০৭/০৭/২০২২-ইউরোপবসন্ত

আরব বসন্তের কথা মনে আছে? শুরু হয়েছিলো ২০১০ সালে।

আরব বিশ্বে সর্বপ্রথম গণবিক্ষোভের শুরু হয়েছিল মিশরে। গণবিক্ষোভ ছিল মিশরীয় জনগণের দীর্ঘকালের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। ১৭ দিন গণআন্দোলনের পর ১১ই ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের পতন হয়। এরপর তা লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, বাহরাইন, ইরান, জর্ডান, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি-আরব, সুদান, সিরিয়াতেও ছোট বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিদ্রোহে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন, জনসভা প্রভৃতি কর্মসুচী নেয়া হয়।

আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লবের ঝড়কে পশ্চিমা সাংবাদিকরা আরব বসন্ত হিসাবে আখ্যায়িত করে। মিশরের আগেও আরব বসন্তের সূচনা হয় আসলে তিউনেশিয়ায়। স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর দুঃশাসনের ফলে সেই দেশে বেকারত্বের হার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এর প্রতিবাদে এক যুবক প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহুতি দেয়। ফলাফলস্বরুপ, লোকজন বেন আলীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে পড়ে। ফলে সূচনা হয় আরব বসন্ত। যদিও তিউনিসিয়ায় এটিকে জেসমিন বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়।

চরম রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অর্থনীতি, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য ও শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ যুবসমাজ, খরা ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়ছিল।

আরব বিশ্বের এই গনঅভ্যূত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কের পতন ঘটাতে সাহয়ক ভূমিকা রেখেছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, আরব বসন্তের ফলে মাত্র দুই বছরে লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনের গণ-আন্দোলনের ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে দুই হাজার ৫৬ কোটি ডলার।

এতো বছর পর, কেনো জানি আমার কাছে মনে হচ্ছে-এবার বসন্তটা হবে “ইউরোপশ্চিমা বসন্ত”। কেনো বলছি?

এই ইউরোপের দেশগুলিতে এখন পুরুদমে একনায়কতন্ত্রের চর্চা, মানবাধীকার লঙ্ঘন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অর্থনীতি, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য ও শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ যুবসমাজ, খরা, খাদ্য, তেল গ্যাস এমন কি শিশুদের খাবারের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধিতে সারাটা ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশগুলিতে সরকার প্রধানদের অবস্থা মুটামুটি টালমাটাল।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অপসারন এই ইফেক্টের প্রথম কারন বলা যায়। বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অবস্থাও প্রায় বরিস জনসনের মতো হতে যাচ্ছে। একে একে তাঁর কোয়ালিশন পার্টি এবং কিছু সতন্ত্র এমপি ইতিমধ্যে সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রী পেটকভকে একঘরে করে ফেলছেন। বাকীটা হয়তো অচীরেই নজরে আসবে।

জার্মানীর অভ্যন্তরে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়াকে বিভিন্ন কমোডিটির উপর স্যাংকশন দেয়ার কারনে দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধিসহ অনেক শিল্প কারখানা প্রায় বন্ধের উপক্রম। তাতে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে, কিন্তু সরকার নাগরিকদের জন্য বিকল্প কিছু তৈরী করতে না পারায় জার্মানীর ভিতরে নাগরিকগন এতোটাই হতাশ যে তারা এখন রাস্তায় নেমে পড়েছেন।

স্পেনের মাদ্রিদে এখন প্রকাশ্যে আন্দোলন চলছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তথা ন্যাটোর একচ্ছত্র সিদ্ধান্তকে স্পেন সরকার মানার কারনে। তারা ব্লক থেকে বের হয়ে যাবার জন্য আন্দোলনসহ ন্যাটোর বিলুপ্ত চান। ফ্রান্সের অবস্থাও প্রায় একই। যে নির্বাচনে ম্যাক্রো অনেক ভোটে এগিয়েছিলো, কিন্তু পার্লামেন্টারী পর্বে গিয়ে তাঁর ভরাডুবি হয়েছে। ইতালী, পোল্যান্ড, লাটভিয়া, ইত্যাদি দেশগুলিতে এখন নাগরিকেরা প্রায়ই আন্দোলনে শরীক হচ্ছেন অর্থনইতিক বিপর্য্যের কারনে।

আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচন করার মত কোনো পরিবেশ আর অবশিষ্ঠ নাই বলেই মনে হচ্ছে। তাঁর পাবলিক রেটিং নীচে নামতে নামতে এখন দাড়িইয়েছে মাত্র ২৭% তে যা আমেরিকায় এ যাবতকালের যে কোনো প্রেসিডেন্টের জন্য সর্বনিম্ন। আমেরিকার নিজস্ব কোনো প্রোডাক্ট তেমন দেশের মধ্যে নাই। আর যা আছে, তা খুবই সামান্য। আমেরিকা গাড়ি থেকে শুরু করে সব কিছুতেই তারা কোনো না কোনো দেশের উপরে নির্ভরশীল। ফলে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞাসহ আরো প্রায় ৩০টি দেশের উপর এ যাবতকাল নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় আমেরিকা নিজেই এখন প্রায় একঘরে হয়ে যাচ্ছে। আরব দেশগুলির কারো সাথেই আমেরিকার ভালো সম্পর্ক নাই, আফ্রিকার দেশগুলির সাথেও না। এবার শুরু হয়েছে এশিয়া দেশগুলির সাথে দন্ধ। ফলে আমেরিকা সারা প্রিথিবীকে একঘরে করতে করতে এখন সে প্রায় নিজেই একপেশে হয়ে গেছে। প্রতিটি দেশে তাদের কারেন্সী বিশেষ করে ইউরো এবং ডলারের ইনফ্লেশন হচ্ছে। বলা হচ্ছে ইউরোপিয়ান দেশগুলি অচিরেই ১০% জিডিপি শ্লথ হবে। এসব কিছু মিলিয়ে উপসংহারটা যে খুব ভালোর দিকে এগুচ্ছে না, সেটা এখন প্রায় পরিষ্কার।

আগামী বছর এর পুরু দৃশ্যটা একেবারে চোখের সামনে ভেসে উঠবে যদি না এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া হয়।

'চাঁদ উঠুক বা না উঠুক, আজ বসন্ত"।