০৬/১২/২০১৯-সেদিনের কথা মনে পড়ে

সেদিনের কথা আজো আমার মনে পড়ে। কোনোদিন তোমাকে আমি দেখিনি। কোনোদিন চিনিও নাই। অদ্ভুদ পরিপাটি হয়ে তুমি নিকোলাসের সাথে আমার অফিসে এসেছিলে। কোনো কারন ছিলো না আমার তোমার উপরে চোখ রেখে পৃথিবী থেকে লক্ষ মাইল দূরের কোনো এক চাঁদকে দেখার। নিকোলাস ছিলো নিতান্তই একটা সাধারন লোক। তারপরেও আমি নিকোলাসকে সাদরে গ্রহন করেছিলাম। আর তার কারনটা ছিলে শুধু তুমি। কি এক মোহ নিয়ে যেনো আমার চারিদিক একটা মন্ত্রের মতো তুমি যাদুবন্দি করে রেখেছিলে, আমি বুঝতেও পারিনি। তুমি আমাকে চাঁদ দেখিয়েছিলে। আমি চাদের কলংক বুঝি নাই, চাদের অসমান পাথরও দেখি নাই, চাদে যে বাতাসও নাই, সেটাও বুঝি নাই। তারপরেও আমি এই শুকনা মাটি আর বাতাসবিহীন মৃত্যুসম পরিবেশকে উপেক্ষা করেই বন্ধু ভেবে সাদরে গ্রহন করেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ পরাজয়কে। আমি শুধু দেখেছিলাম চাদের মতো আলো আর ভারসাম্যহীন চাদের বুড়ির চাহনী। কি যে মাদকতা আর নেশা ছিলো আমি বুঝি নাই, আমাকে নামিয়ে দিলে আমার আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন থেকে। আমি বিভোর হয়েছিলাম।

ঠিক তার পরেই আমার মোহটা কেটে গিয়েছিলো কারন তুমি আর আমার আকাশে উদিত হও নাই। ডুবে যাওয়া চাদকে কেউ দেখতে চায় না। আমিও ভুলতে বসেছিলাম সেদিন দেখা এক চাদের রুপ আর তার আলো। অতঃপর আবার তুমি উদিত হলে আরো একদিন। এবার নিকোলাস নয়, তার স্ত্রী অর্থাৎ তোমার মা জেসিকা এলো তোমাকে নিয়ে। উদ্দেশ্য তো ছিলোই। তোমার উদ্দেশ্য ছিলো জীবনকে গড়ার আর আমার উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে আবিষ্কার করার। একে একে সব কিছু খুব কাছ থেকে ঘটে যেতে থাকলো অনেক ঘটনা।

কতগুলি বছর? অনেকগুলি। প্রতিটি প্রহর আমার কেটেছে এই চাদের বুড়ির নেশায়, আমার সমস্ত জীবনীশক্তি দিয়ে আমি বাচাতে চেয়েছিলাম এই চাদের বুড়িটাকে। কারন চাদের বুড়িটাই ছিলো আমার সমস্ত নেশার এক জগত। কোনো কিছুই আমি লুকাই নাই এই চাদের বুড়িটাকে বাচাবার জন্য। অথচ আমি জানতেও পারি নাই, এই চাদের বুড়িটা আমাকে নিজের চড়কাটায় কখনো বসার জন্য একটু স্থানও রাখে নাই। আমি ক্লান্ত ছিলাম না, আমি আমার সমস্ত আত্তা দিয়ে এই চাদের বুড়িটাকে কতটা আগলে রেখেছিলাম, আমার সাধের বুড়িটিও জানে নাই। একদিন এই চাদের বুড়িটি কোনো কিছুই না বলে সবার অগোচরে চলে গেলো? সে হারিয়ে যায় নাই, কিন্তু আমার কাছে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো। অথচ একটিবারও জানা হলো না আমার কি অপরাধ ছিলো। সে চলেই গেলে। দেশটাকে আর ভালো লাগছিলো না। এর গাছ পালা, এর বিরাট বিরাট অট্টালিকা, আর মুখরীত জনপদ আমার কাছে দম বন্ধ হয়ে আমাকে প্রতি নিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। তারপরেও একটা ক্ষীন আশা ছিলো, হয়তো কোনো না কোনো মোহে তুমি ফিরে আসবেই। তারপরেও রয়ে গেলাম আরো অনেকগুলি মাস।

হটাত একদিন-

দেখা হলো ইউসিকারোস্কি ট্রেন ষ্টেশনের এক প্লাটফর্মের অপেক্ষাগারে। বিধ্বস্ত তোমার সেই কোমল মুখাবয়ব, এলোমেলো উস্কুখুস্কু চুল। আমিই প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম। খুব জানতে মন চেয়েছিল, তুমি কেমন আছো? কিন্তু আমার ট্রেন চলে আসায় আর তোমাকে ছোয়া হয়নি আমার। ছুয়ে বলা হয়্য নাই, আমি সেই আগের মানুষটাই আছি। ফিরে এসো আমার এই শুন্য বুকে। এটা এখনো শুন্য্যই আছে। আমি জানি, তুমি ভালো নাই, আমি জানি, তুমি আসলেই ভালো নাই। তারপরেও যদি কখনো দুচোখ জলে ভরে এসে একবার বলো, আমাকে তুমি ওই পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাও, ওই কল্পনার মানুষটার সাথে, আমি তাও করে দিতাম আর পিছনে না ফিরে নিজেকে শান্তনা দেবো এই ভেবে যে, অন্তত তুমি তো ভালো আছো!! এটাই আমার সবচেয়ে আনন্দের। আমিও আর তোমাকে খুজি নাই কিন্তু বারবার মনে হয়েছে, আমি কি তোমার জন্য কখনোই কিছু করি নাই?

মনে কষ্টটা ছিলই। কখনো কমে নাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে আমি আর পেরে উঠতে পারছিলাম না। তাই, একদিন সব ছেড়ে সেই নাড়ির টানে আবার পাড়ি দিলাম অসহায় নিজের পলিমাটির দেশে যেখানে আমার জন্য কোনো লিসা আর অপেক্ষায় নাই।

অনেক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই চকচকে এয়্যারপোর্টের লবিতে। এই বুঝি তুমি এলে। আমার ভালোবাসার টানেই হয়ত তুমি আসবে। এমনটাই আমার কল্পনায় ছিলো। অথচ তুমি এলে না। আর তুমি আসবেই বা কেনো? তুমি তো জানোই না যে, আজ তোমার এই অপরিকল্পিত সপ্ন পুরুষটি চিরতরে চলে যাচ্ছে। আমার ফ্লাইট প্রায় বিলম্ব হয়েই যাচ্ছিলো, ফিরে আসতে মন চায় নাই। কিন্তু আসতেই হয়েছে একরাশ না বলা কথা পিছনে ফেলে। যখন আমি শেষ পদদলিটা উঠিয়ে নিয়ে সেই বাহনের পিঠে চড়ে বসলাম, আমার মনে হয়্যেছিলো, গোটা ১৮ টি বছর এই শহরে থাকার পরেও শহরটা আমার হলো না। এই দেশটা আমার হলো না। চোখে এতো জল এতোদিন কোথায় ছিলো? প্লেনের ভিতরে উঠলাম। পাশে ৫ বছরের একটি বাচ্চা বসেছিলো তার মায়ের পাশে। অনেক কান্নাকাটি করছিলো। হয়তো তার কষ্টটা অন্য রকমের। ভাবলাম, আহা, যদি আমিও ওর মত এইরকম করে বুকফাটা কান্নায় কিছুক্ষন কাদতে পারতাম। বাচ্চাটার কান্নায় শব্দ ছিলো, চোখে জলও ছিলো। অথচ আমার চোখের জল ছিলো সাগরের থেকেও উত্তাল নিঃশব্দে।

আমি সহ্য করতে শিখছি, আমি অভ্য্যস্থ হতে শিখছি। এখনো সম্বিত ফিরে নাই, মোহটা আছে। কিন্তু ভালোবাসাটা এখনো কাচা। এই কাচা ক্ষতে বারবার মনে হয় হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার মতো ভালোবাসারও কি ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়? যদি যায় তাহলে আমি আবারো একবার না দেখে, না বুঝে ভালোবাসতে চাই। তার আগে চাই আমার পায়ের তলার মাটি। আর সেই মাটি এবার আমি তৈরী করবো আমার দেশের দুব্বা ঘাসের উপর দিয়ে। অন্য কারো গোলামি করে আমি বেশীদিন বাচতেও চাই না। আমি চাই এমন একটা প্লাটফর্ম যা আমার নিজের হবে, যেখানে আমি হবো আমার স্বাধীনতার ধারক। আমি জানি আমার সময় লাগবে এই যুদ্ধে। কিন্তু আমি পারবো। আমি এটাও জানি, আমার এই যুদ্ধে পাশে কেউ নাই। তারপরেও আমি আমার জন্যই বাচবো। আমার এখন একটাই সংকল্প- নিজের পায়ে আবার ঘুরে দাড়াও আর যদি পারো কাউকে তোমার পাশে নাও। কিন্তু সেই পাশের মানুষের উপর হাত রেখে যুদ্ধের ক্ষমতা বাডানোর কোনো সংকল্প নয়। যদি সেও আমার মতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বুক উচু করে সামনে এসে বলে, আমিও পারবো, তাহলেই হবে বিশ্বাসের আরেক স্তম্ভ। আর এবারের এই ভালোবাসার মানুষটি হবে আগুনে পোড়া সোনার মতো। কথার ফুলঝুরি নয়, দেখার তৃপ্তিতে নয়, এবার ভালোবাসাটা হবে সত্য কাহিনীর উপর নির্মিত সেই জাপানিজ ছবিটার মতো- She Never Saw Him but loved Till Death. তোমাকে আমি ভালোবাসতে চাই এই এমন একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। দেখা নাই, সুম্মুখ কোনো কথা নাই, তবু হৃদয়ে ভালোবাসো জেগে থাকে কিনা। যদি এই রকমের অদৃশ্য বোবার মতো নিঃশব্দে আর গোপনে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে না দেখেই মনের বিশ্বাসে ভালোবাসো। অন্তরের চোখ দিয়ে যদি ভালোবাসো, যদি বিশ্বাসের চোখ দিয়ে ভালবাসো, তাহলে ভালবাসো ঠিক সেভাবেই , আমাকে না জেনে, না দেখে, না কথা বলে। হয়তো এটাই হবে দুজনের জন্যই পরীক্ষার প্রথম ভাগ। কতকাল অপেক্ষা করতে পারবে এই না দেখা মানুষের জন্য? কতদিন শক্তি নিয়ে সমস্ত সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে উচ্চকন্ঠে বলতে পারবে-----আমি তাকে ভালোবাসি কিন্তু তাকে আমি চিনি না। সে আমাকে ভালোবাসে, সেও আমাকে দেখে নাই????? সেই জাপানিজ ছবির নায়িকার মতো কখনো কি বলতে পারবে-天国で会いましょう

(Tengoku de aimasho). যার মানে হলো, See youin heaven তোমার সাথে আমার দেখা হবে হেভেনে (বেহেশতে)।

যদি পারো, তাহলে মন তৈরী করো, প্ল্যাটফর্ম তৈরী করার জন্য হাত বাড়িয়ে দাও, দুজনে হাটি এক সাথে।  গন্তব্য হয়তো এক।