কম্পিউটার সার্ফ করছিলাম। হার্ড ডিস্ক ক্লিন করার সময় হটাত করে একটা অনেক পুরানো ছবির সন্ধান পেলাম। অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলাম ছবিটার দিকে। মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। একটা ছবি অনেক কথা বলে। একটা ছবি একটা সময়ের ইতিহাস বলে। একটা ছবি না বলা অনেক স্মৃতি মানষ্পটে জাগিয়ে তোলে। আজকের এই ছবিটাও তেমনি একটি ছবি।
আজ থেকে প্রায় ৪০/৪১ বছর আগের কথা আমি যখন গ্রামে ছিলাম সেদিনের কথাগুলি যেনো একে একে স্পষ্ট জেগে উঠতে থাকলো আমার স্মৃতির পাতায়। আমরা কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক ক্লিন করি, তারমধ্যে আবার নতুন কোনো তথ্য লোড করি, পুরানো তথ্যগুলি অনেক সময় আর খুজে পাওয়া যায় না। হয়তো বিশেষ কায়দায় কোনো ছায়া-মেমোরি থাকলেও থাকতে পারে যা থেকে হয়তো আবার সেই ডিলিটেড কোনো তথ্য বিশেষ কায়দায় ডিস্টর্টেড অবস্থায় কিছু পাওয়া গেলে যেতেও পারে কিন্তু আমাদের ব্রেনের মধ্যে সেই শিশুকাল থেকে যতো স্মৃতি এই মেঘা হার্ডডিস্কে লোড হয়েছে, সেটা কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে আবার জেগে উঠে অবিকল ঠিক সেই বিন্যাসে যা ক্রমান্নয়ে ঘটেছে বা ঘটেছিলো। এমনি একটা স্মৃতির পাতা আজ আমার মন আর ব্রেনের কোনে ঠিক জাগ্রত হয়ে জীবন্ত আমার দৃষ্টির মধ্যে চলে এলো- বজলু, আমার সেই ছোট বেলার অনেক প্রিয় একজন বন্ধু।
বজলু আমার খুব ভালো একজন বন্ধু ছিলো। আমাদের গ্রামের প্রায় শেষ পশ্চিম প্রান্তে ওদের বাড়ি। একই ক্লাসে পড়তাম, এক সাথে মাঠে খেলাধুলা করতাম। ওরা তিন ভাই ছিলো, বজলুই ছিলো সবার বড়। ওর বাবা ছিলো ধনী কৃষক। ওদের সামাজিক অবস্থা গ্রামের অন্যান্যদের থেকে বেশ ভালো। বজলুর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো যে, ও খুবই তোতলা ছিলো কিন্তু আমার কাছে এটা কোনো ব্যাপার ছিলো না। মজার ব্যাপার হলো, বজলু আমার সাথে যখন থাকতো, আর কথা বলতো, সে প্রায় তোতলামী করতোই না। কিন্তু যেই না অন্য কারো সাথে কথা বলতো, তার তোতলামীটা বেড়ে যেত। আমার সাথে বজলু স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতো। ও খুব ভালো গান গাইতো। লেখাপড়ার প্রতি টান থাকলেও কেনো জানি বেশী দূর এগুতে পারে নাই। এমন না যে টাকা পয়সা টানাটানির কারনে বা অভাবের সংসারে ওকে হাল ধরতে হয়েছিলো যার কারনে লেখাপড়া করতে পারে নাই। আমাদের গ্রামের মানুষগুলির বড় সমস্যা হচ্ছে-তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠায়, কিন্তু খবর নেয় না তারা স্কুলে কি পড়ছে, কেমন করছে, কিংবা সন্তানদের কোনো গাইড লাইন দেয়ার দরকার আছে কিনা।
আমার মনে আছে যে, আমি আর বজলু ওদের বাসায় একসাথে পড়াশুনা করতাম। ওর মা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অনেক সময় দুপুরে খাওয়া দাওয়াও করাতেন। আসলে পৃথিবীর সব মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য সব কিছু করতে পারে। তারা সব সন্তানদেরকে একই রকম করে ভাবেন। আমি বজলুকে অংক শিখাতাম কারন বজলু অংকে আর ইংরেজীতে কাচা ছিলো। ১৯৭৭ সালে আমি ক্লাস সেভেন থেকেই গ্রাম ছাড়ি। তার কারন আমি ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে বজলুর সাথে আর আমার স্কুলে পড়া হয় নাই। ক্যাডেট কলেজে বাধাধরা নিয়ম, মাঝে মাঝে ছুটি পাই, তখন বেশীরভাগ সময় আমি গ্রামেই কাটাতাম। বজলু তখনো স্কুলেই পড়ে। ছুটিতে আমার কোনো কাজ থাকতো না, কিন্তু বজলুর থাকতো। ক্ষেতে কাজ করতো, গরুগুলিকে নদীতে নিয়ে গোসল করাতে হতো। ওর বাবাকে সাহাজ্য করতে হতো, ক্ষেতে আলু কিংবা অন্যান্য শশ্য লাগাতে হতো। আমিও ওদের সাথে ওইখানে বসেই আড্ডা দিতাম। কারন গ্রামে আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিলো।
রাতেও আমি ওদের বাসায় অনেকদিন আড্ডা দিতাম। তোতলা হলেও গান গাওয়ার সময় বজলু কখনো তোতলামী করতো না। প্রচন্ড মায়া ছিলো ওর অন্তরে সবার জন্য। কারো সাথে ঝগড়া করেছে এমনটা দেখি নাই। পড়াশুনার চাপে আর ক্যাডেটে থাকার কারনে ধীরে ধীরে আমার এসব বন্ধুদের থেকে যোগাযোগটা আমার কমে গিয়েছিলো। প্রায় বছর তিনেক পরে আমি যখন একবার ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ যাবো বলে গুলিস্তান থেকে একটা বাসে উঠেছি, হটাত কে যেনো আমার নাম ধরে ডাক দিলো। ড্রাইভার সিটে বসা একজন লোক। তাকিয়ে দেখি-বজলু। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম বজলুকে দেখে। বল্লাম-কিরে তুই ড্রাইভারি করিস নাকি? বজলু আমার হাত টেনে ধরে বল্লো, আমার পাশে বস। নারায়নগঞ্জ যাবি? বল্লাম-হ্যা। খুব ভালোই হলো। তোর সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। আমার জীবনে এইই প্রথম আমার কোনো খুব কাছের মানুষ ড্রাইভার। খুব আপন মনে হচ্ছিলো। বজলু বলতে থাকলো-
তোরা সব চলে যাবার পর আমার আর পড়াশুনা হয় নাই। গ্রামে আসলে পড়াশুনার পরিবেশও নাই। বাড়ি থেকে বারবার চাপ আসছিলো কিছু একটা করার। গ্রামের বেশীরভাগ ছেলেরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছিলো। আমিও সেই লাইনেই ছিলাম। বিদেশ চলে যাবো। তাই ড্রাইভারি শিখতে হলো। লাইসেন্স পেয়েছি। ঘরে বসে না থেকে হাত পাকা করছি আবার কিছু পয়সাও কামাচ্ছি। পড়াশুনা তো আর হলোই না।
সম্ভবত সেটাই ছিলো বজলুর সাথে আমার সর্বশেষ একান্তে কথা বলা। পরে শুনেছি বজলু জাপান চলে গেছে। সেখানে অনেক বছর চাকুরী করে আবার গ্রামে এসেছিলো। আমাদের গ্রামে আমাদের সাথে পড়তো সুফিয়া নামে একটি মেয়ে ছিলো। ওর বোন সাহিদাকেই বজলু বিয়ে করেছে। তিনটা মেয়ে আছে ওর। আমার সাথে ওদের কারো কোনো যোগাযোগ ছিলো না। মাঝে মাঝে গ্রামে যেতাম ঠিকই কিন্তু ওরা দেশে না থাকায় কারো সাথেই আমার যোগাযোগ হতো না। মা যতোদিন বেচে ছিলেন, গ্রামে যাওয়া হতো কিন্তু মা ইন্তেকাল করার পর গ্রামে যাওয়াটা আমার প্রায় শুন্যের কোটায় পরিনত হয়।
২০১৮ সালে হটাত একদিন আমার ফোনে একটা ফোন এলো। আমি অপরিচিত নাম্বার সাধারনত ধরি না। কিন্তু কি কারনে হটাত করে আমি সেই ফোনটা ধরেছিলাম। অন্য প্রান্ত থেকে দেখি বজলুর কন্ঠ।
কিরে দোস্ত, কেমন আছিস? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-বজলু?
খুব ভালো লাগলো ওর কন্ঠ শুনে এতো বছর পর। বজলু বল্লো, সে দেশে এসেছে। বেশ কয়েকদিন থাকবে। তারপরেও বছর খানেক তো থাকবেই। বজলু ওর পরিবারের অনেক খবর দিলো। ওর স্ত্রী সাহিদা আমাদের প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী করে। তিনটা মেয়ে, সম্ভবত মেয়েদের বিয়ের আয়োজন করছে। ওর শরীরটা নাকি ইদানিং খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক কথা মনে পড়লো-
সেই প্রায় ৪০/৪১ বছর আগে এক সাথে মাঠে খেলা করতাম, এক সাথে নদীতে গোসল করতাম, বাজারে যেতাম, মাছ ধরতাম। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চলে যেতাম, রাত হলে কখনো স্কুলের মাঠেই জ্যোৎস্না রাতে আমরা অনেকে মিলে গান গাইতাম, বজলুই ছিলো প্রধান ভোকালিষ্ট। ওর একটা জাপানিজ গিটার ছিলো, একটা সিন্থেসাইজার ছিলো, জাপান থেকে এনেছিলো। কখনো কখনো এমন হয়েছে যে, আমিই ওদের বাড়িতে থেকে যেতাম ঘুমানোর জন্য। একটা ভীষন মিষ্টি সময় কেটেছে।
বজলু বল্লো- আমি আগামি কয়েকদিন পর তোর অফিসে আসবো। চুটিয়ে গল্প করবো। তোর সাথে খাবো। সারাদিন থাকবো আমি তোর অফিসে। এনামুল, ওয়ালী, মুসা সবাইকে নিয়ে আসবো। সেদিন আমরা সবাই তোর অফিসেই খাবো। খুব ভালো লাগলো ওর কথায়। আমি এখন বড় একটা ব্যবসায়ী, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, আমার কোনো তাড়া নাই, কোনো চাপ নাই। ভালই হবে ওরা এলে। কিন্তু বজলু কোনো তারিখ দেয় নাই কবে আসবে।
বজলুর সাথে কথা বলার পর আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, বজলু আমার অফিসে আসবে কিন্তু কবে কিংবা কখন সেটা আমার মাথাতেই ছিলো না। মনে হয়েছিলো, আসবেই তো। আমি তো অফিসে প্রতিদিনই আসি। আর আমার গ্রাম কিংবা ওরা যেখানে থাকে সেখান থেকে আমার অফিসে আসতে লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। ওরা যে কোনো সময় নিজের সময়ে এলেই আমাকে পাবে।
এমনি এক অবস্থায় আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আমাকে কথায় কথায় ফোনে জানালো যে, বজলু নাকি অসুস্থ্য। হাসপাতালে ভর্তি। ছোট খাটো ব্যাপার মনে করতে আমিও আর ওকে দেখতে যাইনি। ভেবেছিলাম, কয়দিন পর তো দেখাই হবে। তখন জেনে নেবো ওর কি হয়েছিলো। কিন্তু তার ৩/৪ দিন পর আমার কাছে এমন একটা ব্রেকিং এবং হার্ট টাচিং নিউজ এলো যা আমি কল্পনাও করতে পারি নাই। বজলু নাকি মারা গেছে।
এই সংবাদটা আমাকে এতোটাই মর্মাহত করেছিলো যে, কেউ যেনো আমার দরজার একদম কাছে এসেও আমার সাথে দেখা করতে পারলো না। অথবা এমন একটা পীড়া যা আমাকে এমনভাবে নাড়া দিলো যা কিনা আমার নজরেই ছিলো না। বজলুকে আমি যেমন ভালোবাসতাম, তেমনি বজলু সর্বদা আমাকে মনে রাখতো। বন্ধুরা কেনো জানি ধিরে ধীরে সব হারিয়ে যাচ্ছে।