তাইওয়ানে পেলোসির ভিজিটে চীনের এতো হুমকী ধামকীর কোনো প্রকার বহির্প্রকাশ আদতে দেখা যায় নাই। অবাক শুধু সারা বিশ্বই হয়নি, পেলোসি এবং আমেরিকাও অবাক হয়েছে। এটা কি হলো?
তবে আমার কাছে দুটু জিনিষ একেবারেই ক্লিয়ার ছিলো-(ক) পেলোসি তাইওয়ানে যাবেই (২) চীন কিছুই করবে না যা তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হয়। বিশেষ করে তাইওয়ানে আক্রমন বা পেলোসির বিমানে হামলা কিংবা পেলোসির উপরেই হামলা। এই প্রসঙ্গে আমি ফেসবুকেও ব্যাপারটা শেয়ার করেছিলাম। সেটাই আসলে হয়েছে। তাহলে ব্যাপারটার রহস্য কি হতে পারে?
তাইওয়ানিজরাও চায়নিজ। ভাষা এক, কালচার এক, হেরিডিটিও এক। ঠিক রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের জনগনের যে অবস্থা। মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বা যারা সত্যটাকে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন, তাদের কাছেই বেশীরভাগ শোনা যাবে যে, ইউক্রেনের অধিকাংশ জনগন রাশিয়াকে ঘৃণা করে, রাশিয়াকে তারা চায় না ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ঐ রকমের না। সবদেশেই ভিন্ন মতালম্বীর লোক থাকে, তাদেরকে ইনিয়ে বিনিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে একটা কঠিন সত্যকে মিডিয়াগুলি লুকিয়ে ফেলে তাদের জন্য যারা এসব ব্যাপারে খুব একটা বেশী জানেন না। ফলে বিশ্বব্যাপি একটা আলাদা মনোভাব সৃষ্টি হয়। সোস্যাল মিডিয়ায় না জেনেই বিজ্ঞের মতো মতামত পড়তে থাকে। রাশিয়া প্রথম থেকেই ইউক্রেনের সাধারন জনগনের উপর কোনো আক্রমন করে নাই বা যদিও রাশিয়ার বেশ কিছু অপারেশনের কারনে ইউক্রেনের লোক আহত নিহত হয়েছে সেটা কোলেটারেল ড্যামেজ। ঠিক তেমনি, তাইওয়ানের মধ্যেও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ আছে। কিন্তু বেশীরভাগ তাইওয়ানিজরা কিন্তু নিজেরদের সায়ত্তশাসিততা এবং গ্রেট চীনের অধীনেই ভালো আছে বলে মনে করে। এ কারনে চীন যদি তাইওয়ানের উপর আক্রমন করে বা করতো, তাতে চীনের রেপুটেশন অবশ্যই নষ্ট হতো এবং তাইওয়ানের জনগনের মধ্যে একটা ঘৃণার সৃষ্টি হতো। চীন তাইওয়ানিজদেরকে ব্রাদার মানুষ হিসাবে নিজেদের গোত্রীয়ই গন্য করে। চীন তাই সম্ভবত তাৎক্ষনিক আক্রমনে যেতে চায়নি।
তাছাড়া পেলোসিকে আক্রমন করা বা তার বিমানে হামলা করা মানেই হলো, সরাসরি আমেরিকাকে যুদ্ধে ডেকে আনা, হোক সেটা যারই ভুল বা এরোগ্যান্সি। যুদ্ধটা গতকালই লেগে যেতো। তখন না আমেরিকা, না চীনের কারো হাতে আর কোনো কন্ট্রোল থাকতো। আমেরিকা পেলোসির এই ভিজিটটাকে ইজ্জতের ছাওয়াল হিসাবে ভেবে প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলার, ৮টি US Air Force warplanes, including F-15s, Four US warships, including an aircraft carrier এগুলি দিয়ে পেলোসিকে তাইওয়ানে মাত্র ১৪ ঘন্টার জন্য ভিজিট করিয়েছে। মানে তারা চীন আক্রমন করুক চেয়েছে। ফলে চীন আমেরিকার ফাদে পা দেয়নি। চীন এদিক দিয়ে অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।
তাহলে পেলোসির ভিজিট তাইওয়ান কিংবা পশ্চিমাদের উপর কিংবা চীনের উপরেই কি প্রভাব হতে পারে? এটা একটা লং টার্ম, (হতে পারে অনেক মাস, হতে পারে অনেক বছর) ইফেক্টে যাচ্ছে। আমার ধারনা, চায়নীজদের রিস্পন্সটা পর্যায়ক্রমে আসতে থাকবে। আর সেটা কোনোভাবেই যুদ্ধের রুপ নেবে না। প্রথম ইফেক্টটা হবে-আমেরিকার সাথে চায়নার সম্পর্ক আজীবনের জন্য খারাপ থাকবে এবং প্রতিনিয়ত চায়না তাইওয়ানকে বিভিন্নভাবে চাপের মধ্যে রাখবে যেটা করছে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর।
এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার যে, জাতিসংঘের দ্বারা নির্ধারিত তাইওয়ানের এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন চীনের কন্ট্রোলে। চায়না যে কোনো সময়ে তাইওয়ানের সমস্ত বহির্গত এবং আভ্যন্তরীন বানিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করার ইখতিয়ার রাখে। শুধু তাইই না, তাইওয়ানের সমস্ত নদীপথের একচ্ছত্র কন্ট্রোল্ধারী চীন। যে কোনো সময়ে চীন তাইওয়ানের সমুদ্রপথ ব্লক করার ইখতিয়ার রাখে আর এটা জাতিসংঘের দ্বারাই নির্ধারিত। এর ফল স্বরূপ এই মুহুর্তে চীন বলেছে যে, তাইওয়ানের কোনো পন্য আমদানী করবে না, না সমুদ্রপথে অর্থাৎ এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন দিয়ে তাইওয়ান নির্দিষ্ট কিছু পন্য পরিবহন ছাড়া অন্যান্য পন্য পরিবহন করতেও পারবে না বলে নিষিদ্ধ করেছে। চীন তাইওয়ানের আকাশপথ এবং সম্যদ্র পথে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে।
পেলোসির ভিজিটকে উপলক্ষ করে চায়না এই প্যাসিফিক অঞ্চলে তার পুরু আগের চেহাড়া পালটে ফেলবে। আর সেটা সামরিক উপস্থিতির সাথে সল্প মেয়াদীতে চীন তাইওয়ানের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে দূর্বল করতে থাকবে। যেটা রাশিয়া করছে ইউক্রেনকে। চীন তাইওয়ানের সরকারের প্রতিটি ভুল পদক্ষেপকে মারাত্তক এগ্রেসিভভাবে কাজে লাগাবে। চীন তাইওয়ানের জনগনের উপর কিন্তু ক্ষিপ্ত নয়, ক্ষিপ্ত তাইওয়ানের প্রশাসকদের উপর যারা চীনের না বলা সত্তেও পেলোসির ভিজিটকে সমর্থন করেছে যেখানে হাজার হাজার তাইওয়ানিজরা এই ভিজিটের বিপক্ষে আন্দোলন করেছে। এর সাথে চীন তাইওয়ানের উপর সাইবার এটাকের মাধ্যমে তাদের প্রচুর পরিমানে ক্ষতি করার সম্ভাবনা আছে।
পেলোসির এই ভিজিটের পরিপ্রেক্ষিতে বাইডেন প্রশাসনের রুপরেখা “গার্ডরেইল” আর বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনাই নাই।
৮০র দশকে পশ্চিমারা এই সোভিয়েট ইউনিয়নকে ভেংগেই ইউনিপোলার ক্ষমতাধারী হয়েছিলো। এবার রাশিয়া আর চীন একত্রিত হয়ে পশ্চিমাদেরকে একঘরে করার পায়তারা করে তার ইউনিপোলার ক্ষমতার অবসান যেমন ঘটাতে পারে, তেমনি ক্রমাগত অর্থনৈতিক রিসেসনের কারনে পশ্চিমার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলিও নিজস্ব সাধীনতার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ ভাঙ্গনের সুর। এটা হতে হয়তো কয়েক যুগ লেগে যেতে পারে কিন্তু সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন এখন শুরু হয়েছে গ্রেট ব্রিটেনে আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডে। গ্রেট ব্রিটেনে ক্রমাগত জনগনের দূর্ভোগের কারনে আয়ারল্যান্ড , স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসের ভিতর এই আন্দোলনের সুরে গতকাল ইউকে রাশিয়ার উপর এককভাবে বেশ অনেকগুলি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে, তার মধ্যে একটা শিপিংলাইন এলাউড এবং ইন্সুরেন্স বৈধতা, যাতে রাশিয়া তেল এবং অন্যান্য কমোডিটি ইউকে তে পাঠাতে পারে। খবরটার হেডিং এ রকমের- “London has re-allowed the provision of insurance for aircraft, sea vessels and their components to Russia-linked entities”
আমেরিকার Veteran Intelligence Professionals (এটা সিআইএ এর অবসর প্রাপ্তদের একটা সংঘটন) গত ৩০ জুলাই ২০২২ এ ওপেন একটা চিঠি লিখেছেন (লিংক চাইলে দিতে পারি) বাইডেন প্রশাসনকে যে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা বেজড পলিসিতে যতো না অন্য দেশকে ক্ষতি করছে তার থেকে বেশী ক্ষতি করছে পশ্চিমা এবং তাদের মিত্রদেরকে। ফলে ইতমধ্যে যে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সাথে যুদ্ধ মনোভাব দেখানো মানেই হচ্ছে বর্তমান নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে ফেলা। চীন-রাশিয়া এই সুযোগ অবশ্যই নিবে এবং পেলোসির এই ভিজিট অবশ্যই পশ্চিমাদের এবং তাদের মিত্রদেরকে ক্রমাগত ইউনিপোলার ক্ষমতা থেকে ছিটকে দেবে। তারা আরো বলেছেন যে, আমেরিকার USS Ronald Reagan carrier battle group যা বর্তমানে সাউথ চায়না সমুদের অবস্থান করছে, সেই অঞ্চল পশ্চিমাদের আওতায়ও নয়। বহুদূর। ফলে এই শিপগুলিতে যদি চীন আক্রমন করে এবং একটা শীপ বা ক্রু নিহত হয়, তখন নিউক্লিয়ার যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প কোনো অপশনও নাই। আর সাউথ চায়না সমুদ্র চীনেরই আওতায় বেশী।
এর মানে হলো দুইপক্ষই নিউক্লিয়ার যুদ্ধ এড়াবে ঠিকই কিন্তু চায়নার রেঞ্জের কাছে ক্ষুদ্র ওয়েপনারী দিয়েও তারা ডিটারেন্ট ইফেক্ট করার সক্ষমতা রয়েছে যা পশ্চিমাদের নাই। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, চীন লাইভ এমুনিশন দিয়ে উক্ত সাউথ চায়না সমুদ্রে অনুশীলন করার নামে আমেরিকার শীপসমুহকে উক্ত রেঞ্জের বাইরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। আর সেটা লিখিত ভাবেই।
এবার আরেকটা কথা বলি। ইউক্রেনকে পশ্চিমারা এখন অফিশিয়াল্ভাবেই ডি-প্রাইরাটাইজ ঘোষনা করেছে। তারমানে এবার ইউক্রেন প্রচন্ড সংকটের মুখে। আর ঠিক এই মুহুর্তে রাশিয়া ইউক্রেনকে সংবাদ দিয়েছে- রাশিয়ার টার্মে যদি ইউক্রেন যুদ্ধবন্ধে রাজী হয় তো ভালো, তা না হলে রাশিয়া তার মুল উদ্দেশ্য যেভাবেই হোক সমাপ্ত করবেই।
এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার হলো- ইইউ কিংবা ন্যাটো পেলোসির ভিজিটে কোনো প্রকার মুখ খুলেনি, তারা কিন্তু একেবারে নীরব। অন্যদিকে ন্যাটো এই চায়না-আমেরিকার তাইওয়ান ইস্যুতে জড়ানোর কোনো প্রকার ইখতিয়ারই নাই।
হতে পারে এবার ন্যাটো তাইওয়ানকে ন্যাটোতে ফাষ্ট মুভিং প্রোসেসে ন্যাটো মেম্বার করতে চাইবে। কিন্তু সেটা হলে হবে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ।