গতকাল আমার ছোট মেয়ের এসএসসি এর পরীক্ষার রেজাল্ট বাহির হইয়াছে। তো গত পরশুরাতে ওর মা খুব টেনশানে ছিলো কি ফলাফল করে মেয়ে সেটা ভাবিয়া ভাবিয়া। কিছু কিছু মানুষের টেনশন তাহার চেহারার মধ্যে একদম ফুটিয়া উঠে। তাহার মুখের অবয়ব দেখিয়া বুঝা যায় যে, শরীরের হরমুন ঠিক মতো কাজ করিতেছে না বলিয়া মুখে একটা ছাপ পড়ে। খাবার দাবারে অনীহা আসে, কথাবার্তায় খিটখিটে মেজাজ ফুটিয়া উঠে। ফোনে অধিক অধিক কথা বলে, কেউ কেউ আবার ফোন থেকেই বিরত থাকে। এইসব আর কি। আমার বউ সুন্দরী বলিয়া তাহার চোখ মুখ দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই সে টায়ার্ড কিনা কিন্তু সে যে টেনশনে আছে ইহা বুঝা যায়।
জিজ্ঞাসা করিলাম, খুব টেনশনে আছো নাকি? উত্তরে যা শুনিবার তাই শুনিলাম, “তোমার আবার টেনশন আছে নাকি? তোমার মতোই তো মেয়েগুলি হয়েছে। না আছে কোনো টেনশন, না আছে কোন আগ্রহ। ঐ যে বাপের মতন সব। এমতাবস্থায় আমার কি আর কিছু বলিবার আছে? এক কথাতেই তো শেষ- বাপের মতো সব অভ্যাস হইয়াছে মেয়েদের।
ঈশ্বর এইদিক দিয়া বউগুলোকে একদম নিস্পাপ করিয়া রাখিয়াছেন, সব বাচ্চাদের দোষ তো বাপের দোষ। আরে বাবা, বাচ্চাগুলিতো তার মায়েদের মতোও হইতে পারিতো, নাহ? যাক, সংসারে সুখ চাই, ঝগড়া চাই না। তারমধ্যে এখন তাহার টেনশনের মাত্রা মনে হইতেছে একটু বেশি। হাতে তসবিহ, মুখে বিড় বিড় করিয়া কোন এক দোয়া হয়তো সে পড়িতেছে। জিজ্ঞেস করিতে ভয় পাই কোন দোয়াটা পড়িতেছে। ব্যাঘাত ঘটিলে ভেজাল আছে। শান্ত থাকাই ভালো। কে খামাখা নীরব পুকুরে খামাখা ঢিল ছুড়িয়া সাপের লেজে আঘাত করে!! পরে দেখা যাইবে, শক্ত পরোটা খাইতে হইবে। এই মুহূর্তে দাত ব্যথা আছে। আমি দাতকে বেশী কস্ট দিতে চাই না। পড়ুক সে যে দোয়া পড়িলে টেনশন কমে সেটাই পড়ুক। কোনো কথা না বলে বললাম, হ্যা মেয়েগুলার আর কাজ পাইলো না। সব বাপের গুনগুলি পাইয়া বাপের সর্বনাশ করলো আর কি।
এই কথা বলিয়াও যে আমি তাহাকে খুব একটা খুশী করিতে পারিলাম সেটাও ওর মুখ দেখিয়া বুঝা গেলো না। মনে হইলো এই বুঝি নীরব আকাশ হটাত করিয়া কোন মেঘবৃষ্টি ছাড়াই গর্জন করিয়া উঠিবে। ভাগ্যিস ঈশ্বর প্রসন্ন হইয়া এই যাত্রায় আমাকে কোনো রকমে বাচাইয়া দিলেন। খুব বেশি ঝড় উঠিলো না। শুধু ঘাড় ঘুরাইয়া এমন একটা ভাব করিয়া গিন্নি অন্যরুমে পরোতা বানানোর জন্য চলিয়া গেলো তাতে বুঝিলাম, আমার শেষ কথাটিকে তিনি ব্যাঙ্গ ভাবিয়া একটু হুম করিয়াই ছাড়িয়া দিলেন। ঈশ্বর বড় রসিক। সাংসারিক জীবনে কিছু কিছু ছোট ছোট তর্ক-বিতর্ক এমন করিয়া লাগাইয়া রাখেন তাতে না ঝড় শুরু হয়, না অশান্তি। একটু ঘূর্ণিপাক খাইয়াই আবার পরিবেশ ঠান্ডা করিয়া দেন। যাই হোক, আমি গর্বিত যে, বাচ্চারা আমার জিদ, আমার সভাব পেয়েছে। আলসেমীটাও পেয়েছে ঠিক আমার মতোই।
তো মেয়েকে জিজ্ঞেস করিলাম, মা, তোমারো কি ফলাফলের জন্য টেনশন হচ্ছে? মেয়ের উত্তর- বাবা, আমার তো কিছুই মনে হচ্ছে না। আর টেনসন করে এখন কি আর কিছু করতে পারবো? বললাম, তাতো ঠিকই কিন্তু পরীক্ষার আগেও তুমি টেনশনে ছিলা না, এমন কি পরীক্ষা চলাকালীন সময়েও তো আমি বুঝি নাই যে, তুমি একজন পরীক্ষার্থী। মেয়ে মুচকি হাসি দিয়া বলিলো, চলো, ক্রাইম পেট্রোল দেখি। ও জানে আমি ক্রাইম পেট্রোল দেখিতে খুব পছন্দ করি। এই হলো আজকের দিনের যেনারেসন। এই সময়ের জেনারেশন কতটা ইন্টেলেকচুয়াল যাহারা তাহাদের হ্যান্ডেল করেনা, তাহাদের কোনো আইডিয়া নাই। তাহাদের কাছে কোনো পরামর্শ চাইলে তাহার আপনাকে দুই যুগ আগের কোনো এক পুরানো পরামর্শ দিয়া আপনাকে এমন এক ফন্দি দিয়া বিপদের মধ্যে ফেলিবে, যে, তখন না আপনি সমস্যা হইতে বাহির হইতে পারিবেন, না বুঝিতে পারিবেন আরো কোনো বিপদ ঘনাইয়া আসিলো কিনা। তাই যদি পরামর্শ নিতে হয়, আমার কাছ হইতে নিবেন। এই জাতীয় পরামর্শ আমি বিনা পয়সায় দিয়া থাকি। কাজ হইলে জানাইয়া দিবেন, কাজ না হইলে দিতিয়বার আর আসিবেন না।
যাক, ফলাফল দিলো। আমার বউই আমাকে প্রথম খবরটা দিলো যে, মেয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে। ফোনে তার কথার সুরেই বুঝিতে পারিলাম, সে এক প্রশান্তিতে আছে। এই সকালেও যিনি আবহাওয়ার ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের মতো রুপ ধারন করিয়াছিলেন, কোনো রুপ তান্ডব ছাড়াই মনে হইলো, হ্যা, আকাশ বড় পরিস্কার। সমস্ত ঝড় আর কালোমেঘ সব কোথায় কোন অঞ্চলে উড়িয়া চলিয়া গিয়াছে বুঝিতেই পারিলাম না। আমার বউ বড় খুশী। বলিলাম, খুব খুশী মনে হইতেছে তোমায়? এবার তার আরো চমকপ্রদ উত্তরে আমি ফোনের এপ্রান্তে বসিয়া হাসি। “তোমার তো কোনো সাধ আহ্লাদই নাই, মেয়ে এতো ভালো ফলাফল করিলো , কই তুমি মেয়েটাকে একটা ধন্যবাদ দিবা, তা না করিয়া ফোনে বকর বকর করিতেছো। আরে বাবা, আমি আবার কখন ফোনে বকর বকর করিলাম? মাত্রতো ফোন শুরু হইল!! বুঝলাম, এবার আর বাপের মতো হইয়াছে মেয়েগুলি এইটা অন্তত শুনিতে হইবে না। তাহার প্রশান্ত হাসিতেই আমার মন ভালো হইয়া গেলো। হাতের পাশে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট হইতে একটা আস্ত সিগারেট লইয়া তার মাথায় আগুন ধরাইয়া নাসিকা ভর্তি ধোয়া ছাড়িয়া বউকে বলিলাম, দাও , মেয়েকে দাও। একটু কথা বলি।
মেয়ে মোট নম্বর পেয়েছে ১৩০০ মধ্যে ১১৭৪। কম না কিন্তু? প্রায় গড় নম্বর ৯০.৩১%। এই নম্বরে আমাদের সময় বোর্ডে স্ট্যান্ড করতো ছাত্র-ছাত্রীরা। তখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছাত্রদেরকে পাড়ার লোকজন নিজেরাই মিষ্টি নিয়ে এসে গালে হাত বুলিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে যেতো। যারা পরবর্তী বছরের ছাত্রদের অভিভাবক, তারা হয়তো একটু বলেও যেতো, আমার বাচ্চাটাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো, একটু গাইড লাইন দিয়ে দিও কেমন করে ভালো ফলাফল করতে হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ আর এইসব নাই। আজকাল অভিভাবকগন খবর নেয়, কোথায় কোচিং করিয়েছেন, কোন স্যার কোচিং এ ভালো। কোচিং হয়ে গেছে এখন একটা লাভজনক ব্যবসা।
চলুন একটা কোচিং এর স্কুল দিয়া দুইটাই লাভ করি। নাম এবং অর্থ। কে বলিলো যে, এই দেশে ব্যবসা নাই? কোচিং এর থেকে ভালো ব্যবসা তাও আবার বিনা পুজিতে, আর একটাও নাই।