০৪/০৬/২০১৬-ভিক্ষুকের পাল্লায় আরেক দিন

Categories

আমি জুরাইন রেলগেটের কাছে ট্রেন পাশ দেয়ার জন্য গাড়ীতে বসে আছি। অনেক গাড়ি থেমে আছে, কেউ কেউ আমার ও অনেক আগে থেকেই থেমে আছে। আমার লাইন অনেক পরে। আমি ঠিক যেখানে গারিতে বসে আছি, তার ডান দিকে গুটি কতক হাত দূরে রাস্তার আইল। অখানে এক আখ বিক্রেতা তার চিকন চিকন আঁখগুলো অনেক যত্ন করে খোসা ছারাচ্ছে, তারপর কচি কচি কঞ্চির মত করে একটা তিনের পাতায় এক এক করে সারি দিচ্ছে। তার পাশে ছোট একটা মেয়ে হাপ প্যান্ট পরা অবস্থায় বাবার আখ কাটা দেখছে। তার হাতেও একটা আখের কঞ্চি। আখ বিক্রেতার পাশে এসে এক ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতাও বসে আছে। ওর সব মিলিয়ে দুটু সম্বল, একটা সম্ভবত ফ্লাক্স আর আরেক্তি বিস্কুতের একটি জার। এটা দিয়েই হয়ত ওর সারাদিনের রোজগার, সংসার চলে।

আমার বা পাশ দিয়ে খুব ব্যাস্ত একটি সাইকেল আরোহী উল্টো পথ ধরে পার হবার চেষ্টা করছে, কোন তাড়া আছে হয়ত কিন্তু ওর বয়স আর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে ট্রাফিক আইন ভেঙ্গে অন্যান্য গাড়ি গুলো বিপদজনক ভাবে টপকিয়ে এভাবে যাওয়ার মানুষ, তারপরে তিনি করছে, অল্প বয়স, বয়সের একটা গরম আছে। পিছন থেকে অযথা একটি গাড়ি হর্ন বাজিয়ে উঠল যেন বিরক্ত কারো উপর। আমার ড্রাইভার নিজে নিজেই অনেক কথা বলে ফেলছে, ‘কেন কোন সেন্স নাই এত আগে রেল গেত ক্লোজ করে সবাইকে দাড় করাইয়া রাখবে, কি হয় ঠিক টেন আসার আগে দাড় করাইলে? দেশ তারে কেউ ভালবাসে না, কেউ তাদের ডিউটি ঠিক মত করে না। কি হবে এদেশের? বুঝলাম এবার আমার ড্রাইভার দেশ প্রেমিক হয় উঠেছে। অথচ আমার এই ড্রাইভারকেই রঙ সাইড দিয়ে না যাওয়ার জন্য আমাকে অনেক বার বকাও দিতে হয়। সুযোগ পেলেই আমার ড্রাইভার চান্স নেয়।

বাইরে বেশ গরম, বুঝা যাচ্ছে। ঐ অদুরে সারি সারি দোকানে দোকানদার কেউ কেউ হাত পাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস করার চেষ্টা করছে, বুঝলাম এলাকায় বিদ্যুৎ নাই। তা না হলে হাত পাখার ব্যবহার হত না এখন। এরই মধ্যে বাস আসার অপেক্ষায় কিছু সাধারন যাত্রি প্রচন্ড খরার মত রৌদ্রে দাড়িয়ে আছে কখন তাদের বাস আসবে। যারা একটু যুবক, তাড়া আবার কেউ কেউ হাতে সিগারেট ধরিয়ে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করছে। আমার ড্রাইভার গাড়ির রেডিও তা অন করতেই কোন এক জকির ম্যাকি সুরে কত কথা শুনা গেল।

ঠিক এমন সময় একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে আমার গাড়ীর সামনে এল এবং ভিক্ষা চাইল। আজকাল অনেক পদের ভিক্ষুকের সমাহার এদেশে। কেউ খুরিয়ে খুরিয়ে হাটে, কেউ আবার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে এই সার্টিফিকেট নিয়ে রাস্তায় নামে তার টাকা জোগাড়ের জন্য। কেউ আবার পুরু শরীর উদম করে আসে কোথায় তার ক্ষত আর কোথায় তার শারিরিক সমস্যা মুখে না বলে যেন যিনি ভিক্ষা দেবেন তিনি তাকে দেখেই বুঝে ফেলতে পারেন তার ভিক্ষা চাই। কেউ আবার অনেক প্যান্ট শার্ট পরে খুব ভদ্র ভাবে সামনে এসে চুপি চুপি বলবে যে, তার সব খুইয়ে এখন এমন অচেনা শহরে একা, তার বাড়ীতে যাওয়ার পয়সা নাই কিন্তু তিনি ভিক্ষুক নন। নতুন কৌশল।

যাক গে, আমার সামনে এই মুহূর্তে যে ভিক্ষক টি দাড়িয়ে তাকে দেখেই আমার ভিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে হল না। কারন তার যে বয়স, তাতে সে অনেক বাসায় কাজ করতে পারে, কিংবা গার্মেন্টসেও কাজ করতে পারে কিংবা অন্য যে কোন পরিশ্রমের কাজ তার দ্বারা করা সম্ভব। তার ভিক্ষা করার প্রয়োজন হয় না আসলে।কিন্তু নাছোড়বান্দা। বারবার আমার গাড়ীর কাচে নক করছিল। বিরক্ত হয়ে বললাম, প্লিজ মাফ কর। আমার বিরক্তে তার কিহু যায় আসে না। সেও বিরক্ত। এত দেরি করে কেন কাচ খুললাম এই জন্য।

মহিলা রেগে গিয়ে বল্ল, এতক্ষন না করলেন না ক্যান, আমারে খামাখা দাড় করাইয়া রাখলেন? আগে বললেই তো পারতেন?

অবাক হইলাম তার রাগের কারনে। আমি তার সময় নষ্ট করে দিয়েছি বলে। তো, আবার ডাকলাম, ভাব্লাম কিছু কথা বলি।

বললাম, কোলের বাচ্চাটা কে বা কার? অনেকে আবার বাচ্চা ভাড়া করে নিয়ে আসে এবং ভিক্ষা করে। এতে হয়ত অনেক মানুষের একটু বেশি সিম্পেথি পাওয়া যায়, আর ভিক্ষাটাও জমে উঠে হাতে পায়সার ভারে।

মহিলা বল্ল, আমার বাচ্চা। বুঝলাম, তার রাগ কমে নাই, সব ভিক্ষুকেরা সাধারনত স্যার বলে সম্বোধন করে। হয়ত সেও করে কিন্তু সে আমার উপর রাগ।

বললাম, কাজ করোনা কেন?

উত্তরে সে যা বলল সে এক লম্বা ফিরিস্তি। নাই বা বললাম।

আমি আবার বললাম, কয় টাকা পাও প্রতিদিন ভিক্ষা করে? এবার মনে হল, সে আমার কোথায় একটু হলেও রাগ কমেছে অথবা চিন্তা করছে যে সাহেব মনে হয় কিছু বেশি সাহাজ্য করতে পারে ইত্যাদি। ভিক্ষুকরাও কিন্তু সাহেব্দের সাইকোলজি বিশ্লেষণ করে।

সে আমতা আমতা করে বল্ল, হয় স্যার প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই প্রতিদিন। এবার সে আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করল। বুঝলাম, অনেক্তাই রাগ কমেছে আমার উপর।

আমি আবার বললাম, গতকাল কত টাকা পেয়েছ?

সে বল্ল, স্যার গতকাল প্রায় ২০০ টাকার মত পাইছি।

আমি বললাম, তাহলে তোমার মাসিক ইনকাম প্রায় ৬০০০ টাকা। তোমার তো মাসে ৬০০০ টাকা লাগে না। কয় টাকা হলে তোমার সংসার চলে?

সে কিহুক্ষন চুপ থেকে একবার আকাশের দিকে, একবার আমার দিকে, আবার একটু নিরব থেকে, হাতের কড়া গুনে গুনে বল্ল, স্যার, মোটামোটি হাজার ৫ হলেই আমাদের ছোট সংসার চলে যায়। 

আমি বললাম, ধরো, আমি যদি তোমাকে আজকে ৫০০০ টাকা দেই, তাহলে কি তুমি এখন বাড়ি চলে যাবা? যদি বল, যে, তুমি বাড়ি চলে যাবা, এবং তুমি আর এই মাসে ভিক্ষা করবা না, তাহলে আমি তোমাকে এখনই ৫০০০ টাকা দেব। কিন্তু আমি তোমার উপর লক্ষ রাখব তুমি ভিক্ষা করছ কিনা। সে নিসচুপ হয়ে কিছুক্ষন দারিয়ে থেকে আমার গাড়ীর সামনে থেকে চলে গেল। মনে হল তার এই আয়ে পোষাবে না। তার মানে এই যে, সে ভিক্ষাটা ছারবে না। অথবা এমনও হতে পারে যে, সংখ্যাটা কম বলে ফেলেছে।

………… তার বেশ কয়েক মাস পর,

আমি আবার গুলিস্থানের জিপিও এর সামনে গাড়ীর জ্যামের মধ্যে বসে আছি। হটাত দেখলাম, ঐ সেই একই মহিলা। কোলে একটা বাচ্চা, তবে আজকে ছেলে বাচ্চা নয়, মেয়ে বাচ্চা। আমি মহিলাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু মহিলা আমকে দেখে চিনতে পারে নাই। আমার গাড়ীর সামনে এসে সেই একই ভঙ্গিতে ভিক্ষা চাইল। আমি এবার আবারো সেই একই প্রশ্ন গুলো করলাম।

আমি বললাম, তোমার কয় বাচ্চা?

সে বল্ল, স্যার, এই একটাই। বুঝলাম, সে মিথ্যা বলছে। এটা আসলে ওর ভাড়া করা বাচ্চা মনে হয়।

 তারপর আমি শুরু করলাম আমার সে আগের প্রশ্নগুলো।কয় টাকা পায়, কয় টাকা লাগে প্রতিমাসে। কেন কাজ করতে চায় না ইত্যাদি।

এবার মহিলা কিন্তু কম করে ফিগারটা বলে নাই। সে বল্ল, স্যার আমার মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লাগে। স্বামী অসুস্থ ঘরে। আমার বোনের এক বাচ্চা স্কুলে পরে, তাকেও আমার টানতে হয়, নিজেও অসুস্থ, সঙ্গে শ্বশুর শাশুড়িকেও টানতে হয়ইত্যাদি। বুঝলাম, ১৫ হাজারের হিসাবটা তার আগে থেকেই করা।

আমি এবার অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল জুরাইন রেলগেটে। তখন আমি তোমাকে এই প্রশ্নগুলো করেছিলাম এবং তুমি মাসে ৫০০০ টাকা হলে তোমার হয়ে যায় বলেছিলে, আজ আবার তা ১৫০০০ হাজার টাকা হয়ে গেল ক্যান?

মহিলাটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমারে এক ঝারি দিয়ে বল্ল, ধুত মরার, খালি আপনার লগেই আমার দেহা হয় ক্যান? অন্য রাস্তা দিয়া যাইতে পারেন না? তারপরযত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার গাড়ী পার হয়ে আরেক জনের কাছে চলে গেল।

 মনে হইল, ভিক্ষা যার পেশা, ভিক্ষা তার নেশাও বটে। নেশা আর পেশা যখন এক হয়ে যায়, তখন আর তাকে ঐ কাজ থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব না। একজন ভিক্ষুক যত ধনিই হোক না ক্যান, স্বয়ং বিধাতা তাকে সবার সামনে প্রকাশ্যে ফকির বানিয়ে রেখেছে, তাকে বিধাতা দিনের সূর্যের প্রখর তাপে শাস্তি দিচ্ছেন, আবার শীতে কষ্ট দিচ্ছেন, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে রাখছেন, অথচ হয়ত তার একটা সুন্দর বাড়ি আছে, তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে হত না, শীতে কাঁপতে হত না যদি ভিক্ষা না করতে হত। কিন্তু সে তো ভিক্ষা করবেই। এটা তো পেশা। ভিক্ষুক হয়ত আনন্দ পায় তার সঞ্চিত টাকার সংখ্যা দেখেই। তার ভোগ করার সময় কই? সেটা তো বিধাতা দেবেন না। তার কাছে পূর্ণিমার রাত যা, অমাবস্যার রাতও তা, ওর কাছে বৃষ্টির ঝন ঝন শব্দ কানে ভাসে না, ওর শুধু নজর কখন একটা গাড়ী আসবে আর তার সামনে গিয়ে সে কাতর হয়ে মুখের সবটা যন্ত্রনার অভিব্যক্তির অভিনয়টা করে একটা হাত পেতে বলবে, দেন গো স্যার, আমারে কিছু দেন, দুইদিন কিছু খাই নাই। হয়ত পুরুটাই মিথ্যা কথা।

 আর এইসব ভিক্ষুকের জন্য যারা সত্যি ভিক্ষা করে একটু সস্থি পেতে চায়, তাদের কপাল পুড়ে। শুনেছি, ভিক্ষুকদের এসোসিয়েশন আছে, সেখানে প্রেসিডেন্ট আছে, সেক্রেটারি আছে, সেখানে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ইলেক্সন হয়, এবং একদিন তারা আবার এমপি মিনিস্টার পদেও কন্টেস্ট করে।

তখন আমরা তাদের স্যার বলি।  তারপরের কাহিনী অন্য রকম।