০১/০১/২০২১-মেয়েরা বগুড়ায়

Categories

আজ থেকে প্রায় ৫৪ বছর আগে, আমার বাবা বুঝতে চেয়েছিলেন, তার অবর্তমানে তার পরিবার কিভাবে থাকবে, কে কিভাবে আচরন করবে, কার চেহারা কি হবে ইত্যাদি। আর এ কারনে তিনি একবার ৬ মাসের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। আমার মাও জানতেন না আমার বাবা কোথায় আছে কেমন আছে। শুধু জানতেন আমার বড় ভাই। আর বাবা আমার বড় ভাইয়ের আশেপাশেই ঢাকায় গোপনে ছিলেন। আমার ভাই প্রতিনিয়ত বাবাকে গ্রামের, বাড়ির, এবং অন্যান্য সদস্যদের আচার ব্যবহার আপডেট দিতেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, বাবা হয়তো কোথাও মারা গিয়েছেন, অথবা আর কখনোই ফিরে আসবেন না। তাতে যেটা হয়েছে সেটা হলো, সবাই তার নিজ নিজ চেহারায় আবর্ভুত হয়েছিলো। ফলে ৬ মাস পর যখন বাবা ফিরে এলেন তার গোপন আস্তানা থেকে, তখন তিনি বুঝলেন, কে আমাদের আপন, কে আমাদের পক্ষের আর কে আমাদের বিপক্ষের। শুধু তাইই নয়, আমাদের পরিবারের মধ্যেও তিনি বিভিন্ন সদস্যদের চরিত্র সম্পর্কে একটা নিখুত ধারনা পেয়েছিলেন। অন্তর্ধানের পরে আমার বাবা আরো বেশী বাস্তববাদী হয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে আমাদের জন্য ছিলো যুগান্তকারী এবং পারফেক্ট।

এই ঘটনাটা এখানে বলার অন্য কোনো কারন নাই। নিছক একটা সমকালীন ভাবনার মতো। আমার ছোট মেয়ে মানসিকভাবে আসলে আর এদেশেই নাই। তার ভাবনা কবে কোথায় কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়বে, তাও আবার আমেরিকার কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে। সারাক্ষন তার এই একই চিন্তা, আর এই চিন্তার রেশ ধরে সারাক্ষন তার সেই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য এখানে এপ্লিকেশন, ওখানে এপ্লিকেশন, স্যাট পরীক্ষা, আইএলটিএস ইত্যাদি। আমরা ধরেই নিয়েছি, যে, আগামী বছরের শেষের দিকে আমরা আমার ছোট মেয়েকে আর পাচ্ছি না। সে বিদেশের মাটিতে পড়াশুনা করবে। এটা যেনো এক প্রকার মেনেই নিয়েছি। আর কনিকা তো শতভাগ সেভাবেই ভাবছে। বাকীটা আল্লাহর রহমত।

বড় মেয়েও বিসিএস পরীক্ষায় যদি চান্স না হয়, তারও পরিকল্পনা প্রায় একই রকমের। সেও সেই সুদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যেই হয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এই যে, একটা ভ্যাকুয়াম, মানে দুই মেয়েই আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার একটা আভাষ, তখন আমাদের জীবন কি হবে, কেমন কাটবে, সেই ভাবনাটা যেনো আজ পেলাম। কারন আজকে দুই মেয়েই আমাদের ছেড়ে বগুড়ায় আছে। বাড়ি একেবারেই খালি। একদম ফাকা। এ যেনো সেই পরীক্ষাটা যখন ওরা কেউ আর আমাদের সাথে থাকবে না, তখন কেমন হবে আমাদের জীবনটা।

আজ বুঝলাম, কেমন হবে জীবনটা। সারাটা বাড়ি ফাকা। সবই আছে, চেয়ার টেবিল যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে। উম্মিকার ঘরের কোনো কিছুই এদিক সেদিক হয় নাই, কনিকার ঘরেরও। ডাইনিং টেবিলে সব কিছু আগের মতোই আছে, ড্রইং রুমটাও তাই। খাবার টেবিলে সবসময় যে মেয়েরা আমার সাথে খেতে বসে, সেটাও না। কিন্তু তখন হয়তো ওরা ওদের রুমেই থাকতো। কিন্তু আজকে মনে হলো, ওরা বাসায় কেহই নাই মানে আমার খাবার টেবিলের খাবারের সাধটাও ভিন্ন। ওদের ঘরের দিকে তাকালে মনে হয়, মানুষগুলি এখানে বসতো, এখানে কম্পিউটারে কাজ করতো, ওইখানে ওরা পায়ে পায়ে হাটতো। ওদের মা কারনে অকারনে কখনো ডাকাডাকি, কখনো না খাওয়ার কারনে রাগারাগি, কখনো আবার একসাথে বসে হাসাহাসি করতো। আজকে কিন্তু ওরা আছে কিন্তু কাছে নাই। এতো ফাকা লাগছে কেনো?

ওদের বগুড়ায় যাওয়ার মাধ্যমে আমি যেনো ওদের আমেরিকা যাওয়ার একটা প্রক্সি অনুভব করলাম। এটাই হবে যখন ওরা সত্যি একদিন আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে থাকবে। আজকে একটা কথা প্রায়ই মনে পড়লো-

তাহলে আমার এতো বড় ব্যবসা, এতো বড় বানিজ্য, আমার এতো বড় বড় প্রোজেক্ট নিয়ে কি হবে যদি ওরাই আর এখানে না থাকে? কে দেখভাল করবে আমার অনুপস্থিতিতে এই বিশাল সাম্রাজ্য? কোথায় যেনো একটা খটকা লাগলো। দরকার আছে কি এতোসবের?

অনেক ভাবনার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *