০৪/০৩/১৯৮৬-যশোর সেনানিবাস

রাত ৩টা পাচ মিনিট

এই একটু আগে শেষ পর্জন্ত অনুশীলন শেষ করে সেনানীবাসে পৌঁছলাম। সেনানিবাসটা এখনো ভালো করেই দেখি নাই। তবে চমৎকার একটা লোকেশন আর ডেকোরেশন দেখে মনে হলো, বেশ সুন্দর। চারিদিকে আলো জ্বলছিল। সম্ভবত সবাই শীতকালিন মহড়া থেকে ফিরে আসবে বলে রিয়ার এসলন প্রতিটি ইউনিটেই মরিচ বাতি, লাল নীল আলো জালিয়েছে। খুব অবাক হয়ে দেখছিলাম সেনানীবাসের চেহাড়াটা। ভালো লাগছিলো।

ইউনিটে এসে পৌঁছেছি প্রাউ রাত দুইটার দিকে। গাড়ি বহর ইনট্যাক্ট অবস্থায় আছে, আগামিকাল সকাল ৯ টায় আনলোডিং এর কাজ চলবে। আমরা সবাই যার যার রুমে চলে এসছি। আমি এখনো অফিসার মেসে সামিল হই নাই। আমার অবস্থান একটা ব্যারাকে। শীতকালীন মহরার সময় ছিলাম তাবুতে আর এখন বিল্ডিং এ তবে সৈনিক দের সাথেই। বি এইচ এম সায়েদুরের পাশে আমার বিছানা। খুব টায়ার্ড সবাই। অনেকেই হাত মুখ না ধুয়েই যার যার বিছানায় মূটামুটি শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছিলো না। আর এই সময় আমার ডায়েরী লিখার কোনো কারনও নাই, কারন আমি খুব টায়ার্ড। কিন্তু মনটা অনেক ভালো লাগছে এইজন্য যে, যে কারনে আমি গতকাল থেকে একটা অপরাধ বোধে নিমুজ্জিত ছিলাম, সেটা বুক থেকে সরে গেছে। তাহলে ঘটনাটা বলি। ঘটনাটা ঘটেছিলো গতকাল সকালে।  

আমরা তখন সবাই যার যার মালপত্র গুছিয়ে গাড়ির তালিকা অনুযায়ী মালামাল লোডিং করতে ব্যস্ত। সবাই কাজেই ব্যস্ত। কখন সেনানিবাসে ফিরে যাবে এই আনন্দে মালামাল লোডিং এর সময় একটু হৈচৈ হচ্ছে। বড় বড় আর্টিলারী কামান, তাবু, রেশন স্টোর, অফিসারদের মালামাল, অস্ত্র শস্ত্র, টিন, আরো কত কি যে লোডিং এর কাজ। আশেপাশের অনেক বেসামরিক লোকজন জড়ো হয়ে আছে আমাদের এই চলে যাওয়ার প্রিপারেশন দেখতে। ছোট ছোট ছেলেমেয়রা, বড়রা, আরো অনেকেই। গ্রামের বহু লোক জড়ো হয়ে আমাদের চলে যাওয়ার ব্যাপারটা অবলোকন করছে। এই এলাকার সবাই এখন জানে যে, আমরা সবাই চলে যাচ্ছি। হয়তো ওদের জন্যেও ব্যাপারটা খুব আনন্দের না।

আমি গ্রামের লোকজনের ভীড়ের মধ্যে বারবার একটা জিনিষ দেখার চেষ্টা করছি যে, ঐ বুড়িমা আছে কিনা। মনে মনে খুব আরাধনা করছিলাম, আহা যদি বূড়ি মা আসতো। যদি দেখা পেতাম। আমি কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো, তার নামও জানি না, সে কার বাড়ির তাও জানি না। ফলে কাউকেই জিজ্ঞেস করতেও পারছিলাম না। একবার একটা স্কুলে পড়া বাচ্চা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে এমন কোনো বুড়ি কি আছে যে, রাতের বেলায় ঐ রুপদিয়া গ্রামের বরই গাছের তলায় আখের রস জ্বাল দেয়? ছেলেটি মাথা চুলকিয়েছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে কে সেই বুড়ি খোজার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেও এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর জানে না বলে সহজ করে মুখখানি মলিন করে হেসে দিয়ে বলেছে, জানি না স্যার। মনটায় কোথায় যেনো খচখচ খচ করতেই লাগলো। কিন্তু ঈশ্বর খুব মজার প্রভু। তিনি ব্যথা দেন, আবার ব্যথার ঔষধ দেন, তিনি হতাশ করেন কিন্তু আবার পুষিয়েও দেন। তিনি চোখের জলে আমাদেরকে বুক ভাসিয়ে দিয়ে আবার সেই চোখেই জলভরা আনন্দে বুক ফুলিয়ে দেন। আজ যেনো ঈশ্বর ঠিক সেটাই করলেন। 

হটাত দেখি একজন বুড়ি একটা থালা হাতে নিয়ে বেশ দূরে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। আমার চিনতে একটুও অসুবিধা হইলো না, এটাই সেই বুডিমা। আমি মূটামূটি স্পিডে হেটেই বুড়ির দিকে গেলাম। বুড়ি আমাকে চিনতে পারে নাই। না পারারই কথা। কারন সে এমনিতেই চোখে ভালো দেখে না, তারপর ঐ রাতে সে আমাকে ভালো করে চিনতে পারার মতো করেও দেখে নাই।

আমি কাছে গিয়ে বুড়িমা বলতে সে যেনো আকাশের  চাঁদ হাতে পেলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বল্লো, তোর জন্য দুই টুকরা আখের রসের মিঠাই নিয়া আইছি। এতো সৈনিক চারিদিকে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি বুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি তোমাকে খুব মিস করছিলাম বুড়িমা। তোমার মিঠাই যতোটা না আমাকে মজা দিবে, তোমার সাথে দেখা হওয়াতে আমার মনটাই ভরে গেলো।

হাত দিয়ে বুড়িমার পা সালাম করে বললাম, বুড়িমা, আজ চলে যাচ্ছি। তোমার বাড়িতে আসবো। কি নাম বললে সবাই তোমাকে চিনবে? বুড়ি বল্লো, জসিমের মা।

আমি বুডিমাকে একটা চেয়ার দিতে বললাম। অনেক বুড়ো মহিলা। হয়তো বেশীক্ষন দাড়ায়ে থাকতে তার কষ্ট হবে। যতোক্ষন না আমাদের গাড়ি বহর রেডি হচ্ছিলো, গ্রামের মানুষ গুলির সাথে বুড়িমাও সেখানে ঠায় চেয়ারটায় বসেছিলো। কি জানি তার মনে কি খেলছিলো, কিংবা কি ভাবনা মনে নিয়ে সে আমাদেরকে বিদায় জানাতে এসেছিলো। গাড়িতে উঠার আগে আমি বুডিমাকে আবারো পায়ে ছুয়ে সালাম করে হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, বুড়িমা, আমি আবার তোমাকে দেখতে আসবো। তুমি শুধু ভালো থেকো।

এবার অনুভব করলাম, বুড়ি একটু কাদছে। আমি সৈনিক, আমার কাদা নিষেধ। কিন্তু মনের ভিতরে কোন কারনে কি দুক্ষে যেনো আমারো একটা কাপুনী হচ্ছিলো। একবার মনে হচ্ছিলো, নিয়ে যাই বুড়িকে, আবার ভাবলাম, কোথায় নেবো? পৃথিবীর অনেক অলিখিত ভালোবাসা শুধু বয়েই চলে না, মাঝে মাঝে কোথাও গিয়ে থেমেও যায়।

তখন গাড়ি বহর লোডিং শেষ হয়ে গেছে, অধিনায়ক সাহেব ইউনিটের প্যারেড স্টেট নিতে চলে এসছেন, আমাকে প্যারেডে থাকতে হবে। আমি আর বুড়িমার কাছে থাকার কোনো সুযোগ নাই। বুড়িমাকে আমি পিছনে ফেলে সামনের দিকে ইউনিটের প্যারেডের দিকে হাটতে থাকলাম। মনে হলো, এতো শত শত চোখগুলি আমাকে দেখলেও এর মধ্যে শুধুমাত্র দুটু চোখ আছে যা এখন হয়তো জলে ভেসে যাচ্ছে। অথচ বুড়ি আমার কেউ নয়, আমিও বুড়ির কেউ নই।

জীবন বড্ড রহস্যময়।