অনেক অনেক দিন পার হয়ে গেলো। না আমি আর তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেছি, না তুমি। জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে এমনভাবে কোনো এক চক্রএর মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ায় সেটা বুঝা খুব সহজ না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন মানেই কি পিছলে পড়া পথে হাটু গেড়ে বসে পড়া? নাকি সেই পিচ্ছিল পথ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে পতিত হয়ে আবার সেখান থেকে নতুন করে বেড়ে উঠা? হয়তো দুটুই ঠিক। কেউ পাহাড়ের চূড়ায় উথে নামার ভয়ে হাহাকার করে, আবার কেউ পাহাড়ে উঠতে না পেড়ে হাহাকার করে। কেউ কারো অবস্থানে সুখী নয়।
যাই হোক, এসব কথা আর না বলি। তবে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি এখনো খুব সহজে সব কিছু ভুলে যাও? কিংবা হাতের কাছে তোমার দরকারী কাগজটি না থাকলে কোথায় রেখেছো সেটার জন্য আমার নাম ধরে চেচামেচি করো? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। তখন হয়তো এরকমের চেচামেচি ভালো লাগতো না, কিন্তু আজকে মনে হয় তোমার সেই চেচামেচিকে আমি খুব মিস করি। মনে হয় খুজে খুজে তোমার ঠিকানাটা বের করে আরো একবার যদি তোমার সেই কন্ঠসরটা শুনতে পেতাম!! কিছু একটা খোজার বাহানা করে আমি সারাক্ষন মাঝে মাঝে আসলে হয়তো এখনো তোমাকেই এই আজব পৃথিবীর মানুষগুলির মধ্যে খুজি। আমি জানি না হটাত কখনো যদি তোমার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে যায়, তখন আমি কি করবো। জড়িয়ে ধরবো? নাকি এড়িয়ে যাবো? নাকি দূর থেকে তোমার চলে যাওয়া দেখবো। আমি জানি, তুমি আমাকে ভুলে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু আমার জগতে তুমিই ছিলে একমাত্র মানুষ যাকে আমি কখনো ভুলতে চাই নি। আমি তোমাকে পাইনি বটে কিংবা তুমি আমাকে ছেড়েছো বটে কিন্তু পেরেছো কি? আমি পারিনি।
বৃষ্টি ভেজা রাতে নীরবে যখন আমি আমার বারান্দায় বসে অতীতের ভালো লাগা কোনো একটা গানের কলি শুনি, আমাকে নিয়ে যায় সেই রাতে যখন আমি তোমার হাতে হাত রেখে উচ্ছল ধরনীর শীতল মাটিতে নেচে বেড়াতাম। আমার ভেজা চুল বেয়ে বেয়ে জোনাকীর মতো পানির ফোটা ঝরে পড়তো, আর তুমি সেটা চিপে চিপে ধরে বলতে –আহা, কি সুন্দর, যেনো মুক্তার মত। তোমার ছাদের কোনায় কি এখনো অই ছোট জবা ফুলের গাছটা আছে? আমি লাগিয়েছিলাম। তুমি কাটাজাতীয় ফুল পছন্দ করো না জেনেও আমি গাছটা লাগিয়েছিলাম। কতদিন জবা ফুল তুলতে গিয়ে হাতে কাটা বিধেছিলো আর তুমি বারবার আমার হাতে মলম লাগিয়ে বলতে কেনো কাটা গাছটাই রাখতে হবে ছাদে? অথচ তুমি গাছটা নিজেও কখনো কেটে ফেলোনি, বরং প্রতিদিন এর গোড়ায় পানি দিতে। কি আজব না? তোমার অপছন্দের একটা গাছ, তুমি কেটে দিলে না, পানি দাও, এটাকে বড় করো, যত্ন করো, অথচ তাকে তুমি পছন্দ করো না। আমাকে তুমি পছন্দ করতে, আদর করতে, আমার কষ্টে তোমার কষ্ট হতো, আমার আনন্দে তুমি আনন্দিত হতে, অথচ তুমি আমাকে চিরতরে কেটে দিলে। কাটতে পেরেছো? ওই জবা ফুলের গাছটার কাছে গেলে তোমার মন উদাসীন হয়ে উঠে না? হয়তো গাছটা আর নাই, অথবা আছেও। আমি তো আর জবা গাছ নই। আমার ভাষা ছিলো, অনুভুতি ছিলো, সব ছিলো, তাতেও তো আমি তোমাকে আমার ভিতরের অনুভুতি দিয়ে বুঝাতে পারিনি, কি ছিলে তুমি আমার। আর সেটা তো একটা ভাষাহীন জবা গাছ। সে তো তোমার কিছুই ছিলো না। আছে গাছটা? তাড়িয়ে দাও নি তো?
মাঝে মাঝে আমার খুব তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। কেনো দেখতে ইচ্ছে করে, সেই সঠিক উত্তর আমার জানা নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, চিৎকার করে হাউমাউ করে কাদি। যদিও জানি, আজকালকের মানুষগুলির আবেগ, অনুভুতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এখন মানুষেরা আর হাউমাউ করে কাদে না, মানুষ কি ভাববে বলে। প্রান খুলে হাসে না, লোকে বোকা ভাববে বলে। এই চাপা হাসি আর বোবা কান্না মানুষ গুলি এতো অসহায়। তাই মানুষগুলি একা একাই বেচে থাকার মধ্যে প্রান খুজে বেড়ায়। আসলে আমরা সবাই একাই। এই একা জীবনে আড্ডা দেয়া যায়, গল্প করা যায়, কিন্তু সে পর্যন্তই। এর মানে যে, নিঃসঙ্গতা যে কাজ করে না এমন নয়। এই নিঃসঙ্গ জীবনের ও একটা মাধুর্যতা আছে। সেখানে আমিই সব। এর মানে এই নয় যে, আমি রক্তমাংশে গড়া কোনো আপনজনের অভাব অনুভব করিনা।
আমি এখনো মাঝে মাঝে ভাবি- আমি কি অন্য দশজন মেয়ের মতো জীবন সংগী বেছে নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারতাম না? হয়তো পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। কারন আমরা আমাদের জীবনসংগী বাছাই করি কথা শোনার জন্য, কথা বলার জন্য, যার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে, যার কথা শুনলে বছরের পর বছর সুখে দিন পার করা যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, মাঝে মাঝে আমরা জীবনসাথী বাছাই করি তার রুপ, তার সউন্দর্য, তার অর্থবৈভব, তার সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে এটা ভুলেই যাই, সেই জীবনসাথী যাকে আমরা বাছাই করলাম, তার সাথে কারনে অকারনে, সময়ে অসময়ে আমার মনের কথাগুলি তাকে বলতে পারবো কিনা কিংবা সে আমার সেই সব ছোট ছোট অনুভুতি গুলির মুল্যায়ন করবে কিনা। যদি এর কোনো পরিবর্তন হয়, আর ঠিক তখন দেখা যায় যে, আমার বাছাই করা সাথী আমার কথাগুলি শুনতেই তার বিরক্ত লাগছে, কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যাচ্ছে, আর তখন সম্পর্কগুলিতে মরচে ধরা শুরু করে। এটা একটা অনিশ্চিত পরীক্ষা। যাকে চিনিনা, যাকে কখনো অন্তরে রাখিনি, যে আমাকে জীবনের ৩০ বছর কোথাও জায়গা দেয় নি, হটাত করে তার সেই অন্দর মহলে আমি ঢোকে কতটা স্থান দখল করতে পারবো? সেখানে তো আরো হাজার হাজার ভাবনা, হাজার হাজার বিক্ষিপ্ত অনুভুতি, কিংবা অনেকের বসবাস রয়েছে। আমি কি হটাত করে এসেই তার সেই সব ভাবনা, অনুভুতি, আর অন্য মানুষদের পদরেখা ধুয়ে মুছে আমার নিজের করে দখল নিতে পারবো? হয়তো এটা কখনোই সম্ভব না। তাই আর আমার কোথাও যাওয়াওই হলো না।
একটা জিনিষ জানো? লেখকের কোনো লেখা পড়ে যতোটা পাঠক মুগ্ধ হয়, তার থেকে বেশী মুগ্ধ হয় পাঠক যখন তার সাথে সামনে বসে কথা বলে।