Categories
“সময়” এমন একটি জিনিষ যে এটি প্রতিটি মানুষ, বস্তু, এবং প্রতিটি ইভেন্টের সঙ্গে প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে সে জড়িত, কিন্তু সে কারোরই বন্ধু নয়। সে টিক টিক করে সবার সঙ্গে বয়ে বেড়ায় কিন্তু সে কারো সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে তোলেনা। সে সবার সঙ্গে আছে আবার অন্যদিকে সে কারো সঙ্গেই নাই। সে যেমন কারো জন্যই অপেক্ষা করে না, আবার কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে বলে সে তড়িঘড়িও করে সামনে এগিয়ে আসেনা। বাজারের পন্যের মতো তাকে কোথাও কম বা বেশী দরে কিনে যেমন সঞ্চয় করা যায় না, তেমনি, অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের কারনে সেই অপচয় করা “সময়”টি আর ফিরেও পাওয়া যায়না। সময়ের কোন বিকল্প নাই। কারো কাছ থেকে ধার করেও এই “সময়” নামক জিনিষটি কখনো পাওয়াও যায়না। এটা এমন এক জিনিষ যে, কেউ তার নিজের তহবিল থেকে ধারও দিতে পারে না। তার গতি সর্বদা সামনের দিকে, কারো জন্যই সে পিছনে ফিরে আসেনা। আজকের সূর্যাস্ত যদি আপনি না দেখে থাকেন, আর কখনোই আজকের চলে যাওয়া সূর্যাস্ত আপনি আর দেখতে পাবেন না। আপনি হয়ত কোনো একটি “সময়ের” ফ্রেম ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখতে পারবেন, কিন্তু ওই সময়ের ওইপরিবেশ, ওই আমেজ, ওই আস্বাদন, ওই অনুভুতি সেটা আপনি কখনোই ফিরে পাবেননা। এটা যেনো সেই জলবিন্দু মতো, যে একবার কোন একস্থান বয়ে সামনে চলে গেছে, সে আর দ্বিতীয়বার ওই স্থানে ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই, আর আসেও না। Same drop of water never passes twice through a same bridge.
সময় এমন একটা জিনিষ, যাকে সর্ব পরিস্থিতির মহৌষধও বলা যায়। যার ফলে ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে, Time is the panacea of all situations. কেউ কেউ আবার একে অন্যভাবেও বলে যে, Time is the panacea of all diseases. কথাটা সত্য। যেমন ধরুন, আজকে অতি আদরের কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার কারনে মাঝে মাঝে কারো কাছে মনে হবে, সব বুঝি শেষ। দুঃখের আর শেষ নাই, কিংবা কারো এই অসময়ের প্রস্থানে অনেকেই ভেঙ্গে পড়েন, অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিংবা এমন হয় যে, আজকে যে অশান্তি পরিবেশ মানুষকে কাবু করে ফেলেছে, হয়ত সময়ের অবগাহনে সে আবার সব ভুলে, সব কিছু আবার নতুন করে ধীরে ধিরে সাজিয়ে তোলেছে। সময়ের ব্যবধানে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ, শান্ত হয়ে আসে জীবনের অনেক কিছুই। এই “সময়”ই মানুষকে সাবলম্বি করে তোলে, আরোগ্য করে তোলে। “সময়ের” স্রোতে মানুষ আবার ঠিক হয়ে যায়। ক্ষন যায়, দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, মানুষ “সময়ের” স্রোতে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে। হারিয়ে যাওয়া বেদনার কথা ভুলে যায়, ব্যথার কথা ভুলে যায়, চোখের জল মুছে যায়। আর এজন্যই হয়ত বলা হয় “সময়” মানুষকে বদলে দেয়।
“সময়” মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। একই সমস্যা, একই ব্যক্তি, বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাধান করেন। আর এর কারন একটাই, আর সেটা হচ্ছে, “অভিজ্ঞতা”। যে সমস্যাটা আজ আপনি একভাবে সমাধান করেছেন, সেই একই সমস্যা আগামিকাল একই পদ্ধতিতে আপনি সমাধান নাও করতে পারেন। অথবা সময়ের ব্যবধানে অভিজ্ঞতার কারনে আপনি নিজেও হয়ত সেই একই সমস্যা ওই একই পদ্ধতিতে সমাধান করতে চাইবেন না। আর এটাই হচ্ছে পরিপক্কতার লক্ষন।
“সময়” সবকিছু পালটে দেয়। পালটে দেয় পরিস্থিতি, পালটে দেয় মানসিকতা, পালটে দেয় ব্যবহার, অভ্যাস। এমনকি পালটে দেয় মানুষের পছন্দ, অপছন্দ, এমনকি পালটে দেয় সম্পর্ক পর্যন্ত। আজ আপনি যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, হোক সেটা সুখের বা কষ্টের, সময়ের ব্যবধানে সেটা পালটে যেতে পারে। আজ আপনার যে মানসিকতা, “সময়ের” ব্যবধানে আপনার মানসিকতা পুরুটাই পালটে যেতে পারে। যে বয়সে আপনি অনেক দুরন্তপনা করেছেন, কিংবা যে “সময়ে” আপনি আবেগের বশে অনেক কঠিন কঠিন শপথ করে কালবৈশাখী ঝড় মাথায় নিয়ে একা সাহস করে অনেক কিছু মোকাবেলা করেছেন, জীবনের কোনো এক সময়ে এসে মনে হবে, হয়ত সেটা করাই ঠিক হয় নাই, আবার মনে হতে পারে আজ এই বয়সে ওই একই পরিস্থিতিতে আপনি ওই রকম কোনো কিছুই হয়ত করবেননা। হয়ত আপনিই উপদেশ দিবেন, ধৈর্য ধরতে। কারন, আপনি এখন জানেন, আবেগের বশে অনেক কিছু করা যেতে পারে বটে কিন্তু সবশেষে যা অপেক্ষা করছে তার পরিনতি ঠিক যা আশা করছেন তা হয় নাই বা হয়না। তাই উপদেশ হবে হয়ত “ধৈর্য” ধরুন। আর একেই বলে “অভিজ্ঞতা”। অভিজ্ঞতার সঙ্গে “সময়” একটা যোজন। “সময়” যত পেরুবে, অভিজ্ঞতা তত ভারি হবে। আর অভিজ্ঞতা যত ভারি হবে, আপনি তত শান্ত হয়ে যাবেন। বয়স্ক সবচেয়ে বোকামানুষটিও অল্পবয়সের কোন তথা কথিত চালাক মানুষের থেকে বেশি অভিজ্ঞ। আর তার এই অভিজ্ঞতার কারনে এই বোকামানুষটিও ওই অল্প বয়স্ক মানুষটির থেকে ঢের বেশি জ্ঞ্যান রাখেন। এটা অনেকেই হয়ত মানবেন না কিন্তু এটাই সত্য কথা।
“সময়ের” ব্যবধানে বন্ধু পর্যন্ত পালটে যায়। কখনো কখনো বন্ধু পালটে শত্রু হয়ে যায়, আবার “সময়ের” প্রেক্ষাপটে বাব্যবধানে শত্রু একদিন মিত্র হয়ে যায়। আজ যাকে আপনি আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে মনে করছেন, হয়ত “সময়ের” ব্যবধানে কাল সে আপনার অনেক দুরের বলে মনে হবে। কিংবা আজ যাকে আপনি সবচেয়ে দুরের কাউকে মনে করছেন, “সময়ের” ব্যবধানে হয়ত সেইই আবার সবচেয়ে কাছে মানুষদের মধ্যে একজন বনে যেতে পারে। আর এটাই বাস্তবতা। তাই আজকের “সময়”টাই শেষ কথা নয়। অপসন খোলা রাখুন যেন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রুকে মিত্র, আর মিত্র থেকে সতর্ক থাকার ক্ষেত্র খোলা থাকে। আজ যে আপনার কষ্টে আপাতদৃষ্টিতে বুক ভাসিয়ে চোখের জল ফেলছে, কাল হয়ত এই চরিত্রটিই আপনার সর্বনাশের জাল বুনছে। আজ যাকে আপনি হৃদয়ের সবটুকু অবিশ্বাস দিয়ে যোজন মাইল দূরে সরিয়ে রাখতে সাচ্ছন্দ বোধ করছেন, হয়ত আগামীকাল মনে হবে, তার কোনো বিকল্পই নাই।
“সময়” বড্ড বেরশিক জিনিষ। সে কাউকে আপন মনে করে না, সে কাউকে পরও মনে করেনা। আসলে “সময়” কারো সঙ্গেই তার সম্পর্ক রাখেনা। সে একা, সবাই তার সঙ্গেই চলার চেষ্টা করে। যে পিছিয়ে যায়, সে পিছিয়েই থাকে, আর যে তার সঙ্গে চলতে চায়, “সময়” তার সঙ্গেই কাধে কাধ মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। আপনি আজ হেরে গেছেন? এমনও হতে পারে আগামি কাল আবার আপনি জিতে যাবেন। শুধু “সময়ের” ব্যবধান। “আজ” আর “আগামিকাল”। “সময়ের” ব্যবধানে একদিন হেরেছেন আর আরেকদিন জিতে গেছেন।
আজ থেকে শত বছর আগেও এটাই ঘটেছে, আজো এটাই ঘটছে, এবং আগামি শতকের পর শতক অবধিতাই ঘটবে। এটাই সময়ের নিতি। সে কখনই তার নিতি পরিবর্তন করেনা। সে শুধু তার চারিপাশে যারা আছে, শুধু তাদের পরিবর্তন করে দিয়ে চলে যায়।
“সময়” দুর্বলকে সবল করে, সবলকে দুর্বল করে, শক্তিশালীকে পরাভূত করে, নিষ্পেষিতকে শাসক বানায়। “সময়” এমন এক জিনিষ যে, সে গরীবকে ধনী বানায়, ধনীকে গরীবের কাতারে দাড় করিয়ে দেয়। “সময়’ এমন এক অপ্রতিরোধ্য জিনিষ যে, সে ভালোবাসাকে ঘৃণার স্তরে নিয়ে আসতে পারে, আবার ঘৃণার স্তর থেকে ভালোবাসায় পরিবর্তন করাতে পারে। “সময়” কচি খোকাকে পুরুষে পরিনত করে, ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়েকে জটিল সংসারের হাল ধরতে শিখায়। “সময়” মানুষের সব কিছু পালটে দিয়ে এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে দাড়া করাতে পারে যেখান থেকে বের হয়ে আসার মতো কোন পথও খোলা না রাখতে পারে। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি অন্যের পরিস্থিতি উপভোগ করছেন, হয়ত আগামিকাল ঠিক সেখানে দাড়িয়েই অন্য একজন আপনার পরিস্থিতি উপভোগ করবে। “সময়” কখন কার সঙ্গে থাকে, কেউ জানে না।
কোনো একসময় “সময়” চলেছিলো রোমের জন্য, রোম শেষ হয়েছে। তারপর “সময়” চলেছে স্পেনের জন্য, স্পেন শেষ হয়েছে। তারপর “সময়” চলেছে রাশিয়ার জন্য। এখন “সময়” চলছে আমেরিকার জন্য। হয়ত একদিন, এই “সময়”টাও শেষ হয়ে যাবে, হয়ত অন্য কারো জন্য সে আবার চলবে।