০৫/০২/১৯৮৬-নাইটগার্ড চেকিং এর বিরম্বনা

'শীতকালীন মহড়া’ মানেই প্রায় সারা দিনরাতই ইউনিটের ভিতরে কোনো না কোনো অনুশীলন থাকে। ছুটির দিনেও কাজ থাকে। লেপাই পোছাই, এবং রক্ষনাবেক্ষন। সবচেয়ে জুনিয়র অফিসার হিসাবে কোনো কাজ নাই আমার কিন্তু সারাদিন কারো না কারো ডিস্পোজালে আছিই আছি। ইদানিং ইউনিটের  ক্যাঃ গনি স্যার আমাকে রাতের কিছু ডিউটি ভাগ করে দিয়েছেন। রাত ২ টা থেকে ৫ টার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় নাইটগার্ড চেক করা। আসলেই নাইটগার্ড রাতে ডিউটি করছে নাকি ঘুমিয়ে আছে, এটা অত্যান্ত একটা বিবেচনার বিষয়। তারমধ্যে সিভিলিয়ান এরিয়ায় যখন অনুশীলন এলাকা। তাই এটাকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে দেখতে হয়। যে কোনো সময় যে কোন কাল্পনিক শত্রু (অর্থাৎ সাজানো শত্রু) আমাদেরকে এটাক করতে পারে বিধায় সেন্ট্রিকে জাগ্রত থাকতেই হয়। অনেক অস্ত্র, অনেক গোলাবারুদ, অনেক গাড়িঘোড়া।

কিন্তু প্রতিদিন তো আর রাত জেগে জেগে এই নাইট ডিউটিপোস্ট চেক করতে আর ভালো লাগছিলো না। দোস্ত লুতফরকে বললাম, কিরে দোস্ত, একি শুরু হইলো? প্রতিদিন আমাকেই রাতে ২ টা থেকে ৫ টার মধ্যে এতো দূরে দূরে হেটে হেটে আবার কখনো কখনো পিক আপে করে একা একা ডিউটি চেক করতে কি আর ভালো লাগে? তারমধ্যে আবার সারাদিন কাজেই তো থাকি। ঘুমানোর সুযোগ নাই। কিন্তু আমার লুতফর দোস্ত অপারগ। আদেশ মানেই আদেশ। কিচ্ছু করার নাই তার।

ভাবলাম, আমাকেই একটা বিহিত করতে হবে। কিভাবে এই আদেশ রহিত করা যায়। আমার মনে হলো, অধিনায়ক এটা জানেন না যে, আমার উপর এই রকম একটা টর্চার চলছে। তাই গতকাল একটা বুদ্ধি আটলাম। সেটা এই রকমেরঃ

সিও সাহেবের তাবুর পাশে উপঅধিনায়কের তাবু, তার পাশে এডজুটেন্ট লুতফর সাথে কোয়ার্টার মাষ্টার লেঃ নিজাম স্যারের তাবু, তার পাশেই ক্যাঃ গনি স্যারের তাবু। ব্যাটরীর অফিসারগন তাদের নিজ নিজ ব্যাটরীর লোকেশানে তাবু গেড়ে থাকেন। আমার তাবু সৈনিকদের তাবুর সাথে। প্রতিরাতে নতুন নতুন পাশওয়ার্ড দেওয়া থাকে। যখনই কোনো মানুষ বা সৈনিক অথবা অফিসার ক্যাম্প লোকেশানে আসে, রাতের বেলায় পাশওয়ার্ড চেকিং করার মধ্যে সে নিজেদের লোক নাকি অন্য কোথাকার লোক বা শত্রু পক্ষ সেটা বুঝা যায়। এই পাসওয়ার্ড প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা এবং অত্যান্ত গোপনীয়।  আমি যখন নাইটগার্ড চেক করতে যাই, তখন সেন্ট্রি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে। তখন এই পাশওয়ার্ড বলতে পারলেই ওরা ধরে নেবে যে, আমি বহিরাগত নই, আমি তাদেরই একজন। এখানে একটা ছোট কৌশলের কথা বলি। পাস ওয়ার্ড সাধারনত দুইটা শব্দে বিভক্ত। যেমন ধরুন ‘গোল্ডেন ড্যাডি’। যখন কোনো সেন্ট্রি কাউকে পাস ওয়ার্ড চ্যালেঞ্জ করে, তখন সেন্ট্রি এই দুই শব্দের যে কোনো একটি শব্দ বলবে। আর যাকে চ্যালেঞ্জ করা হলো, তিনি বাকী শব্দটটা বলতে পারলেই নিজেদের লোক, আর না বলতে পারলেই তাকে চ্যাংদোলা। তো, সন্ধ্যার পরপরই আমি অধিনায়কদের তাবুর পাশে যারা রাতে ডিউটি দেয় তাদের বলে রাখলাম যে, আজ রাতে আমি তোমাদের গার্ড চেক করতে আসবো। তখন ডেমোর মতো আমাকে চ্যালেঞ্জ করবা। অর্থাৎ যখন সেন্ট্রি পোষ্ট চেক করতে আসবো, তারা যেনো আমাকে গলা ফাটিয়ে এমনভাবে সেন্ট্রি চ্যালেঞ্জ করে যেনো পুরু এলাকা শুনতে পায়।

আমি রাত সাড়ে তিনটায় কথামতো অধিনায়কের তাবুর পাশে আসার সাথে সাথে ডিউটিরত সৈনিক গলা ফাটিয়ে আমাকে বলে উঠল,

"থাম............... হাত উপর!! ......এগিয়ে আসুন......... তারপর সে পাশওয়ার্ডের অর্ধেক বল্লো, আর বাকীটা আমি বললাম। মিলে গেলো। সুতরাং আমি বহিরাগত নই এটা প্রমান হলো। কিন্তু

সৈনিকের এতো উচ্চস্বরে চিৎকার করার কারনে সিও সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তিনি আসলেই খুব বিরক্ত হয়ে তাবু থেকে বের হয়ে এলেন। এসে আমাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার আখতার, এতো জোরে সেন্ট্রি চ্যালেঞ্জ কেনো? বললাম, স্যার প্রতিদিন আমি তো রাত ২ টা থেকে ৫ টার মধ্যে নাইট গার্ড চেক করি, তাই ভাবলাম, আমার নিজেরও ঘুমঘুম আসে, আবার ওরাও ঘুমে ঘুমে থাকে অনেক সময়, যদি জোরে চিল্লায়, তাহলে হয়ত ঘুমটা থাকবে না।

অধিনায়ক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিদিন তুমি কেনো রাত ২ তা থেকে ৫ টা পর্যন্ত গার্ড চেক করো? বললাম, স্যার এটাতো প্রায় সপ্তাহ খানেকই হয়ে গেলো করছি। আর যায় কোথায়। সিও সাহেবের এমনিতেই মেজাজ খারাপ তারমধ্যে আবার তার আইওর এই অবস্থা। সাথে সাথেই ডাকলেন এডজুটেন্ট আর ক্যা; গনি স্যারকে। অতো রাতে এডজুট্যান্ট আর ক্যাপ্টেন গনি স্যার এই শীতের কম্বল থেকে বের হয়ে এলেন। আর যায় কই? অধিনায়ক দিলেন এক বকা।

ক্যাঃ গনি স্যারের বুঝার বাকী নাই ব্যাপারটা। আর লুতফরও মিটি মিটি হাসছিলো। আগামীকাল থেকে আমার নাইটগার্ড চেকিং বন্ধ। অধিনায়কের আদেশ। আর আদেশ তো আদেশই।

অধিনায়ক বিরক্ত নিয়ে তার তাবুতে ঢোকে গেলেন। গনি স্যার চালাক মানুষ, আমার দিকে তীর্যক একখানা চাহনী দিয়ে এটাই বুঝালেন, তুমি যদি যাও ডালে ডালে, আমি যাই পাতায় পাতায়। বুঝলাম, নাইট ডিউটি বাদ হইলো বটে, কিন্তু নতুন কিছু আসিতেছে।

সামরীক বাহিনীর জীবন, বড় বৈচিত্র্যময়।  মাঝে মাঝে কোল্ডওয়ার হয় নিজেদের মধ্যে।

রাতের বেলায় সাধারনত একটি সেন্ট্রি পোষ্টে দুজন করে প্রহরী থাকে। অনেক সময় দেখা যায় যে, রাত যতো গভীর হয়, একজন আরেকজনকে ঘুমানোর জন্য সাহাজ্যও  করে, এটা বিপদজনক। তাই প্রতি রাতেই কোনো না কোনো অফিসার প্রতিটি সেন্ট্রি পোষ্ট কয়েকবার করে অকস্মাত চেক করেন।

সবসময় দেখা যায় যে, কনিষ্ঠতম অফিসারদের বেলায় এই রকম ভাগ্যে জুটে যে, প্রায় প্রতিরাতেই তাদের নাইট গার্ড চেক করতে হয়। আর অন্যান্য অফিসারগন নিরিবিলিতে শান্তিতে ঘুমাতে থাকেন। কিন্তু কতোক্ষন, কতোদিন একটানা করা যায়?