প্যালেস্টাইনের মুক্তিকামী সংগ্রামের ইতিহাস গত কয়েক সপ্তাহের নয়। কিভাবে প্যালেস্টাইন এই বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়েছে সেটার ইতিহাস বলতে গেলে অনেক অনেক লম্বা ইতিহাস বলতে হবে। সেখানে আর গেলাম না। কারো কারো সেই ইতিহাসের সত্যতা বা তথ্য নিয়ে বিভাজন হয়তো আছে, কিন্তু প্যালেষ্টাইন হটাত করে তাদের এই জন্মভুমি রক্ষার অধিকারের লক্ষ্যে গত ৭৫ বছর যাবত যুদ্ধ করছে না। এটা তো ঠিক।
বিগত আট দশক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থানের মধ্যে গত ৭ অক্টোবরের হামাস কর্তৃক ইসরাইলের ভূখন্ডে অতর্কিত হামলার জের ধরে হামাস নিধনের উছিলায় প্যালেষ্টাইনের আপামর জনসাধারনের উপর নির্বিচারে ইসরায়েল টেক্টস বুক ইথিনিক ক্লিজিং অপারেশনে নেমেছে। জাতীসংঘ, হিউম্যান রাইটস, কিংবা অন্যান্য বিশ্ব নেত্রিত্তের কোনো দোহাইতেই ইস্রায়েলকে উক্ত গনহত্যা থেকে কেউ সরিয়ে আনতে পারেনি এবং পারবে বলেও মনে হয় না।
এখন আমার চারটে প্রশ্ন জাগছে-(১) হামাস জানে তাদের লিমিটেড সামরিক শক্তি দিয়ে এক তরফা ইসরায়েলের উপর হামলা করে একই দিনে প্রায় হাজার খানেক ইহুদীকে হত্যা করে তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল তো সফল হওয়া দুরের কথা, তারা নিজেরাই টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। তাহলে কেনো হামাস এরুপ একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলো? (২) দ্বিতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে-হামাস এই আক্রমনের ফলাফল জেনেও যদি ইসরায়েলের উপর এই আক্রমনটা করেই থাকে, তাহলে হামাসের মুল উদ্দেশ্য কি? তারা কি প্যালেস্টাইনকে নির্মুল করতে চায়? বা তারা কি ইসরায়েলের পক্ষে বি-টীম হিসাবে কাজ করছে? (৩) তৃতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে-হামাসের সাথে ইরানে অবস্থিত হিজবুল্লাহ্র একটা আন্তরীক সম্পর্ক রয়েছে। হিজবুল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক রয়েছে ইরানের, লেবাননের। আর তাদের এই মুসলিম দেশসমুহের মাধ্যমে কোন না কোনোভাবে সংযোগ রয়েছে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলির সাথে। যদি হামাস ইসরায়েলের পক্ষে বি-টীম হিসাবেই কাজ করে থাকে, বা করে তাহলে এই সম্পর্কযুক্ত মুসলিক দেশগুলি কি এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না? (৪) চতুর্থ প্রশ্নটা হচ্ছে- ইসরায়েলের এ রকমের একক টেক্সট বুক ইথনিক ক্লিঞ্জিং এর বিপক্ষে পাশ্চাত্য দেশসমুহ সোচ্চার না হয়ে বরং তাকে অর্থ এবং সামরীক অস্ত্র দিয়ে সাপোর্ট করছে কেনো?
এবার আমি প্রথম প্রশ্নটার ব্যাপারে বলি। হামাসের আক্রমনের দিন ইসরায়েলের একেবারে বর্ডার সংলগ্ন এলাকায় একটা অনুষ্ঠান চলছিলো। ইসরায়েল তাদের কোন ভুখন্ডেই নিরাপত্তা ছাড়া কখনোই অরক্ষিত অবস্থায় রাখে না। কিন্তু সেদিন সেখানে কোন প্রকারের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় ছিলো না কেনো? আর অনুষ্ঠানটা হচ্ছিলো একেবারেই হামাসের নাকের ডকায় যেনো ইসরায়েল চাচ্ছিলোই যেনো হামাস আক্রমনটা করুক, মানুষ হত্যা করুক, বিশ্ববাসি দেখুক হামাস কি করলো। অন্যদিকে, আক্রমনের পরপরই ইসরায়েল একটা কথা চাওড় করেছিলো যে, হামাসকে ঘুষ দেওয়ার পরেও তারা বিট্রে করেছে। এর মানে কি? এর মানে কি এটা হতে পারে যে, কিছু কথিত হামাস দিয়ে এই আক্রমনটা ইসরায়েল নিজেই করিয়েছে? হয়তো পরিকল্পনাটা আরো বিস্তর এবং সেটা ইরান পর্যন্ত? একটা ব্যাপার লক্ষনীয় যে, গত কয়েকমাস যাবত ইসরায়েল ক্রমাগত গাজা উপত্যকায় প্যালেস্টাইন অধিবাসিদের উচ্ছেদ করে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনা করছিলো। তাতে অনেক প্যালেষ্টিনিয়ানরা গাজা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। এই ক্রমাগত অধিগ্রহনের মধ্যে আমজনতার মধ্যে একটা ধারনা আসতেই পারে যে, প্যালেষ্টিনিয়ানদের পিঠ দেয়ালে থেকে যাওয়ায় হামাস এর বদলা নিচ্ছে। অতঃপর ইসরায়েলের সমস্ত আক্রমন এখন বৈধ। হামাস মরুক বা না মরুক, গাজা মুক্ত হচ্ছে এটাই হয়তো ইসরায়েল চেয়েছে যাতে গাজা ইসরায়েলের অংশ হিসাবে একদিকে লেবানন, সিরিয়া এবং ইরানের স্থল অংশের কাছাকাছি নিরাপত্তা বাহিনি মোতায়েনের একটা বৈধ সুযোগ পায়।
এবার আসি, হামাস কি ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করেছে কিনা। হামাসের মধ্যেও দ্বিধাবিভক্তি আছে। যারা সত্যিকারের মুক্তিকামী হামাস, তারা কখনই ইসরায়েলের পক্ষে তাদের বি-টীম হিসাবে কাজ করার কথা নয়। যদি হামাসের কোনো অংশ বি-টীম হিসাবে কাজ করে, তাহলে এটা প্রকাশিত হলো না কেনো? হয়তো ইসরায়েলই চায়নি এটা প্রকাশিত হোক। আর প্রকাশ করবে কে? কোন মিডিয়া? আপনি যদি শুধুমাত্র বিবিসি, সিএনএন, এবিসি নিউজ, ইএসপিএন, ফক্স নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমস, নিউইয়র্ক পোষ্ট, ওয়াশিংস্টন পোষ্ট, ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল, এমন কি ফেসবুক থেকে সংবাদ আহরন করেন, এরা কেহই আপনাকে সত্য সংবাদটি প্রকাশ করবে না। কারন এই সবকটি মেইন স্ট্রীম মিডিয়া ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত এবং মালিকানাধিন। এসব মেইন স্ট্রীম মিডিয়ার সব খবর আগে তাদের দ্বারা ভেটিং হয়, অতঃপর ব্রডকাষ্ট। তাহলে আমি বা আপনি কিভাবে নিরপেক্ষ নিউজের আশা করতে পারি? হামাসের কিছু অংশ ইসরায়েলের বি-টিম হলেও এতা জানার কনো উপায় নাই।
তৃতীয় প্রশ্নটায় অনেক ফ্যাক্টর জড়িত। মুসলিম দেশগুলি কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, আর পারবেও না। কারন তারা টোটালেরিয়ানিজমের শাসক। ওরাও কোন না কোনো পাশ্চাত্য শক্তি এবং সাপোর্টের উপর দাড়িয়ে। ফলে যার যা খুশি হোক না কেন, তারা বহাল তবিয়তে আছে কিনা সেটাই ওদের বিবেচ্য বিষয়। ওরা অনেক কিছু জানলেও মুখ খুলবে না, কোন একশনে যাবে না। এটাই ওআইসি দেশসমুহের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
চতুর্থ প্রশ্নটার ব্যাপারে যা জানা দরকার সেটা হল, ইসরায়েলের পক্ষে আমেরিকা, কানাডা, ইউকে কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোনো দেশই ইসরায়েলের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ নাই। কারন যদি এরা ইসরায়েলের যে কোনো কর্মকান্ডকে (হোক সেটা গনহত্যা, বা জোর করে বসতিস্থাপন ইত্যাদি) সাফাই না গায় বা তাদের পক্ষে না থাকে, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলি-যদিও ইসরায়েলের লোক সংখ্যা মাত্র দেড় কোটি (সারা পৃথিবীর মাত্র ০.২%, ইস্রায়েলে বসবাস ৫০ লাখ, আমেরিকাতে ৭০ লাখ, কানাডায় প্রায় ৪ লাখ আর ইউকে তে প্রায় ৩ লাখ) কিন্তু তারা সারা বিশ্ব কন্ট্রোল করে। আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট জয়ী হতে পারবে না যদি ইহুদী কর্তৃক সাপোর্ট না পায়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচনী ফাণ্ড বা তহবিল সংগ্রহ হয়–AIPAC (America Israel Public Affairs Committee) থেকে। আমেরিকান রাজনীতিতে তাদের প্রভাব একচেটিয়া। আমেরিকার ১০০ জন সিনেটরের ১৩ জন ইসরায়েলী ইহুদী। আমেরিকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসররা ইহুদী এবং তারা থিংক ট্যাংক হিসাবে আমেরিকার পলিসি মেকার। আমেরিকার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলো ইহুদীদের দখলে। ফলে আমেরিকার কেউ চাইলেও এদের কিছু করতে পারবে না। বরং জুইশ কমিউনিটি বা ইহুদি সম্প্রদাকে হাতে না-রাখলে ক্ষমতায় টেকা যাবে না। এসব কারনেই যখন জাতিসংঘের মহাসচিব প্যালেস্টাইনের পক্ষে সবেমাত্র মুখ খুলেছেন, অমনি ইসরায়েল তার পদত্যাগ চেয়ে ইউএন এর সকল কর্মকর্তার ভিসা স্থগিত করে দিয়েছে। মহাসচীব তারপরের দিনই তার গলার সুর পালটে ফেলেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধকে ইউরোপের নিরাপত্তার সিম্বল হিসাবে দেখা হয় এবং পুটিনকে দেখা হয় ইউরোপের জন্য একটি ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব। এরপরেও পাশ্চাত্য দেশসহ গোটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এখন ইউক্রেনকে প্রায় ছেড়েই দিয়েছে শুধুমাত্র ইসরায়েলকে সাপোর্ট করার জন্য।
যারা এ যাবতকাল পুটিন ইউক্রেনকে খেয়ে ফেললো, মেরে ফেললো, পুতিন আগ্রাসি হিসাবে ইউক্রেনের ধংশযজ্ঞ চালালো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললো, তারা কিন্তু এখন ইসরায়েলের এমন গনহত্যায় কোন রা পর্যন্ত করছেন না। রাশিয়া গত দেড় বছরে যে পরিমান বাড়ীঘর, লোকবল ক্ষতি করেছে তার থেকে কয়েকগুন বেশি ক্ষতি করেছে ইসরায়েল মাত্র দুই সপ্তাহে। খাবার, মেডিকেশন, শিশু হত্যা, নিরিহ জনগন নির্বিঘ্নে হত্যার প্রতিবাদে হিউম্যান রাইটস এর ডাইরেক্টর পর্যন্ত নিজে ইস্তফা দিলেন, তারপরেও কিন্তু কেউ মুখ খুললেন না।