আগের যে কোনো বছর থেকে ২০২২ সালের পরে ন্যাটো উল্লেখযোগ্যভাবে সবার নজরে এসছে এবং ন্যাটো নিয়ে অনেক আলোচনাও হচ্ছে। এই ন্যাটোটা আসলে কি?
ন্যাটো (NATO) মানে হচ্ছে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগ্যানাইজেশন।
এটি বর্তমানে ৩১টি দেশ (২৯ টি ইউরোপের এবং ২টি উত্তর আমেরিকান) নিয়ে গঠিত একটা আন্তঃসরকার সামরীক জোট। বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধের আগে তদানীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের (USSR) ওয়ার্শো প্যাক্ট (Warsaw Pact) এর বিপরীতে USSR থেকে আগত যে কোনো আক্রমনাত্তক হুমকীকে মোকাবেলা করার জন্য এই ন্যাটো জোটের উদ্ভব। প্রথম মোট ১২টি দেশ (বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালী, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, ব্রিটেন, এবং আমেরিকা) নিয়ে ন্যাটোর জন্ম। যদিও ন্যাটোর সম্প্রসারনের নিমিত্তে তদানিন্তত আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানীর রাষ্ট্র প্রধানদের মাধ্যমে এটাই কথা ছিলো যে, ভবিষ্যতে ন্যাটোর কোনো সম্প্রসারন হবে না এবং কাউকে আর সদস্য করাও হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আরো ৯ বার এর সম্প্রসারন হয়েছে যা রাশিয়ার জন্য বিপদ সংকেত বলে রাশিয়া মনে করে। USSR এর অধীনে করা ওয়ারশো প্যাক্ট বাতিল হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু ন্যাটো রয়ে গেছে যা পরবর্তীতে USSR Bloc এর বাইরে বলকান, মধ্যপ্রাচ্যে, দক্ষিন এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যেমন কুয়েত, আফগানিস্থান, লিবিয়া, ইরাক, বসনিয়া-হার্জেগোবিনা, সিরিয়া, ইউগোস্লাব, কসোবো ইত্যাদি দেশে ন্যাটো মিলিটারী অপারেশন করেছে। ন্যাটোর প্রধান হেডকোয়ার্টার বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এবং এর সামরিক সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩৫ লক্ষ (বস্তুত এই ৩১ দেশের সামরিক সদস্য যা, সেটাই ন্যাটোর সংখ্যা)।
এ যাবতকাল রাশিয়া ন্যাটোর সম্প্রসারনের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আপত্তি তোলেনি। কিন্তু রাশিয়া সবসময় এটাই বলেছে যে, রাশিয়ার দোড়াগোড়ায় ন্যাটো তাঁর সামরিক জোট স্থাপনে সে কোনোভাবেই মেনে নেবে না মানে “রেড লাইন”। সর্বশেষ যখন ইউক্রেন ন্যাটোর সামরিক জোটে যোগদানের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে, রাশিয়া তাঁর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহন করে। এ ব্যাপারে ন্যাটো এবং তাঁর নেতৃবৃন্দকে রাশিয়া একটা পিসপ্ল্যান দিয়েছিলো। যার মধ্যে রাশিয়াকেও ন্যাটোতে নেয়া হোক এটা ছিলো। কিন্তু ২০২১ সালে সেটা অগ্রহনযোগ্য বলে আমেরিকা তা প্রত্যাখ্যান করে। দেখি পুটিন কি বলেছিলো আর এর উত্তরে ন্যাটোর প্রধান কি বলেছিলোঃ
Putin asked U.S. president Joe Biden for legal guarantees that NATO would not expand eastward or put "weapons systems that threaten us in close vicinity to Russian territory."[134] NATO Secretary-General Jens Stoltenberg replied that "It's only Ukraine and 30 NATO allies that decide when Ukraine is ready to join NATO. Russia has no veto, Russia has no say, and Russia has no right to establish a sphere of influence to try to control their neighbors."[135][136]
গন্ডোগোলটা ঠিক এখানেই। ইউক্রেনকে ইউরোপিয়ান ব্লকে যোগদানে রাশিয়ার কোনো আপত্তি নাই, তাঁর আপত্তি শুধু সামরিক জোটের বিরুদ্ধে। ন্যাটোতে ইউক্রেন যোগ দিতে পারবে না এই অজুহাতেই রাশিয়া ইউক্রেনে স্পেশাল অপারেশন চালায়। সে ইতিহাসে আর গেলাম না।
এখন বড় প্রশ্নটা হচ্ছে-ইউক্রেনকে ন্যাটোর এই ৩১ টা দেশ একযোগে সামরিক, অর্থনইতিক এবং যাবতীয় মিলিটারী ইন্টিলিজেন্স দিয়ে সাহাজ্য করলেও সরাসরি তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অংশ গ্রহন করছে না কেনো? ব্যাপারটা জানা দরকার।
ন্যাটোর গঠনতন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শর্ত হচ্ছে-আর্টিক্যাল-৫। এর মাধ্যমে বলা হয় যে, ন্যাটোর যে কোনো একটি সদস্য দেশ যদি কারো দ্বারা মিলিটারিলি আক্রান্ত হয়, তাহলে ন্যাটোর অন্যান্য সমস্ত দেশ একযোগে তাঁর সাপোর্টে যুদ্ধ করবে। এই পরিচ্ছেদটা কাজে লাগিয়েই ৯/১১ এর পর আমেরিকা আফগানিস্থান আক্রমন করেছিলো। আর তাঁর ধারাবাহিকতায় লিবিয়া, সিরিয়াতে তাদের অপারেশন সম্প্রসারন করে। কিন্তু এবার ন্যাটো সেটা করতে পারছে না। কারন দুটু। (১) ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়, তাকে কেউ আক্রমন করলেও ন্যাটোর সদস্যদেশ গুলি একযোগে ইউক্রেনের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধ করতে পারবে না (২) রাশিয়া সর্বোচ্চ নিউকধারী একটি দেশ। রাশিয়ার এক্সিস্ট্যান্ট যদি রাশিয়া থ্রেট মনে করে, তারা যে কোনো সময়ে তাদের নিউক ব্যবহার করার সাংবিধানিক আদেশ রয়েছে। এতে ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ একেবারেই হাতের ট্রিগারের মধ্যে। এটা কেউ শুরু করতে চায় না।
ইউক্রেনের একক সামরিক শক্তিতে ইউক্রেনে যুদ্ধটা এতোদিন চলমান থাকার কথা নয়। এটা এতো সময় দীর্ঘায়ু পাচ্ছে কারন ন্যাটো এবং কালেক্টিভ ওয়েষ্টের ছায়া যুদ্ধের কারনে যেখানে তারা সরাসরি অংশ গ্রহন না করেও যাবতীয় সামরিক, অর্থনইতিক, ইন্টিলিজেন্সের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও ইউক্রেন তেমন সাফল্য পাচ্ছে না। তাহলে ন্যাটোর কিংবা পশ্চিমাদের এই প্রক্সিওয়ার কি ইঙ্গিত দেয়?
ইঙ্গিত দেয় যে, ন্যাটো সদস্য দেশগুলি তাদের সর্বাত্তক সাহাজ্য সহযোগীতা করেও যখন তেমন কোনো সফলতা পাচ্ছে না, তাহলে আর্টিক্যাল-৫ এর বিনিময়েও ন্যাটো তাঁর সদস্য দেশ সমুহকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা। এটা একটা পেপার টাইগার। ন্যাটোর জন্য আলাদা কোনো পার্লামেন্ট নাই, ন্যাটোর জন্য আলাদা কোনো আইন নাই, কোনো এনফোর্সমেন্ট নাই, এবং সদস্যদেশ সমুহের নাগরীক বা সইনিকদেরকে পুরুষ্কার বা শাস্তির কোনো বিধানও নাই। এগুলি কন্ট্রোলড হয় প্রতিটি ন্যাটোভুক্ত দেশের তাদের নিজস্ব আইনের দ্বারা। পুরুটাই যার যার তাঁর তাঁর। রিসোর্স যার যার দেশের তাঁর তাঁর অধীনে থাকে, হোক সেটা মিলিটারী, জনবল কিংবা সামরিক সরঞ্জাম। অস্থায়ীভাবে কোনো একটা অপারেশনের আগে সেগুলি সদস্যভুক্ত দেশ সমুহের রিসোর্স ন্যাটোর অধীনে শুধুমাত্র অপারেশন অর্ডারের জন্য স্থাপিত হয় বটে আবার যে কোনো সময় সেই সদস্যদেশ যখন খুশী তুলেও নিতে পারে। এমন একটা খাপ ছাড়া স্ট্রাকচারের মধ্যে ন্যাটো কমান্ডারগনও সাফল্যের মুখ দেখা খুবই কঠিন।
এই ইউক্রেন যুদ্ধে সব ন্যাটোর সদস্যরা যেভাবে তাদের মিলিটারী স্টকপাইল নিঃশেষ করেছে, এরফলে সদস্য দেশসমুহের বর্তমান অবস্থা এমন যে, তারা নিজেরাই নিজেদের ডিফেন্স মেকানিজমকে দূর্বল করে ফেলেছে। ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশই এখন নিজ শক্তিতে তাদের নিজস্ব হুমকী মোকাবেলায় সমর্থবান নয়। কারো এমুনেশন স্টকপাইল শেষ, কারো মিসাইল সিস্টেম অর্ধেক হয়ে গেছে, কারো এয়ার ফোর্সের যুদ্ধ বিমান শেষ, কারো ট্যাংক শেষ, কারো আবার রিজার্ভও শেষ।
অন্যদিকে হুজুকের বশে পড়ে, কিংবা কাউকে খুশী করার নিমিত্তে রাশিয়ার উপর তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য, ইউরেনিয়াম, ফার্টিলাইজার, লোহা, ডায়মন্ড, এবং আরো কমোডিটি নিষেধাজ্ঞায় দেয়ায় এখন প্রতিটি ইউরোপিয়ান এবং ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত দেশসমুহের আর্থিক মন্দায় এতোটাই জর্জরীত যে, তারা না নিজেরা তাদের ঘাটতি পুরনে সক্ষম, না ঘাটতি ডিফেন্সিভ মেটারিয়েলস পুনরায় রিপ্লেস করতে সক্ষম। রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল এনার্জি সেক্টরের ঘাটতির কারনে ইউরোপের ইন্ডাস্ট্রিজগুলি প্রায় বন্ধের পথে (৪৫% ইন্ডাস্ট্রিজ এখন বন্দ শুধুমাত্র এনার্জি ঘাটতির কারনে)। আর যেগুলি চলমান তারাও বিশ্ব বাজারের কমপিটিশনে টিকতে পারছে না প্রোডাক্ট খরচ বাড়িতির কারনে। রাশিয়ার ফার্টিলাইজারের অভাবে কৃষিজ উৎপাদন প্রায় ঘাটতির দিকে ইত্যাদি। তাদের মুদ্রাস্ফিতি আকাশ চুম্বি, বেকারত্তের হার যে কোনো সময়ের থেকে প্রায় ২৫% বেশী।
এমন অবস্থায় প্রতিটি ইউরোপিয়ান কান্ট্রি (তথা ন্যাটোভুক্ত দেশসমুহ) এবার নিজেদের দেশের উপর ইন্ডিভিজুয়ালী নজর দিচ্ছে। তারা এই উপলব্দিতে আসা শুরু করেছে যে, রাশিয়ার সস্তা কমোডিটি ছাড়া, রাশিয়ার গ্যাস, তেল, ফার্টিলাইজার, লোহা, খাদ্যশস্য ছাড়া ইউরোপ অচল। তাদের রাশিয়াকে দরকার। ন্যাটোর চেয়ে আরো বেশী প্রয়োজন তাদের রাশিয়াকে। তাছাড়া রাশিয়া তো ইউরোপেরই একটা অংশ এবং প্রতিবেশী। তারা এবং তাদের জনগনেরা এটা বুঝা শুরু করেছে যে, রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিতে গিয়ে তারা নিজেরাই এখন শীতে কাবু, খাদ্যে ঘাটতি, বেকারত্তে জর্জরীত, এবং তারা অসহায় হয়ে পড়ছে।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্তেও সেই ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলিই যারা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারাই স্পেশাল অপারেশন শুরু আগে যে পরিমান আমদানী করতো, এখন সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় ২৫০ থেকে ৩৫০%।
এই কন্সেপ্ট থেকে আমার কাছে মনে হচ্ছে-ন্যাটো জোটের উপর ন্যাটোর দেশসমুহই দিনকে দিন কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলছে, ধীরে ধীরে সাধারন জনগন ন্যাটোর বিরুদ্ধে এবং রাশিয়ার পক্ষে সোচ্চার হচ্ছে। তাহলে কি এটা ভাবা খুব একটা অসমীচিন হবে যে, খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই ন্যাটো কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংঘবদ্ধ ক্লাব? অথবা থাকলেও রাশিয়ার সাথে এমন কোনো শর্তাবলীতে আসতে হবে যা ন্যাটোর প্রধান উদ্দেশ্য (রাশিয়াকে দমন) ব্যহত হবে।