যে কোনো দেশের কারেন্সী সাধারনত সোনা বা হার্ড এসেটের মাধ্যমে ব্যাকিং করে সেই অনুপাতে তারা তাদের কারেন্সী প্রিন্ট করতে পারে। যদি হার্ড এসেট এর বাইরে কেউ তাদের কারেন্সী প্রিন্ট করেন, তাহলে সেই কারেন্সী অবমুল্যায়িত হয়ে মুদ্রাস্ফিতিতে পড়ে যায়। এক সময় ডলারও তার বিপরীতে হার্ড এসেটের মাধ্যমে কতটুকু ডলার প্রিন্ট করতে পারবে সেটা নির্ধারিত ছিলো।
কিন্তু ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সৌদি আরবের প্রিন্স ফাহাদ আবুদুল আজিজ ৬ পাতার যে একটা এগ্রিমেন্ট করেন সেখানে এই দুই দেশ এইমর্মে রাজী হয় যে, তেল আমদানী রপ্তানিতে শুধুমাত্র ডলার ব্যবহার হবে, অর্থাৎ ডলার পেট্রো ডলারের স্বীকৃতি পেলো। এই ডলার যখনই পেট্রো ডলার হিসাবে স্বীকৃতি পেলো, তখন থেকে ডলার আর সোনা বা অন্য কোনো হার্ড এসেট এর বিনিময়ে ব্যাকিং করার দরকার পড়লো না বরং আমেরিকার অর্থনইতিক শক্তির উপরেই এটা হার্ড এসেট হিসাবে গন্য হবে বলে ধরে নেয়া হলো। ফলে আমেরিকার জন্য যেটা হলো যে, সে যতো খুশী ডলার ছাপালেও কিছু যায় আসে না, যেহেতু কোনো হার্ড এসেট লাগে না। এটা একটা আনলিমিটেড শক্তি। প্রায় ৪২% ট্রেড হচ্ছিলো এই ডলারে। এরমানে এই যে, শুধু কাগুজে ডলার দিয়েই আমেরিকা তেল সমৃদ্ধ দেশ ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, মিডল ইষ্ট, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদি দেশ থেকে তেল ক্রয় করতে পারে। এটার সর্বপ্রথম বিরোধিতা করেছিলো সাদ্দাম এবং পরে বিরোধিতা করেছিলো হূগু সাভেজ। এর ফলে তাদের পরিনতি কি হয়েছিলো সেটা আমরা সবাই জানি।
যাই হোক, ৪২% এর বাকী ট্রেডিং হচ্ছিলো নিজ নিজ দেশের কারেন্সীতে অন্যান্য পন্যে। কিন্তু আরেকটা মজার ব্যাপার ছিলো যে, ডলারকে একমাত্র রিজার্ভ কারেন্সী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া। ফলে অন্য দেশের কারেন্সীতে ট্রেড করলেও প্রতিটি দেশ তাদের নিজের কারেন্সীকে রুপান্তরীত করতে হতো ডলার। এরমানে প্রায় ১০০% ট্রেড এই ডলার কারেন্সীতেই। সব দেশ তাদের রিজার্ভ রাখতে হয় ডলারে আর সেটা আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। এটাকে অন্যভাবে FIAT Currency ও বলা যায়। এই ফিয়াট কারেন্সি নিয়ে আরেকদিন বল্বো।
যেহেতু পলিসি মোতাবেক সব ট্রাঞ্জেক্সন হয় পেট্রো ডলার বা রিজার্ভ কারেন্সী (ডলার) এ করতে হয়, ফলে প্রায় সব দেশ আমেরিকার কাছে মুটামুটি জিম্মি। ফলে এই ডলার হচ্ছে আমেরিকার লাষ্ট সার্ভাইভিং সুপার পাওয়ার টুলস। এটার মাধ্যমে আমেরিকা যে কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারতো, রিজার্ভ আটকে দিতে পারতো। কোনো দেশ আমেরিকার পলিসির বাইরে গেলে বা তাদের সুবিধা মতো কাজ না করলেই আমেরিকা এই রিজার্ভ কারেন্সী আটকে দিয়ে সেটা তাদের নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারতো। এই জিম্মি দশা অনেক দেশ মনে প্রানে মেনে নিতে যেমন পারছিলো না, তেমনি এ থেকে সরে যাবার পথও খোলা ছিলো না। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সুইফট থেকে যখন বাদ দেয়া হলো, তখন রাশিয়া এটাকে ব্লেসিংস হিসাবে ধরে নিলো। বহু দেশ যেনো এই জিম্মি হওয়া ডলার থেকে বেরিয়ে অন্য কোনো কারেন্সীতে পা রাখা যায় কিনা তার দিকে তাকিয়েই ছিলো। এর সুযোগ গ্রহন করছে চায়না। অর্থনীতির এই জায়ান্ট তার নিজস্ব কারেন্সী ইউয়ানকে ডলারের প্রতিস্থাপক হিসাবে দাড় করানোর চেষ্টায় রাশিয়ার সাথে এবং আমাদের পার্শবর্তী ইন্ডিয়াকে তাদের পাশে নেয়ার চেষ্টায় ব্রিক্স কারেন্সীর উদবোধনে সচেষ্ট হয়ে গেলো। এখন এই ডলার আউট হয়ে যাচ্ছে। রিজার্ভ কারেন্সী হিসাবে ইউয়ান এবং এর সাথে নিজস্ব কারেন্সীতে ট্রেড। নিজস্ব কারেন্সীতে ট্রেড করলে কোনো দেশেয় আর তাদের রিজার্ভ এর ঘাটতি হবে না। এটাই ধ্রুব সত্য।
তাহলে ডলার কিভাবে আউট হয়ে যাচ্ছে? সেটা একটা সংক্ষিপ্ত ভাবে না বললেই নয়।
রিচার্ড নিক্সন এবং হেনরী কিসিঞ্জার এক সময় ভবিষ্যত বানী করেছিলো যে, যদি আমেরিকাকে তার ইউনিপোলার হেজিমনি ধরে রাখতে হয়, তাহলে সে যেনো সর্বদা রাশিয়া এবং চীনকে কখনোই একত্রে আসতে না দেয়। অন্য কথায় তারা এটা বুঝাতে চেয়েছে যে, রাশিয়া আমেরিকার শত্রু নয়, শত্রু হচ্ছে চীন। চীন এটা জানে এবং সবসময় সেটা মাথায় রাখে। চীন পৃথিবীর সবদেশ গুলির মধ্যে ইকোনোমিক জায়ান্ট। কিন্তু আমেরিকার গত কয়েক রিজিমে এই পলিসি থেকে আমেরিকা অনেক দূর সরে আসায় এখন চীন এবং রাশিয়া এতোটাই কাছাকাছি চলে এসছে যে, তারা বলছে তাদের বন্ধুত্ত সিমেন্টের থেকে শক্ত। তিনটাই সুপার পাওয়ার। দুইটা একদিকে আর আমেরিকা আরেকদিকে।
আমেরিকা গত কয়েক দশকে বিভিন্ন দেশসমুহকে এমনভাবে যাতাকলে রেখেছে যে, ধীরে ধীরে সউদী আরব, ইরান, ইরাক, ভেনিজুয়েলা, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা সবাই এর উপর ত্যাক্ত বিরক্ত। আর সবচেয়ে বিরক্তের ব্যাপার হলো এই যে, ”হয় তুমি আমার দলে, না হয় তুমি শ্ত্রুর দলে” এই কন্সেপ্টে কেউই নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও থাকতে পারছিলো না।
এখন যেহেতু ওপেক, বা ওপেক প্লাস তেল আমদানী-রপ্তানীতে হয় নিজস্ব কারেন্সী অথবা ইউয়ান ব্যবহার চালু করছে বা করতে যাচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বেশী লাভ হবে চীনের এবং তার সাথে অন্যান্য দেশেরও। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে আমেরিকার যারা এতোদিন বিশ্ব কারেন্সীর মোড়ল ছিলো। ডলারই ছিলো একটা মারাত্তক অস্ত্র। এই অস্ত্র এখন হাতছারা হয়ে চলে যাচ্ছে চীনের হাতে।
কিন্ত আমেরিকা এতা হতে দিতে চাইবে কেনো? আর ঠিক এ কারনে গত মার্চ মাসে আমেরিকা ডিক্লেয়ার করেছে যে, তারা ৪০% ডিফেন্স বাজেট বাড়াবে যাতে তারা সরাসরি চায়নাকে এটাক করতে পারে। তারা চায় চায়না যুদ্ধে আসুক। আর ইউয়ান কারেন্সি যেনো ট্রেড কারেন্সি না হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, চীন কখনো কোনো যুদ্ধে জড়ায় না।
বর্তমানে সৌদি আরব, ইরান, রাশিয়া, মিডল ইষ্ট, রাশিয়া, চীন, ইন্ডিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং অন্য বেশীর ভাগ দেশ সবাই এখন ডলারের পরিবর্তে চায়নার ইউয়ানে ট্রেড করতে আবদ্ধ হচ্ছে। এর অর্থ কি?
এটা হচ্ছে গেম চেঞ্জার।