ফরিদ ভাইয়ের বাসা ভিজিট

আমার সিডিউলের মধ্যে সর্বপ্রথম (অনাত্তীয়দের মধ্যে) যাদের বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেটা হল বাংলাদেশে আমার বাড়ির পাশের প্রতিবেশী ফরিদ ভাইদের বাসায় যাওয়া। আর সেটা হয়েছিলো ২২ মে ২০২৫। বাংলাদেশে আমার বাসার লাগোয়া প্রতিবেশি ফরিদ ভাই এবং মুন্না ভাইয়েরা। অনেক হাসিখুশি, জলি মাইন্ডেড এবং স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ফরিদ ভাই। প্রতিদিন ব্যায়াম করতেন। এখন উনারা আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে থাকেন। খুব সুখী পরিবার। আমি আমেরিকায় আসার আগে শুনেছিলাম ফরিদ ভাই অসুস্থ্য কিন্তু কতটা অসুস্থ্য বুঝতে পারিনি। ফলে আমেরিকায় এসে আমি ম্যারিল্যান্ড থেকে প্রায় ঘন্টা তিনেক ড্রাইভ করে ভার্জিনিয়াতে দেখতে গিয়েছিলাম ফরিদ ভাইকে। আমি যাবো শুনে ফরিদ ভাই অনেক খুশি হয়েছেন বটে কিন্ত ফরিদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফরিদ ভাই আমার ধারনার বাইরে অসুস্থ্য।
যখন ঊনারা বাংলাদেশে ছিলেন, আমাদের মধ্যে প্রতিদিন দেখা হতো, এক বাসা থেকে আরেক বাসায় খাবারের আদান প্রদান হতো। বড্ড ভালো একটা প্রতিবেশি ঊনারা। এখন বাংলাদেশের সেই বাসাটায় কেউ থাকেন না, শুধু থাকে ভারাটিয়ারা।
আগের রাতে মিটুল ফরিদ ভাবীর সাথে কথা বলে রেখেছিলো যে, আমরা যাবো ভাইকে দেখতে। যখন আমরা ফরিদ ভাইয়ের বাসায় পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় ১১ টা বাজে। সুন্দর একটা আবহাওয়া। গরম নাই আবার একটু একটু ঠান্ডাও আছে।
ফরিদা ভাইদের বাসায় গিয়ে দেখলাম ফরিদ ভাই শুয়ে আছেন একটা মেডিকেটেড বিছানায়। আমার কল্পনাতেও ছিল না ফরিদ ভাইয়ের বর্তমান চেহাড়ার অবস্থা। আমি আসলে জানতাম ফরিদ ভাই অসুস্থ্য কিন্তু কতোটা সেটা আমি সত্যিই অনুমান করতে পারিনি। ঊনার মেয়ে দিবা বাসায় ছিলো, ভাবির সাথে একান্তে কথা বলে বুঝলাম যে, ফরিদ ভাইয়ের লিভারের সমস্যার সাথে ওনার নিউরোজনিত সমস্যাও আছে। ফরিদ ভাই শুকিতে কাঠ হয়ে গেছেন। চোখগুলি দেখলে মনে হয়-একটা কংকালের মধ্যে যদি চামড়া থাকতো আর সেই কংকালের যে চোখ ঠিক যেনো তেমন। আহা রে কত কস্ট যে ঊনার। খুব মায়া লাগলো ফরিদ ভাইকে দেখে। খুব সুন্দর সাস্থ্য ছিলো, প্রতিদিন ব্যায়াম করতেন, একমাত্র সিগারেট ছাড়া আর কোনো নেশা ছিলো না। তাও সারাদিনে হয়তো ৪/৫ তা সিগারেট খেতো। এই মানুষটার এই অবস্থা আমার কল্পনারও বাইরে।
ফরিদ ভাইয়ের চিকিতসা আমেরিকার সরকারই বহন করে। সারাক্ষন দেখভাল করার জন্য সরকার একটা পাকিস্থানি মেয়েকে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে। যতোক্ষন ভাবি এবং তার মেয়েরা বাসায় থাকেন, তারা এই পাকিস্থানী মেয়েটার সাথে ফরিদ ভাইকে দেখভাল করেন। দিবার বয়সের সমান অথবা আর ছোট হতে পারে পাকিস্থানী মেয়েটার। বেশ ভদ্র এবং ভালই মনে হল। শুনলাম মেয়েটার নাকি ইতিমধ্যে ৩টা বাচ্চাও রয়েছে। খুব ছোট বেলায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মনে হয়। ফরিদ ভাবী আমাদের জন্য অনেক পদের রান্না করেছিল। মুরগী, গরু, মাছ, শব্জী, ভর্তা, ডাল, ইত্যাদি। পোলাও করতে চেয়েছিল কিন্তু আমি পোলাও খাই না বলে সাদা ভাতই করেছিলেন। চমৎকার রান্না বান্না ফরিদ ভাবীর। ফরিদ ভাই প্রায় ৮ মাস পরে আমাদের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করলেন। বেশ কয়েক পিস মুরগীও খেলেন। ভাতও খাইলেন। ভাব আর দিবা বলছিল, কি সুখের কথা যে, ফরিদ ভাই প্রায় ৮/৯ মাস পর ডাইনিং টেবিলে বসে সবার সাথে দুপুরের খাবার খাইলেন।
এটাই মনে হয় জীবনের রুপান্তর। মানুষ বেশীদিন বাচে না। কেনো আমরা তাহলে এতো আশা করি? ওনারা ভালোই তো ছিলেন সেই ঢাকায়। বন্ধু বান্ধব ছিলো, লোকালয় ছিলো চেনা, হৈচৈ ছিলো প্রতিদিন, রিক্সার ঝুঞ্ঝুনানী, গাড়ির বিকট হর্নের শব্দ, আজানের সুর আর পাবলিকের কোলাহলের সাথে বড় বড় সাউন্ড বক্সের উত্তাল গানের মাতোয়ারা। ভালোই তো ছিলো ওগুলি।
একটু পর মুন্না ভাই এলেন। ফরিদ ভাইয়ের থেকে বড় উনি। বাংলাদেশে উনি অডিট ডিভিশনে সম্ভবত অথবা ব্যাংকে কাজ করতেন। খুব ভালো মানুষ।
সবার সাথে অনেক আলাপ, কথাবার্তা হল। ফরিদ ভাই একেবারে দেশে ফিরে আসতে চান, আগের সেই ক্লাব, বন্ধুবান্ধব, আত্তিয় সজন, পারাপ্রতিবেশীদের আবার সান্নিধ্য চান কিন্তু উনি তার সাস্থগত কারনে আর কখনোই বাংলাদেশে ব্যাক করতে পারবেন না। খুব আফসস করে বললেন- একটা সময় ভেবেছিলাম, আমেরিকায় গিয়ে কতই না সুখে শান্তিতে আরামে বাস করতে পারবো। কিন্তু আমার এই লাইফের চেয়ে বাংলাদেশের সেই জ্যাম, কোলাহল, হরতাল, রিক্সাওয়ালার ঝুঞ্ঝুনি, লোকার শব্জিওয়ালার হাকানিই অনেক মিস্টি আর সুখের। ছেলেমেয়েরা এখানে থাকতে চায়, এই আমেরিকা শুধু ইয়াং জেনারেশনের জন্য। আমাদের জন্য নয়। যদি কার কন সমস্যা না থাকে, সে যেন আমেরিকায় বা বিদেশে সেটেল্ড না হয়। এটা একতা বিরক্তিকর লাইফ। এখানকার রাস্তাঘাট খুব সুন্দর, বাড়িঘর সুন্দর, আইন কানুন সুন্দর, প্রিবেশ সুন্দর, চাকুরী যখন তখন পাওয়া যায় কিন্তু এই দেশ একতা রবোটিক দেশ। কেউ কার বন্ধু নয়, কেউ কার প্রতিবেশ হয়েও প্রতিবেশ নয়।
আমরা প্রায় ঘন্টা তিন বা চার ফরিদ ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। পুরু বাড়িটা ঘুরে ঘুড়ে দেখলাম, সুন্দর বাড়ি। অনেক সপ্নের একটা বাড়ি ফরিদ ভাইয়ের। যার জন্যে তিনি একদিন বাংলাদেশের ৫ তালা বাড়ি ত্যাগ করে, নিজের সমাজকে ছেড়ে, বন্ধু বান্ধব্দের ছেড়ে সেই সুদূর আমেরিকায় চলে গিয়ে একটা বাড়ি কিনলেন, সেই বাড়িটা এখন তার কাছে হাসপাতালের বিছানা ছাড়া যেনো আর কিছুই না। বল্লেন-খুব ক্লাবে গিয়ে সবার সাথে হইচই করতে মন চায়, গোলারটেকের সেই গলিটায় দাঁড়িয়ে পুরান কলিগ আর বন্ধুদের সাথে গল্প করতে মন চায়, বুদ্ধিজীবি শহিদ মিনারের সেই বিশালকায় মাঠের দ্রিশ্য চোখে ভাসে, দেশে চলে আসতে খুব মন চায়, কিন্তু আজ সেই আমেরিকায় বসে একটা মেডিকেটেড খাটের মধ্যে শুয়ে চোখ বন্ধ করে শুধু স্ম্রিতিকে মনে করা ছাড়া আর কনো উপায় নাই। এখন তাদের আর টাকা পয়সার দরকার নাই, ছেলেরা অন্য স্টেটে চাকুরী করে, এক মেয়ে অন্য স্টেটে স্বামীকে নিয়ে বসবাস করে। দিবাও চলে যাবে দ্রুত। শুধু ভাবিই থাকবেন কাছে। এটাই যদি জীবন হয়, তাহলে নিজের সেই পুরান ঘর কি দষ করেছিল?
এক সময় মুন্না ভাই আমাদের থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কই যাবেন? মুন্না ভাই বল্ল-ভাই রে এখানে ঘরে আপনি কতোক্ষন একা একা পেপার আর টিভি দেখে সময় কাতাবেন? তার থেকে একটা অফিসে পার্ত টাইম জব নিয়েছি, সেখানে সান্ধ্যকালিন একতা জব করছি, সময়টা কেটে যাচ্ছে আর সাথে কিছু ইনকামও হচ্ছে। অথচ তাদের কনো কাজ করারও কন প্রয়োজন ছিলো না দেশে।
আমি কখনোই আমেরিকায় বা অন্য কনো দেশে হাজার প্রলোভনেও মাইগ্রেট করতে নারাজ। আমার দেশ যতোই করাপ্টেড হোক, যতই জ্যামের দেশ হোক, কিংবা নোংরা হোক, আমি এ দেশেই থাকতে চাই। ফরিদ ভাইয়ের বাসা থেকে বিদায় নেবার সময় দেখলাম, ফরিদ ভাই ঘুমিয়ে গেছেন, দেখে খুবই মায়া হলো। অত্যান্ত অসুস্থ্য আসলে ফরিদ ভাই। অনেক দোয়া করি যেনো ফরিদ ভাই সুস্থ্য হয়ে উঠেন। যত দিনই বাচুন না কেন, তিনি যেন ভালভাবে বাচতে পারেন।
বিদেশের জীবন নিয়ে আসে অনেক চ্যালেঞ্জ, অনেক মানসিক বা শারিরীক সংঘর্ষ। আর মানুষ এই সংঘর্শের মধ্যে খুজে নেয় তার পরিবারের মানুষদের জন্য কিছু আনন্দ, কিছু সুখের বার্তা। এই সুখ দুক্ষের পরিবেশে খুব কম মানুষকেই পাওয়া যায় যারা অকপটে নিজের থেকে সামনে এসে বলে-“আমরা আপনার পাশে আছি, কোনো প্রয়োজনে অবশ্যই জানাবেন”। আর এটাই বিদেশ। এখানে কেউ কারো না, কোনো প্রতিবেশিই প্রতিবেশী না, কেউ কাউকে যেন চিনে না, আর চিনলেও কারো কোন দায়িত্তও নাই। এতাই দেখছি প্রতিদিন এখানে এই আমেরিকায়।
চলে আসার সময় ফরিদ ভাবী আবার কি কি যেনো উপহার হাতে তুলে দিলেন। কয়দিন পর আবার দেশে চলে যাব, কে জানে আবার ফরিদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয় কিনা। আল্লাহ ঊনাকে সুস্থতা দান করুক।