আমরা যখন ভুল করতে থাকি, আমরা যখন নিজেদের সার্থের উপর দাঁড়িয়ে কোনো একটা সিচুয়েশনের অবমুল্যায়ন করতে থাকি, আর সেই অবমুল্যায়নের পথ ধরে যখন একটা এমন সিদ্ধান্ত নেই যেখানে যাওয়ার পর মনে হয়, আহা, ব্যাপারটা ঠিক হয় নাই, ঠিক তখনই শুরু হয়, “যদি আর একবার” এর মতো অনুশোচনা। এই ” যদি আর একবার” অনুশোচনা এমন একতা অনুশোচনা যেখানে নিজের হাতে আর কিছুই থাকে না, তাহকে পুরুটাই ভাগ্যের উপর। এই “আহা, যদি আর একবার” সুযোগটা খুব কম ভাগ্যবানের কপালে ফিরে আসে। বেশীর ভাগ সময়েই এটা আর ফিরে আসে না। কিন্তু এর অনুশোচনা, এর বোকামীর ফল কিংবা এর ফলে সৃষ্ট মনোবেদনা আজীবন কাউকে গোপনে বা প্রকাশ্যে মেনে নিয়ে একটা হতাশার সৃষ্টি করেই থাকে। তখন এই হতাশা তাকে বারবার এটাই মনে করিয়ে দেয়, “আহা যদি এই রকম না করতাম তখন”, “আহা যদি আরেকটু চুপ থাকতাম”, “আহা, কি দরকার ছিলো ঐ সময় এমনটা করার” ইত্যাদি। এই অনুশোচনা তাদের বেশী হয় যারা একটা সুযোগ হারিয়েছেন, যারা কোনো না কোনো ভাবে এই সুযোগ আর ফিরে পাবে না বলে নিশ্চিত থাকেন। তখন নিজেকে পৃথিবীর সব বোকা আর অবুঝের মতো মনে হয়। এই অনুশোচনা আরো বেশী করে প্রতিনিয়ত মানুষকে বেদনায় ফেলে যখন দেখা যায় যে, ফেলে আসা সুযোগটিই আসলে দরকার ছিলো, কিংবা এটাই আসলে তার জীবনের মোড়টা ঘুরিয়ে দিতে পারতো কিন্তু ব্যাপারটা না বুঝার কারনে ঘরে কাছে এসেও ভাগ্য তাকে এমনভাবে বিতাড়িত করেছে যার জন্য দায়ী সে নিজেই।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, কেনো আমরা এমন পরিস্থিতিতে পড়ি।
অনেক সময় কড়া কৈফিয়তকে মানুষ অপমান মনে করে। হোক সেটা কোনো চাকুরীর ক্ষেত্রে, কোনো কিছু কেনা কাতার ক্ষেত্রে, কোনো দায়িত্তিয়ের ক্ষেত্রে, কিংবা কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কিন্তু মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় যে, সবাই যার যার হিসাবটা যখন নিজেরাই কড়ায় গন্ডায় সে নিজেই বুঝে নিতে চায়, কিন্তু অন্য কেউ যখন এই একই কাজটা নিজের উপরে করতে চায়, তখন সেটাকে নিজে বড় অপমান মনে করে, কিংবা অবিশ্বাস মনে করে। ভাবে, কেনো আমার কাছ থেকে এতো শক্ত করে কৈফিয়ত চাইতে হবে? কিংবা কেনো আমার উদাসিনতার কারনে এতো জবাব্দিহি করতে হবে? আমি তো তার অমুক, আমি তো তার তমুক, কিংবা আমি তো অনেক বড় আত্তিয় কিংবা আমি তো এটা সেটা ইত্যাদি। আমার তো এতো কৈফিয়ত দেওয়ার কথা না। আর এই অবাস্তব চিন্তা মানুষকে প্রায়ই একটা ভুল সংবাদ দেয় যে, তার এগুলি সহ্য করতে কেনো হবে? আর এই “কেনো সহ্য করতে হবে” এই ভুল ভাবনাটাই তাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে নিয়ে হাজির করে যার নাম “ইগো”। আর এই ইগো থেকেই তারা ভাবে যে, কি হবে এইসব মানুষের থেকে সরে গেলে? ফলে, তারা অনেক সময় এই “ইগো”র কারনে হয় তারাই ক্রমশ সেইসব মানুষের থেকে, যারা বন্ধু, যারা আত্তীয়সজন কিংবা কাছের মানুষগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অথবা তারাই তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। প্রাথমিকভাবে এটাই মনে হয় যে, ছেড়ে গেলে যেনো কিছুই যায় আসে না। এই যে ছেড়ে দেয়া বা ছেড়ে ফেলার পর কি হতে পারে, সেটা ঐ মুহুর্তে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উভয়েই না করে বিশ্লেষন, না করে এর বাস্তব প্রতিফলন। কিন্তু এর একটা প্রতিক্রিয়া সবসময় থাকে যা সময়ের আবর্তে উম্মোচিত হয়। যখন উম্মোচিত হয় তখন একটা জিনিষ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। আর সেটা হলো, যিনি সুপেরিয়র, তার যতোটা না ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে অনেক অনেক বেশী ক্ষতি হয়েছে যিনি ইনফেরিয়র। দেখা যায় যে, ছেড়ে আসার ফলে যা ক্ষতি যাকে ছেড়ে আসা হয়েছে তার থেকে বেশী নিজের, তখনই শুরু হয় এই আহাজারি, “আহা, যদি আবার” আরেকটা সুযোগ পাই, “আহা, যদি আবার আমাকে ডাকা হতো” আমি কোনো প্রশ্ন ছাড়া সেই আগের জায়গায় চলে আসতাম। তখন মনে হয়, যে কোনো শর্তেই আমি আবার সেই আগের জায়গাটা ফিরে পেতে চাই। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, কদাচিত সেই সুযোগটা কারো জীবনে ফিরে আসে। বিশেষ করে যিনি সুপেরিয়র, সে যদি আর সুযোগটা না দেয়, তাহলে ইনফেরিয়রের জন্য এটা আর কখনোই ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
অনেক সময় লোভ মানুষকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে যতটুকু পাওয়ার জন্য আমরা যোগ্য, তার থেকে যখন আমরা বেশী পেতে চাই কিন্তু কোনো কারনে সেটা আমাদের জীবনে বা হাতে না আসে, তখন রাগ হয়, জিদ হয়, মনে হয় যেনো কেউ আমাদেরকে ইচ্ছে করে ঠকাচ্ছে। এই যে পরের ধনের উপর আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত লোভ, এটা মানুষকে এমন একটা জায়গায় উপনীত করে যে, মনে হয় ঐ মানুষগুলি আমার কেউ না। নিজের অভিমান, নিজের চাওয়ার মধ্যে পাওয়ার যে ব্যবধান, এই সুত্রটাই আমাদেরকে একে অপরের থেকে ছিটকে পড়তে সাহাজ্য করে। যখন কেউ ছিটকে যায়, তখন যিনি লোভ করেছিলেন, তিনি বুঝতে পারেন, তার এই অযাচিত লোভই তাকে এমন এক কুড়েঘরে নিক্ষেপ করেছে যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। তখন সে নিজেই তার মুল্যবোধ বুঝতে পারে আর ভাবে, “আহা যদি আর একবার” সুযোগটা পেতাম, তাহলে অন্তত আমার জীবনটা আরো সুন্দর হতো। চোখের সামনে যখন দেখা যায় যে, যে আয়েশী জীবনটা আমার হাতের পাশ থেকে ছুটে গেলো আর যেটা অন্য আরেক জন উপভোগ করলো, তখন সেই নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে বড্ড অসহায় আর বোকাই মনে হয়। কিন্তু তার মন জানে কোথায় সে ভুলটা করেছে। যখন সে একা থাকে, তখন সে ঠিক এটাই ভাবে, আবার যদি এ রকম একটা সুযোগ আসে, আমি আর একই ভুল করবো না। কিন্তু সেটা শুধুই ভাগ্যের উপরে নির্ভরশীল একটা ইচ্ছা। বাস্তব আর নাও হতে পারে।
অপরিপক্ক বয়সের কারনেও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আজকে কোনো এক দৈবচক্রে কারো ভাগ্য এমনভাবে খুলে যেতে পারে যা তার জীবনে দ্বিতীয়বার না হবারই কথা। যেমন ধরুন, কোনো এক মধ্যবিত্ত অপরিপক্ক যুবকের ভাগ্যে এমন এক প্রতাপ্সহালী আর ধনাঢ্য পরিবার সম্পর্ক করে ফেলতে পারে। অকালে এতো বিত্ত আর ক্ষমতার সহচার্য্যে নিজের যোগ্যতাকে যুবক এমন কিছু ভাবা শুরু করতে পারে যার কারনে সেই ধনাঢ্য পরিবার বারবার বিব্রতকর পরিবেশে পড়ে এবং তার লোভের নেশার কারনে সমুলে ছেড়ে দিতে পারে। যখন কোনো একদিন যুবক বুঝতে পারবে কি হারালো সে, তখন তার কাছে বারবার মনে হবে, “কি বোকাটাই না ছিলাম, কি প্রয়োজন ছিলো আমার এই সুযোগ হাতছাড়া করার?” ইত্যাদি। কিন্তু এই অবস্থায় দ্বিতীয়বার আর কোনো সুযোগ আসার কোনোই সম্ভাবনা থাকে না কারন Once fortune comes with luck but when lost, same fortune would come after lots of vigorous testing, and may not even come again. তখন হতাশাটা আরো ব্যাপক। অনুশোচনাটাও শুধু নিজের জন্যেই।