উচ্ছিষ্ট সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
৭
প্রায় সবগুলি কাজ শেষ। ভিসা আগেই হয়ে গিয়েছিলো, টিকেটও কেনা আছে, টিউশন ফি গতকাল পাঠিয়ে দেয়া হয়ে গেছে। ভ্যাক্সিনেশন যা যা নেয়া দরকার ছিলো, সবই সম্পন্ন করা হয়েছে। ব্যাগপত্র, মালামাল সব কিছুই প্যাকড হয়ে গেছে, আগামী এক বছরের আর্থিক জোগানও শেষ, এখন বাকী শুধু করোনা টেষ্ট আর ফ্লাইটে উঠা। আগামী ১০ তারিখের দিবাগত রাত অর্থাৎ ১১ আগষ্ট এর ভোর বেলায় কনিকার ফ্লাইট। মাত্র তিনদিন বাকী। কনিকার চলে যাওয়ার শুন্যতাটা এখন মাঝে মাঝে অনুভব করছি, উম্মিকা রীতিমত প্রায় প্রতিদিনই কান্নাকাটি করছে কনিকা চলে যাবে বলে। কনিকা এখনো খুব একটা মন খারাপ করছেনা তবে বুঝা যায় সে একটা দুদোল্যমান অনুভুতিতে ভোগছে। কারন একদিকে কনিকা আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে বেশ খুসী, অন্যদিকে বাড়ি ছাড়ার কষ্ট। মিটুলের অবস্থাটাও প্রায় ওই একই রকমের। আর আমার? আমার শুধু একটাই ভয়, ওরা যেনো ভালো থাকে যেখানেই থাকুক। মন তো খারাপ হচ্ছেই। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমি মেনে নিয়েছি বাস্তবতা।
বাড়িটায় সারাক্ষন কনিকাই মাতিয়ে রাখতো, বাসায় যতো কথাবার্তা, যতো হইচই কনিকাই করতো। এই পরিবেশটা মিস করবো আমরা। অফিস থেকে আমি বাসায় আসার পর প্রথমেই আমি ঢোকি সাধারনত কনিকার রুমে আর তার সাথে উম্মিকার রুমে। ইদানিং উম্মিকা ডেল্টা মেডিক্যালে জব করে বলে, প্রায়ই আমি খবর নেই মেয়েটা লাঞ্চে খাবার খেয়েছে কিনা বা রাত সাড়ে আটটা বাজলেই মনে করিয়ে দেই, উম্মিকাকে আনতে গাড়ি গেছে কিনা।
আমি জানি, কনিকা যেদিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হবে ইনশাল্লাহ, সেদিন আমার ভিতরে কি কি ঘটবে কিন্তু মনকে শক্ত করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। যতোক্ষন না কনিকা তার ডেস্টিনেশনে গিয়ে পৌছায় ততোক্ষন আমি জানি ওর ফ্লাইট মনিটর করতে থাকবো। যখন আল্লাহর রহমতে কনিকা আমেরিকায় ওর ডেস্টিনেশনে পৌঁছাবে, হয়তো তখন একটু ভালো লাগবে যে, ওখানেও অনেক আত্তীয় স্বজনেরা আছেন যারা কনিকাকেও অনেক ভালোবাসে, তারা দেখভাল করবে।
কনিকা অনেক খুতখুতে। কিন্তু গোছালো। ওর কোনো কিছুই অগোছালো থাকে না। কোন একটা জিনিষ এদিক সেদিক হলেই ওর সেটা ভালো লাগে না। মেজাজ খারাপ করে। ফলে ভয় পাচ্ছি, নতুন পরিবেশে কতটা দ্রুত কনিকা এডজাষ্ট করতে পারে। ওখানে কনিকাকে সব কিছুই নিজের হাতে করতে হবে। পারবে কিনা জানি না। তবে প্রথম প্রথম কনিকা হোমসিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। এটা কাটিয়ে উঠতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
আমি কনিকা যেনো আমেরিকায় অন্তত টাকা পয়সা নিয়ে কোনোরুপ সমস্যায় না পরে, সেইটা শতভাগ নিশ্চিত করেছি (আলহামদুলিল্লাহ)। আসলে আমি ইদানিং আমার জীবনের মুল পলিসিটাই বদল করে ফেলেছি। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। যাতে আমি না থাকলেও আমার সন্তানেরা কোথাও কোন সমস্যায় না পড়ে, বাকীটা আল্লাহ ভালো জানেন। আমার জমি জমা, টাকা পয়সার এসেটের থেকে বড় এসেট আমার মেয়েরা। এদের জন্য পয়সা খরচে আমার কোনো কার্পন্য নাই। যতোটুকু আমার সক্ষমতা আছে, আমি ওদেরকে ততোটাই দিতে চাই।
গতকাল রাতে প্রথম দেখলাম, উম্মিকা কনিকা দুজনেই বেশ ইমোশনাল ছিলো। ব্যাপারটা ঘটছে কারন সময়টা খুব কাছাকাছি কনিকার চলে যাওয়ার। ফলে উম্মিকাও অনেকটা খুব বেশী মন খারাপ করে আছে। চৈতী এসছে কনিকার যাওয়ার কারনে। ওরা সবাই খুব কাছাকাছি ছিলো সব সময়। ওদের বয়সের তারতম্য থাকলেও কনিকাই ছিলো যেনো ওদের সবার মধ্যে নেতা। ওর আবদার কেউই ফেলতো না।
বিমানবন্দর ঢোকার জন্য পাশ এর অবস্থা এখন খুব কড়াকড়ি। কোথাও থেকে কোনো পাশ পাচ্ছি না। ব্যাপারটা একটু হতাশার। অনেককেই বলেছি কিন্তু সব জায়গা থেকেই নেগেটিভ ফলাফল আসায় একটু আরো ভয়ে আছি। আমার দোস্ত উইং কমান্ডার মাসুদকে বলেছি যে, সিভিল এভিয়েশন আসোশিয়েসন অফ বাংলাদেশ থেকে অন্তত কয়েকটা পাশ জোগাড় করতে। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান হচ্ছে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। সে আমাদের থেকে এক কোর্ষ সিনিয়ার কিন্তু আমার সাথে কখনো পরিচয় হয় নাই। যেহেতু মাসুদ এয়ার ফোর্সের, তাই একটা ভরষা মাসুদ দিয়েছে যে, সে পাশ জোগাড় করতে পারবে। কিন্তু ব্যাপারটা আমি এখনো সিউর হতে পারছি না আসলেই মাসুদ পাশ জোগাড় করতে পারবে কিনা।
কনিকা হয়তো ওর বাড়ি ছাড়ার অনুভুতিটা ঠিক এই মুহুর্তে ততোটা উপলব্ধি করতে পারছে না। কিন্তু যেদিন কনিকা স্টেপ আউট করবে, আমি জানি, ওর সবচেয়ে বেশী মন খারাপ থাকবে। যদি এমন হয় যে, পাশ একটাও পাওয়া গেলো না, তাহলে কনিকাকে একাই সব সামাল দিতে হবে। লাগেজ বুকিং, বোর্ডিং পাশ সংগ্রহ, চেক ইন, ইত্যাদি। আর যদি একটা পাশও পাই তাহলে শুধুমাত্র আমি ভাবছি মিটুলকে দিয়ে দেবো যাতে মিটুল সবকিছু ম্যানেজ করে মেয়েকে যতোদূর পারে উঠিয়ে দিতে। তা না হলে প্রশ্নের আর ইঙ্কোয়ারীর প্রশ্নে জর্জরীত হতেই থাকবো। আর যদি দুটু পাই, তাহলে সাথে উম্মিকাকে দিয়ে দেবো। আর যদি বেশী ভাগ্যবান হই, আমিও পাই, তাহলে তো আল্লাহর রহমত, আমরা অকে সবাই এক সাথে বিমানে তুলে দিতে পারবো। কনিকা কাতার এয়ার ওয়েজে যাচ্ছে ইনশাল্লাহ।
আজ শুক্রবার। ভেবেছিলাম, বাইরে কোথাও যাবো। কিন্তু কনিকাকে এই মুহুর্তে বাইরে বের করতে চাই না। চারিদিকে করোনার প্রভাব খুব বেশী। কনিকার করোনা টেষ্ট করাতে হবে ফ্লাইটে উঠার ৪৮ ঘন্টা আগে। তাই খুব একটা বের করতে চাই না কনিকাকে। তাই সবাই চিন্তা করছি- আমাদের ছাদের উপরে ঘরোয়া একটা পার্টি করবো যেখানে শুধুমাত্র আমরাই থাকবো। জাষ্ট একটা আউটিং এর মতো আর কি।
একটা সময় আসবে যেদিন আজকের এই অনুভুতিটা হয়তো আমি আগামী ৪ বছর পর যখন পড়বো, তখন আমার অনুভুতি হয়তো হবে পুরুই ভিন্ন। সফলতার গল্পে আমি হয়তো অনেক গল্প করবো এই কনিকাকে নিয়ে। আমি সব সময় উম্মিকাকেও বলে যাচ্ছি, সেও চলে যাক আমেরিকায়। তাহলে দুইবোন এক সাথে থাকলে আমিও কিছুটা ভরষা পাই। কিন্তু উম্মিকার যাওয়ার ব্যাপারটা খুব ধীর। সে মনে হয় বাইরে মাইগ্রেশন করতে চায় না।
দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় আমাদেরকে নিয়ে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসেন।