০৭/০৪/২০১৬ ফাঁসি

Categories

রাত প্রায় বারোটা। ঘরের কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলিতেই দেখিলাম ১৭-১৮ বয়সের একটি মেয়ে, কাঁধে একটা ঝুলানো ব্যাগ লইয়া দরজার সামনে দাঁড়াইয়া আছে। তাহাকে আমি চিনি না কিন্তু কোথায় যেন তাহাকে দেখিয়াছি আমার ঠিক মনে পরিতেছে না, আবার তাহাকে আমার অপরিচিত বলিয়াও  মনে হইলো না। বাসায় কেউ নাই, আমার মেয়েরা তাহাদের খালার বাসায় মানিকগঞ্জে বেড়াইতে গিয়াছে, সঙ্গে তাহাদের মাও আছেন, আমার অফিসে অনেক কাজ জমা হইয়া গিয়াছিল বলিয়া রাত জাগিয়া জাগিয়া গুটিকতক কাজ শেষ করিতে হইতেছে। তাই আমার পরিবারের সঙ্গে আমার আর বেড়াইতে যাওয়া হয় নাই। ছেলেপুলে আর ঘিন্নি ছাড়া আমার কোনো কিছুই চলেনা। তাহাদের অবর্তমানে আমার এই সময়টা আমি হারে হারে টের পাই। আমি অলস মানুষের মধ্যে একজন। একগ্লাস পানি খাইতেও তাহাদের প্রয়োজন পড়ে। ঘরের মধ্যে যখন ওরা থাকে তখন তাহাদের উপস্থিতি টের পাইনা কিন্তু তাহারা যখন থাকেনা তখন তাহাদের অনুপস্থিতি খুব নজরে আসে বইকি। বাসায় কেহ আসিলে সাধারনত আমার গিন্নিই দরজা খোলার কাজটি করিয়া থাকেন। বাসায় যতো কর্মীবাহিনী আসে, কেহ তাহার রান্নার বুয়া, কেহ আবার পাশের বাসার গিন্নি, কেহ আবার আমাদের ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজন ইত্যাদি। হয়ত সময়মতো ভাড়া পরিশোধ করিতে পারিবেন না বলিয়া একটু আবদার, কেহ আবার দান দক্ষিনার জন্য আসে, এইসব। ফলে আমি সবাইকে চিনিও না আর তাহা জানার আমার কোন প্রয়োজনও মনে করি না। আজ তাহারা কেহ বাসায় নাই, তাই আমাকেই এই কর্মটি করিতে হইতেছে।

রাত এগারোটা বাজিলেই আমার গিন্নি ঘরের সব দরজা বন্ধ করিয়া, জানালার পর্দাসমুহ একেবারে আঁটসাঁট করিয়া লাগাইয়া দিয়া, ঘরের যাবতীয় ছিটকানি বন্ধ করিয়া তাহার পর কি যেনো একটা দোয়া পড়িয়া হাতে তিনখান হাততালি দিয়া সম্পূর্ণ ঘরটাকে নিরাপদ করিয়া তাহার পর শুইতে যায়। গিন্নি না থাকিলে আমাকে অবশ্য দোয়াদরূদ পড়িতে বলেনা কিন্তু ঘরের ছিটকানীসমুহ ভালো করিয়া লাগাইয়া যেনো ঘুমাইতে যাই, সেই নির্দেশাবলী দিতে কখনই ভুলিয়া যায়না। আর যদি ছিটকানি লাগাইতে ভুলিয়া যাই, সেইজন্য আগেভাগেই ঘরের স্বয়ংক্রিয় তালাখানা যেনো লাগাইতে ভুলিয়া না যাই তাহা নিশ্চিত করিয়া তারপর ফোন রাখেন। সে জানে আমি অলস মানুষ, তাই মাঝে মাঝে মনে করাইয়াও দেয়। কারন ভুলিয়া যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্তত এইদিক দিয়া আমার উপর তাহার আত্মবিশ্বাস একেবারেই নাই, ভরষা তো নাইই।

দরজা খুলিয়া অপরিচিত এই অল্প বয়সের মেয়েটিকে দেখিয়া দরজার পাশে দাঁড়াইয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাকে চাই?’

আমি প্রশ্ন করিলেও মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়া ঘটঘট করিয়া খোলা দরজা দিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করিল। আমি অগত্যা কিছু না বলিয়া অদুরে ডাইনিং চেয়ারটা টানিয়া দিয়া বলিলাম, তুমি কি আমাদেরকে চিনো বা আমি তোমাকে চিনি?

মেয়েটি হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর না দিয়া আমাদের ঘরের চারিদিকে যে কয়টা ছবি ফ্রেমে টাঙ্গানো ছিলো তা দেখিতে থাকিল। ব্যাপারটা যেনো এমন, আহা- কতদিন এই ছবি গুলি দেখা হয় নাই কিংবা এমন যে, আহা, ওই ছবিটা এখানে কেনো ইত্যাদি। আমি তাহার ছবি দেখার ভঙ্গি দেখিয়া কিছু প্রশ্নের আশা করিতেছিলাম বটে কিন্তু সে ইহার কোনো কিছুই বলিলো না। ছবি দেখা হইয়া গেলে, বেশ খানিক্ষন পর মেয়েটি নিজেই ডাইনিং চেয়ারে আসিয়া বসিল এবং টেবিলের উপর রাখা এক যগ পানি হইতে এক গ্লাস পানি ঢালিয়া লইয়া ঢকঢক করিয়া পান করিয়া ঠাস করিয়া হাতের গ্লাসখানি টেবিলে শব্দ করিয়া নামাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস এমন করিয়া ছাড়িলো যেনো পানি খাইতে গিয়া তাহার অনেক পরিশ্রম হইয়াছে অথবা কতজনম ধরিয়া যেনো পানির আশায় বুক ধরফর করিতেছিলো।

– না, আমি আপনাকে চিনি না, কিন্তু আপনি হয়তবা আমাকে চিনিতে পারেন। আসলে আমাকে এখন অনেকেই চিনে, পুরু কাহিনি বলিলে হয়ত আপনিও আমাকে চিনিতে পারিবেন। এই পথ দিয়া যাইতেছিলাম, অনেকরাত, কোথাও কেহ জাগিয়া নাই, দেখিলাম আপনার ঘরে আলো জ্বলিতেছে, তাই এখানে আসা। আমি আপনার কোনো ডিস্টার্ব করিবার মতলবে আসি নাই। কিংবা আপনার কোন ক্ষতিও করিতে আসি নাই। আপনি বিরক্ত হইতেছেন কি? আর ডিস্টার্ব হইলেইবা কি, এখন তো ভিতরে চলিয়াই আসিয়াছি। একনাগাড়ে এতগুলি কথা বলিয়া মেয়েটি আবার আরেক গ্লাস পানি ঢগঢগ করিয়া পান করিয়া লইলো।

কি তাজ্জব ব্যাপার। চিনি না, জানি না, কি কারনে আসিলো, তাও আবার এতোরাতে। আমি একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিলাম আর বলিলাম, পুরু কাহিনীটা কি তাহলে? আমিও জানার জন্য উৎসুক হইয়া বলিলাম। আর এতোরাতেই বা তুমি কাহার সাথে কি কারনে বাহির হইলে, আর তোমার পিতামাতাই বা কি রকম যে, এইরকম একটা যুবতী মেয়েকে রাত গভীরে ঘর হইতে বাহির হইবার দয়া করিলেন?

-আরে সাহেব, ভয় পাইতেছেন নাকি? ভয়ের কোনো কারন নাই। আমার নাম শিমা। নিশ্চয় এই নামটা আপনার শুনিবার কথা। ঐ যে মেয়েটি, যে তাহার বাবামাকে রাতের আধারে একসঙ্গে খুন করিয়াছিল? পরেরদিন বড় বড় করিয়া দেশের সব কয়টা পত্রিকায় তাহার লোমহর্ষক গল্প লিখিয়া নাম প্রকাশ হইয়াছিল। আপনি পড়েন নাই সে খবর? যাইহোক, আমি আপনাকে খুন করিতে আসি নাই।

নামটা শুনিয়াই যেনো আমার গলা পর্যন্ত শুকাইয়া গেল। শরিরের শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুতের মত এক অনুভূতি খেলিয়া গেলো আর পশমের যে কয়জায়গায় অনুভূতি আঘাত করিতে পারিল না, সব কয়টাই যেন খাড়া হইয়া আমাকে এই সংবাদ দিয়া গেল, কেন তুমি না জানিয়া এমন একটি মেয়েকে তোমার ঘরে ঢুকিতে দিলে? তুমি তো আর পুলিশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চে কাজ করোনা যে, এখন একটা ফোন করিলেই তোমার সাহায্যের জন্য গোটাবিশেক পুলিশ আসিয়া তোমাকে উদ্ধার করিবে। নিজেকে একটু আহাম্মক বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হইল, আচ্ছা ওতো আর পিস্তল, ছুড়ি লইয়া আসে নাই যে, আমাকে খুন করিয়া ফেলিবে, আমার সঙ্গে ওতো জোরেও পারিবেনা, আবার আমার আশেপাশে আরও লোকজন তো আছে, বিপদ দেখিলে গলা ফাটাইয়া চিৎকার দিলেইতো আর কোন অসুবিধা নাই। পুলিশ না আসুক, অন্তত কিছু মানুষজন তো আসিবেই। মনে একটু বল সঞ্চার হইল।

-তোমার না ফাঁসির আদেশ হইয়াছে? তাহা হইলে তুমি এইভাবে এতরাতে কেমন করিয়া ঘোরাফেরা করিতে পারিতেছ? তুমি কি জেল হইতে পালাইয়া আসিয়াছো? দেখ শিমা, তুমি এখানে আসিয়া আমাকে কোন বিপদের মধ্যে ফেলিবার কোন পরিকল্পনা করিতেছো না তো?

মেয়েটি, যেন মজার একটা কথা বলিলাম, এইভাব করিয়া অট্টহাসিতে লুটাইয়া পরিবার উপক্রম হইলো। ঘরের ভিতর তখন রবিন্দ্রসঙ্গিত বাজিতেছিল… মম চিত্তে … কেযে নাচে তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ… কিন্তু তাহার অট্টহাসিতে রবীঠাকুরের গানের কলিগুলি যেনো গুরুম গুরুম শব্দে কি এক অদ্ভুত আওয়াজে ঘরের চারিদিকে বিহব্বল বাতাশের মতো ঘূর্ণিপাক খাইয়া প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করিলো। তাহাতে আর যাই হোক, চিত্ত নাচিবার কোনো কারন দেখিতেছি না। বরং এক অজানা ভয়ে চিত্ত শুকাইতেছিলো। ইহার পরে আবার আরেক অজানা ভয় ঢোকিতেছিলো যে, এতোরাতে আমার স্ত্রীর অবর্তমানে আমার ঘরে একজন মেয়েলী কণ্ঠে হাসির তামাশা আমাকে আরো শঙ্কায় ফেলিয়া দিলো। আমি ভদ্রমানুষ, সমাজে আমার নামডাক আছে, আমি সমাজের একজন ক্লিন মানুষের মধ্যে একজন। এই এতো রাতে আমার বাসায় কোনো এক অপরিচিত যুবতি মেয়ের প্রবেশ কোনোভাবেই আমি ব্যখ্যা করিতে পারিবো না। অন্তত আমার বউ, আমার পরিবার-পরিজন বিশ্বাস করিলেও অন্য কেউ ইহা সহজে বিশ্বাস করিবে তাহার কোন যুক্তি আমি খুজিয়া পাইতেছিলাম না। শঙ্কায় পড়িয়া আমি মেয়েটিকে একটু শান্ত হইয়া বসিয়া তাহার যাহা বলিবার তাহা যেনো কণ্ঠ সংযত করিয়া বলিতে থাকে সেই অনুরোধ করিলাম। এতো অট্টহাসি দিয়া আমার ঘরের লক্ষ্মী পরিবেশকে সংকিত করিতে মানা করিয়া বলিলাম। অনেকটা আদরের সহিতই বলিলাম,  “মা তুমি আমার মেয়ের বয়সের সমান, আমি অপদস্থ হই, এমন কোনো প্রতিক্রিয়া করিও না।”

-আরেনা বাপু, এতো অস্থির হইবার কোনো কারন নাই। আর আমাকে কেউ জেলখানা হইতে বাহির হইতে দেখেও নাই আবার সকাল না হইতেই আমি আবার আমার কন্ডেমসেলে ঢুকিয়া পরিব। তোমার কোন ভয় নাই। আমি মাঝে মাঝেই এই রকম রাতে বাহির হইয়া থাকি। আজই প্রথম নয়। কয়দিনই বা আর এই পৃথিবীতে বাঁচিবো বলো, এত ভয় করিবার তো কোন কারন দেখিনা। জেলেই তো আছি, জেলের আবার ভয় কিসের? তবে আমার ফাঁসি হওয়াতে আমার মনের অনেক কষ্ট লাঘব হইয়াছে বলিয়া আমি মাঝে মাঝে মনের আনন্দে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারিতেছি। অন্তত একটা সুরাহা তো হইয়াছে। পাপীর তো শাস্তি হইয়াছে।

মেয়েটি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন না করিয়া  সরাসরি ‘তুমি’ এবং এমনভাবে ‘বাপু’ শব্দটি উচ্চারন করিলো যেনো হটাত করিয়া আমার বুকের কোনো এক জায়গায় একটি মানবিক সম্পর্ক টানিয়া আনিয়া জোড়া লাগাইয়া দিলো। মনে হইলো, আমি বুঝি সত্যিই তাহার ‘বাপু’। অন্তরে একটা শীতলপরশ একঝলকের জন্য বিদ্যুতের ন্যায় আচমকা একটা সাড়া দিয়া নড়িয়া উঠিল। আমি মেয়েটির দিকে অনেক্ষন চাহিয়া থাকিলাম, যেনো কোনো এক সুদূর অচেনা এক দেশ হইতে মেঘের ভেলায় ভাসিয়া আসিয়া আমাকে একখন্ড শিক্ত জলে ভিজাইয়া দিলো। তাহাকে এখন আর আমার আগের মুহূর্তের মতো ভয়ঙ্কর এবং অস্বাভাবিক মনে হইলো না। মনে হইল মেয়েটি আমার পরিবারের যেনো কেহ।

-তোমার ফাঁসি হইয়াছে এই খবরে তুমি এতো আনন্দিত কেন?

শিমা এইবার আর হাসিলো না। অনেকক্ষন চুপচাপ থাকিয়া তাহার ছোট গালের দুইপাশে তাহার দুইহাত ঠেস দিয়া কাধের ব্যাগখানি টেবিলের উপর রাখিয়া আমার চোখের দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলঃ তুমি কি কখনো কোন ফাঁসির আসামীর সঙ্গে ফাঁসীর আগের রাতে গল্প করিয়াছো?

-আমি বলিলাম, না, সে সুযোগ আমার আসে নাই। তবে জানিতে অনেকবার মন চাহিয়াছিল তাহাদের মনের অবস্থা কি, জীবন সম্পর্কে তাহাদের উপলব্ধি কি, কিংবা তাহার ওই সময়ের ভাবনা কি, কি নিয়ে তাহারা কিভাবে কি ভাবে বা কাউকে কি কোন কিছু বলিয়া যাইতে ইচ্ছা করে কিনা ইত্যাদি। অথবা এমন কোনো ভাবনা কি আসে, আহা যদি আরেকবার সুযোগ আর স্বাধীনতা পাইতাম, তাহা হইলে ফাসি হয় এমন কোনো কাজ আমি করিবো না, অথবা, আহা এমন কি কোন জায়গা আছে, যেখানে আমি লুকাইয়া গেলে আমাকে আর কেহই খুজিয়া পাইবে না? ফাসি হইবে না?  

– তাহা তো ঠিকই। যুগেযুগে প্রতিদিনই তো আর ফাঁসির কাজটা হয়না যে, আজকে সুযোগ পাইলাম না বলিয়া আগামিকালের ফাঁসিটায় তা উপভোগ করা যাইবে। এইটাতো আর পুকুরপাড়ে গিয়া বরশি দিয়া মাছ ধরিবার মতো ঘটনা না যে, আজ পাইলাম না তো কাল পাইয়াই যাইবো। আর পাইয়া গেলে ওই ধরাশায়ী মাছকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইবো, সে পানির ভিতরে কিভাবে সাতার কাটিতে কাটিতে হটাত করিয়া মানবের বরশির ফাঁদে পা দিয়া তাহার অনবদ্য জলীয় জীবন হইতে এক নিমিষে স্থলের মুক্ত বাতাসে আসিয়া প্রানবিনাস করিয়া পগারপার হইয়া গেলো। মৎস্যদের সাহিত্যক কেহ থাকিলে হয়তো তাহার কোন এক কাব্যগ্রন্থে লিখিত, “স্থলের মুক্ত বাতাস শুধু প্রানের জীবনীশক্তিই জোগায় না, ইহা কখনো কখনো কিছু কিছু প্রানীর প্রানেরনাশের কারনও হইয়া দাড়ায়”।

মেয়েটি অনেক সুন্দর করিয়া গুছাইয়া কথা বলিতে পারে বুঝিতে পারিলাম। “স্থলের মুক্তবাতাস শুধু প্রানের জীবনিশক্তিই জোগায় না, ইহা কখনো কখনো প্রাননাশের কারনও হইয়া থাকে” কথাটা আমার খুব মনে ধরিলো। সে কি মনে করিয়া এই রকম একটা তত্ত্ব কথা বলিলো তা আমার বোধগম্য হইলো না, তবে বাচিয়া থাকিবার জন্য যাহার যেখানে যাহা প্রয়োজন, সে তাহাই সম্ভবত বুঝাইয়া দিলো। আমি এতোক্ষন অফিসের জটিল একটা একাউন্টিং নিয়া কাজ করিতেছিলাম কিন্তু এই মেয়েটি আসিয়া এখন আমাকে আরো জটিল সময়ের মধ্যে ফেলিয়া দিলো বলিয়া আমার মনে হইতে লাগিলো। কিন্তু খারাপ লাগিতেছিলো না। তাই, অফিসের কাজ একপাশে রাখিয়া তাহার সাথে গল্প করিতেই মন চাইলো।

আমি এইবার তাহাকে কিছু খাইবে কিনা জিজ্ঞাসা করিতেই বলিয়া উঠিল যে, “জেলখানায় না গেলে সে বুঝিতে পারিতো না, চার দেওয়ালের ভিতরেও কতো ধরনের নীতি আর কত আকারের দুর্নীতি রহিয়াছে। যাহাদের টাকা আছে, তাহাদের জন্য নীতি এক রকমের, যাহারা বিখ্যাত, তাহাদের জন্য পলিসি আরেক রকমের, যাহাদের কেউ নাই, তাহারা তো কোনো প্রানিকুলের মধ্যেই গন্য হয়না। যাকগে সেইসব কথা, তোমরা থাকিবে এই পৃথিবীতে, যেইভাবে তোমরা আরাম আয়েশ করিতে চাও, সেইভাবেই পলিসি করো কিংবা নীতি পাল্টাও তাহাতে আমারই কি আর আমি বা কে তাহার বিরুদ্ধে নালিশ করিবার? আমি ভালো খাইতে পারিতেছি, আমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা আছে, ইহাতেই আমি খুশি। এই যেমন, আজ আমি খাইয়াছি ইলিশের তরকারী, ঘনডালের চর্চরী, সঙ্গে ডিমের হালুয়া। খাওয়ার পর আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলো, আমি আরো কিছু খাইতে চাহি কিনা। আমি আইসক্রিম খাইতে খুব পছন্দ করি, বলিতেই দেখি, একটু পরে খুব মজার আইসক্রিম চলিয়া আসিলো। আমি তো ভালোই আছি। একটা জিনিস জানো? কোরবানীর পশুকে তাহাদের মালিক কোরবানী করিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অনেক আদর যত্ন করিয়া, ভালো ভালো খাবার খাওয়াইয়া, গোসলপাতি করাইয়া ঠিক সময়মত তাহাকে হুজুর কিংবা পাগড়ীপরা মুসুল্লী দিয়া গলায় ছুরি দিয়া একনিমিষে কতল করিয়া দেয়। আমি হয়তবা সেই রকমের একজন কোরবানীর পশুর গননায় আছি। কোরবানীর পশুকে জবাই করিতে কাহারো হৃদয়ে কোন কম্পন সৃষ্টি হয়না। বরং দল বাধিয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ সব মুরুব্বীরা ঈশ্বরের নাম জপিতে জপিতে তাহাকে প্রানে মারিয়া ফেলে।

আমি একটা সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিলাম, তুমি কি সিগারেট খাও?

-দাও একটা। খাওয়ার অভ্যাস তো ছিলোই, জেলে যাওয়ার পর আর খাইতে পারি নাই। আমি বুঝি না, জেলের মানুষগুলি যাহা চাই, তাহাই আমাকে দেয় কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে একটা সিগারেটও দিলো না। অথচ নেশার জগতের সবচেয়ে বড় আভাসভুমি হচ্ছে জেলখানা। দল বাধিয়া সবাই নেশা করে। ঐখানে নেশা করিবার কারনে পুলিশ কখনো কাউকে গ্রেফতার করে না। অবশ্য আমি কখনো সিগারেট চাইও নাই।

শিমা আমার সিগারেটের প্যাকেট হইতে একটা সিগারেট লইয়া আগুন ধরাইয়া একমুখ ধোয়া পুরা রুমের ভিতর ছড়াইয়া দিয়া একটা হাসি দিয়া বলিল- আহ কতোদিন পর এমন করিয়া সিগারেট ফুকি নাই। হয়ত এই সিগারেটের জন্যই তোমাকে আমার মনে থাকিবে। আমার আর মনে থাকিবে কি, আমি তো মরিয়াই যাইবো, বরং মনে থাকিবে তোমার। ওই একই হইলো। তুমি আমাকে মনে রাখিবে না আমি তোমাকে মনে রাখিবো, ইহাতে কোনো কিছুই পরিবর্তন হইবে না। না পরিবর্তন হইবে তোমার অফিসের কাজের, না সমাজের, না অন্য কাহারো। এই পরিবরতনের সাথে আমাদের প্রিথিবী অনেক পরিচিত। ইহাকে আমাদের এই পৃথিবী সাধারন ঘটনার মধ্যে গন্য করিয়াই তাহার মনুস্যকুলকে এক প্রজন্ম হইতে আরেক প্রজন্মে লইয়া যায়। ইহাকেই হয়ত আমরা ইতিহাস বলিয়া চালাইয়া দেই।

এতোক্ষন আমি যেই ভয়টা পাইতেছিলাম, সেই ভয়টা এখন আর নাই। মনে হইতেছিলো শিমা আমার পরিচিত কেউ। বলিলাম, তোমার জেলের ভিতরের অভিজ্ঞতা, ফাঁসির খবরে তোমার প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি বলো তো দেখি শুনি।

-আচ্ছা, তোমার বাসায় কি কফি আছে? খুব কফি খাইতে ইচ্ছা করিতেছে। এই বলিয়া শিমা নিজেই আমাদের রান্না ঘরের ভিতরে ঢূকিয়া গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া দুইকাপ ব্ল্যাক কফি বানাইয়া এককাপ আমাকে আর এককাপ সে নিজের জন্য রাখিয়া গল্প করিতে আরম্ভ করিলো।

-গল্পটা শুরু কবে হইতে শুরু হইয়াছিলো তাহা আমার জানা নাই। তবে আমার জীবনে আদর আর আহ্লাদের কোন কমতি ছিলো না। যখন যাহা চাহিয়াছি, তখনই তাহা আমি আমার মতো করিয়া পাইয়াছি। সুখেই দিনগুলি কাটিতেছিলো। সচ্ছল পরিবার, ছোট পরিবার। খুব একটা বিড়ম্বনা নাই। বন্ধুবান্ধব যাহারা ছিলো, তাহারাও আমার অবস্থা বুঝিয়া মানিয়া চলিতো। লেখাপড়া করিতেছিলাম কিন্তু খুব ভালো লাগিতেছিলো না। বাবা সরকারী চাকুরী করেন কিন্তু সময় যতোটা পাইতেন, তাহা হইতে বেশি বাহিরে থাকিতে পছন্দ করিতেন। মা গৃহিণী মানুষ, অতো চালাক চতুর নহেন, সামান্যতেই তিনি সুখি। আমাদের যত্ন আদিতে তাহার কোন কমতি ছিল না। তারপরেও আমার মাকে মনে হইতো তিনি সংসারে একা। কখনো কখনো আমার মা আমার বাবার সাথে কথা কাটাকাটি করিতো বটে কিন্তু মা ইচ্ছা করিয়াই হারিয়া যাইতেন। সংসারের শান্তি থাকুক এই ভাবিয়াই চুপ থাকিতেন। তাহার সাধ আহ্লাদের মধ্যে যাহা ছিলো তা নিতান্তই কয়েকটা টিভি সিরিয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাকে আমি খুব ভালোবাসিতাম কিন্তু মায়ের এই কম্প্রোমাইজের গুনটি আমি কখনোই মানিয়া লইতে পারিতাম না। ফলে, বাবার সাথে আমার প্রায়ই খিটখিটে ঝগড়া লাগিয়া থাকিতো। বাবাও আমাকে ভালোবাসিতেন বটে কিন্তু আমার পড়াশুনা লইয়া, আমার আচার আচরনে তিনি মাঝে মাঝে এতোই বাড়াবাড়ি করিতেন যে, মনে হইতো এই লোকটি আমার অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে রহিয়াছেন কিন্তু তাহাকে তাহা আমি বুঝাইতে চাহি নাই।

এইভাবেই আমার দিনগুলি কাটিয়া যাইতেছিলো। মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাসায় বিশেষ বিশেষ উৎসবের বাহানায় আমি বাসার বাহিরে থাকিতে পছন্দ করিতাম, নাইট ক্লাবে ঘুরিতাম, অনেকরাত পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। আমার মা কিছু বুঝিতে পারিলেও খুব একটা উচ্চবাচ্য করিতেন না। করিলে আবার খামাখা সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয় এইভয়ে বাবাকেও মা খুব একটা কানে দিতেন না। বিশেষ করে আমার নেশা করিবার ব্যাপারটা তো তিনি বেমালুম চাপিয়া থাকিতেন। মা আমার অনেকদিন অনেকভাবে একা গায়ে হাত বুলাইয়া, আদর করিয়া, মা-সোনা বলিয়া নেশা না করিবার জন্য অনেক জ্ঞ্যানদান করিতেন কিন্তু নেশা এমন এক জিনিস, একবার শুরু করিলে, শেষে নেশাই তোমাকে টানিয়া লইয়া যাইবে। ঐখান হইতে আর বাহির হইবার জোগার থাকে না। মা আরো বলিতেন- নেশা একটা মনের আনন্দ। নেশায় মন এমন এক জায়গায় চলিয়া যায় যেখানে কোনো বাধা নাই। যেনো শুধু স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা। বড় শহরের অনেক অন্ধকার গলিতে যেমন প্রতিরাতে একটা নেশার জগত গড়িয়া উঠে, তেমনি বড় লোকেররা বা তাহাদের সন্তানেরা অন্ধকার গলির বাহিরে আলো ঝক মকে আধুনিক প্রাসাদে সেই নেশার জগত গড়িয়া তোলে। উভয় জায়াগতেই সমাজের অনেক শ্রেনী থেকে অনেক যুবকরা আসিয়া থাকে। তাহার সবাই নিজেদের আত্মীয়স্বজন ছাড়িয়া নিজেদের নেশায় ভাসিয়া থাকে। সভ্য সমাজ এদেরকে দেখিয়াও উপেক্ষা করিয়া যায়। খুব বেশী হইলে হয়তো কেউ কানাঘুষা করে, কিন্তু এদেরকে আটকানো বা শোধরানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সমাজের এই নীরবতা পরোক্ষভাবে অনেক অপরাধকে আমন্ত্রন জানায়। এই নীরবতার সাথে সাথে আরেকটা সত্যির মুখুমুখি হয় মানুষ, তাঁর নাম অপরাধ। এমন একটা অপরাধ যে, এই নেশয় আধমরা হইয়া থাকা বা উত্তেজিত হইয়া থাকা যুবক যুবতীদের সাথে অন্যান্য সাধারন মানুষেরও প্রান চলিয়া যায়।

আমারো ঠিক তাহাই হইয়াছিলো। আমি প্রায় প্রতিদিন নেশা করিতাম। আমি যে একটা মেয়ে, আমার যে অনেক কিছু লুকাইবার আছে, এইগুলি আমার বিবেক, আমার জ্ঞ্যান আমাকে কখনোই বাধা দেয় নাই, না বাধা শুনিয়াছি আমার মায়ের অথবা ভালো বন্ধু বান্ধবদের। মায়ের বাধা আমার কাছে কোনো বাধাই মনে হইতো না। ফলে নেশারই জয় হইয়াছিলো।

আমি অনেক্ষন ধরিয়া শিমার কথাগুলি শুনিতেছিলাম। এইবার আমি তাহাকে প্রশ্ন করিলাম, ‘আচ্ছা কে তোমাকে এইরুপ সঙ্গ দিতো?’

–অসৎ সঙ্গ দেওয়ার জন্য মানুষের অভাব হয় না। শুধু টাকা হইলেই চলে। দেখিবে, তোমার আশেপাশে এমনসব মানুষের ভীড় জমিয়া গিয়াছে যাহা তোমার মাথাটাকে, তোমার আত্মসম্মানবোধটাকে ভূলুণ্ঠিত করিতে একটু সময়ও অপচয় হয় না। নেশার রেশ ধরিয়া প্রথমে একঘর হইতে আরেকঘর, তাহার পর একবাড়ি হইতে আরেকবাড়ি, এবং ধীরে ধীরে একপাড়া হইতে আরেকপাড়ায় এই বদনাম ছড়াইতেই থাকিবে। আর যদি একবার এই বদনাম ছড়াইতে থাকে আর মন তাহা গ্রাহ্য না করিয়া আরো অদম্য গতিতে তাহার শাখা প্রশাখা বাড়াইতে থাকে তখন বিনাশ ছাড়া আর কিছুই নিজের জন্য বহিয়া আনে না। তখন শুধু চাহিয়া চাহিয়া নিজের সর্বনাশ অবলোকন করা ছাড়া আর কিছুই করিবার থাকে না। একটা কথা না বলিলেই নয়। আসলে এই পৃথিবীর সবাই যার যার মতো। সবাই যার যার থেকে আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সবার সবার সাথে মিল রহিয়াছে। আর সেটা হইলো, সবাই একা। দলবদ্ধ সমাজই বলি, আর একক পরিবারই বলি, সারাটা জীবন প্রতিটি মানুষ একাই ছিলো আর একাই থাকিবে। এই একাকীত্ততা মানুষের জীবনে একটা আফসোসের পাশাপাশি একটা সুখের অনুভুতিও নিয়া আসে যখন সে ভাবে যে সে যাহা করিতে চায় না, সে সেটা করেই না। আবার সে যেইটা করিতেই চায়, সে সেটাই করেই। আর ঠিক এ কারনেই কেউ দলবদ্ধভাবে সুখীও নয় আবার এককভাবেও নয়। এভাবেই একটা চরম আফসোস লইয়া মানুষ এই নীল আকাশের রুপ, এই নির্জন পাহাড়ের মাদকতা কিংবা কনকনে শীত অথবা বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির টুং টাং শব্দের মূর্ছনা ছাড়িয়াই বিদায় নেয় যাহাকে কেউ আর কখনোই মনে রাখে না। আমার কাছে ইহাই বার বার মনে হইতো যে, আমি একা। আর আমার একাকীত্বই আমাকে বারবার ওই নেশার জগতে টানিত।

সম্ভবত ইহাই হইয়াছিলো আমার এই ছোট্ট জীবনে। আমি আমার জীবনে যাহা করিয়াছি, এখন ভাবিলে আমার নিজেরও মনে হয়, আমি ইহা কিভাবে করিতে পারিলাম? ইহা করা আমার কখনোই উচিত হয় নাই। কিন্তু যে সাপ একবার তাহার বিষদাত ফুটাইয়া তাহার সমস্ত বিষনালী খালি করিয়া সর্বনাশের কামড় মারিয়া দিয়াছে, তাহা হইতে পরিত্রান পাওয়ার জন্য সাপে যাহাকে কামড় দিয়াছে তাহার চিকিৎসা অনেক জরুরী হইয়া ওঝার প্রয়োজন হইয়া পরে। আমি ওঝার সাহায্য নিতে হইবে ইহাও বুঝিতে পারি নাই। 

এইভাবে আমি যেনো আস্তে আস্তে কোন এক অন্ধকার জীবনের শহরে ঢোকিয়া গেলাম। অন্ধকার আর কালোর মধ্যে একটা তফাত আছে। কালোর একটা রঙ আছে কিন্তু অন্ধকারের কোনো রঙ নাই, আছে অনিশ্চয়তা আর প্রতিনিয়ত বিপদের হাতছানি। কিন্তু বয়স বলিয়া একটা কথা আছে। এই বয়সে তাহার মন আর যুক্তি বাস্তবের সাথে কতটা যে ফারাক, তাহাতে আর যাই হোক তাহার আত্মার শান্তি হয় না। আত্মা, মন, আর যুক্তি যখন একই সুতায় থাকে না, তখন প্রতিনিয়ত শুরু হয় অন্তর্দাহ, আর এই অন্তর্দাহ হইতে শুরু হয় কলহ। আর একবার যদি কলহ বাধিয়া যায়, তাহা আর  নিভিবার উপায় থাকে না। অন্তর্দাহ নিভাইবার জন্য জলভর্তি কলশী কিংবা তীরভর্তি নদীর প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন সময়ের সাথে পরিবর্তনের ইচ্ছা। ইহা আমার ছিলো না। ফলে অন্তর্দাহ যেমন নিভিতেছিল না, তেমনি বাতাসের স্পর্শ পাইয়া উহা আরো তীব্র দাবদাহে পরিনত হইতেছিলো। আর এই তীব্র আগুন একদিন আমাদের পরিবারেও ছড়াইয়া গিয়া অনাখাংখিত অঘটন ঘটিতে লাগিলো।

প্রতিদিন সকাল হইলেই আমি কেনো দেরি করিয়া ঘুম হইতে উঠি, কেনো আমার ক্লাশের ফলাফল ভালো নয়, কেনো আমাকে প্রতিদিন বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় যাইতে হইবে, আর তাহাদের সঙ্গে আড্ডায় যাইয়া কেনো রাত অবধি থাকিয়া বাসায় ফিরিতে হইবে, এইসব ব্যাপারে কথা শুনিতে হইতো। বাবার সব কথায় আমি প্রতিবাদ করিতাম না কারন আমি জানিতাম, আমার প্রতিবাদে বাবার কাছ হইতে আমার সাহাজ্য বন্ধ হইয়া যাইবে, আর আমার মায়ের এমন কোনো গুপ্ত তহবিলও ছিলো না যেখান হইতে বাবার সাহাজ্য ছাড়াই আমি আমার যাবতীয় শখের মনোবাঞ্চনা পুরুন করিতে পারিবো। তাই মাঝে মাঝে আমি বাবার অকথ্য গালিগালাজের ব্যাপারটা অনেকটা উপেক্ষা করিয়াই আমি বাবার সাথে এমন ব্যবহার করিতাম যেনো, বাবা ছাড়া আমার এই পৃথিবীতে আর কাউকে আমি বেশী ভালোবাসিনা। বাবার অকথ্য গালিগালাজের পরেও আমি বাবাকে এইটা বুঝাইতে পারিতাম যে, আমার বাবা হইতে আরো ভালো বাবা এই পৃথিবীতে আর একটাও সৃষ্টি হয় নাই। তিনিই যেনো সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। ইহা ছিলো একটা নকল ভালোবাসা। হইতে পারে, বাবারা বা মায়েরা নকল ভালোবাসা বুঝিতে পারেন না। তাহাদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নাই।

এইভাবেই আমার দিন চলিতেছিলো। আমার রুপের কথা যদি তোমাকে বলিতে যাই, সেইটা মনে হয় আর দরকার নাই। আমিতো তোমার সামনেই এখন বসিয়া আছি। আমি দেখিতে কেমন, কেমন আমার চোখ, নাক, গাল কিংবা আমার মুখমন্ডল, ইহা তোমাকে আর বিশেষণ দিয়া বুঝাইতে হইবেনা। অনেক ছেলেবন্ধুরা আমার এই চেহারার প্রতি অনেক আকৃষ্ট হইয়া হয়ত অনেকে অনেক কবিতা, গল্প লিখিয়া থাকিতে পারে, তাহা আমার জানা নাই। তবে অনেকের রাতের ঘুম যে অনেকাংশেই বিঘ্নিত হইতো সেটা আমি জানিতাম। আমাকে নিয়া ছেলেমহলে অনেকের  সঙ্গে অনেকের দুই একবার অনেক যুদ্ধও যে হয় নাই তাহা নয়। কিন্তু আমি প্রকৃতভাবে কাউকেই এমন করিয়া ভালোবাসি নাই যাহাকে তোমরা আধুনিককালের ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভালোবাসার সীমানা টানিয়া থাকো। তবে এইটা ঠিক যে, মনুষ্যকুলে আমি যাহাকে সবচেয়ে বেশী আদর করিতাম তাহা হইলো আমার ছোটভাই। বড় মিস্টি করিয়া আমাকে আপু বলিয়া ডাকে, বড্ড দুস্টুমী করিয়া আমার পাশে আসিয়া তাহার যতো আবদার আছে সব খুলিয়া বলে। আমি তাহাকে কখনো গাল টিপিয়া, কখনো বুকে চাপিয়া ধরিয়া, কখনো আবার মিথ্যা ভয় দেখাইয়া বলিতাম, আমি তোমাকে ছাড়িয়া অনেক দূর চলিয়া যাইবো, তখন দেখিবো তুমি কাহাকে এতো কস্ট দাও। আসলে আমার ভাইটি আমাকে কখনো কষ্টও দেয় নাই। নিছক মজা করিবার জন্য তাহাকে আমি মিথ্যা ভয় দেখাইতাম। বুঝিতে চাহিতাম, আমার সেই কথায় সে কতটুকু বিচলিত কিংবা মন খারাপ করে। অনেকদিন হইলো আমি আমার সেই ছোট ভাইটিকে আর দেখিতে পাই না।

এই বলিয়া শিমা একটু থামিলো বটে কিন্তু পরক্ষনেই বুঝিলাম, সে ফুপিয়া ফুপিয়া কাদিতেছে। নিঝুমরাতে এই অসম বয়সী দুই মনুষ্য যুগলের মধ্যে কোনো ভাষার আদান প্রদান হইতেছিলোনা বটে কিন্তু দুইজনের অন্তরের ভিতরে যাহা ঘটিয়া যাইতেছিলো তাহা অদৃশ্য ঈশ্বরের অজানা ছিলোনা। চিনি না, জানি না, কখনো দেখি নাই, এমন একজন মানুষের গল্প শুনিয়া আমার মনের ভিতরেই বা কেনো ব্যথায় একটু মোচর দিয়া উঠিতেছে? আমি তাহার ভাইয়ের ভালোবাসার কথা মনে করিয়া আমি যেনো তাহার ওই ছোট ভাইটিকেও চোখে দেখিতে পাইতেছি। মনে হইতেছিলো, আহা, আমারও যদি এমন একটা ছোট ভাই থাকিতো? সিমার ছোট ভাইয়ের প্রতি এতো ভালোবাসার অনুভুতি দেখিয়া আমার দুই মেয়ের ছবি ভাসিয়া উঠিল। কি অদ্ভুদ এই ভাইবোনের সম্পর্ক। কখনো ঝগড়া, কখনো হাতাহাতি, কখনো খুব ক্ষুদ্র একটা জিনিষ লইয়া তাহাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি আবার কখনো একসঙ্গে এক টেবিলে বসিয়া রাজ্যের হাসাহাসি, আরো কতো কি? ভালোবাসার মানুষ যখন কাছে থাকে, তখন তাহাকে যতটা না আপন মনে হয়, যখন সে কাছে থাকে না, তখন তাহার জন্য প্রান বড় আনচান করে। মনে হয়, একবার যদি আবার কাছে পাইতাম, তাহা হইলে অনেক আদর করিয়া সব ব্যাথা বেদনার জল তাহার কাছে সমর্পণ করিয়া আরেকবার ক্ষমা চাহিয়া বলিতাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলিবেনা। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।

রাত অনেক হইয়াছে। কেহ জাগিয়া আছে বলিয়া আমার মনে হয়না। মাঝে মাঝে ঐ দূরে নাইট গার্ডের চিৎকার শুনা যায়, কিংবা অনেক রাতের বিমান যাত্রিদের নিয়া কিছু কিছু বিমান নিশাচরের মতো আমাদের এলাকা দিয়া উড়িয়া যাইবার সময় বিকট একটা শব্দ করিয়া কোনো এক অজানা অন্ধকারের রাস্তা ধরিয়া একদেশ হইতে আরেক দেশে মিশিয়া যাওয়ার সেই চেনা শব্দ দূর হইতে ভাসিয়া আসিতেছে। কিন্তু ইহাতে আমাদের মধ্যে কোন বিরক্তবোধ হইতেছে না। দেখিলাম, সিমার চোখে একটু একটু জলের আভা ঘরের আলোতে চিক চিক করিতেছে। চোখের জল যখন পরি পরি করিয়াও পরিতেছে না, তখন তাহা চোখের পাপড়ির সঙ্গে এক হইয়া এমন একটা বিন্দুর সৃষ্টি করে যে, মনে হইবে চোখের দুই ধারে যেনো একটা স্বচ্ছ হিরার খন্ড ঈশ্বর বসাইয়া দিয়াছেন। সিমার চোখের কোনায় তাহার দুঃখের বহিরপ্রকাশ যেনো এমন করিয়াই ঐ একখন্ড হিরার জল চিকচিক করিয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল। 

সিমা তাহার চোখের জল আমার কাছ হইতে লুকাইবার কোনো চেষ্টাই করিলো না। আমার দিকে ছলছল নেত্রে তাকাইয়া, দুই হাত দিয়া চোখের জল মুছিয়া অতি সাধারন ভঙ্গিতে বলিল,

– আরেক কাপ কফি খাই? তুমিও কি কফি খাবে?

আমি কফি খাইবো কি খাইবো না, ইহার প্রতিউত্তরের জন্য কোন অপেক্ষা না করিয়াই সিমা চেয়ার ছাড়িয়া নিজেই আমাদের রান্নাঘরে কফি বানাইতে চলিয়া গেলো। সিমা একটা নীল ওড়নার সহিত হলুদের কামিজ পড়িয়াছে। কম্বিনেসন করিয়া হয়ত সাদা স্যালয়ার পরিয়াছে কিন্তু খারাপ লাগিতে ছিলো না। আর জেলখানায় তো নিজের আলমারী থাকে না, হয়ত এই কয়টা জামাই তাহার কাছে রহিয়াছে। কতইবা বয়স তাহার। আমার মনটা বড্ড কেমন কেমন যেনো করিতেছিলো। আঘাত করিলেই শুধু অন্তরে ব্যথা হয় এমন নয়। আমাদের চারিদিকে অহরহ এমন কত কিছু ঘটিতেছে যাহার ইতিহাস শুনিলে আঘাত যিনি পাইয়াছেন, তাহার থেকেও আঘাত বেশী প্রতিয়মান হয় যিনি ঐ ইতিহাস শুনিতেছেন। আমারও তাহাই হইতেছিল। আমিও যেনো কোথায় বিনা কারনে আঘাতপ্রাপ্ত হইতেছিলাম।

অনেক্ষন হইয়া গিয়াছে সিমা কফি বানাইতে গিয়াছে, এতক্ষনে কফি বানানো হইবার কথা। দেরী দেখিয়া আমিও রান্নাঘরে ঢুকিলাম। দেখিলাম, একহাতে সিমা একটি ছোট চামচ লইয়া কফির কাপের মধ্যে কফি শুধু নাড়াচাড়াই করিতেছে, অথচ আর নাড়িবার প্রয়োজন নাই। বুঝিলাম তাহার মনোযোগ ঐ কফির কাপের মধ্যে নাই। সে যেনো কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। সে যে একটা অপরিচিত বাসায় এতো রাতে কাহাকেও না বলিয়া আসিয়াছে, তাহার যে অতি তাড়াতাড়ি এইখান হইতে আবার চলিয়া যাইবার তাড়া থাকিবার দরকার, আমি তাহার চোখে মুখে, চেহাড়ায় ইহার কোনো চঞ্চলতা দেখিতে পাইলাম না।

আমার উপস্থিতি টের পাইয়া সিমা যেনো সম্বিত ফিরিয়া পাইলো। বুঝিলাম, এতোক্ষন সময়টা সিমার কাছে থামিয়াই ছিলো। একটু লজ্জা পাইলো বটে কিন্তু মুচকী হাসিতেও হাসিলো না। কফি বানানো হইয়াছে। আমরা যার যার কফি হাতে নিয়া আবারো আমাদের ডাইনিং চেয়ারে বসিলাম।

আরো একটা সিগারেট ধরাইয়া আমি সিমাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তারপর কি হইলো?

সিমা কফির কাপের সাথে সিগারেট টানিতে টানিতে বলিতে লাগিলো-

একদিন আমি অনেক রাত করিয়া বাড়ি ফিরিলে দেখিলাম, আমার বাবা তখনো রাত জাগিয়া বসিয়া আছেন। আমার আসিবার অপেক্ষাতেই যেনো বাবা রাত জাগিয়া বসিয়া আছেন। মায়ের দিকে চোখ পড়িতেই বুঝিলাম, মাকে বাবা শারীরিকভাবে হয়তো আঘাত করিয়াছেন। বাবার উপর আমার প্রচন্ড ঘৃণা হইলো। বাবাকে তো আমি আগে হইতেই ভালোবাসিতাম না, আজ সেই নকল ভালোবাসাটা যেনো তাহার খোলস ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিলো। আমি বাবার দিকে এমন করিয়া তাকাইয়া আমার অগ্নি মুর্তি প্রকাশ করিলাম যেনো যদি বাবা আমাকেও কোনো শারীরিক নির্যাতন করেন, তাহা হইলে আমি এমন কিছু করিয়া বসিতে পারি যাহা তাহার পক্ষে সামাল দোয়া সম্ভব না। বাবা হয়তো আমার প্রতিক্রিয়াটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। ব্যাপারটা ওখানেই সেই রাতে সমাপ্তি হইয়া গিয়াছিলো। কিন্তু আমার মনের ভিতরের রাগ, ঘৃণা কোনোটারই সমাপ্তি হয় নাই। মনে মনে বাবার উপর চরম প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলাম। কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাহাতে সাধারনের চোখে মনে হইবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আমিও ঠিক এই রকম একটা নাটক তৈরী করিয়াছিলাম। কিছুদিন এমনভাবে সবার সাথে আচরন করিলাম যেনো সবাই ভাবে, আমি ভালো হইয়া গিয়াছি, নেশা করিতেছি না, সবার খোজ খবর লইতেছি। আমার বাবা মাও খুব খুশী আমার এহেনো আচরনে। আসলে নিজেদের মধ্যে যখন কেউ হিংসা হানাহানিতে জড়াইয়া পড়ে, তখন সেইটাই হয় যাহা রক্তের সাথে রক্তের পাল্লা। ক্ষতি হয় শুধু নিজেদের রক্তের। তাহলে এই খেলায় কে জিতে? কেউ না। হয়তো আমিও জিতি নাই।

একদিন আমি আমার বাবা মাকে নিজ হাতে চা বানাইয়া দিলাম, খাবার টেবিল গুছাইয়া দিলাম। কিন্তু আমার বাবা মা ঘুনাক্ষরেও টের পাইলেন না যে, আমার বানানো চায়ে আমি এমন নেশার ট্যাবলেট মিশাইয়াছি, যাহাতে তাহারা নিমিষেই ঘুমের ঘোরে অচেতন হইয়া যান। তাহারা অল্প সময়ের মধ্যে অবসন্ন দেহে ঘুমাইয়া পড়িলেন। অনেক রাত। আমার নেশা করিতে খুব ইচ্ছা হইলো। গোপনে আনা একটা মদের বোতল খুলিয়া প্রানভরে সে রাতে আমি মদ খাইলাম। নেশার সাথে পাল্লা দিয়া আমার রাগ, আমার গোস্যা, আমার ঘৃণা যেনো আরো বাড়িয়া যাইতেছিলো। ঘরের মধ্যে ছুরি কাচি সবই ছিলো। ঘরের শট রুমে কিছু দড়ি ছিলো, আমি খুব সন্তর্পনে সেই দড়ি গুলি দিয়া আমি আমার বাবার পা দুইটা খাটের সাথে বাধিয়া ফেলিলাম। আমার মায়ের উপর আমার কোনো রাগ ছিলো না, কিন্তু মাকেও আমার ভালো বন্ধু বলিয়া মনে আসিলো না। আমি মাকেও বাবার মতো বাধিয়া ফেলিলাম। আমি ধীরে ধীরে রান্না ঘর হইতে বড় মাপের একটা ছুড়ি আনিয়া প্রথমে বাবার গলায় ছুড়ি বসাইয়া দেই। কোনো প্রকারের কোনো বাধা ছাড়াই যেনো আমি বিয়াল্লিশ বছরের একজন সুপুরুষকে মারিয়া ফেলিলাম। মানুষের রক্ত বড্ড গরম। আমার বাবার গলা হইতে রক্ত এমন করিয়া ফুলিকী দিয়া বাহির হইতেছিলো যেনো কনো একটা কুরবানীর পশুর মতো। আমি তাহার রক্তে এক প্রকার ভিজিয়া গেলাম। বাবার গোংগানীতে মা যেনো অবচেতন্তা হইতে নড়িয়া চড়িয়া উঠিলেন। কোনো কিছু চিন্তা না করিয়ায়ি আমি আমার মায়ের গলাতেও ছুড়ি চালাইয়া দিলাম। কথায় আছে, যখন কোনো মানুষ নেশার ঘোরে জংলী জানোয়ারের মতো কোনো কিছুর সাধ পাইয়া যায়, তখন সে নরখাদকই হইয়া উঠে। আমি সম্ভবত তখন এমনই একজন নরখাদক হইয়া উঠিয়াছিলাম।

ঘরে তখন টিম টিম করিয়া আলো জলিতেছিলো, সারাটা বিছানা, বিছানার চাদর, মেঝের ফ্লোর, আর তাহার সাথে আমার সারাটা শরীর স্যাতস্যাতে রক্তের ছোপ। এই অল্প আলতে রক্ত লাল কিনা আমি বুজিয়া উঠি নাই, কিন্তু মানুষের রক্তের একটা গন্ধ আমি পাইয়াছিলাম। যে রক্ত আমার শরীরে বইতেছিলো, সেই একই রক্ত এখন আমার সারা বাড়িতে এদিক সেদিক গড়াইয়া এক জায়গায় গিয়া জমা হইতেছিলো।

সিমা, এই পর্যায়ে আসিয়া একটু থামিলো। কিছুক্ষন কি যেনো ভাবিলো। আমি সিমার দিকে তাকাইয়া ছিলাম। বাড়িটা নীরবতায় ভর্তি। তারপর আমি সিমাকে বলিলাম,

-সিমা, শুধু কি বাবা মার প্রতি রাগের কারনেই তুমি তাহাদের খুন করিলে? খুন করিবার সময় কি তোমার মন একটুও বিচলিতবোধ করে নাই? তোমার মধ্যে কি একবারের জন্যও মায়া, মহব্বত, তাহাদের আদর, কিংবা এমন কিছু মনে পড়ে নাই যাহাতে তুমি চিরতরে তাহাদের খুন না করিয়া তাহাদের ক্ষমা করিয়া দিয়া অন্তত প্রানে বাচাইয়া দিতে পারিতে? অথবা খুন করিবার পর তোমার মনের অবস্থা কেমন হইয়াছিলো? তুমি কি একটু সময়ের জন্যও কাদিয়াছিলে? অথবা এমন কিছু কি ভাবিয়াছো যে, আহা, আমি ইহা কি করিলাম ইত্যাদি?

সিমা সিগারেটের প্যাকেট হইতে আরো একটি সিগারেট লইয়া ম্যাচের কাঠি কয়েকবার চেষ্টা করিয়া জালাইতে না পারিয়া আমার জলন্ত সিগারেটের আগুন হইতে তাহার সিগারেটখানা ধরাইয়া একগাল ধুয়া ছাড়িয়া বলিতে লাগিলো,

– মানুষ যখন নেশায় থাকে তখন তাহার অবস্থা এক, আর যখন নেশা কাটিয়া যায়, তখন তাহার অবস্থা থাকে অন্য রকম। সিমা আমার দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলো, তুমি কি কখনো নেশা করিয়াছো? নেশা মানুষকে শুধু স্বার্থপরই বানায় না, তাহাকে নেশা এমন করিয়া চাপিয়া ধরে যে, তখন তাহার কাছে অন্য আর কিছুই বাস্তব বলিয়া মনে হয় না। সে হয়ে উঠে এক অদম্য অপ্রকৃস্থত প্রানি যাহার না আছে কোনো সমাজ, না আছে কোনো বন্ধন, না আছে কোন মহব্বত, না আছে কোনো সংসার। হয়তোবা আমিও সেই রকম একটা ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। তাহাদেরকে আমার আপনজন বলিয়া একটুও মনে হয় নাই। আমার ছোট ভাইটিও তাহাদের পাশেই ছিলো, আমি একবারের জন্যও মনে করিতে পারি নাই যে, আমি না হয় তাহাদের হারাইবো, কিন্তু আমার ছোটভাই যাহাকে আমি আমার প্রানের চেয়েও বেশী ভালোবাসি, সে কেনো তাহার বাবা মাকে হারাইবে? আমার শুধু মনে হইতেছিল যে, তোমরা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছো, আজ তাহার পরিনাম ভোগ করিবে। এই পরিনাম তাহাদের অপরাধের তুলনায় কত বড় শাস্তি, কিংবা এই পরিনাম আদৌ শাস্তি কিনা অথবা এই পরিনাম প্রকারান্তে আমি আমাকেই আরো অধিক শাস্তি দিতেছি কিনা তাহা আমার মনের অজান্তেও আবির্ভাব হয় নাই। ঈশ্বর যখন কাউকে শাস্তি দিতে চাহেন, তখন তাহার দ্বারাই তাহার শাস্তির পথ প্রসারিত করিয়া দেন। ঈশ্বর সব সময়ই নির্দোষ থাকেন।

-কিভাবে তুমি এমন কাজটি এতো সহজে করিলে? আমি সিমাকে প্রশ্ন করিলে, এইবার সিমা আমার দিকে একটু রাগের সহিতই আচরন করিলো।

-আমার আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলিতে ভালো লাগিতেছে না। অন্য কথা বলো।

বুঝিলাম, সিমা বিরক্ত হইতেছে। ওকে আমার বিরক্ত করিবার কোন ইচ্ছাই নাই। শুধু জানিতে মন চাহিতেছিলো, তাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। এখন আমার জানিলেও যাহা হইবার তাহাতে কোনো রুপ পরিবর্তন হইবে না, আর না জানিলেও ঘটনার কোনো ব্যতয় হইবে না।

– আচ্ছা, আচ্ছা সিমা, তোমাকে আর আমি এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করিবো না। তবে তোমার যাহা বলিবার ইচ্ছা হয় তাহাই আমাকে বলো। তোমার কথা শুনিতে আমার ভাল লাগিতেছে।

সিমা এইবার আপন মনে বলিতে লাগিলো-

– জেলখানায় বসিয়া আমি অনেকবার অনেক কিছু ভাবিয়াছি। মায়ের কথা ভাবিয়াছি, বাবার কথা ভাবিয়াছি, আমার ছোট ভাইয়ের কথা ভাবিয়াছি, আমার বন্ধু বান্ধবদের কথা ভাবিয়াছি, আরো ভাবিয়াছি আমার আত্মীয়স্বজনের কথা। বারবার শুধু এইটুকুই মনে হইয়াছে, আমি যাহাদেরকে শাস্তি দিবার জন্য এতোসব করিয়াছিলাম, আসলে তাহারা কেহই শাস্তি পান নাই, শাস্তি পাইয়াছি আমি নিজে। যাহারা আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া গেলো, তাহারা আসলে ছিলো আমার নিজের মানুষ। সেগুলি কি শুধু স্মৃতি নাকি স্বপ্ন? আমি জানি, আমি অপরাধ করিয়াছি। আর আমার এই কাজের জন্য আমার কোনো না কোনোদিন শাস্তি হবেই। অপরাধীর পরনতি হলো আইনের হাতকড়া। দেরীতে হলেও আইন তাকে ধরে ফেলবেই। আমি সেচ্ছায় পরদিন সকালে রক্তমাখা শরীর লইয়াই পাশের থানায় আমার ছোট ভাইকে নিয়া হাজির হইয়া সমস্ত ঘটনার বিবরন দেই। থানার অফিসার প্রথমে আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না। তিনি আমাকে আসলে কি ঘটিয়াছে তাহা আবার বলিতে বলিলেন। অতঃপর থানার অফিসার কয়েকজন ফোর্স লিয়া আমাদের বাসায় আসিয়া সমস্ত ঘটনা স্বচক্ষে দেখিলেন। আমি বন্দি হইয়া গেলাম। আমাকে হাজতে পাঠানো হইলো। প্রায় দেড় বছর সময় ধরিয়া আমার এই হত্যাযজ্ঞের বিচার হইলো। অবশেষে বিচারক আমার কৃত কর্মের জন্য আমাকে ফাসির আদেশ শুনাইলেন।  

আমি জানি, আমাকে আজ মুক্ত পৃথিবীর আলোবাতাসে ছাড়িয়া দিলেও আমি আর আগের অবস্থানে ফিরিয়া যাইতে পারিব না। যাহারা আমার জীবনের সব আনন্দ, সব সমস্যা সমাধানের জন্য তাহাদের প্রানের ঝুকি পর্যন্ত নিতে প্রস্তুত ছিলেন, আমি তাহাদেরকে নিজহাতে চিরতরে বিদায় করিয়া দিয়াছি। এখন কেনো জানি বারবার সকাল হইলেই মনে হয়, আহা যদি বাবা আমাকে আবার বকা দিতে আসিতো, আহা যদি মা এসে বলিতো, ‘সিমা এবার বিছানা ছাড়ো, উঠো, অনেক বেলা হইয়াছে, নাস্তা খাবে’। কিংবা আমার ছোট ভাইটি যদি আমার ওড়না টানাটানি করিয়া আমাকে জালাতন করিয়া অতিষ্ঠ করিয়া তুলিত? কিন্তু আমি জানি, আজ আর কেহই নাই। চোখে জল আসে, কিন্তু মুছিয়া দিবার মানুষ নাই। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় বলিয়া মনে হয়, কিন্তু আদর করিয়া কাছে টানিয়া ভরসার কথা শুনাইবার কোন মানুষ নাই। জেলখানায় বসিয়া যখন পূর্ণিমার আকাশ দেখি, অথবা ঘোর বৃষ্টি নামা দেখি, তখন আমার বাড়ির কথা মনে হয়। মনে হয়, কতদিন নিজের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়াইয়া আকাশ দেখা হয় নাই, কতদিন দাদুর বাড়ির টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ শুনা হয় নাই। কষ্ট হয় না বলিলে মিথ্যা বলা হইবে কিন্তু কি আরো এক অদ্ভুত কারনে জানি দুই চোখ ভিজে আসে। এখন আর নেশা করিতে ইচ্ছা করে না। নেশার প্রতি আর আমার কোন আকর্ষণও নাই। তাহার পরেও মনে হয়, মায়ের বকুনির জন্য আমি আজ নেশাগ্রস্থ, বাবার ধমকের জন্য আজ আমি নেশাগ্রস্থ। জানো? যা হারাইয়া যায়, আর যাহার সব কিছু হারাইয়া যায়, সে জানে কি হারাইয়া গিয়াছে আর কাকে হারাইয়া নিঃস্ব হইয়া গেছে।

আজ শুধু মনে হয়, যদি আমি উহা না করিতাম, যদি এমন কিছু করিতাম যাহা আবার ফিরিয়া পাইতাম, অথবা এমন কিছু যাহা আবার ফিরিয়া আসে। তাহা হইলে আজ শরতের সকাল, শীতের পিঠা, মায়ের অযথা বকুনী, ভাইয়ের অযাচিত আবদার, সেই দাদু বাড়ির আঙ্গিনায় বসিয়া একগুচ্ছ দুরন্ত বালক বালিকার সঙ্গে হৈচৈ, কোনো কিছুই জীবন হইতে হারাইয়া যাইতো না। তোমরা বাচিয়া থাকিবে, হয়ত একদিন সময়ের রেশ ধরিয়া তোমরাও আমার মত এই পৃথিবী হইতে বিদায় লইবে। অনেকেই তোমাদের জন্য কাদিবে, কেউ চিৎকার করিয়া বলিবে, তোমাকে ছাড়িয়া যাইতে আমার বড় কষ্ট। কিন্তু আমি যেদিন বিদায় হইবো, তখন সারা পৃথিবীর মানুষ জানিবে, আমি কোনো এক জঘন্য পাপ কাজ করিয়া এই পৃথিবী হইতে বিদায় নিলাম। আমার জন্য কাদিবার কোনো লোক খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। আর যারা আমার জন্য আফসোস করিবে হয়তো তাহাদেরকে আমি চিনি না। আসলে এই পৃথিবী আমার জন্য নয় বিধায় আমাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। বড় বড় অক্ষরে তাহার পরের দিন প্রতিটি খবরের কাগজে তোমরা পড়িবে, “বাবা মাকে একসঙ্গে জোড়া খুনের দায়ে আমার ফাসি হইয়াছে”। কেহ কেহ আমাকে ঘৃণা করিবে, কেহ আবার ‘মাফ করিয়া দিলেই পারিত’ বলিয়া মন্তব্য করিবে। আর আমার ছোট ভাইটি যেদিন বুঝিতে পারিবে, তাহার পিতামাতা তাহার বোনের কারনে মৃত্যুবরন করিতে হইয়াছে, সেদিন হয়ত সেও আমাকে আর ক্ষমা করিবে না। অপরাধ একখন্ড জমি নয় যে, কাহারো নামে লিখিয়া দেওয়া যায়। রক্ত চোখের জলের থেকেও বেশী ঘন, তাহার পরেও চোখের জলের বেদনা রক্ত ঝরার থেকেও কষ্টের। আমি তাহাদের রক্ত ঝরাইয়াছি বটে কিন্তু কষ্টটা রহিয়া গিয়াছে আমার চোখের জলে।

আমি যেদিন এই পৃথিবী থেকে বিদায় লইবো, জল্লাদ যখন আমাকে আমার শেষ ইচ্ছার কথা জানিতে চাহিবে, জানো আমি কি বলিতে চাইবো? হয়ত মুচকি হাসি দিয়া বলিবো, “আমি পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়া মরিতে চাহি না, আমি এই পৃথিবীর কোনো আলো বাতাস লইয়া কথা বলিতে চাহি না, আমি জীবনের চরম সুখ বা দুঃখের কথা বলিয়াও কাউকে চমক দিতে চাহিবো না। আমি শুধু একটিবার সবার সামনে উচ্চস্বরে চোখের জল ভাসাইয়া বলিতে চাইবো, “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা, এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে আর কোনো এমন বাবার জন্ম হইবে কিনা আমি জানি না, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। আমি তোমাদের কাছে চলিয়া আসিতেছি। আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও”।

এই বলিয়া সিমা তাহার মাথাটা নুয়াইয়া টেবিলের উপর রাখিয়া ফুপিয়া ফুপিয়া কাদিতে লাগিলো। আমি নিরন্তর কোনো ভাষাবিহীন এক শ্রোতার মতো শুধু সিমার কথাগুলি শুনিতেছিলাম। আমার চোখের পাতাও ভিজিয়া আসিতেছিল। মনে হইতেছিলো, এই ছোট মেয়েটি যেন তাহার বাবার সামনে বসিয়া তাহার জীবনের সমস্ত কষ্টের কথাগুলি বলিয়া বাবাকে আরেকবার ভিজাইয়া দিয়া অস্থির করিয়া তুলিতেছে।

-এই যে শুনছো, এইভাবে টেবিলের উপর ঘুমাইতেছো কেন? কোনো এক হটাত শারীরিক ধাক্কায় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেলো। দেখিলাম, অনেক বেলা হইয়াছে। আমার গিন্নি তাহার দল লইয়া মানিকগঞ্জ হইতে সকাল সকাল রওয়ানা হইয়া ইতিমধ্যে বাসায় চলিয়া আসিয়াছে। তাহার সহিত ঘরের চাবি ছিলো, অনেক্ষন কলিং বেল টিপার পরেও যখন আমার ঘুম ভাঙ্গাইতে পারে নাই, তখন তাহার ভ্যানিটি ব্যাগে রক্ষিত আরেক গোছা চাবি দিয়া ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আমি আশেপাশে কি যেনো খুজিতে লাগিলাম। সিমা কি এখনো আছে নাকি চলিয়া গিয়াছে? যদি মেয়েটি আসিয়াই থাকে তাহলে ঘরের চাবি লাগাইয়া আবার কিভাবে চলিয়া গেলো? তাহার কাছে তো কোনো চাবি ছিলো না? তাহলে কি কেহই রাতে আমার সঙ্গে গল্প করে নাই? আমার টেবিলের উপর তো এখনো দেখিতেছি দুইটা কাপ রহিয়াছে। তাহলে কি সিমা আসিয়াছিলো?

আমার গিন্নি, আমি কি খুজিতেছি জিজ্ঞাসা করিতেই বলিলাম, “সিমা……”

আর শেষ করিতে পারিলাম না। গিন্নি বলিয়া উঠিল, জানো? আজকের পত্রিকায় প্রথম পাতায় ঐ যে মেয়েটি যে তার বাবা মাকে খুন করিয়াছিলো, সিমা, তাহার ব্যাপারে বড় বড় করে সংবাদ আসিয়াছে যে, গতকাল রাত বারোটার পর সিমার ফাসি কার্যকর হইয়াছে”।

বুকটা ধক করিয়া উঠিল।

পত্রিকাটি হাতে লইয়া অনেক্ষন ধরিয়া খবরটি পড়িলাম। কিছুতেই মিলাইতে পারিতেছিলাম না। পত্রিকার সংবাদে সিমার শেষ ইচ্ছা জানিতে চাহিলে সিমা নাকি বলিয়াছিলো, “আমার কোনো কিছুই আর কাহারো কাছ হইতে চাহিবার নাই, শুধু আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও। আমি আমার বাবা মায়ের কাছে যাইবো। তখন নাকি সিমা অতি উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিতেছিলো, “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা, এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে আর কোনো এমন বাবার জন্ম হইবে কিনা আমি জানি না, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। আমি তোমাদের কাছে চলিয়া আসিতেছি। আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও।”

(এই গল্পের সাথে কারো কোনো মিল নাই, এটা নিছক একটা গল্প।)