৫ কার্তিক, ১৯৯৩
বড় বউদি, তোমাকে আমি সাধারনত কখনো চিঠিপত্র লিখিনি। তুমিও আমাকে কখনো চিঠি লিখনি। এরমানে এই নয় যে আমি কিংবা তুমি আমাকে বা আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই ভালবাসি। আমি একটা জিনিষ লক্ষ করছি যে, তুমি একটা জায়গায় ফেল করছ। আর তা হচ্ছে তুমি তোমার সন্তানদেরকে মানুষ করতে পারছ না। বিশেষ করে শাসন। পারবে এত দূর নিয়ে যেতে সবাইকে?
একটা সময় আসবে যখন তুমি আর কখনো ওদের শাসন করতে পারবে না। কারন তখন শাসনের বয়সটাই থাকবে না। আজ তুমি যতোটা আদর করে ওদের অনেক অযাচিত আবদার, অনেক শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণ, অনেক অগ্রহণযোগ্য ব্যবহার গলাদকরন করছো, কোন এক সময় এই অহেতুক আব্দারের প্রেক্ষাপটে তাদের বর হয়ে উঠা, তাদের বিশৃঙ্খল হয়ে বেড়ে উঠার মাশুল শুধু তুমি না, তোমার এই আদরের সন্তানদেরকেও দিতে হবে। তখন হয়ত এরাই তোমার দিকে আঙুল তুলে এইটা বলবে, কেনো আমাদেরকে যখন শাসন করার দরকার ছিলো, সেতা করো নাই? আজ মনে হচ্ছে তুমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও না। মনে হচ্ছে তুমি আগামী প্রজন্মের যে ধারা এই পৃথিবীতে আসছে, তুমি সেই ধারনার থেকে অনেক পিছিয়ে আছো।
আমি যেদিন গ্রাম থেকে ঢাকায় আসি, সেদিন দেখেছিলাম, আমাদের গ্রাম এই অল্প দূরের ঢাকা শহর থেকে কত পিছিয়ে ছিলো। আর তার সাথে সাথে আমি দেখেছি, গ্রামের গর্ভে যারা তখনো বসবাস করছে, তারা ঢাকার সভ্যতা থেকে কতই না পিছিয়ে আছে। কথার বলার স্টাইল, একে অপরের সাথে ব্যবহার করার অভ্যাসে, কিংবা স্বপ্ন দেখার বাউন্ডারী পর্যন্ত জানে না ঐ সব গ্রামের মানুষগুলি। আমি গ্রাম থেকে এই শহরে এসে পুরুই একটা বেমানান প্রানীতে পরিনত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি চলমান ছিলাম, আমি ব্যতিক্রম কি, কোথায় তার প্রতিকার, কি করা উচিত, সেটা ভাবতে বেশী সময় নিতে চাই নাই। আমি খুব দ্রুত ঢাকার পরিবেশের সাথে, মানুষগুলির সাথে, এই শহরের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। যতোদিন পারি নাই, সেটা আমার ব্যর্থতা নয়, সেটা আমার এডাপটেশনের জন্য সীমারেখার সীমাবদ্ধতা। তারপরে যখন আমি এই শহর থেকে আরো একধাপ এগিয়ে ক্যাডেট কলেজে গেলাম, তখন দেখেছি, সমাজের উচু স্তরের পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিভাবে বেড়ে উঠে। তাদের কথাবার্তা, তাদের চলাফেরা ঢাকা শহরের মানুষগুলির থেকেও আলাদা। তাদের চিন্তা ধারা আলাদা, তাদের সব কিছু আলাদা। ঢাকা শহরে তোমাদের বাসায় এর চর্চা নাই। আর না থাকারও কথা। তোমরা সমাজের উচু স্তরের লোক নও। মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ। আমি সেই অজ পাড়াগায়ের সাথে এই উচু স্তরের পরিবার গুলির মধ্যে যে পার্থক্য, যে দুরুত্ত, সেটা যথাসম্ভব বুঝবার চেষ্টা করেছি এবং আমাকে আমি ঠিক আমার পরিস্থিতির আওতায় তা মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তারপর যখন আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে সেনাবাহিনীর নতুন জগতে প্রবেশ করলাম, দেখলাম, এখানে আরেক জগত। এর সব ধরনের শাখা বা উইং আছে। গ্রামের অজ পাড়াগায়ের লোকজন ও আছে, মধ্যবিত্ত ঘরের অসচ্ছল সসদ্য ও আছে, আবার একেবারে উচু স্তরের সদস্য রাও আছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, পাশাপাশি, কাছাকাছি, একই ইউনিফর্ম, একই রেশন, একই কমান্ড, অথচ কেউ কারো সাথে ম্যাচ করে না। কিন্তু সিস্টেম কাজ করে। এই এডাপ টেশন টা একটা জটিল বষয় কিন্তু একেবারেই সহজ আমার জন্য। কারন আমি সব গুলি স্তর ইতিমধ্যে নিজে পার হয়ে অভিজ্ঞ হয়ে এসেছি। তলাহীন গ্রামে বড় হয়ে দেখেছি, এখানে যারা ঐ তলাবিহীন সমাজ থেকে এসেছে তাদের কি মনের অবস্থা, তাদের কি চাহিদা। আবার তোমাদের সাথে আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সদস্য হিসাবে এতাও অভিজ্ঞতায় পেয়েছি, এই মধ্যবিত্ত মানুষগুলির মানষিক অবস্থা কি, কি তাদের বৈশিষ্ট। ফলে সেনাভিনীর এই মধ্যবিত্ত সদস্যগুলি কে নিয়েও আমার খাপ খাইতে অসুবিধা হয় নাই। আবার ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে আমি উচু স্তরের মানুষ গুলির ব্যবহার, আচরণ, প্রত্যাশা, বৈশিষ্ঠও আমার জানা ছিলো। ফলে প্রতিটি স্তরের পরিবেশ, মানুষগুলির চাহিদা কিংবা তাদের সাথে উঠাবসা করার কৌশল আমার অনেকটাই জানা। এই সুবিধা গুলি কিন্তু আমাকে কেউ এমনি এমনি দেয় নাই, আমাকে প্রতিটি জিনিষ আহরন করতে হয়েছে, পাওয়ার জন্য আমাকে সেই চেষ্টা গুলি করতে হয়েছে।
আমি যদি সেই অজ পাড়া থেকে উঠে এসে এই স্তরে আসতে সক্ষম হই, তাহলে তুমি বা তোমরা কেনো এক ধাপ এগিয়ে থাকা তোমার সন্তানদেরকে আরেক ধাপা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো না? তোমার কাজ তো শুধু ঘরের রান্না বান্নাই না। পেটে সন্তান ধরেছো, তাহলে তাদেরকে আধুনিক সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কি তোমার বা তোমাদের কিছুই করার নাই? ওরা পিছিয়ে পড়ছে মুল ধারার সমাজ থেকে। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে অবিরত যেখানে সমাজ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কোনো এক সময় তুমি বা বদি ভাই এর মাশুল দিয়ে হয়ত এটাই বলবে, দেশের জন্য অনেক কিছুই তো করলাম, কিন্তু নিজের পরিবারের জন্য কি করলাম? দেশ তোমাকে তোমার ঘরে এসে তোমাকে সেবা প্রদান করবে না। দেশের যাবতীয় কাঠামো গত সুবিধা তোমাকে পেতে হলে তোমার সন্তানদেরকে সেই স্তরে উঠিয়ে দিতে হবে। আর যেটা তুমি আজ করছো না। এটাই হচ্ছে তোমাদের ভুল।
তোমার সঙ্গে হাবিব ভাইয়ের বউয়ের বিশাল একটা পার্থক্য আছে। তুমি কি সেই পার্থক্যটা বুঝো? তুমি সাগরের মত পানি আর সে দিঘিতে রাখা জল। তোমার সাগর সমান পানি অনেক সময় তৃষ্ণা মিটাবে না কারন সাগরের পানি পান করতে গেলেও তাকে অনেক শোধনাগারে শোধন করতে হয়। কিন্তু হাবীব ভাইয়ের বউ দীঘির জলের মতো পরিষ্কার, সেটা শোধনের জন্য অনেক বেশী পরিশ্রমের দরকার নাই। আমার এই কথাগুলি আজ হয়তো কোনো অর্থ বহন করে না কিন্তু হয়তবা আজ থেকে ৩০ বছর পর যদি আমরা বেচে থাকি, তার একটা পার্থক্য ধরা পড়বেই। আজ তোমার সংসার তোমার হাতে, তোমার রান্না করার পরিকল্পনা তোমার হাতে। আজ তোমার সাধ্যের মধ্যে যা কিছু ইচ্ছে হয় তুমি কোনো নাকোনোভাবে সেটা নিজের তরিকায় পুরুন করার ক্ষমতা তোমার হাতেই। কিন্তু কোনো এক সময় তোমার এই সংসার আর তোমার হাতে নাও থাকতে পারে। তখন এর চাবিকাঠি হয়ত অন্য কারো হাতে চলে যাবে। এখন তুমি শক্ত সামর্থবান, কিন্তু যখন তুমি শারীরিকভাবেও দূর্বল হয়ে পড়বে, সংসারের চাবিকাঠি আর তোমার হাতেথাকবে না, তখন মনে হবে, এই সংসার জীবনে কি আমি কিছুই করি নাই? নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হবে। আজ তোমার স্বামী তোমার রাজা। তার উপর তোমার অধিকার শুধু স্বামীহিসাবেই নয়, সে তোমার ধারন করে। কিন্তু কোনো এক সময়, যখন হয়ত সে আর থাকবে না, তখন তুমি অনেকের কাছেই একটা এক্সট্রা মালামালের মতো বোঝা হয়ে পড়বে। আমি আমার মাকে দেখেছি সে কতটা অসহায়। আমি আমার ভাইকে দেখেছি, পট পরিবর্তনে কতটা সময় লাগে। আজকের এই দিনটা আগামীকাল নাও একই থাকতে পারে।
তুমি ভাল থেক।