Categories
প্রতিদিন এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার হিসাব সবসময় কেউ রাখে না আর রাখাও দরকার আছে বলিয়া কেউ মনে করেনা।অনেক সময় অনেক অতিকায় বৃহৎ জিনিস নজর এড়াইয়া যায় আবার অনেক সময় অতিকায় তুচ্ছ জিনিসও আমাদের চোখ না এড়াইয়া উহা এমন আবেগের সৃষ্টি করে যা মন এবং হৃদয় উভয়কেই প্রভাবিত করে। আজ এমনই কয়েকটা দৃশ্যের কথা বলছি।
পরিবার নিয়েগ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুইদিন পর সবাইকে নিয়া আবার ঢাকায় ফিরছিলাম। আগে গ্রামে যাইতে হইলে বৃষ্টিতে ভিজিয়া, রোদে পুড়িয়া, কিছু দূর হাটিয়া, আবার কিছুদূর কোন এক বটবৃক্ষের তলে জিরাইয়া, পথ হইতে সঙ্গি পাওয়া কিছু হরেক পদের বন্ধু পথচারী লইয়া ঘন্তার পর ঘন্টা হাটিয়া বাড়ি যাইতে হইত। শহর হইতে যদিও খুব দূরে নয় এই আমাদের গ্রামের বাড়ি কিন্তু তাতেই তিন হইতে চার ঘন্টা লাগিয়া যাইত। যখন গ্রামে পৌঁছাইতাম, তখন অনেক দিনের বন্ধু বান্ধব, পারা প্রতিবেশি, এমন করিয়া প্রশ্ন করিত যেন শহরের একজন অতি উচ্চ দরের বাসিন্দা গ্রামে আসিয়াছে। আমাদের সময় শহর ছিল এক ধরনের বিদেশের মত। যেন বিদেশ হইতে আসিয়াছি। আমার মেয়েরা এই শহর আর গ্রামের যে বিস্তর একটা পার্থক্য তাহা তাহারা কখনো বুঝিবে না আর আমিও অনেকবার গ্রামের কথা বলিতে গিয়া দেখিয়াছি, তাহাদের গ্রামের কথা শুনিবার মানসিকতা খুব একটা নাইও। এখন আমি গ্রামে যাই গারিতে চরিয়া, সঙ্গে ড্রাইভার থাকে, আমি অনেক বড় সাহেব। এখন যদিও সেই চেনা পরিচিত লোকগুলো শহরকে আর বিদেশ বলিয়া মনে করে না, তারাও এখন আমি গ্রামে গেলে অতিব খুশি হয়। কারো কারো অনেক অভিযোগ আছে আমার বেশি বেশি গ্রামে না আসার কারনে, কেউ আবার আমার অফিসে দেখা করাই সম্ভব হয় না, দিনের পর দিন অপেক্ষা করিয়াও তাহারা আমার দর্শন পায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। সব অভিযোগ যে মিথ্যা তা আমি বলব না কিন্তু অনেক অভিযোগ আছে যা আমার কখনো শুনিতেও ভাল লাগে আবার কিছু কিছু অভিযোগ আছে যাহা সত্যিই সত্য নয়। কিন্তু তাহাতে আমার কিছু যায় আসে বলিয়া আমার মনে হয় নাই।
এতক্ষন গাড়ী ভালই চলিতেছিল, কোথাও কোন জ্যাম বা রাস্তায় দাঁড়াইতে হয় নাই কিন্তু শাহবাগে আসিয়া দেখি লম্বা এক গাড়ীর সারি। কতক্ষন যে লাগিবে এই জ্যাম শেষ হইতে তা অনুমান করিতে পারতেছিলাম না। রাস্তার জ্যামে সবচেয়ে বড় অসুবিধা যেটা হয় তাহা হইল, কিছুক্ষন পর পর হরেক পদের গল্প লইয়া অতিশয় ক্ষুদ্র বয়স হইতে থুরথুরে বুড়িও আসিয়া গাড়ীর কাঁচ নক করিতে থাকে। নিজের বিরক্ত হইলে তারাও আরও বেশি করিয়া বিরক্ত হয় এবং কখনো কখনো এমন মন্তব্য করিয়া মুখ ভেংচি কাটিয়া চলিয়া যাইবে যেন আমি ই অপরাধ করিয়াছি তাহাকে কোন ভিক্ষা না দিয়া। আজও তার ব্যতিক্রম হইল না। একজন ৪০ কিংবা ৪৫ বয়সের মহিলা আমাদের গাড়ীর সামনে আসিয়া দারাইল। রবি ঠাকুরের মত লিখিলে বলিতে হয় যে, “অতি কাতরতার সহিত তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করিয়া “কিছু দেন স্যার গো” বলিয়া এমন একখান মুখাবয়ব করিল যেন পৃথিবীতে তাহার হইতে আর কোন মানুষ অসহায় নাই আর আমি ছাড়া তাহাকে উদ্ধার করিবার ও যেন আর কেহ নাই।”
আমি সাধারণত সবাইকে ভিক্ষা দেই না। ভিক্ষুকের শারিরিক অবস্থা, মানসিক বিকাস, বয়স কিংবা তার কাজ করিবার ক্ষমতা-অক্ষমতা অনেক কিছু বিবেচনা করিয়াই আমি ভিক্ষা দিতে পছন্দ করি। অনেকে হয়ত বলিবেন, দিবেন তো এক টাকা বা দুই টাকা, তারপরে আবার এত সব কাহিনী বিবেচনা করিয়া ভিক্ষা দিতে হইবে? আসলে ব্যাপারটা ঐ রকম নয়। আমি ভিখা বৃত্তিকে সমর্থন করি না। তারপরেও অনেক ভিক্ষুককে আমি ভিক্ষা দেই। তাতে যে সব সময় আমার ঐ বিবেচনা গুলি থাকে তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো আমার মানসিক অবস্থা, আমার ব্যবসায়িক পরিস্থিতি, কিংবা আমার ভাবের উপরও আমি অনেক অযোগ্য ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেই। “ভিক্ষুকের আবার যোগ্যতা”, এই কথা অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করিতে পারেন, কিন্তু সত্যি ভিক্ষা করিবার জন্যও কিন্তু যোগ্যতা লাগে। সবাই ভিক্ষুক হইতে পারে না। শুনেছি, অনেক ভিক্ষুক নাকি অনেক বড় লোক, তারাঅত্যাধুনিক গাড়ী চালায়, বিশাল অট্টালিকায় তাহারা শীততাপ বাড়ীতে ঘুমায়। তাহাদের সেবা করিবার জন্য দাস, চাকরানী সবাই আছে। শুধুমাত্র ভিক্ষা করিবার নিমিত্তে তাহার তাহাদের নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়া আবারো সেই পুরানো পোশাক পরিয়া মুখের হাবভাব পরিবর্তন করিয়া মানুষকে ধোঁকা এবং বোকা বানাইয়া সেই একই ভিক্ষা ব্রিতিতে সামিল হন। দিনশেষে আবার তাহারা তাহাদের ঐ বৃহৎ অট্টালিকায় সাহেব বেশে ফিরিয়া আসেন। ইহা একটা ইনভেস্টমেন্ট বিহীন লাভজনক ব্যবসা। যাই হোক, কে ভিক্ষা বৃত্তি করে কত টাকা লাভ করিল বা কে সত্যি সত্যিই ভিক্ষুক এবং জিবিকা নির্বাহের জন্য যে তাহার ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোন গতি আছে কিনা, এই সব তাত্তিক বা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার জন্য আমি এই লেখাটি লিখছি না।
আমি এখন শাহবাগে জ্যামের মধ্যে গাড়ীতে বসিয়া আছি এবং ঐ ৪০-৫০ বয়সের মহিলা ভিক্ষুকের দিকে তাকাইয়া আছি। আমার ছোট মেয়ে তার অতি প্রিয় আই প্যাডে এক নজরে কি যেন করিতেছে আর আমার বড় মেয়ে তার কানে হেড ফোন লাগাইয়া কোন দেশের কোন সঙ্গিত শুনিতেছে, তা আমার বা আমাদের গাড়ীতে যাহারা বসিয়া আছি কেহই শুনিতে পাইতেছি না। শুধু মাত্র মেয়ের মাথা নারা দেখিয়া বুঝিতেছি যে আমার বড় মেয়ে সঙ্গিত শুনিয়া সঙ্গিতের জগতে ডুবিয়া আছে। পাশের ভিক্ষুক, আর জ্যামের জন্য তাহার কোন কাজে ব্যঘাত হইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে না। আমার প্রিয়তমা পত্নী একটু একটু তন্দ্রা আবার একটু একটু জাগ্রত ভাবে বসিয়া আছে। ড্রাইভার সাহেব অতি সুক্ষ মনোযোগের সহিত কোন ফাক ফোঁকর পাওয়া যায় কিনা এই চিন্তায় গাড়ির স্টেয়ারিং ধরিয়া বসিয়া আছে। আশেপাশের অন্যান্য গারি গুলির অবস্থাও আমার মত।
আমি নরিয়া চরিয়া বসিলাম, আর আমার মানি ব্যাগে হাত দিয়া ঐ মহিলা ভিক্ষুককে কিছু টাকা দিতে উদ্যত হইলাম। আমার এই নড়াচড়ায় আমার ছোট মেয়ে তাহার আই প্যাড হইতে নজর ফিরাইয়া আমার দিকে তাকাইল, আমার বড় মেয়ের এতক্ষন বুঝা চোখ একটু খানি আড় চোখ হইল, আমার পত্নিও একটু নরিয়া বসিল। তাহার সবাই হয়ত এই ভাবিল যে, আমি তো সাধারনত সব ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেই না, এমন কি হইল আজ যে, অতি কর্মক্ষম একজন মহিলা, যাহার কাজ করিবার ক্ষমতা আছে তবুও আমি ভিখা দিতে উদ্যত হইলাম?
আমি মেয়েদের মনভাব বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, দেখ , আমি একটা সাইকোলজিক্যাল কাজ করিবার চেষ্টা করিতেছি এইবার। বলিয়াই আমি আমার মানি ব্যাগ হইতে নতুন একটা পাচশত টাকার নোট বাহির করিয়া ঐ মহিলা ভিক্ষুকটির হাতে এমন ভাবে দিলাম যেন, এটা কিছুই না। মহিলা ভিক্ষুকটি প্রথমে টাকাটা হাতে লইল, এবং পরক্ষনেই আমার দিকে তাকাইল। পরক্ষনেই আবার সে তাহার হাতে দেওয়া নোটটির দিকে তাকাইল আবার আমার দিকেও তাকাইল। আমি শুধু তাহার মুখের ভাবটা পরিবর্তনের ব্যাপারটা লক্ষ করিতেছিলাম। হটাত কয়েক মুহূর্তের পর মহিলা ভিক্ষুকটি পিছন ফিরিয়া সোজা দৌর দিল। যেহেতু সব গারি গুলি জ্যামের মধ্যে দারাইয়া ছিল, ফলে অল্প সময়ের মধ্যে সে বেশ খানিক টা পথ কোন বাধা ছারাই পার হইয়া গেল আড় ইতিমধ্যে সে রাস্তার ঐ পাড়ের ফুটাপাতে পৌঁছাইয়া গেল। ফুতপাতে পৌঁছাইয়া ও সে দৌড়াইতে লাগিল কিন্তু একবার সে আমার দিকে পরক্ষনেই সামনের দিকে দৌড়াইতেছিল। এক সময় মহিলা ভিক্ষুকটি আমাদের চোখের আড়াল হইয়া হাজার মানুষের ভিরে হারাইয়া গেল।
এতক্ষন আমার ছোট মেয়ে, বড় মেয়ে কেহই কোন কথা বলিতেছিল না। এইবার আমার ছোট মেয়ে আমার দিকে তাকাইয়া আমাকে প্রশ্ন করিল, বাবা, মহিলাটা এমন করিয়া দৌড় দিল ক্যান? ওকি ভয় পাইয়াছে?
আমি বলিলাম, না মা, ও ভয় পায় নাই। এতক্ষন তুমি যাহা যাহা দেখিলে, সেটা একটা সাইকোলজিক্যাল গেম ছিল। সাইকোলজিটা কি তুমি বিঝিতে পার নাই? আমি ব্যাপারটা আমার ছোট মেয়েকে বুঝাইয়া বলার শুরু করিলাম।
মহিলা ভিক্ষুকটি যখন ৫০০ টাকার নোটটা হাতে পাইল, সে তখন বুঝিতে পারে নাই যে, কেউ তাকে ৫০০ টাকার নোট দিয়া ভিক্ষা দিতে পারে। (যদিও অনেকে দেয়, কেউ দেয় না এমন নয় কিন্তু তাহা একটা ব্যতিক্রম ধর্মী ব্যাপার)। কেউ হয়ত দেয় ৫ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা কিংবা ১০০ টাকা কিন্তু একবারে ৫০০ টাকা হয়ত সে কখনই ভিক্ষা পায় নাই। ফলে সে প্রথমে মনে করিয়াছিল যে, আমি ভুল করিয় ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়াছি। তাই সে বারবার একবার আমার দিকে আরেকবার ৫০০ টাকার নোটের দিকে তাকাইতেছিল। সে ভাবিতেছিল, সাহেব কি ভুল করিয়া ছোট নোট মনে করিয়া তাহাকে ৫০০ টাকার নোটটি দিয়া দিল নাকি আসলেই সাহেব তাহাকে ৫০০ টাকার নোটটাই ভিক্ষা দিল? এটা কি ভুল নাকি আসল। ভিক্ষুক তাহার নিজের ভিতরে ডিসিসন ম্যাকিং প্রসেসে খুব দ্রুত কি করিবে আড় কি করিবে না এই নিয়া দোলায় ছিল। সে হয়ত ভাবিতেছিল, আমি কি খুব তাড়াতাড়ি আমার ভুলটা বুঝিয়া আবার না ঐ ৫০০ টাকার নোটটা মহিলার কাছ হইতে চাহিয়া লই। অথবা ভাবিতেছিল যে, মহিলা নিজেই কি আমাকে জানাইবে যে, আমি ৫০০ টাকাই দিতে চাহিয়াছি কিনা। তাহার ভিতরে তখন একটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধ চলিতেছিল এই রকম যে, সে এই ৫০০ টাকার ভিক্ষার ব্যাপারটা যদি নিজে থেকে ক্লিয়ার করে তাহা হইলে সে হয়ত ৫০০ টাকা থেকে বঞ্চিত হইবে। আবার যদি না জানায় তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হইতেছে কিনা ইত্যাদি। তাই সে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না কি করিবে। তাহার এই কিঞ্চিত দুরাবস্থার ইঙ্গিত টা যদিও আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম কিন্তু আমি তাহাকে আমার মানসিকতার কোন পরিবর্তন না করিয়া যেন আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না বা আমি ইচ্ছা করিয়া কোন ভুল করি নাই বা করিলেও আমাই তখন ব্যাপারটা বুঝিতে পারিতেছি না। আমার মুখের ভাবের মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন না দেখিয়া সে আমি বুঝিতে পারিয়াছি কিনা তাহা সে বুঝিতে পারিতেছিল না। লাভ আড় লোকসানের হিসাব করা তাহার ইতিমধ্যে শেষ হইয়াছে, তাই আর কোন রিস্ক না নিয়া নতুন কোন খদ্দরের কাছে আড় কোন ভিক্ষা না চাহিয়া সে যত তাড়াতাড়ি পারিল আমার কাছ হইতে ছুটে দৌড় দিল যাহাতে আমি আর তাহাকে নাগাল না পাই। সে দৌড়াইতেছিল বটে বটেকিন্তু তখনও সে নিশ্চিত হইতে পারিতেছিল না, যদি আবার আমি তাহাকে ডাক দেই!! টাই সে একবার সামনের দিকে আবার পরক্ষনেই আমার দিকে তাকাইতেছিল।
কিন্তু আমি জানি আমি তাহাকে ৫০০ টাকাই দিয়াছি। আমার মধ্যে কোন সন্দেহ ছিল না, আমি শুধু দেখিতে চাহিতেছিলাম, ৫০০ টাকা একসঙ্গে পাইলে একজন ভিক্ষুক কি করে। প্রতিদিন হয়ত ও ৫০০ টাকার চেয়েও বেশি কামাই করে কিন্তু একবারে কারো কাছ হইতে ৫০০ টাকা হয়ত ও জিবনে কখনই পায় নাই। ফলে ওর ভিতরে নানা প্রকার সাইকোলজিক্যাল কেল্কুলেসন খেলিতেছিল। মানুসের মন বড় বিচিত্র। সে যেই হোক। ৫০০ টাকা দিয়া আমার ভালই লাগিয়াছিল এই ভাবিয়া যে, আজ যদি সারাদিন সে অন্য কাহারো কাছ হইতে ভিক্ষা নাও পায়, তাহাতেও ওর কয়েকদিন চলিয়া যাইবে।
দেখিলাম, আমার ছোট মেয়ে অতি দ্রুত ইহারই মধ্যে ভিক্ষুক সমাচার লইয়া একটা ফেসবুকে স্ট্যেটাস দিয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে জ্যাম ছুটিএ শুরু করিয়াছে। ড্রাইভার গাড়ি আঁকাবাঁকা করিয়া ফাক ফোঁকর দিয়া কিভাবে আরও দ্রুত চালানো যায় সেইদিকে মনযোগী হইয়া গেল, আমার বড় মেয়ে কোন কিছু না ভাবিয়া আবারো গানের কলি শুনিতে লাগিল। আমি শুধু এই ভিক্ষুকের ঘটনাটা মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম।
মানুষ বড় বিচিত্র।