০৫/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব-১

 

নিউলংকার ক্যাম্প- পর্ব-১ 

পাহাড়ি জীবনের একটা আলাদা সৌন্দর্জ আছে। এই সৌন্দর্জ সমতল ভুমির সাথে কিছুতেই মিল নাই। এখানে পাহাড় কথা বলে, আকাশ কথা বলে, এখানকার গাছ গাছালিও কথা বলে। দিনের বেশীরভাগ সময় পাহাড় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একেবারে নিস্তব্দ হয়ে, কখনো কখনো পাহাড় হয়ে উঠে গম্ভীর আবার কখনো কখনো মেঘের সাথে এই পাহাড়ের মধ্যে মিতালিও হয়। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা পাহাড়ের চুরায় চুরায় বসে থাকে, কখনো আবার রঙধনু হয়ে আকাশের সাথে দূর পাহাড়ের মধ্যে একটা সেতু বন্ধন গড়ে তোলে। বিধাতার কি অপরুপ খেলা।

এই পাহারের সর্বোচ্চ চূরায় বসে আমি যখন উচ্চস্বরে কথা বলি, পাহাড় তার প্রতিধ্বনি দিয়ে আমাকে সেই একই কথা আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমি মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে ক্যাম্পের কোনো এক স্থানে বসে বসে বন মোরগের ডাক শুনি, আবার মাঝে মাঝে পূর্নিমার রাতে হরিন শাবকের কচিকচি ঘাস খেতে দেখি। বানরেরা এখানে ঠিক বানরের মতো অসভ্য নয়। মানুষ দেখলে তারা মুখ ভেংচি করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায় না। আবার বন্ধু মনে করে একেবারে কাছেও আসে না। কিছু কিছু অদ্ভুদ পাখী নজরে পড়ে। কোথা থেকে এরা উড়ে আসে আমি জানি না। কিন্তু বেশ সুন্দর। লম্বা লম্বা ঠোট আর বিভিন্ন রঙ এর।

অফিসার হিসাবে আমি একাই এই ক্যাম্পে আছি। আর আমার সাথে আছে প্রায় ৪০ জন বিডিআরের সৈনিক। আর্মির সৈনিকদের সাথে বিডিআরের সৈনিকদের মধ্যে আলাদা একটা পার্থক্য খুব সহজেই ধরা পড়ে। আর সেটা হচ্ছে, কনিষ্ঠতম বিডিআর সৈনিকও অফিসারের সাথে আর্মির সৈনিকের থেকে বেশী মিশুক। এখানে ওয়ারলেস অপারেস্টর হিসাবে সার্বোক্ষনিক কাজ করে নূর মোহাম্মাদ। ছেলেটা বেশ চটপটে। আমার যে রানার, তার নাম জসিম। আর্মির সৈনিকের চেয়ে এরা অফিসারেদেরকে অনেক বেশী সার্ভিস দেয়।

যখন পেট্রোল করে আসি, সারা শরীর ঘেমে একাকার, আর পা যেনো বিষিয়ে উঠে। প্রায় ২/৩ হাজার ফুট পাহাড় বেয়ে ক্যাম্পে উঠতেই তো জীবন শেষ। যখন ক্যাম্পে ফিরে আসি, একটা জিনিশ লক্ষ্য করলাম যে, জসীম দ্রুত আমার পায়ের বুট খুলে দেয়, মাঝে মাঝে আমার পাও এমনভাবে মালিশ করে দেয় যেনো কাজটা করতে ওর বেশ ভালই লাগছে। আমার কেমন যেনো ইতস্তত বোধ হয়, কিন্তু জসীম প্রায় জোর করেই কাজটা করে আর বলে, স্যার, আপনি হচ্ছেন, আমাদের নেতা। এটা আমার দায়িত্ত আপনাকে ভালো রাখা।

ক্যাম্পে একটা ছোট মসজিদ আছে। কে বা কারা এই মসজিদ প্রথম উদ্ভোধন করেছিলো আমার জানা নাই। তবে এখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজ হয়। নামাজের ইমামতি করেন আমাদের সিনিয়র এক জেসিও। হাবিলদার রহমান নামে একজন হাবিলদার আছে আমার ক্যাম্পে, সে সারাক্ষন যখন ক্যাম্পে থাকে সুতা দিয়ে জাল বুনতে থাকে। হাবিলদার অন্যের সাথে খুব একটা মিশেও না। ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায় নাই। 

প্রতিদিন পেট্রোল করতে হয় না। সপ্তাহে তিনদিন আমরা আশেপাশের এলাকায় পেট্রোল করি। এই কয়দিনে আমি প্রায় প্রতিটা জায়গা যা আমাদের এরিয়ার অন্তর্গত, সবখানেই গিয়েছি। যেদিন পেট্রোল থাকে না, সেদিন আমি প্রায় সারাক্ষনই সৈনিকদের সাথে কোনো না কোন ব্যাপার নিয়ে আলাপ করি, গল্প করি। আর বিকাল বেলায় একমাত্র ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিতে ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট দেখি। ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট বা ক্রিকেট খেলাটা আমার কখনোই বেশী পছন্দের ছিলো না। কিন্তু ক্যাম্পের এই বেকার জীবনে এই একটি মাত্র বিনোদন যন্ত্রতে যা দেখানো হয় সেটাই বিনোদনের অংশ হিসাবে আনন্দ নেবার চেষ্টা করি।

আমার উত্তরে যে ক্যাম্পটা আছে সেটা সাজেক, আর দক্ষিনে যে ক্যাম্পটা আছে সেটার নাম ওল্ড লংকার। সাজেকে প্রচুর কমলা হয়। আর এর পাশ দিয়ে চলে গেছে সাজেক রিভার। সাজেক রিভার পার হলেই ভারতের মিজোরাম শহর। কোনো ক্যাম্পেই অফিসার নাই। আমরা যেদিন উত্তরে যাই, সেদিন সাজেক আর যেদিন দক্ষিনে যাই সেদিন ওল্ড লংকারে যাই। এই যাওয়া আসার মাঝে অনেকগুলি গ্রাম পড়ে। এখানে বেশীর ভাগ ট্রাইব পাংখু। চাকমা খুব কম। পাংখু উপজাতীরা বেশ স্মার্ট। কেউ কেউ জিন্সের প্যান্ট আর গিটারও বাজায়। এখানে যিনি হেডম্যান, তিনি বেশ দয়ালু। সে পারা প্রতিবেশীদের খবরাখবর রাখে। তার বাড়িতে আমরা প্রায়ই যাই, খুব বেশি দুরেও না।

ক্যাম্পে যেহেতু আমার অঢেল সময় হাতে থাকে। ভাবলাম, দুটু প্রোজেক্ট হাতে নেয়া যায়। (এক) আমি ইংরেজীতে যতটুকু পারি চর্চা করবো যাতে আমার ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ে। তাই ভাবলাম, ঢাকা কুরিয়ার নামে একটা টেবলয়েড ইংরেজী পত্রিকা সের দরে কিনে আনি। আমি সেগুলি পড়তে থাকি। পড়তে পড়তেই একসময় আমার ভোকাভেলুয়ারী বাড়বে। আর এর মধ্যে আমি বিবিসির ইংরেজী প্রোগ্রামটা রীতিমতো শুনবো তাতে কিভাবে ইংরেজীতে আরো ফ্লুয়েন্ট কথা বলা যায় সেটাও বাড়বে। আর আমার দ্বিতীয় প্রোজেক্ট হলো যে, আমি বাংলায় পবিত্র কোরান শরীফটা পড়বো এবং শেষ করবো। অন্তত জানতে পারবো আমাদের পবিত্র কোরান শরীফ আমাদের জন্য কি কি বার্তা দিয়েছেন।

বিডিআর এর সৈনিকরা ইতিমধ্যে আমার সাথে অনেক বেশী ফ্রেন্ডলী হয়ে গেছে। আর আমিও ওদেরকে যথেষ্ট পরিমানে আমার নিজের সৈনিকের মতোই দেখার চেষ্টা করি। অবসর সময়ে আমি কখনো কখনো ওদের সাথে তাশ, ক্যারম, কিংবা অন্য যে খেলাগুলি ক্যাম্পে বসে খেলা যায়, সেগুলি করি। ওরাও বেশ মজা পায়।

সন্ধ্যার পর আমরা বেশীরভাগ লোক খাওয়া দাওয়ার পর এশার নামাজের পর জিকিরে বসি। একটা পবিত্রতা আসে। জসীম, আমার রানার, আমাকে যতোটুকু সার্ভিস দেয়া যায়, দেয়।

একদিন জসীম আমাকে বল্লো, স্যার, আজ প্রায় ৬ মাস হয়ে গেলো ছুটি যাই না। বাড়িতে বউ আছে, ছোট একটা বাচ্চাও আছে। কোনো যোগাযোগ করতে পারি না। আমার মতো এ রকম অনেক সৈনিক আছে যারা ছুটির জন্য বসে আছে কিন্তু ব্যাটালিয়ান থেকে আমাদেরকে নামানো হচ্ছে না। দেখেন না স্যার, আপনি কিছু করতে পারেন কিনা। এ ব্যাপারটা আমার নজরে ছিলো না। আমি পরেরদিন আমার দোস্ত ক্যাপ্টেন মাহফুজের (ব্যাটালিয়ানের উপঅধিনায়ক) সাথে আলাপ করলাম। মাহফুজ যেটা জানালো সেটা একটা জাষ্ট মামুলি ব্যাপার। মানে, কোনো একটা সৈনিককে ক্যাম্প থেকে নামিয়ে ছুটি দিতে হলে দুটু পেট্রোল করতে হয়। এক, যে নামবে তার জন্য একটা, আর যে প্রতিস্থাপিত হবে তার জন্য একটা। ফলে সব সময় এই পেট্রোল করার লোক থাকে না। আবার সব সময় প্রতিস্থাপকের লোকও থাকে না। আমি যদি প্রতিস্থাপকের জন্য চাপ না দেই, তাহলে তারা ছুটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না।

ব্যাপারটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এর একটা সমাধান তো দরকার। কি করা যায়, এটা নিয়ে আমি আমার ক্যাম্পের সৈনিকদের সাথে পরামর্শ করলাম। ওয়্যারলেস অপারেটর চমৎকার একটা পরামর্শ দিল যে, স্যার, আমাদের ক্যাম্পে যখন হেলিসর্টি হয়, যদি আপনি ওই হেলিসর্টির সাথে একজন দুইজন করে আনা নেওয়া করতে পারেন, তাহলে এক্সট্রা কোন পেট্রোল করতে হয় না।  আর আমরা তো রতিন পেট্রোল করি না। আর যখন পেট্রোল করি, যাই মাত্র ২০ জনের মতো, কোনো কারনে যদি ছুটির কারনে ২/৩ জন কম ও থাকে বাকি ১৬/১৭ জন দিয়ে ক্যাম্প প্রোটেক্সন দেয়া কোনো ব্যাপার না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হল।

আমার ক্যাম্পে যারা হেলিসর্টি দেয়, সেসব পাইলট সবাই আমার কোর্সমেট। তার মধ্যে আছে ফ্লাইট লেঃ রেজা, ফ্লাইট লেঃ কামরুল, ফ্লাইট লেঃ পাশা, আর ফ্লাইত লেঃ হাসান মাসুদ। আমি বললাম সবাইকে যে, ঠিক আছে, তোমরা সবাই একটা লিষ্ট করো কে কখন কখন ছুটি কয়দিনের জন্য যেতে চাও। সবাই একসাথে ছুটিতে যেতে চাইলে সেটা সম্ভব হবে না। যেহেতু পাইলট সবাই আমার বন্ধু মানুষ, আমি হয়তো ব্যাপারটা এরেঞ্জ করতে পারবো।

যখন এর পরেরবার হেলিসর্টি এলো, আমার বন্ধু কামরুল আসলো। আমি ওকে বললাম, ব্যাপারটা। ও আমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দিল যে, এর পরেরবার যখন হেলিসর্টি হবে, তুমি তোমার ক্যাম্প থেকে কে নামতে চায় সেটা হেলিসর্টির মধ্যে যেনো ইনক্লুড করে দেই। এটা একতা ডিভিশনাল ফর্মালিটিজ। তা না হলে সেও কোনো পেসেঞ্জার নিতে পারবে না।

যেই কথা, সেই কাজ। আমি ব্যাপারটা সহজ করে ফেললাম। অধিনায়ক মেজর জিয়া প্রথমে একটু নারাজ ছিলেন কিন্তু আমার বলিষ্ঠ প্রতিবাদে সেও মানতে রাজী হলো। আমি বললাম, আমার প্রতিস্থাপকের দরকার নাই। আমাই ২/৩ জন কম সৈনিক নিয়েও সুন্দরমতো ক্যাম্প চালাতে পারবো। অধিনায়ক রাজী না হলে এই ব্যাপারটা সৈনিক নামানো সহজ ছিলো না।

এখানে একটা কথা বলা খুব দরকার যে, কেনো মেজর জিয়া আমার কথায় রাজী হতে বাধ্য হলেন। তিনি নিজে একজন অসত লোক। বিডিআর এর অনেক সোর্সমানি, জংগল কাটার টাকা, কিংবা সৈনিকের বাৎসরিক ছুটির টাকা নিজের একাউন্টে রেখে ইন্টারেষ্ট খাওয়া সবই তার ছিলো যেটা একতা নিষিদ্ধ কাজ, কিন্তু আমি জানতাম মেজর জিয়া এটা করেন। যখন তিনি রাজী হচ্ছিলেন না, আর নীতির কথা শুনাচ্ছিলেন, তখন আমি এক পর্যায়ে দূর্নীতির কথা বলে তার এই দুর্বল চারিত্রিক দিকটা আমি তুলে ধরেছিলাম। আর এই কথাগুলি আমার অপারেটর নূর মোহাম্মাদ তথা ক্যাম্পের সবাই জেনে গিয়েছিলো। আমার এ রকম প্রতিবাদী কথায় আমার সৈনিকেরা অনেক সাহস আর আমার উপর একটা ভরষার স্থান তৈরী করে ফেলেছিলো। তারা আমার এ রকম একটা ব্যবস্থাপনায় এতোটাই খুশি ছিলো যে, আমি যেনো তাদের সাক্ষত ত্রানকর্তা রুপে আবির্ভাব হয়েছিলাম।

প্রথম হেলিসর্টিতে নামানো হলো আমার রানার জসীমকে, সাথে আরো একজন। ব্যাপারটা যখন বাস্তবায়ন হচ্ছিলো, সবাই একটা হোপ করছিলো যে, আগামি কয়েক দিনের মধ্যে কারো না কারো টার্ন আসবেই। আর ব্যাপারতা তাইই ঘটতে লাগল। প্রতি হেলিতে আমি তিনজন করে ছুটিতে পাঠাতে লাগলাম। কোনো প্রতিস্থাপক ছারাই আমি আমার সৈনিকদেরকে ছুটিতে পাঠানো শুরু করলাম।

যখনই কোনো সৈনিক ছুটি থেকে আবার ক্যাম্পে ফিরে আসে, তখন কেউ না কেউ আমার জন্য কিছু না কিছু গিফট নিয়ে আসে। কেউ এক প্যাকেট সিগারেট, কেউ একটা ভালো পত্রিকা, কেউ দুটু ব্যাটারি, ইত্যাদি।

এ কাজটা করতে গিয়ে আমি আরো একটা সমস্যায় পরলাম। সাজেক এবং ওল্ড লংকারের সৈনিকেরা জেনে গেলো যে, আমার ক্যাম্প থেকে সৈনিকেরা এখন পালা করে ছুটিতে যেতে পারছে। কিন্তু ওই দুই ক্যাম্প থেকে তারা এ সুযোগটা পেতে চায়। কিন্তু এখন উপায়? উপায় তো একটা বের করতেই হবে। (চলবে)