০২/০৬/২০১৬ – মাধুরীর চিঠি

Categories

তোমাকে কি নামে যে সম্বোধন করি তাই বুঝে উঠতে পারছি না এখন। কি লিখব তোমায়? প্রিয় বন্ধু নাকি শুধু প্রিয়? অথবা শুধু তোমার নাম অথবা কিছুই না !! তোমাকে আমি যেই নামেই ডাকি না কেন, তুমি আমার একান্ত প্রিয়জন। কে জানি বলেছিল, বন্ধুর নাম ভুলে গেলেও সমস্যা নেই, কিন্তু শত্রুর নাম ভুলে যাওয়া যাবে না। তোমার বেলায় আমার এই নীতিটা হয়ত সঠিক নয়। আমি তোমার নাম ভুলে গেলে আমার আর কোন কিছুই হয়ত অবশিষ্ট থাকবে না। যাক, তোমাকে আমি কোন সম্বোধন ছাড়াই চিঠিটি লিখছি।

অনেকদিন ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমি আর কখনো যোগাযোগ করব না। আর যোগাযোগ করে কিইবা হবে বল? তোমার হয়ত এখন সংসার হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে, অনেক উচু স্তরের মানুষদের মধ্যে এখন তুমি একজন। জানি তুমি ভালই আছ।

তোমার এই শরতবেলার বেলাভুমির প্রাতভ্রমনে আমি হটাত করে সেই পুরানো দিনের কোন এক বর্ষার কাকভেজা বৃষ্টির সন্ধ্যাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চের কথা নিয়ে যদি আমি হাজির হই, কিইবা লাভ হবে, তুমিই বল? মাঝখানে হয়ত যেটুকু তুমি আমাকে করুনা করে হলেও মনে রেখেছ, তাও হয়ত আমার ভাগ্যে আর থাকবে না, অকারনে সেটাও হয়ত হারাতে পারি। অনেক কিছু হারিয়ে যদিও এখন হারাবার ভয় আমি করি না কিন্তু স্মৃতির পাতা ধরে স্থান কাল সময় গুনে গুনে যে কয়টা জিনিস আমি এখনো হারাতে চাইনি তার মধ্যে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় একটা। ভেবনা আমি আজ তোমাকে এই পত্র দিয়ে আবার নতুন করে কোন এক সম্ভাবনাময়কে জাগিয়ে তুলছি। অন্তত আমি তাঁর কোন সম্ভাবনা দেখছি না।

আমি জানি পাহারের নিচে দাড়িয়ে যত জোরেই কেউ তাঁর কথা বলুক না কেন, সেই একই সুর, একই শব্দ, সেই একই বানী পাহারের চারিদিকে বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আবারও নিজের কাছেই তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। অবুঝেরা এটাকে বিধাতার উত্তর হিসাবে ধরে নেয়, আর যারা অবুঝ নয়, তারা জানে প্রকৃতির অবজ্ঞা করে এইসব কিছু ফিরিয়ে দেওয়া কত বড় নির্মম সত্য। এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, অন্তত আজ এতটা বছর পর নতুন করে হিসাব করার প্রয়োজন বলে মনে করছি না। আর যখন ঐ নিষ্ফল প্রতিদ্ধনির আওয়াজ ফিরে আসে, তখন যেন তা আরও শতগুনে কঠিন এবং করুন করে কানে বাজে।

কেউ কারো কোন কথা রাখে না, মনে হয় কেউ কারো জন্য কখন অপেক্ষাও করে না। এর মানে আমি তোমাকে এই বলে যুক্তিও দেখাচ্ছি না যে, আমি কি বলতে চেয়েছিলাম, আর আমি তাঁর প্রতিধ্বনিতে কি পেয়েছি। সময় এমন এক জিনিস, সে সবার সঙ্গে আছে, সবার সঙ্গে থাকে অথচ সে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। কেউ তাঁর সঙ্গে থাকুক আর নাই বা থাকুক, সে তাঁর নিজ গতিতে নিজ আবেশে তাঁর ঠিক গন্তব্যে সবাইকে ছেড়ে একা একাই চলতে থাকে। কোথাও তাঁর বিন্দুমাত্র অলসতা হয় না, কোথাও তাঁর কোন গড়মিল হয় না। পৃথিবীর সব চাইতে সস্তা যেমন সময়, তেমনি সবচেয়ে দামিও বটে। ইচ্ছে করলেই একে হেলাফেলা করে যেখানে সেখানে খরচ করা যায় আবার ইচ্ছে করলেই আবার এক আনা দুই আনা দিয়ে কেনাও যায় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা সময়, আর সেই সময়ের চাওয়া-পাওয়ার সাথে হিসাব নিকাশের দেনা পাওনাটাও এই খরচের বিচার্য বুদ্ধিচনায় পরে। চৈত্রের গরমের জন্য কেউ হেমন্তের দুপুরকে দায়ি করে না, কিংবা বর্ষার একটানা বৃষ্টির জন্য কেউ শীতের কনকনে সকালকেও দায়ি করে না। আমিও এখন না সময়, না পরিস্থিতি কিংবা না আইন বা ধর্মকে দায়ী করি।

এই চিঠি পরে তোমার হয়ত মনে প্রশ্ন আসতে পারে আমি কেন তাহলে আমার সেই পূর্বেকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তোমাকে আবার আজকে লিখতে বসলাম। আমার আসলে আর কোথাও কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই, যেটুকু আছে তা শুধু তুমি। এত বিশাল পৃথিবীর মাঝে কত মানুষ যে কতভাবে অসহায়, আমি নিজেকে দেখে তা বুঝতে পেরেছি।

প্রথম যেদিন আমি তোমাকে দেখেছিলাম, মনে পরে তোমার সেই দিনের কথা?  আমি জানি না আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে সমুদ্রের গভীরতার চেয়ে তোমার চোখের ভাষা আরও বেশি দুর্গম মনে হয়েছিলো, অথচ আমার কেবলই মনে হয়েছে ঐ আখির ভাষা আমার পরিচিত, তোমার মুখের ভাষা আমার পরিচিত। যদিও তোমার কোমল কঠিন দেহখানি আমার কাছে পাহাড়ের শিলাভুমির প্রস্তরখন্ড থেকেও কঠিন মনে হয়েছিল কিন্তু তাঁরপরেও আমার কেবলই মনে হয়েছে কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছি।

আমি আর পাঁচটি মেয়ের মত নই, সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। নীল আকাশের ছায়াপরা কোন এক চকচকে পুকুরের মাঝখানে নীলপদ্ম দেখলেই আমি সবার মত উল্লসিত হয়ে চারিদিক চমকিয়ে দেই না হয়ত কিন্তু আমার ভিতরে যে কোন সাড়াশব্দ হয় না তা নয়। আমার অনেক রাত কেটেছে কোন কিছু ভাবা ছাড়াই, আমার অনেক দিন হয়ত নাওয়াও হয় নাই শুধুমাত্র এই ভেবে, কে তুমি? যেদিন বুঝেছি তুমি কে, সেদিন উপলব্ধি করেছি, আমি স্রোতের বিপরিতে নৌকার গুন টানছি, বুঝতে পেরেছি আমি উল্টো পথে রথে উঠেছি। তারপরেও আমি রয়ে গেছি, আর রয়ে গেছি তোমাকে পাবার জন্য নয়, তুমি আমার কাছাকাছি আছ, এই ভরসায়। এটাই বা কম কিসের? এতসব অপরিচিত মানুষদের মাঝে অন্তত আমি তো একজনকে হলেও চিনি, তোমাকে চিনি, তুমি আছ। তুমি কি কখনো জানতে পেরেছ যে, পৃথিবীর সমস্ত মানবকুলের মধ্যে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম, এর মানে এই নয় যে তুমি ভয়ংকর। আমার ভয়ের কারন একটাই। তোমার নির্লিপ্ততা। তোমার কোন কষ্টের কারন যেন আমি কখনো না হই সেই ভয়ে আমি সর্বদা ভীত থেকেছি। অথচ আজ আমার ভিতরে কোন প্রকার ভয় নেই, কারন তুমি আমার পাশে কোথাও নেই। আর কোথায় আছ তাও আমি সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারি না। জীবনের এই সায়াহ্নে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে। মনে হয়েছে যদি একদিন বা কোথাও একবার আবার তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারতাম, আমি হারিয়ে যাইনি, অথবা আমি হারিয়ে যেতে চাইনি, আমার কুড়েঘরের সদর দরজার মেঠোপথ তোমার জন্য সবসময় খোলা ছিল এবং এখনো আছে। যদি কখনো দৈবাৎক্রমে আমার এই আশ্রুজলে শিক্ত লেখাটা তোমার হাতে পরে আর যদি তখনো আমার এই দেহে টিমটিম করে হলেও একটু প্রানশক্তি থাকে, তবে জেনে রেখ, আমি তোমাকে হয়ত বলতে চেয়েছি, তুমি এসো আর একবার যদি কখনো তোমার ভিতরটায় শুন্যতায় ভরে গিয়ে হাপিয়ে উঠো। এসে একবার আমার চোখের জলের সাথে তোমার সেই বেদনাবিধুর চোখের অসমাপ্ত কান্নাগুলো দিয়ে বলো, তুমি ভাল আছো। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সেই ক্লান্ত আঁখির শিশিরের টিপটিপ করা ব্যাথাকনাগুলো বয়ে নিয়ে আখি বন্ধ করে দেব। তুমি এক ফোটা জলও দেখতে পাবে না।

আজ এই অবেলায় তোমাকে কত কথা লিখতে ইচ্ছে করছে যেন।

মনে পরে তোমার সেই কাকডাকা ভোরে একবার আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই শাওতালদের গ্রামে? ট্রেন আটকা পড়েছে কোন এক বনের ধারে। ট্রেন আবার কখন চলা শুরু করবে কেউ বলতে পারছে না। একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের খবর পাচ্ছি ট্রেন নষ্ট হবার কারন জানতে গিয়ে। আসলে কেউ বলতে পারছিল না কি কারনে ট্রেন এই মাঝপথে হটাত করে এতগুলো যাত্রি নিয়ে অজানা সময়ের জন্য বিশ্রামে গেল। অনেক যাত্রি ট্রেন থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। আমরাও এক সময় সবার দেখাদেখি ট্রেন থেকে নেমে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। গল্প আর গল্পে কখন যে কোন রাস্তায় হাঁটছিলাম, আমরাও তাঁর রেখাপথ মনে রাখিনি।

শেষমেশ এক শাওতালদের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়ে গেলাম। কি অদ্ভুদ এক সমাজ। সবাই সবার আপনজন। সবাই যেন সবার জন্য। সবাই যেন এক পরিবার। গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে কোথাও এক কাপ চা খাওয়ার জন্য একটা দোকান পর্যন্ত পেলাম না। আসলে সাওতালদের কোন পৃথক দোকান নেই ঐ গ্রামে। গ্রামের সরু পথ দিয়ে আমরা দুজনে হাঁটছি, সব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘর দুয়ার, এলোপাথারিভাবে সাজানো বাড়িঘর। গরু ছাগলগুলোও যেন স্বাধীন। কোনটাই খোয়ারে বাঁধা নেই। কুকুর, গরু ছাগল, হাস মুরগি মানুষ সব স্বাধীন। গাছগাছালি ভর্তি পুরু গ্রামটা। কোথাও কাদা পেরিয়ে এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি যেতে হয়। পানির মটকাগুলো একদম উদোম। কয়েকটা পাখী বসে আছে মটকাগুলোর উপর। পাখীগুলোও জানে এখানে কোন সমস্যা নাই। ওরা বরং আমাদের দেখে একটু শঙ্কিত হয়ে এদিক সেদিক উড়াল দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে মোরগগুলো উচ্চ স্বরে অন্যদেরকে জানান দিচ্ছিল এখানে আগন্তক এসেছে, যেনো মোটিভ বুঝা যাচ্ছে না বোধহয়। কয়েকটা বাচ্চাওয়ালা মুরগি তরিঘরি করে বাশঝাড়ে লুকিয়ে গেল। আমরা এদের কারো কাছে পরিচিত নই। প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু তাঁদের স্বকীয়তায় ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। বড় ভাল লাগছিল ব্যাপারটা উপভোগ করতে। কতক্ষন কেটে গিয়েছিল আমরা বুঝতেই পারিনি, হটাত অল্প দূর অপেক্ষামান ট্রেনের সচল হবার সংকেত দিয়ে আমাদের চারিদিকে ছরিয়ে থাকা যাত্রিদেরকে মনে করিয়ে দিল আমরা ট্রেনে ছিলাম এবং এখন আবার সেখানে যেতে হবে। তা না হলে ঐ যে বললাম, সময়ের সাথে সাথে এবার ট্রেন হাত জুটি বেধে পুনরায় তাঁর সেই গন্তব্যের দিকে ছুটে যাবে। যারা তাঁর সাথে নেই, তারা থেকে যাবে যেখানে সে আছে সেখানেই।

ফিরতে গিয়ে আমরা বুঝলাম, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। কোন রাস্তায় এই শাওতাল গ্রামে ঢোকেছিলাম, এখন আর সেই আগের রাস্তাটা পরিচিত মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে ভুল পথে ট্রেনের দিকে যাচ্ছি, আদৌ ট্রেনের দিকে যাচ্চি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। ট্রেনের হুইসেলটা মনে হচ্ছে আরও দূর থেকে কানে আসছে। দ্রুত হাটতে হবে, তা নাহলে নির্ঘাত ট্রেন মিস করব। আর ট্রেন মিস করলে এর পরের অধ্যায়টা আমার অন্তত জানা নাই। তুমি দ্রুত হাঁটছ, আমি তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত দ্রুতও হাটতে পারছি না। রাস্তাটা আমার কাছে অমসৃণ গিরিপথের মত মনে হতে লাগলো। আমার সাড়া শরীর ঘামে যেন ভিজে আসছিল। চুলের ভিতর থেকে কেমন একটা গরম আভা বের হচ্ছিল। আমার কপাল দিয়ে শিশিরের ফোটার মত করে একটু একটু ঘাম বেরিয়ে চোখের জলের ফোটার মত আমার কানের পাশ দিয়ে বুকের ওড়নায় পড়ছিল। আমি যেন আর হাটতে পারছিলাম না। তুমি আমার হাত ধরলে।

এই প্রথম তুমি আমার হাত ধরলে। আমি তোমার হাতের অনুভুতিটা তখন কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু মনে হয়েছে, আমি যেন একটা অবলম্বন পেয়েছিলাম শক্ত করে ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। অনেক ক্লান্ত অবশ দেহ আর ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে কোন রকমে যখন আমরা ট্রেনের ধারে ফিরে এলাম, তখন ট্রেন প্রায় ছাড়ি ছাড়ি ভাব। ট্রেনের সিটে বসে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার ক্লান্ত শরিরের সমস্ত পরিশ্রম যখন বিশ্রামে নিমগ্ন, তখন বুঝলাম, একটু আগে তোমার হাতের যে পরশটা আমার শরিরের বাহুতে লেগেছিল, তা এখন আমার অনুভুতিতে আরেক স্বর্গীয় ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, শাওতাল গ্রামের ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে গেলেই তো ভাল ছিল। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল, ট্রেন চলছে, আমার মন চলছে না। বাইরে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। বহুদুরের ঐ গ্রামগুলো কতই না গতিতে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে নিমিষে। এখন আর সবুজ গ্রাম ভাল লাগছে না, নীল আকাশের খন্ড খন্ড মেঘগুলোও আর আমার কাছে কাব্যিক মনে হচ্ছে না। অথচ একটু আগে এর সবকিছুই ছিল আমার কাছে আমার অনন্তময়ি প্রেমের এক আবেদনের মত। ঐ যে বহু দূর অবধি দেখা যায় আকাশ যেখানে আকাশ আর মাটি দুজনে এক হয়ে গেছে, অথবা এই যে ট্রেনের দুই সমান্তরাল সারি যারা একে অপরের পাশে অনন্তকাল ধরে পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে অথচ কখনই তারা একে অপরের নয়, এমন একটা সম্পর্ক যার ঠিকানা কারো জানা নাই। হয়ত তুমি আর আমি ঠিক তাই। আমরা একই ট্রেনের যাত্রি অথচ গন্তব্য এক নয়, আমরা একই আকাশের নিচে চলছি কিন্তু আমার দিগন্ত আর তোমার ভেজা মেঘ এক নয়। মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল সারাটা রাস্তা।

আজ কত কথা মনে পড়ছে আমার। তোমার কি মনে পরে আরও একদিনের কথা?

সেদিন ছিল বর্ষার প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকের আকাশ মেঘে ভরা, গুরগুর মেঘের আওয়াজ। থেকে থেকে হাল্কা বৃষ্টি আবার ক্ষনেক্ষনে রোদ। হুমড়ি ধুমড়ি খেয়ে যেন তুমি উচ্ছল হরিন শাবকের মত মেঘলা সেই দুপুরে অস্থির চিত্তে ঘনঘন দরজার কড়া আর কলিং বেল টিপে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলে যেনো, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করে দরজা খুললে না জানি কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, অথবা কোন এক রাজ্যের রামায়ন তাঁর অপ্রতিরোধ্য মেঘবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তোমার সাড়া শরীর ভেজা, চুলগুলো মনে হল কতকাল চিরুনি পরেনি, তারপরেও তোমাকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছিল। যতবার আমি তোমাকে দেখেছি, আমি ততবারই যেন কোন এক নতুন মানুষকে দেখেছি। সকালের তুমি বিকালের মত নও, বিকালের তুমি আর পরেরদিনের তুমি সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ। কখনো তুমি হিমালয়ের মত স্থবির, আবার কখনো তুমি উস্রিংখল ডাহুকের মত জ্বালাময়ী, কখনো তোমাকে দেখেছি আমি এতটাই নির্লিপ্ত যেনো পানকুড়ির মাছধরার ধ্যানের মত স্থির। কখনো দেখেছি আমি অতিশয় ক্ষুদ্র বিষয়ে তুমি অতটাই উত্তেজিত অথচ অতিকায় হস্তিসমেত বিষয়ে তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভগবান মানুষকে দিয়ে কি পরীক্ষা করান তা আমার জানা নাই তবে তোমার বেলায় ভগবান সর্বদা কৃপাশীল ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি। ভালবাসার হৃদয় ভগবান তোমাকে দিয়েছেন কিনা আমার জানা নাই, তবে তোমাকে ভালবাসবে এই এমন কিছু একটা ভগবান তোমার মধ্যে সে চিরস্থায়ী প্রথা হিসাবে নিশ্চয় দান করেছেন। তোমার ভেজা চুলেও যেমন মাদকতা আছে, চিরুনির আচরনে শুকনা চুলেও মাদকতা আছে। চঞ্চলতা যেমন মনকে উতালা করে দিতে পারে, তেমনি তোমার অবসন্ন দেহও মনকে  ভেঙ্গে খান খান করে দিতে পারে। তোমাকে এই প্রথম আমি যেন আরেক তোমাকে আবিস্কার করলাম। তুমি অতিশয় অস্থির, তোমার কথাবার্তায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। অধিক কথা বলার যেন সময় নেই। কোথায় কি কারনে যেন তুমি আর তোমার মধ্যে নেই। অবশ্য ব্যাপারটা একটুপরেই বুঝতে আমার আর বাকি ছিলনা।তোমার মা অসুস্থ।

আমি তোমার একটা জিনিষ সেই প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। পৃথিবীর যাবতীয় উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আর আবেগ যদি হয় একদিকে, তোমার মার জন্য তোমার এই উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আবেগ অথবা যাই কিছু থাকুক না কেন, তিনি আরেকদিকে। তোমার মায়ের জন্য তুমি সত্যকে মিথ্যা, বা মিথ্যাকে সত্য অথবা ন্যায়কে অন্যায়, বা অন্যায়কে ন্যায়ের দিকে নিয়েও যদি মনে হয় তোমার মা তাতে খুশি, হয়তবা তুমি তাই করার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে সর্বদা, সর্বত্র সব কিছুর বিনিময়েও করতে তোমার কোন প্রকার দ্বিধা হবে না। এ এক ব্যাতিক্রমি চরিত্র আমি তোমার মধ্যে প্রকটভাবে দেখেছি। কোন কিছুর সঙ্গেই তাঁর কোন তুলনা তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর আমার এখানেই সবচেয়ে বেশি ভয় হত যদি কখনো কোন কারনে আমি তোমার এই সবচেয়ে দুর্বলস্থানে একটু হলেও ছোঁয়ার কারনে আমার সমস্ত আরাধনা, আমার ভাললাগার ব্যাক্তিত্ত তোমার কাছে আমি এক নিমিসেই অপরিচিত হয়ে যাই। তোমার সেই মা অসুস্থ। তুমি ঠিক নাই বুঝতেই আমার মনের গভিরে এক চরম উৎকণ্ঠা বোধ হতে লাগলো। দুর্ঘটনা আভাস দিয়ে আসে বটে, কিন্তু সুভাগ্য কোন আগাম সংকেত দিয়ে আসে না। তোমার এই দুর্ভাগ্যে যেন আমার সু-ভাগ্য খুলে গেল। তোমার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে থাকার মত নির্ভরশীল কোন মানুষ তুমি তোমার জগতের চারিপাশে খুজে পেলে না, প্রথম যার কথা মনে হয়েছিল তোমার, সে আমি। আমি ভাগ্যবতী। তুমি আমাকে কোন সময় না দিয়ে, কোন রকমে কোন প্রকার প্রস্তুতি হওয়ার সময় না দিয়ে এক প্রকার বিদ্যুৎ গতিতেই বের করে নিয়ে হাজির করলে সেই অসামান্য মানুষটির কাছে যার সমতুল্য এই পৃথিবীতে তুমি আর কাউকেই জানোনি।

তুমি চলে গেলে আমাকে রেখে। নিস্তব এক ক্যাবিন।

ডাক্তাররা আসছে ঘন ঘন, নার্স, আয়া, সবাই ব্যাস্ত এই ঘুমন্ত শিশুর মত মানুষটির যত্নে। আমি কে, কি তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তারা অনেকেই জিগ্যেস করলেও আমার বলতে কোন অসুবিধা হয় নাই, কারন তিনি আমার মায়ের মতই একজন মানুষ। আমি তাকে আমার মায়ের সঙ্গেই মিল রেখে পরিচয়টা দিয়েছিলাম যে, আমি তাঁর মেয়ের মতই। আমি এছাড়া আর কি বলতে পারতাম বলো? কি অদ্ভুত এক ব্যাপার। তোমার সাথে তোমার মায়ের কোথাও কোন গড়মিল নেই। সেই ঠোঁট, সেই নাক, সে মুখাবয়ব, চোখের ভ্রুটা পর্যন্ত একদম মিল। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন তোমাকেই দেখছি। এত কাছ থেকে এত নিরিবিলিতে আমি কখনো তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিনি। আজ যেন মনে হচ্ছিল আমার সেই না দেখা তোমাকে এত কাছে থেকে দেখছি। কখনো আমি তাঁর হাত দুটো ধরছি, কখনো তাঁর ভ্রুটা, আবার কখনো তাঁর কানের কাছে গিয়ে তাঁর মসৃণ চুলের গন্ধ শুকছিলাম। কখন কিভাবে কি মনে করে জানি না, দেখেছিলাম আমার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল আমার নিজের অজান্তেই এই ঘুমন্ত মানুষটির বুকের উপর পরেছিল। আমি কি কেদেছিলাম? কোন কিছু ভেবে কি আমার মনে কোন কস্টের উদ্রেক হয়েছিল? না, আমার তা মনে নেই। শুধু মনে হয়েছিল, একবার বুক ভরে যদি আমি এই মানুষটির বুকে পড়ে অনেক্ষন কাদতে পারতাম, হয়ত আমি আরও শান্ত হয়ে কিছুটা দিন কাটাতে পারতাম। আমার মায়ের অনেক স্মৃতি আমার মনে নেই। একজন মা একজন সন্তানের জন্য কি কি করে আমার তা জানা নাই। তবে আমি জানি একজন সন্তান তাঁর মায়ের অভাবে কি কি মিস করে। তোমার কথা মনে হলো। আমি আমার ঈশ্বরের কাছে প্রানভরে আরাধনা করলাম, হে ভগবান, তুমি যাকে ভাগ্যবান করে রেখেছ, তাকে আবার হতভাগা কেন করবে? কি নেই তোমার যে, সামান্য একজন মানুষের অনুপস্থিতি দিয়ে তোমার আরেক প্রিয় একজন আদমকে চোখের জলে ভাসাতে চাও? তোমার হিসাব-কিতাব, তোমার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে আমার কোন কৈফিয়ত চাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই কিন্তু আমার আরাধনা যদি কখনো মনজুর করো, তাহলে আজ এইদিনে তুমি এই ঘুমন্ত মানুষটিকে তোমার মত করে আরোগ্য করে দাও। আজ এই প্রথম আমার মনে হল, ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বরের কাছে বলার অনেক কিছু আছে। আজ কেন যেন মনে হল, আমি ঈশ্বরকে ভালবাসি কারন ঈশ্বর আমাকে তাকে ভালবাসবার এবং তাঁর সাথে রাগ করার ইচ্ছাশক্তি আমাকে দিয়েছেন। তোমার ঐ কথাটিই আজ আমার কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যেটা তুমি প্রায়ই বলতে, “আই লাভ গড বিকজ হি হ্যাজ গিভেন মি দি পাওয়ার টু হেট হিম”। কি অদ্ভুত তোমার বলার সাহস আর দাপটতা। তুমি তোমার ধর্মের উপর কিভাবে বিশ্বাস রেখেছ তা আমার বিশদ জ্ঞ্যান হয়ত নাই কিন্তু আজ আমি হাসপাতালের এই নিরব ক্যাবিনে একজন ঘুমন্ত মানুষের সামনে বসে বুঝতে পারছিলাম, ভগবান যেই ধর্মেরই হোক, তিনি সবার জন্য সমান। এই বিশ্বভ্রমান্ডে যা কিছু আছে সব তাঁর। এর রূপ, গন্ধ, এর প্রকৃতির সৌন্দর্য, এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট সবকিছু তিনি তাঁর নিজের মত করে সাজিয়েছন। এর থেকে আরও সুন্দর কিছু হতে হয়ত পারে না। গোলাপের রং শুধু গোলাপিই নয়, এর স্থান কাল তাপমাত্রা ভেদে সে তাকে আরও অনেক রূপে আকার দান করেছে। আকাশ শুধু নীলই হয় নাই, এ কখনো কালো, কখন সাদা, আবার কখনো কতই না রঙে তুমি সাজিয়েছো। কি দরকার ছিল ঐ আফ্রিকার জঙ্গলে অত সুন্দর একটা লাল গোলাপ ফুটিয়ে রাখবার? কার জন্য কেউ জানে না অথচ তা আছে, বাস্তবেই আছে। কি প্রয়োজন ছিল এরিজোনা নদীর তিরে কোন এক ইউকেলিপ্টাস গাছে চুরায় সুন্দর সবুজ টিয়ার বাসা করে দেয়ার? কি প্রয়োজন ছিল ঐ গহিন সমুদ্রে পানির শতশত ফুট নিচে লাল নীল, বিভিন্ন রঙের সারি সারি দুবলা গাছ সৃষ্টি করবার? সবই রহস্য। তাঁর এই রহস্য সন্ধানে আমার শক্তি নাই। আরেক জলজ্যান্ত রহস্য তো এখন আমার সামনে। তিনি তোমার মা। সারাটি বিকাল আমার কেটে গেল কোন এক ঘোরের ভিতর। তুমি এলে সন্ধ্যার পর। ধুপ জ্বালাবার কোন কায়দা নেই এখানে, প্রভুর কাছে রিতি মোতাবেক প্রার্থনা করবার কোন প্রসাদ নাই এখানে। এখানে যার যার ভগবান তাঁর তাঁর অন্তরের একান্ত ভিতরে। এখানে জীবনের আরাধনা চলে, হোক সেটা মৃত্যুর অথবা জন্মের। কেউ হাসিমুখে বাড়ি ফেরে আবার কেউ অশ্রুসিক্ত নয়নে। কি অবাক না!! চোখের জলের ভাষা দুটুইঃ আনন্দের অথবা কষ্টের।

-হন্তদন্ত হয়ে ক্যাবিনে ঢোকেই তুমি প্রথম যে কতাটি জানতে চেয়েছো সেদিন- মাধুরী, মা কি কোন সাড়া শব্দ করেছিল এরই মধ্যে? তোমার তো আজকের দিনটা এখানে মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে, আমি তোমার হোস্টেল সুপারকে খবরটা দিয়ে এসেছি যে তুমি আজ আসছ না। আমি তোমার বন্ধুদেরকেও খবরটা দিতে বলেছি। তুমি দুশ্চিন্তা কর না। আমি হয়ত কাল থেকে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারব। আমার পরিবর্তে আমার এক খালা আসবে কাল গ্রাম থেকে। তখন তুমি আবার তোমার হোস্টেলে চলে যেতে পারবে।

কথাগুলো তুমি এমন করে বললে যেন, আমি আজকের দিনের জন্যই শুধু প্রয়োজন, কাল থেকে আমার কোন দরকার হবে না। তোমার মন খারাপ হবে ভেবে আমি তোমাকে কিছুই না বলে শুধু বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা। যতদিন মা এখানে থাকবে, আমি থাকতে পারব। শুধু আমার কিছু পরিধেয় কাপড়চোপড় বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি আসলে এই অসামান্য মানুষটির পাশে থাকতে চেয়েছিলাম।

অনেক রাত অবধি তুমি ছিলে ওখানে। যাওয়ার সময় মনে হল, তুমি যেন শরীরটা নিয়ে বাসায় যাচ্ছ আর মনটা দিয়ে গেলে আমার হাতে। তোমাকে আমার বড্ড মায়া করতে ইচ্ছে করেছিল। আজকের তুমি কত ভিন্ন। আমি তোমার এই রূপটা কখনো দেখি নাই। কখনো দেখেছি তোমার গলা ধরে এসেছে মায়ের কথা বলতে বলতে, কখনো দেখেছি তোমার চোখের পাপড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে চোখের অসংবরিত নোনা জলে, আবার কখনো দেখেছি তুমি কতটা উদার আমার প্রতি যাতে সব কিছুর বিনিময়ে হলেও যেন আমি তোমার মায়ের সমস্ত দেখভালটা করি। কখনো মনে হয়েছে তুমি কতটা স্বার্থপর। শুধু তুমি তোমাকে নিয়েই ভাবো। একবারও ভাবো নাই যে আমিও তো এখানে তোমার মায়ের কষ্টে ব্যথাতুর হয়ে আছি।

তুমি চলে গেলে। আমি একা বসে আছি মায়ের পাশে। দেয়ালে থাকা ফ্লরসেন্ট বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছি। টেবিল ল্যাম্পটা জলছে আধোআধো ভাবে। হটাত দেখলাম, মা নড়তে শুরু করেছেন। মনে হল তিনি জেগে উঠছেন। যতই তিনি নড়াচড়া করছেন, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ততই কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখনো মনের আনন্দে, আবার কখনো অজানা এক ভয়ে। আনন্দ এই কারনে, তাঁর নড়াচড়া আরোগ্য লাভের জন্য ভাল লক্ষন, কিন্তু ভয় এই কারনে তিনি কখনো আমাকে দেখেন নাই। আমি মায়ের ডান হাতটি আলতো করে চেপে ধরলাম। মনে হল একটা অবলম্বন ধরেছি। উত্তাল সমুদ্রে যখন প্রকান্ড জাহাজটি ভেঙ্গেচূরে খান খান হয়ে আশ্রয়ের সমস্ত ভরসা উবে যায়, কেউ যখন আর কোন আশ্রয়ের অবলম্বন না পেয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠে, তখন কোন অজানা দূর থেকে ভেসে আসা হয়ত ঐ জাহাজেরই ছোট্ট একটা কাষ্ঠখন্ডও আতঙ্কের নিরাময় হয়ে স্বস্থির আভাষ হয়ে উঠে। মায়ের হাত ধরাটাও যেনো আমার কাছে তাই মনে হলো। 

মা বেশ কিছুক্ষন পর যেনো তাঁর অসম্ভব ক্লান্তি ছাড়িয়ে চোখ মেললেন। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অপলক দৃষ্টিতে তিনি আমাকে দেখছেন। আমিও। কি সুন্দর তাঁর চোখ। কি অদ্ভুত তাঁর চাহনি। আমার ভিতরে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দিকবিদিক শুন্য এক তান্ডব বয়ে যাচ্ছিল। আমি শুধু তাকিয়েই ছিলাম মায়ের দিকে। মা শুধু অপলক পলখহীনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে ধরা তাঁর হাতটি আরও শক্ত করে ধরে থাকলেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আমি আর তাকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কখন যে আমি তাঁর বুকে মাথাটা রেখে জরিয়ে ধরেছিলাম আমার কোন কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে পরে, কর্তব্যরত নার্স এসে আমাকে বললেন, আপা, আপনি ইচ্ছে করলে পাশে বিছানায়ও কিছুক্ষন বিস্রাম করতে পারেন। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি আর তাকে এটা বলার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না যে, আমি ক্লান্ত নৈ, আমি ভাল আছি, কারন মা ভাল আছে। আর মা ভাল থাকলে তুমি ভাল থাকবে। ভগবান বড় রসিক। তাঁর রসিকতায় চোখের জল আর মনের আনন্দ সব একাকার হয়ে যায়।

যে কয়টাদিন আমি মায়ের সঙ্গে থেকেছিলাম, আমার জীবনে ওটা ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। আমি জানিনা মা আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমার কাছে মা ছিল একটা শ্রেষ্ঠ উপহার। তুমি ঠিকই বলতে, তোমার মা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন মা। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। সকালে উঠে তিনি প্রতিদিন আমাকে বুকে জরিয়ে চুমু খেয়েছেন। রাতে শোবার সময় বলতেন, আমাকে জড়িয়ে ঘুমাবে। আমার কাদতে ইচ্ছে করত এইভেবে যে, এই একান্ত সময়টা আমার খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মা আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞ্যেস করতেন না কে আমি বা কি বা আমার সম্পর্ক তোমার সাথে। শুধু প্রথম দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার পরিবারের কথা। হয়তবা আমার মা স্বর্গীয় হয়েছেন, বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছেন, আমি একটা মহিলা হোস্টেলে থাকি, এই জেনে আর কিছুই তাঁর জানার প্রয়োজন ছিল না। তোমার মা আমাকে আদর করে কি এক অদ্ভুত নামে ডাকতেন যার অর্থ আমি কখনই হয়ত জানব না কিন্তু আমার তাঁর এই দেয়া নামটায় কোন আপত্তি ছিল না বরং আমার খুব মনে ধরেছিল। তোমাকে আজ ঐ নামটা মনে করিয়ে দিতে চাই না কারন তুমি সেটা যে ভুলে যাও নি তা আমি জানি।

মা সেরে উঠলেন চারদিন পর। আমি এই কয়দিনে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি হোস্টেলে থাকি, আমাকে আবার হোস্টেলে ফিরতে হবে। মা আমাকে তোমাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মা আমাকে জোর করেননি, আমাকে যেতে হবে মায়ের সঙ্গে তোমাদের বাসায়, এই কথাটা এমন করে বলেছিলেন যে, আমার সাত জনমেরও সাধ্যি ছিল না এর কোন ব্যাতিক্রম হয়। হাসপাতালের আয়া থেকে শুরু করে নার্স, পাশের ক্যাবিনের রোগীরাও মায়ের এই প্রত্যাবর্তনে যতটা না খুশি হয়েছিল তাঁর থেকে বেশি যেন কষ্ট পেয়েছিল এইভেবে যে, তারা সবাই মাকে মিস করবে। মাকে দেখে বুঝলাম, মানুষকে আপন করে নেওয়ার জন্য অধিক সময়ের দরকার হয় না। দরকার শুধু মানবিকতা আর নিঃস্বার্থ ভালবাসা।

মাকে নিয়ে তুমি তোমাদের বাসায় এলে। সঙ্গে আমি। এই প্রথম আমি তোমাদের বাসায় এলাম। রবিন্দ্রনাথের জমিদার বাড়ির মত না হলেও দেখলাম বাড়িটা অনেক বড়। তোমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটা পুকুর ঘাট আছে। পুকুর ঘাটের সামনের রাস্তাটা তোমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক উল্টো দিকে গিয়ে মিশেছে। কেউ রাতে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও অসুবিধা নাই, পুকুর ঘাট থেকে সোজা বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছতে পারবে। মাঝে দুইটা সেই পুরানো মডেলের রাজা বাদশার আদলে বাতি আছে। মোটামুটি তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা। পুকুরের চারিধারে বসবার জন্য কয়েকটি আধা পাকা বেঞ্চের মত করে দেওয়া আছে। প্রতিটি বেঞ্চই কোন না কোন একটা গাছে নিচে। বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান। অনেকদিন এই বাগানে মালির হাত পরেনি বুঝা যাচ্ছে। তাঁরমধ্যে বৃষ্টির সিজন। বর্ষার পানি আর যথেষ্ট পরিমান আলো বাতাস পেয়ে বাগানের আগাছাগুলো লিকলিক করে সবার অন্তরালে অল্প সময়ের মধ্যে যার যার স্থান করে নিয়েছে। বুঝা যায়, বাগানে অনেক অতিথি পোকাদের আনাগোনা হয়েছে। এরাও এই জায়গাটাকে প্রানমুখর করে রেখেছে। বাড়ীটার উত্তর ধারে আছে প্রকান্ড একটা জামগাছ। এখন ফলের সিজন শুরু হয় নাই কিন্তু পাপড়ি, কুড়ি গজানোর সময়। তাই জামগাছেও থোকায় থোকায় কিছু নতুন কুড়ি এসেছে। আর এদের সঙ্গে চিরাচরিত পরকিয়া প্রেমিকের মত কিছু মধু আহরণকারী পোকামাকরের সর্বদা ভীড় রয়েছে। জামগাছটিও আর একা নয়। তাঁর উপরের মগডালে নিতান্তই সাধু বাবার মত, ভদ্র পরিবেশ বানিয়ে কয়েক জোড়া বাবুই পাখী তাঁর সুনিপুণ কৌশলে বানানো ঝুলন্ত কয়েকটি বাসা মোটামুটি পাকাপোক্ত করেই যেন চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। একপাশে অনেক পুরানো দিনের পরিত্যাক্ত একটা ডোবা। বুঝা যাচ্ছে এই ডোবাতে কেউ নামে না। এলোপাথাড়ি কচুরিপানা, কিছু গাছের মরা ঢাল, বর্জ্য পদার্থ, অনেক কিছুই চোখে আসে। আর এই ডোবাটার ঠিক আশেপাশে কিছু দস্যুপনা পাখির সারক্ষন আনাগোনা থাকে কখন ছোট্ট একটা নলা মাছ, বা কচি প্রানের একটা ব্যাঙের ছানা যেই না উকি মারে অমনি ছো মেরে ঘপ করে মুখে পুরে নেয়। পুরু বাড়িটার মধ্যে একটা প্রানের লক্ষন আছে। সবচেয়ে বেশি লক্ষ করলাম, বাড়িটা নীরবতায় পরিপূর্ণ কিন্তু নিরব নয়। দুদিন থাকতে হল।

আমার কোন বাড়ি নাই। আমার পৈত্রিক বাড়িতে আমার বিশেষ কোন কদর ছিল কিনা আমি জানি না কিন্তু আমার ঐ পৈত্রিক বাড়িটায় আমার কোন নিজস্ব নেশাও জন্মেনি। সেই ছোট বেলায় আমি যখন শেষ বার গিয়েছিলাম, তাঁর স্মৃতি আমি আজও ভুলি নাই। সেটা ছিল এক দুঃসহ এবং ভয়ংকর অনুভুতি। আমরা সবাই সন্ধ্যা পূজায় বসেছি মাত্র। এমন সময় গ্রামের কিছু লোক আর তাঁদের সঙ্গে কিছু বিশ পঁচিশ বছরের যুবক আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। লোকগুলোকে দেখে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হলো। আমার মা পুজা ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে একজনকে তাঁদের আগমনের কথা জিজ্ঞ্যেস করতেই পিছন থেকে এক যুবক উত্তেজিত কোথায় মাকে গালিগালাজ করতে লাগলেন। যেন ব্যাপারটা এই রকম , মা কোন অন্যায় করেছেন, তাঁর বিচার চাওয়া হচ্ছে। মা কোন প্রতিবাদ  না করে আগত এক বৃদ্ধ মুরুব্বীকে খুবই  বিনিত স্বরে কি যেনো বললেন। কিন্তু ব্যাপারটা তাতেই মিটে গেল বলে মনে হলোনা। হটাত হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, আগত যুবকদের মধ্যে এক অল্প বয়েসি তরুন আমাদের বাসার দরজা আর জানালা উদ্দেশ্য করে এলোপাথাড়ি ঢিল ছুড়তে আরম্ভ করলো। আমার মা যথেষ্ট পরিমানে আহত হলেন, আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, পুজামন্ডপ ছেড়ে আমরা সবাই আমাদের ঘরের এককোনে ঝুপটি মেরে বসেছিলাম। অনেকরাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমার মা বাবার সঙ্গে কোন কথাই বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। আসলে কি জন্য কি হয়েছিল আমরা কেউ কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু পরেরদিন মা বললেন, আমরা সবাই নানু বাড়ি যাচ্ছি। নানু বাড়ি যাচ্ছি শুনে আমার খুব ভাল লাগছিল কিন্তু আমার মায়ের খুব মন খারাপ, ব্যাপারটা আমাকে দোটানায় রেখেছিল, একদিকে নানু বাড়ি যাওয়ার আনন্দ আবার আরেকদিকে মায়ের মনের অবস্থা। ঐ যে শেষবারের মত আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছিলাম, আর যাওয়া হয় নাই। আমার বাবাও আর নানুর বাড়িতে কখনো আসেন নাই। আমরা বাবাকে খুব ভয় পেতাম, তাই কি কারনে বাবা আসেন না, তাও আমরা কেউ জানতে পারিনি। মাকে জিজ্ঞ্যেস করলে মা শুধু অন্য প্রসঙ্গে এড়িয়ে যেতেন। অনেক বছর জেনেছিলাম, বাবা অন্য এক নারির সঙ্গে ঘর বেধেছেন।

তোমাদের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। সকালের রোদ যেমন অকাতরে তোমাদের পূর্ব উঠোনে এসে আছড়ে পরে, তেমনি বিকালের পড়ন্ত রোদেরও কোন কমতি নেই পশ্চিমের পুকুরঘাট থেকে শুরু করে সদর দরজার আঙ্গিনা পর্যন্ত।

যে কয়টা দিন আমি তোমাদের বাসায় থেকেছিলাম, ঐ কয়দিনের মধ্যেই শুধু তোমাদের বাড়ি নয়, আশেপাশে লোকজনের সঙ্গেও তোমার মা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সামনে পরীক্ষা, তাই কয়েকদিন পরই আমি চলে এলাম। বলতে পারো তুমি, আমি কি বিদায় নিয়ে এসেছিলাম? আমার মনে পরে না এখন। সেদিন আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে যে, আমি ঐ বাড়িটার প্রতিটি মুহূর্ত মিস করবো। আমি সকালের রোদটা মিস করবো, পুকুরঘাট, ঐ ডোবা, বাগান, কাকাতুয়া, বাবুই পাখী, ব্যাঙের ছানার উকি মারা, কিংবা সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া জামের কুড়ি সবই মিস করবো। আর এগুলোকে জড়িয়ে যার সংসার, তোমার মা, তাকে আমি মিস করবো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। আমার বুক ভরে কান্না আসছিলো। তোমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম তাঁর ডাকা নামটায় আজ আর ডাকলেন না, শুধু বুকে চেপে ধরে আমাকে বললেন, “তুমি আবার এসো মা,”। এতক্ষন কান্নাটা চেপে রাখতে পেরেছিলাম, এখন তোমার মায়ের মুখে আমাকে “মা” সম্বোধনটা আমার বুকে কষ্টে জমিয়ে রাখা ব্যাথাটা ভেঙ্গে শ্রাবনের বারিধারার মত আখির  অজস্র নোনাজলে এর বহিরপ্রকাশ ঘটল।

আমি যতক্ষন প্রশমিত হইনি, তোমার মা আমাকে অতক্ষনই তাঁর বুকে জড়িয়ে রাখলেন। উনি কেদেছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি যখন তাঁর বুক থেকে মাথা সরিয়ে মার দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর মিষ্টি একটা হাসি। প্রানটা যেন এবার সত্য জুড়িয়ে গেল। বুকের ভিতরের ব্যাথাটা এখন অনেক হাল্কা লাগছে, আমি মায়ের পা ছুয়ে আশীর্বাদ নিলাম। তারপর আমি আমার সেই চিরচরিত হোস্টেলে চলে এলাম। আবারও সেই অগোছালো এক বসবাস, একই ধাঁচের সেই নিয়মের বাড়াবাড়ি। কিন্তু কোন উপায় নেই। জীবনের অনেক কিছুই আমাদের ভাল লাগবে না, তাই বলে এই নিয়মগুলো কেটে বের হয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নাই, যারা নিয়মগুলো বানায়, তারা নিয়মগুলো হয়ত মানার দরকার নাই বলে এর সংস্কার করারও কোন প্রয়োজন মনে করে না। কে কার জন্য কি পালটাবে বলো?

তোমার সাথে আমার যথারীতি দেখা হয়, কথা হয়, তোমার মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করি, বেশ চলে যাচ্ছে আমার সেই নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের কিছুটা সময়। বন্ধুবান্ধব ছিল কিন্তু তারা সব বন্ধুর গন্ডিতেই ছিল। অনেকে আরও গভীরভাবে আমাকে জানতে চেয়েছিল হয়ত, আমি কেন যেন কোন কিছুই বুঝতে চাইনি। আমার সহপাঠী অনেক মেয়েবন্ধুরা এরই মধ্যে বিয়েথা করে সংসার পেতে ফেলেছে, কখনো কারো সুখের কাহিনি শুনে মুগ্ধ হয়েছি আবার কখনো কারো করুন কাহিনি শুনে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে। আমরা মেয়ে মানুষ, পুরুসের মন জুগিয়ে চলাই আমাদের প্রধান কাজ। শুধু পুরুষ কেনো, তাঁর সঙ্গে শ্বশুর, শাশুড়ি, আয়া, জায়া, দেবর ননদ সব। এমন কি বাড়ির কাজের মানুষগুলোও অনেক সময় যা পারে আমরা বউরা ঐ কিঞ্চিত ছাড় পাওয়ার আশা করাও অনেক সময় দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। এ দেশের মায়েরা আর শাশুড়িরা এক বংশের নয়। মায়েরা মনে করে, তাঁদের মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে জামাইকে নিয়ে খুব ভাল আছে কারন তাঁর মেয়ে যা আদেশ করে বা বায়না করে তাঁর স্বামী সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু তাঁর ছেলেটা একেবারে উল্টো। বউ যা আদেশ করে বা বায়না ধরে তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কেন বাবা, পরের মেয়ের এত আবদার, এত কথা কেন শুনতে হবে? যেন তাঁর ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে অথচ তাঁর মেয়ের জামাইটা কি সুবোধ বালকের মত। যা আদেশ করা হবে সব সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই হচ্ছে আমাদের সমাজ। যেখানে আমরা পরিবর্তনের কথা বলি সবাইকে কিন্তু নিজে পরিবর্তন হই না। আমরা প্রত্যেককেই বলি, কেন সবাই পরিবর্তন হয় না? শুধু বলি না, কেন আমি পরিবর্তন হচ্ছি না। যাক, হয়ত এটাই সামাজিক রীতি। কেউ বদল করে কেউ বদল হয়। আমারও কিছু জিনিসের বদল হলো। শেষ করে ফেললাম আমার শিক্ষার জীবন। হোস্টেল জীবন বদল হয়ে গেল ছাত্রি হিসাবে। আমি জানি না কোথায় এখন আবার আবার নতুন জায়গা হবে। তুমিও কোনদিন আমাকে এই প্রশ্নটা করোনি এরপর কি আমার প্ল্যান, বা কি করলে কি হবে। ছাত্রি থাকা অবস্থায় একবার ফ্রান্সে স্কলারশিপের আবেদন করেছিলাম, এর কি অবস্থা একটু খুটিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো। আমি জানি এটা আমার হবে না। আমার জাঁদরেল কোন মামা নেই, আমার বাবার এমন কোন বন্ধু নেই যার কাছে আমি গিয়ে বলতে পারি আমার সাহায্যের প্রয়োজন। অথবা আমার এমন কোন ব্যাক্তির সঙ্গে সখ্যতা নেই যাকে ধরে আমি আমার এই অবৈতনিক ধূসরগণ্ডী পার করতে পারি। তাঁরপরেও একবার খোঁজ নিতে গেলাম ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে যদি কোন কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। আমি আশাবাদি নৈ কিন্তু একেবারে অবসর, তাই কিছু একটা করা আর কি। একটা পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম রেজিস্টারের অফিসের উদ্দেশে।

ভগবান যখন রশিকতা করেন, তাঁর রসিকতায় একটা অদ্ভুত আবেগময়ি স্পর্শ থাকে। আমার বেলায়ও হয়ত তাই হল। কি করে কি হল? আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে শুনলাম, গতকালই নাকি আমার ফ্রান্সে যাবার স্কলারশিপটা মঞ্জুর করেছে। আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না এই খবরটায়। মোট জনাদশেক আবেদন করেছিল, তাঁর মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের দুজন এই স্কলারশিপটা পেয়েছে। তাঁর মধ্যে আমি একজন। আনন্দে আত্মহারায় আমার শরীর কাপছিল, আমি কাকে এই খবরটা দেব? কি বলব? কিভাবে বলব? এটা কি আদৌ কোন বড় খবর নাকি কোন খবরই না? আমি আমার পানির বোতলের সবটুকুন পানি খেয়েও যেন আমার তৃষ্ণা মিটছিল না। সত্যি ভগবান বড় রশিক। যখন কারো আর কোন পরিকল্পনা জানা থাকে না, তাঁরজন্য হয়ত ভগবান বিশেষ কিছু করে থাকেন যা সঠিক সময়ে সঠিকস্থানে এবং সঠিক ব্যাক্তিকে তিনি দান করে আশ্বস্ত করেন। আমার এই অপরিকল্পিত জীবনে এই প্রথম মনে হল, “কোথাও কেউ নেই” এই কথাটা সত্য নয়। অন্তত ভগবান আছেন। তিনি সবাইকে তাঁর অফুরন্ত আলো বাতাসের ভান্ডার দিয়ে, এই বিশাল জলরাশির আধার দিয়ে, কোন না কোন অসহায় জীবকে নিজের পরম মমতায় অতিযত্নে সোহাগ করে তুলে নেন আর এমন স্থানে তাকে জায়গা করে দেন যা অতিশয় আরামদায়ক এবং সৌভাগ্যের। হয়ত ভগবান তাঁর নজর আমার কাছ থেকে এখনো সরিয়ে নেন নাই।

আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি ছাড়া আর এখন তোমার পরিবার ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আমার পৃথিবীর গোটা অঞ্চল ভাগ করলে সেই অঞ্চলে শুধু তোমাদের বাড়িটা ছাড়া আর কোন অঞ্চল এই অংশে দেখা যাবে না। আর সম্ভবত এই কারনেই খবরটা নিয়ে আমি প্রথম যেখানে দৌড়ে গিয়েছিলাম, সেটা তোমার বাসায়। জীবনের মুহূর্তগুলো কিভাবে বদলে যায়, জীবনের আগমুহূর্তটা তাঁর পরের মুহূর্তের মত নয়। প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর নিজ নিজ স্বকীয়তায় পূর্ণ। একটু আগেও আমি ছিলাম ধিরস্থির, আমার কোন নিশানা ছিল না, আমার গন্তব্যের কোন আবাসস্থল ছিল না, অথচ এই মুহূর্তে আমি আর আগের মুহূর্তের মত নৈ। এখন আমি এক চঞ্চলা। মনে মনে গুনগুন করে গান গেতে ইচ্ছে করছে। কোন বিষণ্ণ ধরনের গান নয়। মনে হচ্ছে আমি নিজেই একটা গান নিজের সুরে গাইতে থাকি, “আমি যেন আজ আমি নেই, কোন এক বিশাল জগতের অম্পরা সরীসৃপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ কত অদ্ভুত। হয়ত এই কারনেই ভগবান তাঁর অদ্ভুত আচরনে মুচকি মুচকি হাসেন আর তাঁর রসিকতার মজা নেন।

বিকাল চারটার দিকে আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আমি জানি এই সময় তুমি বাসায় থাকো না। তোমার মা হয়ত এই সময় দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। কিন্তু আমার সময় কাটছিল না। আমি হাজির হয়ে গেলাম তোমাদের বাসায়।   

অবাক হলাম মাকে দেখে। মা অন্য দিনের মত আজ দুপুরের পর খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেননি। কি যেন নিয়ে খুব ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আমি ঢোকতেই একটা সুন্দর মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “এসো মা এসো, ভালই হলো, তুমি এসেছ”। আমি মাকে প্রনাম করে তাঁর পাশে গিয়ে বসতেই আমাকে একটা এ্যালবাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখোত মা, মেয়েটা কি রকম দেখতে?” ধক করে উঠল যেন আমার বুকটা। আমার এতবড় একটা আনন্দের দিনে, মনভরা এতটা সুখি বুকে হটাত করে যেন পিছন থেকে শতটনি একটা গাড়ী আমার পাজরের সবগুলো হাড় চুরমুর করে বাকিয়ে দিচ্ছে। বুঝতেই পারলাম না কোথা থেকে কখন ঐ শত সহস্র ওজনের একটা দানব আমার অজান্তে আমার এত কাছে এসে কত বড় ধাক্কাটা দিয়ে গেল। সামলাতে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও ব্যাপারটা নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখতে পারলাম। “আকাশের জন্য মেয়ে দেখছি, এগুলো ঐ মেয়েটারই ছবি। দেখোতো মেয়েটা কেমন দেখতে?” আমি ছবিগুলো দেখতে দেখতে মা কথাগুলো বলছিলেন। বড্ড সুন্দর একটা মেয়ে। ঠোটে লাল লিপিস্টিকের পাশ দিয়ে চমৎকার লাইনার টানা। মনে হয় কোন আর্টিস্ট যেন খুব সন্তর্পণে তাঁর ঠোঁটের ঐ লিপিস্টিকগুলি অতিশয় যত্নের সহিত একে দিয়েছেন। মাথার চুলগুলো পরিপাটী করে সাজানো। ক্যামেরার আলো প্রতিফলিত হয়ে চুলের এক অংশে একটা আলোর ঝলকানির সৃষ্টি করেছে। কানের দুলটি গ্রীবার পাশ পর্যন্ত ঠেকে আছে। তাঁরমধ্যে অসংখ্য যাদুকরী কারুকার্য। চোখ দুটো নিরব চাহনি দিয়ে তাঁর মাদকতার রূপ জাহির করছে। অদ্ভুত সুন্দর সে চাহনি। মিস্টি মুখের একটা ছাচ। গোলগাল কিন্তু অপূর্ব মায়াবতী। যে কারোরই পছন্দ হবে মেয়েটিকে। কয়েকটি ছবি পূর্ণ অবয়বে তোলা। বেশ লম্বা বুঝা যায়। আকাশের সঙ্গে মানাবে। একটা ছবিতে একটা ছোট গাছের আড়ালে দাড়িয়ে। আড়াল করে দাড়ালেও তাঁর রুপের কোন অংশই লুকানো সম্ভব হয় নাই। পিছনের সবুজ ঘাসের সঙ্গে আর অপরূপ কিছু রঙ্গিন পাতাগাছের পাশে তাঁর সবুজাভাব শাড়ির অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে। নারীরা আসলে সুন্দরের প্রতিক। ভগবান এদের বানিয়েছেন অতি আদর করে , মায়াবতী রূপ দিয়ে। কেউ এদের নোনাজলে ভাসিয়ে কর্দমাক্ত করে দিলেও তাঁর অন্তরের রুপটা হয়ত একেবারে বিলিন হয়ে যায় না। এরা শ্মশানের মত পাষান নয়, আবার মমের থেকেও নরম। এদের গলিয়ে আরেক রূপ দেওয়া যায় আবার শুকিয়ে গেলে বর্জ্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না।

বললাম, “মেয়েটি দারুন দেখতে। আকাশের সঙ্গে মানাবে।”

তোমার মা আমাকে চুমু খেয়ে বললেন, “দেখিস, তোর আকাশ সুখি হবে।”

আমার চোখ ভিজে এল মায়ের কথায়। “আমার আকাশ”। হ্যা, তাই তো, তুমি তো আমারই আকাশ। ঐ আকাশেই তো আমার সর্বদা বিচরন। আমি যখন খুশি উড়তে পারি, আবার আমার যখন মন খারাপ থাকে, ঐ আকাশ থেকেই তো বৃষ্টি আসে। আবার কখনো কখনো ঐ আকাশের মাঝে জলন্ত সূর্যটাই তো আমাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। অনেকক্ষন মায়ের সঙ্গে কাটালাম। আমি আমার খবরটা তখনো মাকে দেই নাই। কি বলব মাকে? আমি চলে যাচ্ছি? আমি কোথায় যাব?

সন্ধে হয়ে এল। হোস্টেলে ফিরতে হবে। অনেক কাজ হয়ত বাকি। রেজিস্ট্রার সাহেব আমাকে একখানা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অনেক কাগজপত্র যোগাড় করতে হবে। আমি ফিরার পথে মাকে বললাম, “মা, আমার  স্কলারশিপ হয়েছে, ফ্রান্সে।  খুব শিগ্রই  হয়ত যেতে হবে। তুমি দোয়া কোরো।”

“সে কিরে? আকাশের বিয়েতে তুই থাকবি না?” মা আমার এই খবরটায় যতটা না খুশি হলেন, মনে হল তাঁর থেকে বেশি বিচলিত হলেন আমার চলে যাবার কারনে হয়ত আকাশের বিয়েতে আমার ভুমিকা নিয়ে।

আর যাই হোক মা তো। মায়েরা নিজের সন্তানের অন্তর যতটা বুঝে তারা অন্য সন্তানের অন্তর অতটা হয়ত বুঝেন না। ওনি তো আকাশের মা।

আমি চলে এলাম আমার হোস্টেলে। মনটা আজ নানা কারনে এতটাই আলোড়িত ছিল যে কখনো উত্তপ্ত টাইফুনের মত আবার কখনো ধুম্রজাল নাটকের মত খসখসে, আবার কখনো বৈশাখীর পড়ন্ত বিকালের আমেজের মত, কখনো জানি কেমন বুঝা যাচ্ছে না। আমার স্কলারশিপ আমাকে অতিশয় আবেশিত করে ফেলেছিলো, আবার আকাশের বিয়ের পাত্রি দেখে আমার মন যেনো কোথায় স্থির হয়ে গিয়েছিলো। টিভি অন করে মনটা বদলের চেষ্টা করলাম। প্রথমেই একটা গানের কলি শুনে মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে গেল, নজরুলের ঐ বিখ্যাত গান, “আমার যাবার সময় হল, দাও বিদায়…” পৃথিবীর কোন একটা মুহূর্ত আরেকটি মুহূর্তের মত কখনই নয়। এরা সবাই যার যার বেদনায় বা উল্লাশে ভরপুর। খেতে ভাল লাগছিল না। না খেয়েই শুয়ে পড়লাম।

একটানা এগারো দিন আর আমি তোমার সঙ্গে অথবা তোমাদের বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখিনি। সত্যি আমি আমার স্কলারশিপের যাবতীয় কাগজাদির জন্য হন্যে হয়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছি। মনে হয়েছে শুধু আমার হাতে সময় অনেক কম, কেন জানি মনে হয়েছে আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। যে করেই হোক আমি তোমার বিয়ের আগে এই সমাজ, এই দেশ, এই রীতিনিতি, এই শাশনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।

আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটি ছিল ইংরেজির ১৮ তারিখ আর বাংলায় ২৯ শে বৈশাখ। আমার সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। আমি চলে যাচ্ছি সেই সুদুর অপরিচিত কোন এক মহলে যেখানে আমি কারো ভাষা বুঝি না, আমার কেউ পরিচিত নাই, আমি ইচ্ছে করলেই মন খারাপ থাকলে তোমার মায়ের মত এমন একজন মানুষের কাছে আমি ছুটে যেতে পারব না। তারপরেও আমি সস্থি পাচ্ছি এই ভেবে, আমার নতুন জীবনে কেউ আমাকেও চিনে না। আমি শেষবারের মত তোমার কাছে এসেছিলাম তোমাদের বাসায়।

মাকে প্রনাম করলাম, বড্ড কান্না পাচ্ছিল। মা আমাকে কত কথা বললেন। খুব আদরে আদরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

তোমাদের বাসা থেকে বের হবার সময় তোমাকে একবার প্রনাম করতে খুব মন চাইছিল। মন যা চাইলো, আমি তাই করলাম, এই প্রথম আমি তোমাকে প্রনাম করতে গেলে তুমি আমাকে বারন করতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে। আমি অবশ শরিরে শুধু কান্নাই করে যাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে কখনোই এইভাবে জড়িয়ে ধরো নাই। তুমি আমার আকাশ, এই প্রথম আমি আমার আকাশকে এত কাছ থেকে বুকের মাঝে ধারন করতে পারলাম। তুমি কি আমার ভিতরের কোন কম্পন অনুভব করোনি? তুমি কি কখনোই বুঝতে পারোনি যে আমার ভিতরের মাধুরী আজ তোমার আকাশ থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? হয়ত বা পেরেছ, হয়ত বা পারোনি।

বিশাল এয়ারপোর্ট। আমি কখনো এই এয়ারপোর্টে আসিনি। আসার দরকার হয় নাই। কত লোক এই এয়ারপোর্ট দিয়ে তাঁদের গন্তব্য পরিবর্তন করে, আমিও আজ আমার জীবনের আরেক গন্তব্যের উদ্দেশে নিজে দেশ ছেড়ে, নিজের সমস্ত স্মৃতি পিছনে ফেলে, যত মায়া মহব্বত, ঘৃণা, আক্রোশ, ক্রোধ, অবিচার, অন্যায়, কিংবা ভালবাসা, আবেগ, অথবা মনের সব জালা জন্ত্রনা ছেড়ে আমি পাড়ি দিচ্ছি অন্য আরেক অপরিচিত দেশে যেখানে আমার কেউ নেই।

প্ল্যান টেকঅফ করেছে। দ্রুত স্থান পরিবর্তন হচ্ছে, ঘাস, গাছ পালা, বিশাল অট্টালিকাগুলো নিমিসের মধ্যেই আমার থেকে পিছনে পরে যাচ্ছে। আমার মনটা একেবারে শান্ত, কিন্তু কোথায় যেন চিনচিন করে ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে। আমার পাশে বসা একজন ষাট বছরের বৃদ্ধা তাঁর সিটে আরাম করে বসবার জন্য ঘনঘন নারাচরা করছেন। আমরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মাটি ছেড়ে অনেক উপড়ে উঠে গেছি। আমি এখন আকাশে। এই আকাশ আর সে আকাশ এক নয়। আমি ইচ্ছে করলেই এই আকাশে ঝাপ দিয়ে বুকে পড়তে পারি না, তারপরেও এর নাম আকাশ। আকাশ কত বিশাল, চারিদিকে শুধু সাদা মেঘের আভা। মনে হয় যেন সাদা মাটির এক দেশ। কেউ কোথাও নেই, শুধু সাদা মাটি।