০২/০৮/২০০৩- জর্জিয়ার টিবলিসিতে ভ্রমন

Categories

গতকাল ২০ দিনের ছুটিতে টিবলিসিতে এসেছি। টিবলিসি শব্দের অর্থ গরম জল। কেনো এই নাম দেয়া সেটা জানা গেলো সোরেনার কাছ থেকে। এখানে প্রচুর সালফিউরিক স্প্রিং আছে। আর এই সালফিউরিক স্প্রিং গুলির কারনে সারা বছরই এলাকাটা গরম থাকে। এই সালফিউরিক স্প্রিং এর কারনেই আসলে টিবলিসির নামকরন। যাই হোক, আমি এখানে কোনো হোটেলে উঠি নাই। যদিও প্রচুর হোটেল আছে।

সোরেনা আমাদের সেক্টরের একজন দোভাষী। ওর সাথে আমার অন্যান্য দোভাষীদের থেকে একটু আলাদা সম্পর্ক। খুবই ভালো একটা মেয়ে। আমি যখন সোরেনাকে বললাম, যে, আমি টিবলিসিতে বেড়াতে যাবো, তখন সোরেনাই আমাকে প্রপোজাল দিলো যে, তার এক খালার বাসা আছে টিবলিসিতে। যদি আমি কিছু মনে না করি, তাহলে আমি ওদের খালার বাসায় থাকতে পারি। রাশিয়ান মানুষেরা খুবই অতিথি পরায়ন। আমি রাজী হলাম। কিন্তু সোরেনা আমার সাথে যেতে পারবে না, ওর ছুটি নাই। ফলে আমাকেই একা যেতে হবে ওর খালার বাসায়। অনেকদিন পর্যন্ত জর্জিয়ায় আছি, ফলে আমি মানুষগুলির স্বভাব, আচরন, ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ জানা আমার। আমার যে কোনো অসুবিধা হবে না, এ ব্যাপারে আমি মূটামুটি নিশ্চিত ছিলাম।

ফলে, টিবলিসি যেতে প্রথমে আমাকে আমার কর্ম ক্ষেত্র গালী সেক্টর থেকে জুগদিদি সেক্টরে আসতে হয়েছে। জুগদিদিতে আমাদের ইউ এন এর জন্য নির্ধারিত এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের নিজস্ব ফ্লাইট দিয়ে সরাসরি টিবলিসিতে এসেছি। আমাদের নিজস্ব প্লেনে আসা যাওয়ায় কনো ভাড়া লাগে না। প্রায় আড়াই ঘন্টা ফ্লাইট। ছোট আন্তোনোভ প্লেন। মাত্র ৪ জন পেসেঞ্জার আমরা। নেমে গেলাম টিবলিসি এয়ারপোর্টে।

সোরেনা আগে থেকেই আমাকে একটা গাইড লাইন দিয়ে রেখেছিলো, কিভাবে টিবলিসি এয়ারপোর্টে নেমে কোনো কোন ইমিগ্রেশন পয়েন্ট দিয়ে বেরিয়ে কোথায় যেতে হবে। এটাও গাইড লাইনে ছিলো যে, এয়ারপোর্টের বাইরে একজন মেয়ে থাকবে আমার জন্য, যাদের বাসায় আমি উঠবো। মেয়েটির নাম দেদুনা বুকিয়া।

আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমার জন্য অপেক্ষারত মেয়েটির সন্ধান করছিলাম। একটা প্লেকার্ড থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সম্ভবত প্লেকার্ডের ধারনাটা ওর নাই। আর আমি মেয়েটাকে চিনিও না। জর্জিয়ার সব মেয়েরাই সুন্দর আর সবাই দেখতে প্রায় একই রকমের। ভাবলাম, আমি তো আর জর্জিয়ানদের মতো নই। ফলে হয়তো মেয়েটা আমাকে দেখলে বুঝতে পারবে।

ঠিক এই সময় ২২/২৩ বয়সের একটি চমৎকার নীল নয়না যুবতী মেয়ে সেন্ডু একটা গেঞ্জি পড়ে আমার সামনে এসে বল্লো, তুমি কি মেজর আখতার?

বুঝলাম, এটাই সেই মেয়ে যার জন্য আমি অপেক্ষা করছি।

আমি হেসে দিয়ে বললাম, হ্যা, আমিই মেজর আখতার। তোমার নাম কি?

সে উত্তরে বলল, তার নাম দেদুনা বুকিয়া। সোরেনার খালাতো বোন।

মেয়েটি অসম্ভব সুন্দুরী, কোকড়ানো চুল, আর তার চোখ সত্যি সত্যিই একদম নীল রঙ এর।

বললাম, চলো।

দেদুনা একতা ট্যাক্সি ভারা করলো, কি যেনো বল্লো, তারপর আমি আর দেদুনা একসাথে ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। দেদুনা বল্লো, ওখান থেকে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিটের পথ। একটা পাহাড়ি বা মাল্ভুমিতে ওদের বাসা। ওটা একটা সরকারী কন্ডোমুনিয়াম, থাকতে খারাপ লাগবে না।

কথা হচ্ছিলো দেদুনার সাথে। সুন্দর ইংরেজী বলে। সে আসলে একজন সাংবাদিক। অবিবাহিত।

বললাম, দেদুনা, তোমার চোখের দিকে তাকালেই তো ট্যাক্সী ভারা মাফ হয়ে যাবার কথা। কারন লন্ডনে যাদের চোখের রঙ নীল, তাদের জন্য সবকিছু মাফ। কারন তারা মনে করে, ওরা রয়েল ফ্যামিলির সদস্য। এভাবেই ওর সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বিনিময়ের পর, একটা মালভুমির মতো এলাকায় গাড়ি ঢোকে গেলো।

জর্জিয়ার সব গুলি বাড়ি প্রায় একই রকম। রাশিয়ার ধাচেই করা। জায়গাতা আমার ভালো লাগলো। এতা একতা সরকারী কোয়ার্তার। দেদুনার মা একটা সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের কনো একটা ডিপার্ট্মেন্টে রেডিওলোজিষ্টের কাজ করেন। অত্যান্ত অমায়িক মহিলা।

বাসায় ঢোকেই দেখলাম, আমার জন্য একতা আলাদা রুম দেয়া হয়েছে। আমার রুমের পাশেই বড় হাইওয়ে রাস্তা দেখা যায়। আমার রুম থেকে বের হলেই দেদুনাদের ড্রইং রুম, সেখানে ২০ ইঞ্চির একতা টিভি আছে, সোফাসেট আছে। সরকারী কোয়ার্তার সব সময়ই বড় সাইজের হয়। আমার পাশেই একটা কমন টয়লেট, তারপাশে থাকে দেদুনা আর ওর আরো দুইবোন, তামারা আর সালোমি। তামারা বড় আর সালোমী ছোট। আমি তো প্রথমে সালোমীকে দেখে বুঝতেই পারি নাই যে, ও ছেলে না মেয়ে। কারন ছোট ছোত চুল, গড়ন দেখে মেয়েলী বুঝা যায় না। সবাই খুব মিশুক। সোরেনা আগে থেকেই সম্ভবত ওদের বলে রেখেছিলো আমার খাবারের অভ্যাস গুলি কি। তাই আমি যখন বাসায় পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছিলো। ওরা বেগুন আর ভাত পাক করেছিলো। বাংলাদেশের মতো তো আর খাবার হবে না, কিন্তু খেতে পারলাম।

রাশিয়া বা জর্জিয়ার একটা কথা আগেই বলেছিলাম যে, এরা যে কোনো অতিথিকে "চা চা" নামের এক প্রকার এল্কোহল দিয়ে আপ্যায়ন করে। আমরা যেমন কেউ এলেই চা দেই বা কফি দেই, ওরা দেয় "চা চা" প্রায় ৭৫% এল্কোহল। নিজেরাই বানায়।

আমি ওদের সাথে প্রায় কয়েকদিন থাকার যেহেতু প্ল্যান করেছি, ফলে আমিও চাইছিলাম যে, আমি ওদের মতো করে একেবারে মিশে যাবো। দেদুনাকে বললাম, দেদুনা, একটা সিডিউল করো, আমরা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাবো, ঘরে থাকবো শুধু রাতের বেলায়। ওরা অনেক ভ্রমন পিয়াসু, খুব পছন্দ করলো। প্রথম দিন আমরা টিবলিসির একটা "ঈগল" রেষ্টুরেন্টে সবাই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে গেলাম। আন্টি গেলেন না। এখানে আমাদের সাথে আরো একজন সাথী জয়েন করেছিলো, সেও দেদুনার খালাতো বোন, নাম রুসুদিন। সে ডাক্তার। কারোরই বিয়ে হয় নাই।

আমরা যেখানেই যাই দল বেধে এই কয়জন যাই। খেতে গেলেও এক সাথে, ঘুরতে গেলেও এক সাথে, গল্প করলেও এক সাথে। অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম।

পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাংগলো। দেখলাম, এতো ভোরে ঘুম ভাংগ্লেও সবাই জেগে গেছে। আমি জাগার পর দেদুনা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, নাস্তা খাবো কি খাবার। বললাম, তোমরা যা খাও আমিও সেটাই খাবো। দেদুনা বল্লো, আমরা তো পাউরুটি খাবো।

ওরা একটা পিপায় পাউরুটি রাখে, সাথে একতা ছোট কুড়াল। কারন পাউরুটি গুলি প্রিজার্ভেশনের নিমিত্তে এমন করে বানানো হয় যে, পাউরুটির উপরিভাগ অনেক শক্ত রাখে যা সাধারন হাতে ছিড়া যায় না, একটা ছোট কুড়াল লাগে। যেই পাউরুটির উপরিভাগ কেটে ফেলা হয়, ভিতরের পাউরুটি একদম ফ্রেস থাকে এবং নরম।

দেদুনাকে বললাম, ডিম ভাজি করতে পারো? বল্লো, হ্যা পারি তো।

আমি দেদুনার সাথে রান্না ঘরে গেলাম, দেখলাম কিভাবে ওরা ডিম ভাজে। খুব মজার একটা জিনিষ শুখলাম। ওরা তেল খায় না। প্রায় খায় না বললেই চলে। তাহলে ডিম ভাজে কিভাবে? ওরা যে কাজতা করে, করাইয়ের মধ্যে একটু দুধ দিয়ে দেয় যেটা তেলের কাজ করে। এই দুধের করাইতে ওরা ডিম ভাজে। ব্যাপারটা খারাপ না।

এভাবেই দুইদিন কেটে গেলো।

আমি ভাবলাম, পরোটা খেতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু ওরা পরোটা কি তাইই জানে না। আমি বিকালে কিছু ময়দা নিয়ে এলাম, সাথে সোয়াবিন তেল। আমিই সকালে দেদুনাকে নিয়ে আর সালোমিকে নিয়ে ময়দা ছানলাম, তেল দিয়ে করাই গরম করলাম, তারপর কোনো রকমে বিচ্ছিরী সেপের একটা পরোতা বানালাম। কারন পরোতা বানানোর কোনো বেলুনি ছিলো না। যখন আমি তেলের ভেজে পরোটা বানালাম, ওরা ব্যাপারটা খেয়ে খুবই মজা পেলো। শুরু হয়ে গেল পড়োটার নাস্তা প্রতিদিন। এই সময়ে আমার মাথায় একতা বুদ্ধি এলো, আর বুদ্ধিতা হচ্ছে, আমি যদি কিছু বাংলাদেশী খাবার বানাই, তাহলে ওরা হয়তো পছন্দ করতেও পারে। আমি রান্না জানি না, কিন্তু যেহেতু এতো বছর ধরে বাংলাদেশী খাবার খাচ্ছি, ফলে একতা ধারনা তো আছেই।

পরদিন বললাম, তোমরা কি খিচুড়ি খেতে পছন্দ করো? খিচুড়ি কি, সেটা তো ওরা জানে না। কিন্তু এবার ওরা ভাবছে, পরোটা খেয়ে যেহেতু ওরা খুব মজা পাচ্ছে, খিচুড়ি নিশ্চয় আরো কোনো ভাল খাবার হতে পারে। ভাবলাম, খিচুড়িতে কিছু গরুর মাংশ দিলে মন্দ হয় না। কিনে আনলাম কিছু গরুর মাংশ। আমি মুটামুটি তেল আর কিছু মসল্লা (আমি সাথে করে কিছু মসল্লা নিয়ে এসেছিলাম) মেখে মাংশটা কসিয়ে নিয়ে নরম করে তরকারীর মতো করে ফেললাম। তারপর খিচুড়ি পাক করা তো কোনো ব্যাপার না। একটু ঝাল হয়ে গিয়েছিলো। সবাই খেয়ে আরো মজা পেলো কিন্তু ঝালের ব্যাপারটা ওরাই বুঝে নিলো কতটুকু ঝাল দেয়া দরকার।

দেদুনাদের বাসায় আমার খাবার নিয়ে কোনো প্রকারের আর ঝামেলা রইলো না।

আমি প্রতিদিন সবাইকে নিয়ে কখনো পার্কে, কখনো রেষ্টুরেন্টে, কখনো কোনো ঐতিহাসিক স্পটে আবার কখন মার্কেটে, আবার কখনো বীচে যাই। বিকিনী পরা আমার এই বন্ধু গুলিকে আমি কখনো অশ্লীল চোখে দেখার মনোভাব খুজে পাই নাই। এমনো হয়েছে, গলায় গলায় ধরে, আমরা হেটে গিয়েছি, বীচে শুয়েছি, খেলা করেছি। অদ্ভুদ সময়টা কেটেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি এখানে একজন অতিথি।

৫/৬ দিন পর সোরেনা এলো। আরো ভালো সময় কাটলো।

যেদিন আমি চলে আসবো, ওরা আমাকে কাদিয়েছিলো বিরহে। একটা গাড়ি নিয়ে সেই টিবলিসি থেকে সরাসরি আমি যুগদিদিতে এসেছিলাম। কিন্তু আমি সরাসরি আমার বাসায় এলাম না। দেদুনা যুগদিদিতে ওর এক খালার বাসায় আমাকে নিয়ে গেলো। প্রথমে বুঝতে পারি নি ওরা যে এতো গরীব। ওরা আসলে কাউকেই বুঝতে দেয় না ওদের আর্থিক অবস্থার কথা। আমি আর ওর খালু এক রুমে থাকলাম, দেদুনা আর ওর অন্যান্য সব বোনেরা থাকলো আরেক রুমে। রাতে সবার সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম। খুব মজা হলো। পরেরদিন সকাল ১০ তাঁর দিকে আমি আমার ২০ নম্বর বাংলাদেশী বাসায় যুগদিদিতে চলে এলাম। সবার কথা আজো আমার খুব মনে পড়ে।