বহুদিন পর হটাত করে আজ ওর সঙ্গে আমার দেখা। বুকটা আঁতকে উঠল ওকে দেখেই। আমাকে ও প্রথম দেখতে পায় নাই, ও খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। আমি ওর পিছন থেকে এক নজর দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, কারন ওর একটা পরিচয় বহনকারী কোড নাম্বারটা আমার আজীবন কালের চেনা। আমি ওকে ধরার জন্য ওর পিছন পিছন ছুটছিলাম। দেখলাম আমি যেদিকে যাচ্ছি, ও ঐ দিকেই থামলো। আমি ওর কাছে গেলাম, দেখলাম ওর কোলে ভীষণ সুন্দর একটি ফুটফুটে বাচ্চা বসে আছে। পাশে একজন মধ্য বয়সী যুবক। বাচ্চা মেয়েটি সম্ভবত ঐলোকটারই হবে। অবিকল বাবার চেহারা পেয়েছে। মেয়েটিকে ওর কোল থেকে নিয়ে লোকটি পাশের এক বইয়ের দোকানে ঢুকে গেল।
আমি এই ফাকে একটি সিগারেট ধরিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম। ও মুচকি হেসে দিয়ে বলল, এখনো সিগারেট ছাড়োনি? তোমার এই সিগারেটের গন্ধটা আমার খুব পরিচিত। আজও মনে পড়ে তুমি যখন আমার কাছে বসতে, তোমার মন ভাল থাকলেও তুমি একটার পর একটা সিগারেট টানতে আবার মন খারাপ থাকলেও তুমি একটার পর একটা সিগারেট ফুকতে। তাঁরপরেও আমি তোমার এই সিগারেটের গন্ধটা অপছন্দ করতাম না। আফটার অল তুমি আমার জিবনে প্রথম পুরুষ। তুমি কি এখনো আগের মত করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরো? নাকি অভ্যাসটা কিছু পরিবর্তন হয়েছে?
নাহ, আমার যে ব্যস্ততা, তাতে মনে হয়না যে অচিরেই আমার এই রাতে বাড়ি ফিরার অভ্যাসটা পরিবর্তন হবে। তবে ছুটির দিনে এখন আর কোথাও যেতে মন চায় না। বললাম, তুমি যখন আমার কাছে ছিলে, তখন ছুটির দিনেও তোমাকে নিয়ে কোন কারন ছাড়া আমি বহুবার বহুদিন এখানে সেখানে ঘুরেছি বটে তবে এখন নতুন সঙ্গী থাকলেও আর যাওয়া হয় না।
“আমার কথা মনে পড়ে?” জিজ্ঞ্যেস করল ও ।
“কি মনে হয় তোমার?” আমি উত্তর করি।
কি জানি, হয়ত মনে পড়ে হয়তবা না। এখন তো তোমার নতুন সঙ্গী হয়েছে আমার থেকেও সুন্দর, আমার থেকেও অনেক বড়। কি জানি মনে নাও পরতে পারে। তবে আমি তোমার কথা সব সময় মনে করি। সবচেয়ে বেশি মনে হয় আমার সঙ্গী যখন তোমাদের ঐ ক্যান্টনমেন্টের পথ দিয়ে কখনো আসা যাওয়া করে। তোমার সঙ্গে থাকার সময় আমি কখনো সাধারন পাবলিকের রাস্তায় ঢোকতে হতো না। তুমি সঙ্গে আছো আর সাই সাই করে ক্যান্টনমেন্টের লেন ধরে তুমি হাত নাড়িয়ে পরিচয় দিলেই কর্তব্যরত এমপি সাহেব কড়া একটা স্যালুট দিয়ে সসম্মানে চলে দিতে দিত। আমি কত সাহেব, কত ভিআইপি পাবলিকের গাড়ির পিছনে এসেও শুধু তোমার কারনে সবার আগে টা টা বাই বাই দিয়ে চলে যেতাম। নিজকে সাংঘাতিক ভগ্যবতী মনে হতো। আর এখন? ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ সব রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, কি সব গাড়ীঘোড়া সবার পিছনে জ্যামের মত ঐ এমপি সাহেবের ক্লিয়ারেন্সের জন্য বসে থাকতে থাকতে আমার আর জান সয় না। আমাকে যেন ঐ এমপি সাহেবও আর চিনতে পারে না। তোমার নতুন সঙ্গী নিশ্চয় এখন এই মজাটা পায়, আমি সেটা জানি।
আমি ওর কথায় হাসি।
“আচ্ছা তোমার চোখের কোনায় এই কাল দাগটা কিসের গো?” আমি ওকে প্রশ্ন করতেই ও চুপ হয়ে গেল।
“কিছু হয়েছে নাকি ওখানে?”
“আর বলো না। আমার নতুন সাহেব একদিন খুব মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরছিল। রাস্তাঘাট ফাকাই ছিল। হটাত কি হলো তাঁর, আল্লাহই জানে, ঘ্যাঁট করে এমন করে সে টার্ন নিল যে, পাশের এক ইলেকট্রিক খাম্বার সঙ্গে দিল লাগিয়ে। আর যায় কোথায়। তখন আমার বাম চোখের পাশে আমি এই ধাক্কাটা খাই, হাসপাতালে যাওয়ার সময় নাই, কারন আঘাতটা গুরুতর বলে মনে হয় নাই বলে আমার সাহেবের ধারনা। সেই থেকে এই ক্ষত নিয়েই চলছি সবার মাঝে।
“তোমার নতুন সঙ্গির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে না?” বলে যেন সে খিল খিল করে হাসতে থাকলো। কি অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে।
আমি বললাম, “নিশ্চয় পরিচয় করিয়ে দেব”। তবে আজ নয়। ওরা আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে নিউ মার্কেটের একটা রেস্টুরেন্টে গেছে।
তোমার সাহেব কি করে? বলতেই আরেকবার চুপ হয়ে গেল বলে মনে হল।
সে আমার উত্তর না দিয়ে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করে বসে। “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে না ছাড়লেই কি পারতে না? অন্তত সেই লক্ষি বড় মেয়েটির জন্য!!?” ও কতদিন আমার কোলে বসে সুন্দর সুন্দর গান শুনতো। কি মিস্টি মেয়ে। লক্ষি মেয়ে বটে। কি করে এখন ও? শুনেছি ও নাকি এখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। অনেক বড় হয়ে গেছে না? আমার কথা কি ওর মনে পড়ে?
আমি বললাম, হ্যা, ও এখন ডাক্তারি পড়ছে। আমাদের কাছে থাকে না। মাঝে মাঝে আমি নতুন সঙ্গিকে নিয়ে ওর ওখানে যাই। আমার বড় মেয়ে প্রায়ই তোমার কথা বলে।
এমন সময় দেখা গেল তাঁর সঙ্গী আবার সেই ফুটফুটে মেয়েটিকে নিয়ে চলে এসেছে। আমারও প্রায় সিগারেট খাওয়া শেষ। কোন ফুরসুত না দিয়ে তিনি আমার এই সেই পুরানো বন্ধুটিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমার আর তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়া হল না।
দেখলাম, সেই পুরান চেহারায় লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির রঙে রাঙ্গানো আমার সেই ১০৮৬ সিসির পিকান্ত গাড়িটি ধুলা উড়িয়ে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ওর ঠিকানাটা আবারও হারিয়ে ফেললাম। আমার প্রথম জীবনের সঙ্গী সে। জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু বিচ্ছেদ হয় আমাদের যার কোনো কারন থাকে না। এমন নয় যে, আমাদের এই বিচ্ছেদের কারন কোনো অনীহা, বা অপছন্দের কিংবা এক সাথে চলতে না পারার কোনো কাহিনী। অনেক সময় মানুষের জীবনের নিত্য প্রয়োজনেও কাউকে না কাউকে বিসর্জন দিতে হয়। তখন সেই বিসর্জনে থাকে বুক ভরা কষ্ট আর স্মৃতি। কষ্টটা হয়তো সময়ের স্রোতে ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু স্মৃতিটুকু সব সময় মনের কোনো এক গহীনে এমনভাবে জমা হয়ে সুপ্ত থাকে যে, অল্পতেই নড়াচরা করলে সেই স্মৃতি পুরানো সেই কষ্টকে জাগিয়ে তোলে। আমার এই কোরিয়ান লাল পিকান্ত গাড়িতা যেনো সেই রকমের কোনো এক বিচ্ছেদের অংশ। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আমি ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে শধু বললাম, I loved you always and I will always love you.