০১/০৪/১৯৮৬-বেসিক কোর্সের প্রি-কোর্স শুরু

বেসিক শব্দটাই বেসিক। অর্থাৎ সামরিক জীবনে পদার্পন করার পর বিএমএ এর সেই ট্রেনিং আর ইউনিটে কোনো কাজেই লাগে না। প্রতিটি ইউনিট তার পেশাদার মুল্যবোধে ব্যতিক্রম। ইনফ্যান্ট্রির কার্যকলাপ এক রকম, সিগন্যালস এর কাজ, আর্মারড এর কাজ, আর্টিলারীর কাজ যুদ্ধক্ষেত্রে সব আলাদা আলাদা। বিএমএ তে যে ট্রেনিং করেছিলাম, তা ছিলো সিভিলিয়ান থেকে মিলিটারীতে ট্রান্সফর্মেশনের ট্রেনিং। আদব কায়দা, ইটিকেটস, সামরীক ড্রিল, বেসিক কিছু মাইনর ট্যাকটিক্স, আর কিছু কমান্ড জাতীয় ব্যাপার স্যাপার। মুলত বিএমএ এর ট্রেনিং পুরুই আলাদা। যখন অফিসাররা কমিশন পেয়ে যায়, তারা যার যার আর্মস অনুযায়ী আবার নতুন করে বেসিক ট্রেনিং শুরু করে। আমি যেহেতু আর্টিলারীর অফিসার, আমাদের আর্টিলারীর উপরেই এখন যতো ট্রেনিং চলবে। আর এর প্রথম কোর্ষটাই হচ্ছে বেসিক কোর্ষ যার নাম 'আর্টিলারী অফিসার্স বেসিক কোর্ষ (এওবিসি) ।

গত শীতকালীন এক্সারসাইজে আমাকে যারা হাতে কলমে আর্টিলারীর উপরে গানসহ ট্রেনিং করিয়েছে, সেটাই আসলে এবার পেশাগতভাবে আমাদের কোর ট্রেনিং সেন্টারে শিখানো হবে শুদ্ধভাবে এবং পরীক্ষা নীরিক্ষা করে, বাস্তব সম্মতভাবে। এরই পূর্ব প্রশিক্ষন হিসাবে আমাদের ব্রিগেড সবগুলি নতুন অফিসারদেরকে নিয়ে সমবেতভাবে কোনো একটা ইউনিটের আন্ডারে বেসিক কোর্ষের জন্য প্রি-কোর্ষ করিয়ে তারপর সাধারনত বেসিক কোর্ষে পাঠায়।

এরই ধারাবাহিকতায় আগামী মাস থেকে আর্টিলারীর বেসিক কোর্স শুরু হবে। এরজন্য আজ হতে সব নতুন অফিসারদেরকে ব্রিগেডের আন্ডারে ২৬ ফিল্ড রেজিমেন্টের তত্তাবধানে ফিল্ড পোর্শন আর ৫ এডি এর আন্ডারে এএ (এন্টি এয়ারক্রাফট) পোর্শন শুরু হলো। গতকাল আমাদের রেজিমেন্টেশন পিরিয়ড ডিভিশন কর্তৃক তুলে দিয়ে অফিসার মেসে ইন করিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা এখন পুরুদমে অফিসার।

ইহা একটা ভালো খবর বটে কিন্তু এতোদিন সৈনিক মেসে যখন খাইতাম, তাহাদের মেন্যুই খাইতাম কিন্তু কোনো বিল দেওয়া লাগিতো না। গতকাল হতে অফিসার মেসে ইন হওয়াতে যাই খাবেন, তাই নিজের বিল দিতে হবে। মাত্র ৭৫০ টাকার বেতন। সিগারেটেই যায় এর তিন ভাগের এক ভাগ। এক প্যাকেট গোল্ড লিফ সিগারেটের দাম প্রায় ২০ টাকা। কখনো কখনো দোকানভেদে আবার তারও বেশি। বেতনের টাকায় চলা খুব মুষ্কিল। মেসে খাবারের বিল নাকি আসে প্রায় ৬০০ টাকার মতো। এর মধ্যে আরো অন্যান্য খরচ। কিভাবে চলে অফিসাররা? বেতন যদিও স্কেল অনুযায়ী ৭৫০ টাকা, কিন্তু ব্যাটম্যান ভাতা, এপয়েন্টমেন্ট ভাতা, এবং অন্যান্য মহার্ঘ্য ভাতাসহ হাতে পাই প্রায় ১৫০০ টাকার মতো। যাই হোক, তারপরেও একটা চাকুরী তো।

যেটা বলতেছিলাম। প্রি-কোর্সের যত না আয়োজন, বা লেখাপড়া, তার অধিক বেশি হইতেছে ২৬ ফিল্ডের ফিল্ড মেসে আমাদের আড্ডা। সকাল ৮টা হইতে ১ টা পর্যন্ত খালি গল্প আর মজার মজার আলোচনা। ইউনিটে গিয়া দেখাই, আহা কতই না কষ্ট করতেছি এই প্রি-কোর্সের লেখাপড়া লইয়া। বিকালেও প্রি-কোর্সের ব্যবহারিক হয়, কিন্তু কাজের কিছুই হয় না। মাঝখান থেকে বিকালে একটু আড্ডাটা ভালো করে জমে উঠে।

১২ লং কোর্সের লেঃ জাহিদ সাহেব মাঝে মাঝে এমন সব কাহিনী করেন আর সবাই মিলিয়া কোনো না কোনো ছুতা বাহির করিয়া তাহাকে ফান্দে ফেলিয়া তাহার নামে এইটা খায় তো ওইটা খায়। তার নাম দেয়া হয়েছে-স্যার জাহিদ। মজার মানুষ। ৫ এডির লেঃ মাহফুজ সাহেব তো হাটিবার সময় এমন একটা ভাব করেন যেনো উনি নবাব অথবা ব্রাহ্মণ, আর যদি সেটা না হয় তাহলে নির্ঘাত ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য। সবাই আড়চোখে একটু কথা তো বলিতেছেই কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুই আসে যায় না। তিনি বাকা হইয়া আলতোভাবে পা ফেলিয়া ঘাড় মটকাইয়া চলেন। শুনেছি, তাহার এক ভাই চলচিত্রে নাকি নায়ক হয় হয় অবস্থা। নায়ক পরিবারের কেউ হাটিতে গিয়া একটু অভিনয় না করিলে কি আর ইজ্জত বাচে?

সেনাবাহিনীর লাইফটা কিন্তু অনেক ভ্যারাইটির। সকাল হইতে ব্যস্ততা কিন্তু কিসের যে ব্যস্ততা, তাহাই বুঝিতেছি না। অথচ কাহারো হাতে কোনো সময় নাই।

প্রি-কোর্ষের পুরু সময়টায় মনে হচ্ছে, একদল দুষ্টু পোলাপান একসাথে জড়ো হইয়া কোনো এক ইতিহাস রচিত না করিলেও সেখানে যে মহাজ্ঞানের কোনো অভাব নাই তা যে কোনো মুর্খও বুঝিতে পারে। শুধু প্রি-কোর্ষের সাময়িক আইজি (ইন্সট্রাক্টর গানারী) রাই তাহা উপলব্দি করিতে না পারিয়া শত শত অংকের হোমওয়ার্ক দিয়া পাশের টেলিফোনে কাহার সহিত তাহারা এতো মৃদুস্বরে  ফোনে আলাপ করে বুঝি না। তাহাদের ঠোট পর্যন্ত নড়িতে দেখিনা। যখন হটাত করিয়া ‘হা হা “ করিয়া হাসিয়া উঠেন, তখন তাহাদের দন্তবিকশিত হয়। এছাড়া তাহাদের কথা বলার সময় ঠোট পর্যন্ত নড়িতে দেখি না।

এই আইজি মহোদয়গন হলেন ২৬ ফিল্ডের লেঃ ফিরোজ, ৪ মর্টার রেজিমেন্টের ক্যাঃ গনী, ২৬ ফিল্ডের আরো একজন আছেন লম্বা অফিসার যাকে লম্বু গানার নামেই অনেকে চিনেন, ভদ্র দি গ্রেট, লেঃ রশীদ স্যার। মাঝে মাঝে আবার আর্টিলারী ব্রিগেডের বিএম (ব্রিগেড মেজর) মেজর আহসান উল্লাহ স্যারও ক্লাস নিতে আসেন। কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার বাকের প্রথম দিন ক্লাসে এসে গুরুগম্ভীর উপদেশ্মুলক কিছু জ্ঞান দিয়া গেছেন, অনেক কঠিন লোক। সিলেটি সম্ভবত। কথায় কথায় যে কাউরে এক্কেবারে সিলেটি ভাষায় গাল দিতে কার্পন্য করেন না।  

সময়টা কেটে যাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা কিছু হইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে না। কারন ছাত্রগুলির পরিচয় পাইলেই বুঝা যাবে কি অত্যাধুনিক মনোযোগী সব ছাত্রের দল। আমাদের ৪ মর্টারের আমি আর লেঃ লুতফর, ২৬ ফিল্ডের ২লেঃ ইকবাল, আর লেঃ জাহিদ, ২৭ ফিল্ডের ২লেঃ আকবর, ৫ এডির ২লেঃ ইশা, আর ২লেঃ ভাওয়ালী, সাথে আছে ১২ লং এর লেঃ মাহফুজ, আরো অনেকে। কেউ কেউ আবার হেভী সিরিয়াস যেনো এইটাই বেসিক কোর্ষ। আমার আসলে কিছুই শিখা হয় নাই।

দিনের বেশীরভাগ সময় প্রি-কোর্ষেই থাকি, বিকালেও। আর রাতে এসে গান শুনি, লুতফরের হোম ওয়ার্ক কপি করি, আর ঘুমানোর আগে ডায়েরী লিখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *