০১/০৯/১৯৯৯- নিঃসঙ্গতা

বুধবার, ১৯২৪ ঘণ্টা, বগুড়া ক্যানটনমেনট।

নিসঃসঙ্গতা আমার প্রতিদিনের একটা সংগি। চারিপাশে এতো মানুষজন, এতো সারি সারি অট্টালিকা, হাই স্পীডের গাড়ি ঘোড়া চলমান, সবাই কোনো না কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কেউ তাদের পরিবার নিয়ে, কেউ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে, কেউ আবার মহাকাশের অন্তর্নীহিত রহস্য ভেদ করা নিয়ে ব্যস্ত। আমার সব কিছুই আছে, অথচ দিনের বেশীরভাগ সময়ই আমি কেনো জানি একা। কাজের মধ্যে ডুবে থাকি, তারপরেও আমি একাই মনে হয়। দিনশেষে সন্ধ্যায় আমি একা, দিনের আলো ফুটবার সময়েও আমি একা, ভরদুপুর লোকারন্য পরিবেশেও আমি একা।

বাইরে যখন বৃষ্টি হয়, টিনের চালের রিমঝিম শব্দ হয়, কিংবা ঝড়ো হাওয়ায় যখন পাশের গাছ গাছালীগুলি একে একে একদিক থেকে আরেকদিকে দিকবিদিক জ্ঞান হারানোর মতো হেলে দুলে উঠে অথচ ওরা ওদের স্থান পরিবর্তন করে এই ঝড় হাওয়া থেকে মুক্তির পথ খুজে পায় না, তেমনি আমার কাছে মনে হয়, আমি সব কিছুর পরেও অন্য কোথাও যাওয়ার কোনো পথ দেখি না। আমি ও ওই গাছ গাছালী গুলির মতো কোথাও পালাতে পারি না।

গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আমি জেগে থাকি একা। নিশিচরের মতো আমার চোখে ঘুম নাই, বাইরের অন্ধকার রাতের মতো আমি আমার জীবনের অনেক কিছু তখন আর চোখের সামনে দেখতে পাই না। আমার ভয় করে। কিসের ভয়, কাকে ভয় আমি সেটাও স্থির করতে পারিনা। একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমাকে চাপা হাতে রুদ্ধ করে কি জানি কানে কানে বলে যায়, আমি তার ভাষা বুঝি না।

আমার সংসার আছে, কেউ না কেউ আমার উপর ভরষা করে। আমি অনেকের ভরষার জায়গা বটে কিন্তু আমি শক্ত করে কোথাও দাড়াতে পারি না। সারাক্ষন মাথা যেনো ভন ভন করে। ক্ষুধা লাগে, খাবার আছে অথচ আমার পেট ভরে না।

আমি একা।

আমার এই একাকীত্ব অবশ্য আজকের একদিনেই তৈরী হয় নাই। দিনে দিনে আমি একটা বাস্তব খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলাম, এই বিশাল দুনিয়ার মধ্যে এতো সব মানুষ নিজের কাধের উপরে থাকতেও কেনো যেনো মনে হয় কেউ আমার হাতটা ধরে বলে না- আছি তো আমি। এতো ভয় কিসের?

তবে আমি আমার এই একাকীত্ব কে খুব উপভোগ করি মাঝে মাঝে। আমার এই জীবনে কেউ থাকুক বা না থাকুক, আমি তো আছি আমার জন্য। যখন রাত হয়, আমি আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজকে দেখি, যখন সকাল হয় আমি আবার আয়নায় গিয়ে দাড়াই, নিজেকে দেখি। অদ্ভুত লাগে আমাকে। আমার আশেপাশে যাদেরকে দেখি তারা আমার সাহস, আমার কনফিডেন্স, আমার জিদ, আমার নতুন নতুন ইগো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা শুধু আমাকে কখনো সাহস দেয়, আমার কনফিডেন্স আমাকে অনেক দূর যেতে সাহাজ্য করে, আমার জিদ আমাকে একা থাকার প্রেরনা জোগায়, আর আমার ইগো? আমার ইগো আমাকে শুধু এটাই বলে, তুমি কারো থেকেই কম কিছু নও। এই দুনিয়ায় তোমার মতো আরো অনেক পুরুষ কিংবা মানুষ জন্মেছিলো যারা একাই সমুদ্র পার করেছে, তারা সমাজকে পরিবর্তন করেছে। তারা এক সময় তোমার থেকেও দূর্বল ছিলো।

কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছি? সদা হাস্যজ্জোল চোখে আমি তড়িত উত্তর দেই- খুব ভালো আছি। কিন্তু আমি কি আসলেই ভালো আছি? হয়তোবা আমি আসলেই ভালো আছি। আমার জগত আলাদা, আমার ভাবনা আলাদা, আমার কষ্ট আলাদা, আমার পছন্দ আলাদা, আমার সুখটাও সবার থেকে আলাদা। পৃথিবীর কেউ সুখী না। আমিও হয়তো সবার মতো সুখী না কিন্তু আমার একাকীত্ব আমাকে সুখী করেছে। সেই সুখটা আমি একাই ভোগ করি। আমি খেতে গেলে একাই খাই, ঘুমুতে গেলে একাই ঘুমাই, হাসলে একাই হাসি। কেউ হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমার অপেক্ষার রাত শেষ হয় না, আমার দিন শেষে মনে হয় আমি তো ভালোই আছি।

একটা সময় আসবে, আমি বুড়ো হয়ে যাবো, আমার মন পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমার আজকের দিনের অনেক শখ আহ্লাদ পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমি হয়তো তখন আর আজকের দিনের বৃষ্টি, আজকের দিনের নিশীথ রাত, কিংবা চাদনী চাঁদ কিছুই আর আকর্ষন করবে না।

আমি তখনো একাই থাকবো। হয়তো তখন আমার সন্তানেরা আশেপাশেই থাকবে, আমার পরিবার এক ছাদের নীচেই থাকবে কিন্তু সেই থাকা আর আজকের দিনের না থাক্র মধ্যে হয়তো কোনো পরিবর্তনই হবে না।

আমি নিঃসঙ্গ একটি মানুষ যার প্রতিটি দিন আর রাতের চরতিত্র এক। তার কষ্ট আর সুখের সংগা এক, তার হাসি আর চোখের জলের ধারা একই। কারন নিঃসঙ্গ মানুষেরা এই রকমেরই।