০১/০১/১৯৮৬ রুপদিয়া অনুশীলন, যশোর

গত ৩১ ডিসেম্বর তারিখে ৪ মর্টার রেজিমেন্টে আর্টিলারীতে আমার আগমন হয়েছে। অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আনিস, উপঅধিনায়ক হিসাবে আছেন মেজর ওয়ালি উল্লাহ স্যার। ঊনি জেআরবি (জাতীয় রক্ষী বাহিনী) এর অফিসার। এখানে একটু বলে রাখি, জেআরবি মানে কি। জেআরবি হচ্ছে 'জাতীয় রক্ষী বাহিনী'। জাতীয় রক্ষীবাহিনী একটি নিয়মিত আধাসামরিক বাহিনী যা নবপ্রতিষ্ঠ বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে গঠন করা হয়। শুরুতে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনীর পত্তন করা হয়। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এই বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ক্যাপ্টেন এ এন এম নূরুজ্জামানকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান করা হয়। আনুষ্ঠানিক নাম জাতীয় রক্ষীবাহিনী হলেও সাধারণত এই বাহিনীকে ‘রক্ষীবাহিনী’ বা সংক্ষেপে জেআরবি (JRB) বলে অভিহিত করা হতো। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিব নিহত হবার পর এই বাহিনী অবলুপ্ত করা হয়। অবলুপ্ত হওয়ার পর রক্ষীবাহিনীর অনেক সদস্য নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে আত্মীকৃত হন। মেজর ওয়ালী স্যার সেই আত্তীকরনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। আমি রোমিও ব্যাটরীর এজিপিও (এসিস্ট্যান্ট গান পজিশন অফিসার) হিসাবে পোষ্টিং পেয়েছি। ছোট ছোট অফিসারদের মধ্যে আছে আমার কলেজের ব্যাচম্যাট লেঃ লুতফর রহমান (১২ লং কোর্সের), লেঃ নিজাম স্যার (১১ লং কোর্সের), লেঃ আমিন স্যার (১০ লং কোর্সের), লেঃ রাজ্জাক স্যার (৯ লং কোর্সের)। লেঃ গনি স্যার (৮ম লং কোর্সের)। ক্যাপ্টেন মাহবুব (৩য় লং কোর্স), সাথে ক্যাঃ শওকাত আলী বুলবুল স্যার, তিনিও ৩য় লং কোর্সের। ব্যাটরী কমান্ডার আছেন মেজর লুতফুল স্যার, আছেন মেজর ইসহাক স্যার।

ইউনিট অনুশীলনে আছে রুপদিয়ায়। ৫৬ দিনের অনুশীলন। সবাই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থাকে এই সময়। শীতকাল, তাবুর জীবন। আমার তাবুটি একেবারে সৈনিকদের সাথে লাগানো। বাথরুম করার জন্য বদনা হাতে নিয়ে সৈনিকদের টয়লেটেই যেতে হয়। একটু একটু লজ্জা লাগে। কেমন দেখা যায় যে, একজন অফিসার পায়খানা করার জন্য হাতে বদনা নিয়ে প্রায় ১০০ গজ দূরে পায়খানার জন্য যাচ্ছে, আর এটা প্রায় সব সৈনিকদের সামনে দিয়েই। 

ইউনিটে আসার পর সিনিয়ররা এমন এমন সব ব্যবহার করলেন, কই একটু খেদমত টেদমত করবেন, তা না। বরং কেউ মেস ওয়েটার সেজে, কেউ আর্দালী সেজে কেউ বা আবার নকল অধিনায়ক সেজে আমাকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করা যায় সেইসব চেষ্টার কোনোই বাকী রয় নাই। মেডিক্যাল চেকআপের নামে ডাক্তার সেজে আসা এক অফিসার তো আমাকে রাতের বেলায় একেবারে দিগম্বর করে সবার সামনে ঘটার পর ঘন্টা রাতের কালো অমাবশ্যা রাতে দাড় করিয়েই রাখলো, তাও তো প্রায় ঘন্টা দুয়েক হবে। বুঝতেছি কি হচ্ছে, কিন্তু কিছুই বলার নাই, কিছুই করারও নাই।

শুধু একফাকে আমার দোস্ত লুতফর এসে বল্লো, পালন করে যা, যা বলছে। তা না হলে ঐ যে দেখছিস পুকুর, সারারাত ওখানেই কাটাতে হবে। লুতফরকে দেখে প্রানে একটু আশার বানী পেয়েছিলাম বটে কিন্তু মাত্র ৬ মাসের সিনিয়ার সে আমার কাছ থেকে, তার অবস্থা হয়তো একটু পুরানো কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ওর গায়ের থেকে সেই বিএমএ এর শিটপটের গন্ধ মুছে গেছে। সেও এক প্রকার ভয়ে ভয়েই জীবন চালায়। লুতফর আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু। আমরা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে ১৫ ইনটেকের ব্যাচের ছাত্র। লুতফর ছিলো আমাদের কলেজ ক্যাপ্টেন।

যাক, শেষ হয়েছে সেদিনের তাদের নতুন অফিসারের সাথে রংগলীলা। পরেরদিন অধিনায়কের সাথে আমার ইন্টারভিউ হলো। বিশাল বড় তার তাবু। সামরীক বাহিনীর লোকেরা যে একটা তাবুকে এই রকম বালাখানা করিয়ে ফেলতে পারে, অধিনায়কের তাবু না দেখলে বুঝা যাবে না। টিভি, ফ্রিজ, আলীশান টেবিল, নীচে কার্পেট সবই আছে। অধিনায়ক আমাকে অনেক কিছু জানালেন, বুঝালেন, এবং বললেন, এই সামরীক বাহিনীর চাকুরীতে সবচেয়ে বেশি জরুরী হলো নিজেকে সামরীক বাহিনীর আদলে শিক্ষিত করে তোলা। খুব ভালো লাগলো অধিনায়কের কথা।

আমার দোস্ত লুতফর একটু পরে এলো। শুনলাম সে নাকি ইউনিটের এডজুটেন্ট। খুব পুলকীত হবার কারন নাই। গত কয়েকদিনে আমার ৬ বছরের ক্যাডেট কলেজের বাল্যবন্ধু লুতফরও অনেক পালটে গেছে। সামরিক জীবনে সিনিয়ার জুনিয়ারের মাহাত্য না কেউ বুঝলে তার কপালে দুঃখ আছে। এখানে যেনো আগের ইতিহাসের কোনো মুল্য নাই। থাকলেও সেটা খুবই কিঞ্চিত। এখানে কাজ করে জুনিয়রিটি আর সিনিয়রিটি। লুতফর আমার সিনিয়র। এটাই বড়।

সারাদিন কম্বেট ইউনিফর্ম পড়ে কোমরে একটা পিস্তল ঝুলিয়ে ম্যাপ আর বাইনোকুলার সাথে নিয়ে অগোছালো ক্ষেতের আড়, জংগল, কবরস্থান, সব কিছুই যেনো আমাদের চলার পথ, থাকার পথ, যুদ্ধ খেলার পথ। যেহেতু আর্টিলারীর কিছুই জানি না, তাই, আমার জন্য বেশ কিছু চতুর আর চৌকশ এনসিও বরাদ্ধ করা হলো যেনো আর্টিলারীর আদিপান্ত আমাকে শিখানো হয়। যাকে বলে বিনে পয়সায় কোচিং। এর মধ্যে আমার দোস্ত লুতফরও সামিল।