এই তো গত ২৯ জুন ২০২৩ তারিখে কুরবানীর ঈদ চলে গেলো। ছুটির দিনে আমি বাসাতেই থাকি, কোথাও ঘুরতে যাওয়া ভালোও লাগে না। বাসায় আমার স্ত্রী তার নিজের পছন্দের মতো কাজ করে, শপিং করে, বাইরে যায়, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে, বেশ ভালোই তার সময় কাটে। আমারও সময় কাটে আমার মতো করে। ছোট মেয়ে আমেরিকায় থাকে, সেও ভালো আছে, বড় মেয়ে ডাক্তারী করে, সে ভালো নাই।
আমি আমার জীবনের অনেক হিসাব কিতাব করছি প্রতিদিন। প্রায় ৬০ বছর বয়স তো হয়েই যাচ্ছে। এর বয়সের অনেক চেনা পরিজন না ফেরার দেশে চলে গেছে, কেউ যাচ্ছে এবং কেউ কেউ অপেক্ষায় আছে কবে তার শেষদিন চলে আসবে। কেউ উদাসীন ভাবে এখনো মনে করছে, অনেক বছর হয়তো বাকী আছে জীবনের, কেউ কেউ আবার এগুলি ভাবার প্রয়োজন ও মনে করে না কারন এর উপরে কারো হাত নাই। আবার কেউ কেউ এমনো ভাবছে, কিছুই তো করা হলো না নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কিংবা বাচ্চা কাচ্চাদের জন্য, তাহলে এখন কি করা?
এসবই নিয়ে সমাজে মানুষের জীবন। কেউ পেয়ে হতাশ, কেউ না পেয়ে হতাশ, কেউ আবার পেতে পেতে আরো না পাওয়ার জন্য আপ্রান চেষ্টায় আরো বেশী হতাশ। কেউ যেনো সুখী নয়। কোনো মানুষ আজ পর্যন্ত শতভাগ সুখী কিংবা খুশী নিয়ে মৃত্যু বরন করে নাই। কেউ তাদের চাহিদা পুরন হয়েছে এটা মনে করে আর কোনো কিছুই প্রয়োজন নাই এটা ভেবে তাদের প্রতিদিনের আফসোস থেকে বিরত হয় নাই। আর এই ট্রেন্ড আদিকাল থেকে শুরু হয়েছে, কিয়ামতের শেষদিন অবধি এই আফসোস মানুষের থেকেই যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, দেখা যাবে সেও তার সম্পদের উপর খুশী নয়, সে আরো চায়। হিসাব করে যদি দেখা যায় যে, তার জীবদ্ধসায় সে যা কামিয়েছে, সেই সব প্রতিদিন খরচ করলেও তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সম্পদে বা টাকা পয়সার কমতি হবে না, তারপরেও তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুসচিন্তাগ্রস্থ। সম্ভবত এটাই মানুষের বেসিক ইন্সটিংক্ট। কেউ সুখী না।
কতদিন বাচবো আমরা?
খুব বেশী হলে ৮০ কিংবা ১০০ বছর? কারো কারো ৬০ (যা আমার প্রায় সমাগত), কারো কারো ৭০, কিংবা ৭৫ অথবা বেশীজোর ৮০। যদি মিনিট সেকেন্ডের হিসাব করি, প্রতিটা সেকেন্ড পার হ ওয়া মানে প্রতিটি সেকেন্ড জীবন থেকে শেষ হয়ে যাওয়া। নতুন করে এও সেকেন্ড যোগ করার কোনো যন্ত্র, বা সিস্টেম তৈরী হয় নাই। এটা ফিক্সড। আর প্রতিটি সেকেন্ড পার হয়ে যাওয়া মানে আমরা সবাই জীবনের ফিনিশিং লাইনের কাছালাছি অগ্রসর হ ওয়া অথবা মৃত্যুর স্তার্টিং লাইনে পদার্পন করা। একটা সময় আসবে যখন সব সেকেন্ড শেষ হয়ে যাবে এবং আমরা আমাদের এই জীবনের যাত্রাপথ শেষ করে দেবো। কতটুকু আহরন করেছিলাম, কতটুকু রেখে গেলাম, কে আমার সেই আহরীত সম্পদ কিভাবে ভোগ করবে, কতজন প্রিয় মানুষ আমাদের জীবনে ছিলো কিংবা কতজনকে আমরা ঘেন্না করেছি, কে আমার শত্রু ছিলো, কে আমার মিত্র ছিলো, বা কাকে আমি প্রাধান্য দিয়েছি আর কাকে ঠকিয়েছি, এর সব কিছুর হিসাব সেদিন জমে থাকা সেকেন্ডের মান শুন্য হলে আর কোনো কিছুই আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।
হাজার বছর বাচতে পারলে না হয় হাতে থাকা সেকেন্ডকে অপচয় করার বদান্যতা থাকতো। সেটা তো আর নাই। তাহলে এতো অল্প সংখ্যক সেকেন্ডের ঝুড়ি নিয়ে মন খারাপ, মনে কষ্ট, কিংবা পচা ব্যাপার স্যাপের গুলিতে সময় নষ্ট করার কোনো সময় কি আসলেই আমাদের আছে? আর ঠিক ে কারনে আমি মাঝে মাঝে যেটা ভাবি-
সময় দিন সেসব ব্যাপারগুলিতে যেখানে আপনি সুখী থাকেন। সময় ব্যয় করুন সেসব কাজে যেখানে আপনার মন প্রফুল্ল থাকে। জানি একা চলতে পারা যায় না, তাই পরিবার, বন্ধু বান্ধবের জন্ম। যদি মনে হয় এগুলি আপনাকে উতফুল্ল রাখে, সেখানে সময় দিন। সবাই আপনাকে হয়তো বরন করে নেবে না, তাহলে সেগুলি ভুলে যান। প্রয়োজন নাই সেসব যেসব আপনাকে হতাশ করে। জীবন একটাই। অন্যের সুখী হাস্যমুখ দেখে আপনি এটা ভাববেন না যে, সে হয়তো অনেক খুসিতে আছে। তাদের মতো করে চল্বার আপনার কোনো প্রয়োজন নাই।
কেউ যদি আপনার পাশে না থাকে কিংবা যারা পাশে থাকার কথা তারা যদি আপনার কষ্টের কারন হয়ে থাকে, ভুলে যান তাদের। যেহেতু আপনার খাওয়া, থাকার কিংবা চিকিৎসার অর্থের অভাব নাই, ফলে দিনভরে আকাশ দেখুন, বৈ পড়ুন, টিভি দেখুন, ভোর বেলা সকালে শিশির ভেজা রাস্তায় ফসলের ক্ষেত দেখুন, বিকালে আকাশ দেখুন, মেঘলা বৃষ্টির বাতাস উপভোগ করুন, নদীর ঘাটে বসে নোউকার পাল তোলা মাঝির ভাটিয়ালী গান শুনুন, রাখালের কন্ঠ শুনুন, ভরা পুর্নিমাতে কিংবা পুর্ন অমাবশ্যায় তীব্র জোয়ারে ফুলে উঠা সাগরকে দেখুন, বেরিয়ে যান কোথাও একা কিংবা কাজের কোনো মানুষকে নিয়ে। যদি সাথী সেটা যেইই হোক, হোক স্ত্রী বা পরিবারের কেউ, তাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। অবুঝ পশু, কুকুর, বিড়ালের সাথে সময় কাটান, যদি পারেন, অবুঝ শিশুর সাথে অনেক অনেক সময় কাটান। তাদের নিষ্পাপ মুখের হাসি আপনাকে উতফুল্ল করবে।
আর এসবের মাঝে কখনোই আপনার স্রষ্টাকে ভুলে যাবেন না। কারন সব শেষে আপনাকে তার কাছেই যেতে হবে। আপনি আস্তিক বা নাস্তিক যাইই হন না কেনো, সব শেষে কেউ না কেউ তো আপনার সমস্ত কাজের জবাব্দিহিতা করতেই হবে। যদি কোনো স্রষ্টা না থেকে থাকে, তাহলে তো বেচেই গেলেন, জীবন শেষ তো কোনো কৈফিয়ত নাই, কিন্তু যদি থেকে থাকে? আর সেই “যদি” ই আপনাকে আপনার ে জীবনের সন কৃত কর্মের জবাব্দিহিতায় আকড়ে ধরবে। তাই অপশন খোলা রাখুন, স্রষ্টাকে আপনার প্রাত্যাহিক সময়ে রাখুন। মন ভালো থাকবে, প্রশান্তিতে থাকবে।
আজ থেকে ১০০ বছর আগের যেমন কাউকে আপনি চিনেন না, নাম ও জানেন না, তাদের ব্যাপারে যেমন আপনার কোনো জানার আগ্রহ ও নাই, তেমনি আজ থেকে শতবছর পরে আপনার ব্যাপারেও কেউ জানার আগ্রহ প্রকাশ করবে না, আপনার নাম ও জানবে না। তাই সেই শত কিংবা সহস্র বছর পরে যদি সত্যিই কিছু আবার এই পৃথিবী থেকে পেতে চান, তাহলে দুহাতে দান করুন।
পৃথিবী সত্যিই সুন্দর যদি আপনি মনে করেন এটা সুন্দর। সমাজের কে কি ভাবলো, সন্তানদের মধ্যে কে আপনাকে কতটুকু মুল্যায়ন করলো, সেটা নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ নাই। পৃথিবীর শুরু থেকেই সমস্ত বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য আপ্রান সব কিছু করে গেলেও সেইসব সন্তানেরা খুব অল্প সংখ্যক সন্তানেরাই তাদের বাবা মায়ের প্রতি ন্যায় বিচার করেছে।
তাই, নিজে আনন্দ করুন, নিজে পৃথিবীর সব কিছু আপনার সাধ্যের মধ্যে ভোগ করুন। হাতে খুব একটা সেকেন্ড জমা নাই।