০৬/০৭/২০২৩-সাকাশভিলি এবং জেলেনেস্কী

আমি UNOMIG (United Nations Observer Missions in Georgia) তে কাজ করার সময় জর্জিয়ায় কেনো শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হইলো সেটা খুব কাছ থেকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছিলাম।

জর্জিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট শাকাসভিলি বর্তমানে জেলে আছেন। এর প্রধান কারন, তিনি তার প্রেসিডেন্সির মেয়াদে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং সেই অপব্যবহারের কারনে জর্জিয়াকে পর পর দুটু রিজিয়ন তার ভুখন্ড থেকে হারাতে হয়েছে-(ক) আবখাজিয়া (খ) সাউথ ওসেটিয়া। দুটুই জর্জিয়ার অংশ ছিল যা বর্তমানে স্বাধীন কিন্তু রাশিয়া অনুরাগী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-জর্জিয়ার অভ্যন্তরের এই দুটু রাজ্য কিভাবে হাতছাড়া হয়ে গেলো যেখানে ভুখন্ড এক, কন্সটিটিউশন এক এবং একই শাসকের অধীনে?

শাকাসভিলি পশ্চিমাদের অনুগত হয়ে সাউথ ওসেটিয়ায় স্নিক এটাক করে তার শাসনামলে সাউথ ওসেটিয়ার অটোনোমাস স্ট্যাটাস থেকে জর্জিয়ার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলো যদিও ওসেটিয়া জর্জিয়ারই একটা অংশ মনে করা হতো। তাইওয়ানের মতো। জর্জিয়া যখন সাউথ ওসেটিয়াতে আক্রমন করে, ঠিক তখন রাশিয়া ওসেটিয়ার পক্ষ নেয় এবং ৫ দিনের মধ্যে জর্জিয়া হেরে যায় এবং সাউথ ওসেটিয়া স্বায়ত্তশাসন থেকে পুরুপুরি সার্বোভোম রাজ্যে পরিনত হয়, ফলে জর্জিয়া সাউথ ওসেটিয়াকে হারায়। একইভাবে আবখাজিয়াও তাই। আবখাজিয়াও জর্জিয়ার সায়ত্তশাশন থেকে পুরুপুরি স্বাধীন রাজ্যে পরিনত হয়।   

পরবর্তীতে জর্জিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্ট স্থলাভিষিক্ত হয় এবং শাকাসভিলি দেশ থেকে পালিয়ে ইউক্রেনে চলে যায়। ইউক্রেনে যাওয়ার পর, ইউক্রেন (পাশ্চাত্য আদেশে) ওডেশার গভর্নর নিয়োগ করে। ইউক্রেন যুদ্ধের ঠিক আগে শাকাসভিলি ওডেসা থেকে আবার জর্জিয়া ফেরত যায়। তার অথবা পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য ছিলো ইউক্রেনের পাশাপাশি জর্জিয়াকেও অশান্ত করা। কিন্তু জর্জিয়ার শাসকগন কিছুতেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ভূমিকা পালন করতে নারাজ ছিলো। ফলে শাকাসভিলির মিশন ফেল করে এবং তাকে এরেষ্ট করে বিচারের সম্মুখীন করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট। এখনো সে জেলে আছে।

এবার আসি ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে।

বিশ্ব মহল মনে করছে যে, ইউক্রেনের যুদ্ধটা ঠিক একই ফরমেটে চলছে। আর সেটা কিভাবে? জেলেনেস্কী ক্ষমতায় আসার পর তার পেট্রোনদের অনুগত হয়ে ২০১৪ সাল থেকে একাধারে ডনবাসে স্নিক এটাক করেই যাচ্ছিলো। ডনবাস কিন্তু সাউথ ওসেটিয়ার মতো কোনো স্বায়ত্তশাসিত রিজিয়ন ছিলো না। এটা ছিলো ইউক্রেনের ভুখন্ডের অবিবেচ্ছদ্য অংশ কিন্তু বেশীর ভাগ রাশিয়ান ভাষাভাষী নাগরিক। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কীও যত দ্রুত ডনবাসকে পুরুপুরি ইউক্রেনীয় কালচারে, আইনে আনা যায় সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কিন্তু রাশিয়ার স্পেসাল অপারেশন এখানে সেই সাউথ ওসেটিয়া কিংবা আবখাজিয়ার মতো রুপ নিলো। ডনবাস সহ আরো চারটি রিজিয়ন যারা ইউক্রেনের সাথে কোনো সংঘাতেই ছিলো না, ইতিমধ্যে সেগুলিও রাশিয়ার কাছে হাতছাড়া হয়েছে ইউক্রেনের, এবং শুধু তাইই নয় তারা রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে যুক্তও হয়েছে।  গত ১৬ মাস যাবত ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে এবং এটার কোনো সাফল্য ইউক্রেন এখনো হাতে পায়নি। আর পাবে কিনা সেটা এখনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। এই স্পেশাল অপারেশনে ইউক্রেন জর্জিয়ার ওসেটিয়ার লক্ষন থেকেও খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। যদি কোনো কারনে পশ্চিমারা এবং ন্যাটো তাদের সাপোর্ট ইউক্রেনে হ্রাস কিংবা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউক্রেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে তার কোনো অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। সাউথ ওসেটিয়ার যুদ্ধটাও পাশ্চাত্যের এবং ন্যাটো ফোর্সের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা প্রক্সি ওয়ার ছিলো।

বর্তমানে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনের কাউন্টার অফেন্সিভে সাফল্য না পেলে ইউক্রেন, তাকে পরবর্তী সাপোর্ট পাশ্চাত্যরা দিবে কিনা আর দিলে কতটুকু সেই বিষয়ে এখন আলোকপাত হচ্ছে। এর মানে প্রক্সি ওয়ারটা প্রায় ধইর্যের শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যে ইউক্রেন তার সিংহ ভাগ মিলিটারী জনবল, ইয়াং জেনারেশন, এবং অন্যান্য ফেসিলিটিজ হারিয়ে ফেলেছে। দেশটি এখন ধংস্তসুপের আখড়া। জেলেনেস্কী এবং তার মিলিটারী কমান্ড ইতিমধ্যে এটা বুঝে গেছে যে, অফেন্সিভ, বা কাউন্টার অফেন্সিভ যেটাই বলা হোক না কেনো, এর ফলাফল অনিশ্চিত। যার কারনে জেলেনেস্কী, কুলেভা, কিংবা তার পরিষদবর্গ সাথে Chair of the House Foreign Affairs Committee Michael McCaul এর মধ্যে এই যুদ্ধে হারার পিছনে ন্যাটো কিংবা পশ্চিমাদের দায়ী করছেন সরাসরি। জেলেনেস্কী নিজেও এটা বুঝতে পারছেন যে, সে ইউক্রেনকে নিয়ে না ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে, না সে এই স্পেশাল অপারেশনে কোনো সাফল্য দেখাতে পারবে। 

সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে যে, ইউক্রেনের যে চারটি রিজিয়ন রাশিয়া দলখল করে নিয়েছে, সেগুলিতে ইউক্রেনের সাথে কোনো সমস্যাই ছিলো না। এখন সেই রিজিয়নগুলিই উদ্ধার করা ইউক্রেনের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। আর এই নিরপেক্ষ রিজিয়নগুলি পুনরায় উদ্ধার করতে গিয়ে ইউক্রেন তার সবকিছু হারাচ্ছে। ইউক্রেন যদি মার্চ ২০২২ এ দিপাক্ষীয় চুক্তিটা করে ফেলতো তাতে অন্তত জ্যাপড়িজ্জিয়া এবং খেরসন রিজিয়ন দুটি ইউক্রেনের অধীনেই থাকতো। কিন্তু Anglo-American Axis sabotage spring 2022’s peace process এর কারনে ইউক্রেন সেই চুক্তি থেকে সরে আসে যা একেবারেই ওসেটিয়া এবং আবখাজিয়ার ফরমেট।

এই অবস্থায় ইউক্রেনে পাশ্চাত্যরা যদি এই প্রক্সি ওয়ারে হেরেই যায়, এর থেকে অপমানজনক আর কিছু হতে পারেনা, এটাই পাশ্চাত্যের বদ্ধমুল ধারনা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটো কিংবা পাশ্চাত্যরা তাদের মানসম্মান একটু হলেও বাচানোর জন্য যেটা ওরা করে, সেটা হচ্ছে-পপুলার সাপোর্ট বিবেচনা করে রিজিম পরিবর্তন করে দেয়, যেমন করেছে জর্জিয়ায়, আফগানিস্থান, কিংবা ইরাক  বা অন্য দেশগুলিতে। এর অর্থ-জেলেনেস্কী আর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নাই। মান রক্ষার্থে হয় ইউক্রেনে একটা ইন্টারনাল রায়ট হবে এবং সেই রায়টে পরে একটা সাধারন নির্বাচন হবে এবং এই ইন্টারনাল আন্দোলন ঠেকাতে সামনে আসবে আর্মির কমান্ডার ইন চীফ ঝালুজনি অথবা গোয়েন্দা চীফ বুদানভ। এটাও সে জর্জিয়ার সেই শাকাসভিলি পরিনতির মতো।

শাকাসভিলির মতো জেলেনেস্কীকেও তার ক্ষমতা হারানোর পর ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারনে, দেশে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি করে যুদ্ধ ঠেকানো যেতো এই মনে করে কিংবা তার বিরোধী দলকে সম্পুর্ন দমন করে শাসনভার চালানোর কারনে অপরাধী করা হবে। জেলেনেস্কী যদি ইউক্রেনেই থাকে তাহলে তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, অথবা তাকে দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র নির্বাসনে চলে যেতে হবে।

পশ্চিমাদের কোনো এলি নাই, আছে শুধু ভেসেল যা তারা হয় শাকাসভিলি কিংবা জেলেনেস্কীর মতো শাসকদের দ্বারা বাস্তবায়িত করার কাজে লিপ্ত থাকে। কেনো বললাম যে, পাশ্চাত্যদের কোনো এলি নাই, কারন এলি রাজ্যগুলিকে পাশ্চাত্যরা তাদের লয়ালটির কারনে যে কোনো পর্যায়েই যাবতীয় সমস্ত কিছু দিয়ে, এমন কি তাদের নিজের দেশের মানুষের সার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে হলেও সাহাজ্য করে। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে জর্জিয়া, আফগানিস্থান কিংবা ইউক্রেনের ব্যাপারে তারা এদেরকে ভ্যাসেল মনে করে, এলি না। ইউক্রেন হচ্ছে সেই আরেকটা ভেসেল যেখানে ইউরোপ, ইউএস-ব্যাকড ন্যাটো কিংবা পাশ্চাত্য তাদের ইউনিপোলারিটি যাতে ম্রিয়মাণ না হয় সেটা রক্ষার্থে যতদিন সাপোর্ট করা যায় সেটা করবে। যেদিন ইউক্রেন যুদ্ধটা ফ্রোজেন হয়ে যাবে, কিংবা ইউক্রেন হেরে যাবে কিংবা যখন ইউনিপোলারিটি ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে, কিংবা ধীরে ধীরে ডি-ডলারাইজেন আরো গভীর হবে, তখন জেলেনেস্কীর আর কোনো প্রয়োজনই হবে না তার পেট্রোনদের।

তখন একটা প্রশ্ন বাকী থাকবে-জেলেনেস্কী কি শাকাসভিলির মতো জেলে থাকবে নাকি ফ্রিম্যান হিসাবে রাজকীয় জীবন পরিচালনা করবে নাকি সে তার জীবন দিয়ে প্রমান করবে যে, ইচ্ছে করলেই পরিস্থিতি পালটে দিতে পারতো যেখানে সাধারন নাগরিকেরা অন্তত মারা যেতো না, দেশটার অখন্ডতা রক্ষা পেতো।

সময় বলে দিবে।