, তখন চোখের জল ছাড়া প্রতিবাদ করার আর কোন ভাষা থাকে না। নিজের সংসার কে আর নিজের বলিয়া মনে হয় না। তাহা অন্য কেহ দখল করিয়া লইয়াছে। আমি সেখানে শুধু একজন প্রাণী যার জীবন আছে কিন্তু জিবনের কোন মুল্য আছে বলিয়া মনে হয় না। কেউ কেউ এখনো আঁকড়াইয়া ধরে বটে কিন্তু সমস্ত সংসারটা আর আগের মত মনে হয় না।
আজ হইতে হয়ত আরও অনেক বছর পর আবার যখন আমার এই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হইবে, আদৌ দেখা হয় কিনা আমি জানি না, তখন হয়ত আমার এই আজকের রাতটির কথা বারবার মনে পরিবে যে এইখানে একশত বছর পুরানো কোন এক কাহিনী আমি শুনিয়াছিলাম, যার ইতিহাস লিখার কোন প্রয়োজন নাই, আর সে ইতিহাস সমাজের, দেশের কিংবা রাষ্ট্রের কোন কাজেও আসিবে না। হয়তবা আজ হইতে আরও একশত বছর পর আজকের এই কান্নাজরিত সুর কোন একদিন আজ যারা নিরবিকার হইয়া বসিয়া প্রাচির দেওয়া দেয়ালের মধ্যে নিসচুপ হইয়া বসিয়া আছেন, তাহারাও অনুভব করিবেন কিন্তু তাহাদের ইতিহাস শুনিবার জন্য, তাহাদের অশ্রুভেজা চোখের পাতা দেখিবার জন্য আর কেহই অবশিষ্ট থাকিবে না।
খুব ভারাক্রান্ত মন লইয়া আমি আমার বউ বাচ্চাদের নিয়া বাসায় ফিরিলাম। বিকালে একটা অলস সময় কাটাইতে গিয়াছিলাম কিন্তু সময়টা ভাল কাটিলেও মনের ভিতরে কোথায় যেন একটি বেদনার কিন্তু কষ্টের অনুভুতি আমাকে বার বার তারা করিয়া বেড়াইতেছিল। রাতে কোন কিছু আর খাওয়া হইল না। ক্ষনে ক্ষনেই আমার বারংবার মনে হইতেহিল 'হোরলে বাড়ি, আর পিরনে নারী'।