এই ইউক্রেন যুদ্ধের আগে জীবনেও আমি এই দ্বীপের নাম শুনিনি। গত কয়েকদিন যাবত এই স্ন্যাক আইল্যান্ডের নাম খুব ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে। এই স্ন্যাক আইল্যান্ড আসলে কি? ঐ যে বলে না যে, চাপে পইরা কিছু জানা। আর আমার বেলাতেও এই জানাটা হইছে এই ইউক্রেন যুদ্ধে স্ন্যাক আইল্যান্ড নামক জায়গাটার ব্যাপারে জানা হলো।
ইউরোপের ডানুবি ডেল্টা নদীর নিকটে কৃষ্ণ সাগরের পাশে ইউক্রেনের অধীনে একটি দ্বীপ যাকে ইউক্রেনিয়ানরা “জিনি আইল্যান্ড” আর ইংরেজীতে একে “সার্পেন্ট বা স্ন্যাক আইল্যান্ড” নামে ডাকে। ১৮৪২ সালে রাশিয়া সেখানে একটি লাইট হাউজ তৈরী করেছিলো এবং সেটা রাশিয়ার অংশ হিসাবেই পরিগনিত হতো কিন্তু ১ম বা ২য় বিশ্ব যুদ্ধে এই লাইট হাউজ ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেখানে পতনের বছর পর রোমানিয়া একটি কেরোসিন দ্বারা পরিচালিত লাইট হাউজ তৈরী করে সামুদ্রিক পরিবহনের দিক নির্দেশনার কারন হিসাবে।
২০১২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায় যে, মাত্র ৩০ থেকে ১০০ জনেরও কম জনবসতি এই আইল্যান্ডের একটি গ্রাম যার নাম বিলি, সেখানে বসবাস করত। এদের বেশীরভাগ মানুষ হচ্ছে ফ্রন্টিয়ার গার্ডস, কিংবা ট্যাকনিক্যাল হ্যান্ডস যারা তাদের পরিবার নিয়ে ওখানে বাস করে। সুপেয় পানির কোনো সম্ভাবনা সেখানে নাই। এরা কিভাবে কি খায়, কোথা থেকে কিভাবে কি আনে এটা আমি জানি না। তবে জানা যায় যে, সব কিছুই হেলি সাপোর্টেড হয়।
এই আইল্যান্ডের আয়তন মাত্র ৬৯০ বাই ৬৮২ মিটার। অর্থাৎ 0.205 km2 খুবই ছোটো একটা ল্যান্ড।। যদিও এটা এখন ইউক্রেন ওদের টেরিটরি হিসাবে ভাবে কিন্তু এর ৮০% রোমানিয়ার অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। মাত্র ২০% হচ্ছে ইউক্রেনের।
১৯৯৭ সালে ইউক্রেন তার পুরু অংশ রোমানিয়ার কাছে ছেড়ে দিয়েছিলো কিন্তু পরবর্তীতে রোমানিয়া সার্ভে করে দেখেছিলো যে, এই আইল্যান্ডে শুধুমাত্র সাগরের রক ছাড়া আর কিছুই নাই বিধায় সে এটাকে রক্ষনাবেক্ষনের অংশ থেকে পরিত্যাগ করে।
২০০৭ রোমানিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ইউক্রেন সেখানে হেলিকপ্টার প্লাটফর্ম, নেভিগেশনাল সিস্টেম, সোলার এবং ডিজেল সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন করে কিছু বেসামরিক স্থাপনা যেমন রিসার্চ সেন্টার, পোষ্ট অফিস, ব্যাংক (ওখানে ইউক্রেনের ‘আভাল ব্যাংকের’ একটি শাখা আছে), সেটেলাইট টেলিভিশন, প্রাথমিক চিকিতসার একটি কেন্দ্র, মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন করে। যদিও রোমানিয়া তার সত্ত্ব ছাড়েনি বলে আখ্যা দেয়। তারমানে এটা এখনো ইউক্রেন আর রোমানিয়ার জন্য একটা ডিসপুটেড আইল্যান্ড।
ইউক্রেনের কোষ্টাল এরিয়া থেকে এই আইল্যান্ড ২২ মাইল এবং রোমানিয়ার কোষ্টাল এরিয়া থেকে এই আইল্যান্ড মাত্র ২৮ মাইল দূরে অবস্থিত। যদি শহরের দুরত্ত ধরি, তাহলে ইউক্রেনের ভিল্কোবি শহর থেকে এটা ৩১ মাইল আর রোমানিয়ার সিলুনা শহর থেকে এর দুরুত্ত মাত্র ২৯ মাইল।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে রাশিয়া এই আইল্যান্ড নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। যদিও রাশিয়ার এই আইল্যান্ডের কোনো প্রয়োজনই ছিলো না এবং এখনো প্রয়োজন নাই।
দখল নেয়ার সময় ইউক্রেনিয়ানরাও জানতো না কতজন আসলে ওখানে ছিলো। ফলে ইউক্রেন জানায় যে, মোট ১৩ জন এই স্ন্যাক আইল্যান্ডে ছিল যারা সবাই মারা গেছে রাশিয়ার দখলের সময়। তাই প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকী ওই ১৩ জনকেই দেশের সর্বাধিক মরনোত্তর পুরুষ্কারে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে রাশিয়া এই স্ন্যাক আইল্যান্ড থেকে আরো ১৯ জন নাগরিককে আটক করে, সেই আটককৃত নাগরিকদেরকে বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছে ছেড়ে দেয়।
এই স্ন্যাক আইল্যান্ড স্ট্রাটেজিক লোকেশন হিসাবে যতোটা না ইম্পর্ট্যান্ট, তার থেকে বেশী ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে যে, ল্যান্ড লকড কান্ট্রি হিসাবে যদি ইউক্রেন লকড হয়ে যায়, তাহলে ওডেসা থেকে এই স্ন্যাক আইল্যান্ডের মাধ্যমেই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে ব্ল্যাক সি এরিয়া দিয়ে রোমানিয়া হয়ে ইউক্রেন তার পন্য পরিবহনে সক্ষম। এটা ইউক্রেনের ম্যারিটাইম টেরিটরিয়াল হিসাবে ইউক্রেনের কাছে বেশী জরুরী। রাশিয়ার কাছে নয়।
রাশিয়া গত ৩০ জুন ২০২২ তারিখে ‘গূড গেশ্চার’ হিসাবে স্ন্যাক আইল্যান্ড থেকে তার মিলিটারী প্রত্যাহার করেছে। রাশিয়া বলতে চাচ্ছে যে, ইউক্রেনের খাদ্য সামগ্রী দেশের বাইরে রপ্তানীর সুযোগ করে দেয়ার জন্যই তারা এই আইল্যান্ড পরিত্যাগ করেছে যাতে কেউ রাশিয়াকে এটা বলতে না পারে যে, ম্যারিউপোল কিংবা ইউক্রেনের অন্যান্য সমুদ্র বন্দর রাশিয়া দখল করার কারনে ইউক্রেন তাদের খাদ্য সামগ্রী বাইরে রপ্তানী করতে পারছে না। এবার তারা সেই সুযোগ করে দিয়ে প্রমান করাতে চায় যে, ইউক্রেন আসলেই তাদের খাদ্য সামগ্রী বাইরের দেশে রপ্তানী করতে ইচ্ছুক কিনা।
যদিও ইউক্রেন জানিয়েছে যে, ইউক্রেনের ক্রমাগত অবিরাম বোমার কারনে তারা স্ন্যাক আইল্যান্ড পরিত্যাগ করেছে।