০৮/০৪/২০১৮-পরিবার নিয়ে  কক্সবাজার…

Categories

গত ২৬ মার্চ ২০১৮ তারিখ থেকে আমি আমার পুরু পরিবার নিয়ে  কক্সবাজার, হিমছড়ি, নাইক্ষংছড়ি, আলিকদম, ফসিয়াখালি, বান্দরবান, বে ওয়াচ বিচ, ইনানী বিচ, স্বর্ণ মন্দির, ১০০ ফুট বৌদ্ধ মূর্তি, সাঙ্গু নদি ভ্রমন, নীলগিরি, মেঘলা, নীলাচল, শইল্ল্যকুপা ঘুরে এলাম। প্রায় ২৮ বছর পর আমি আবার হিল ট্র্যাক্স এলাকায় গেলাম। আমার কাছে প্রতিটি জিনিষ নতুন মনে হচ্ছিলো।

একটা সময় নব্বই এর দশকে আমরা যখন হিলে চাকুরী করতাম, তখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেটে হেটে পেট্রোলিং করে করে যেতাম। হোক সেটা ছুটির জন্য নেমে আসা, অথবা ছুটি থেকে আবার ক্যাম্পে যাওয়া, অথবা খাবারের রেশন আনা। এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে সময় লাগতো প্রায় ছয় সাত দিন। ২০/২৫ জনের একটা পেট্রোল নিয়ে অস্ত্র হাতে অতি সন্তর্পণে প্রান বাচিয়ে বাচিয়ে ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে হতো। একদিকে মশার কামড়, ম্যালেরিয়ার ভয়, আরেক দিকে শান্তি বাহিনীর অতর্কিত হামলার ভয়। খুব সহজ ছিলো না জীবন। অথচ আজ এবার গিয়ে দেখলাম, প্রতিটি জায়গায় গাড়ি যায়। স্থানে স্থানে বিশাল আকারের রিসোর্ট হয়ে গেছে। মানুষ এখন হিলে যায় সময় কাটাতে, আনন্দ করতে, ফুর্তি করতে। আর আমাদের সময় আমরা প্রতিদিন আতংকে কাটিয়েছি কখন শান্তি বাহিনীর সাথে আমাদের গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কে কখন জীবন না নিয়ে ফিরে আসে এই ভয়ে।

সময় কি জিনিষ। সব কিছুর সাক্ষী। সময় পালটে দেয় যুগ, যুগ পালটে দেয় মানুষ, মানুষ পালটে দেয় সভ্যতা। আর সব কিছুই হচ্ছে ইতিহাস। আমি যেনো সেই আদিম কালের সভ্যতার সাথে বর্তমান কালের সভ্যতাটাকে তুলনা করছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। যে পথ দিয়ে আমার শরীরের ঘাম ঝরেছে হেটে হেটে, সেই পথ এখন পিচ ঢালা। যে পথে যেতে আমি সর্বদা আমার ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে পার হয়েছি, কোনো লোকারন্য ছিলো না, মানুষ জনের চলাচল ছিলো না, সেখানে এখানে নতুন টেকনোলজি এসেছে, নতুন সভ্যতা এসেছে, মানুষের কোলাহলের সেস্নাই। এখানে জীবন আর আগের মতো নাই। এসি বাস চলে, বিদ্যুৎ আছে, নানা রকমের ফল মুল অনায়াসেই পাওয়া যায়, যখন তখন বের হওয়া যায়, কি অদ্ভুত পরিবর্তন। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের তোলা ছবির সাথে আজকে তোলা ছবির কতইনা তফাত অথচ জায়গাটা এক, গাছগুলিও এক, পাহাড়গুলিও এক। যে ঝর্নাটা আজ থেকে ৩০ বছর আগেও যেভাবে পানির ধারা প্রবাহিত করতো, সেই একই ঝর্নাটা আগের মতোই পানির ফোয়ারা দিয়ে যাচ্ছে। যে মেঘ মালা পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে এক স্থান্থেকে উরে উরে আরেক পাহাড়ের গায়ে গিয়ে থমকে যেতো, সেই এক ই মেঘের ভেলা আজো সেই রকম করেই আক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে থমকে যাচ্ছে, কিন্তু আগে সেই নিঃশব্দে বহমান ঝর্নার পানি, অথবা মেঘের সেই অদ্ভুত পাগ লামী যার অপূর্ব শোভা দেখার কেউ ছিলো না, আজ হাজার হাজার দর্শনার্থী ঐ ঝর্নার পাশে, ঐ পাহাড়ের মেঘের সাথে কতইনা অঙ্গভঙ্গি করে স্মৃতি করে রাখছে। ঝরনার মধ্যেও যেনো একটা প্রান এসেছে। আজো মশারা আছে, হয়তো আমার মতো সেইসব জোয়ান মশারা আজকে বুড়ো হয়ে শেষ হয়ে গেছে, তাদের কাছেও হয়ত পাহাড় আর আগের মতো নাই। অনেক মানুষের গায়ে তারা তাদের ইতিহাস লিখে দিচ্ছে।

একটা সময় ছিলো, হাতে গোনা কিছু মানুষ এই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতো, তাও আবার সেনাবাহিনীর সহায়তায় যারা কাজ করতো তারা। অথচ এখন বড় বড় বিজনেসম্যান, চাকুরীজীবি, সবাই পরিবারসহ নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত হোটেল হয়েছে, রিসোর্ট হয়েছে, রেস্টুরেন্ট হয়েছে, কত যে গাড়ি চলাচল করছে তার কোনো ইয়াত্তা নাই। আর এর মাঝখানে আমার বয়স পার হয়ে গেছে আরো ৩০ বছর। নতুন কমান্ডারগন এসেছে, নতুন জোয়ানরা এসেছে, তাদের হাতে এখন আর আগের দিনের অস্ত্র থাকে না, থাকে আধুনিক কালের টেকনোলজি। তারা তাদের আপন জনের কাছ থেকে দূরে নয়। নিমিষেই সবাই সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। অথচ আমরা আজ থেকে ৩০ বছর আগে কিছুই করতেপারতাম না। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে একদিনের লেখা চিঠি পনেরো দিন পরে হয়তো পেতাম। জরুরী কোনো ব্যাপারে যখন আমাদের কাছে আপনজনেরা চিঠি পাঠাত, তখন ইতিমধ্যে ব্যাপারটা তার জরুরীতা হারিয়ে ফেলেছে। তাতে কত লোকের যে প্রান হানী হয়েছে, কত সম্পদ যে হাত ছাড়া হয়ে গেছে, কত জীবন যে কত কষ্টে লালিত হয়েছে তার কোনো হিসাব নাই। এখানে এখন রাজনীতি ঢোকে গেছে, মানুষ অধিকারের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে, একজন আরেক জনের কথা শুনে। এখানে এখন আদিবাসি, বা পাহাড়ি বা বাঙালি সব এক সমাজের। এখন আর এক সেনাবাহিনির কোন সদস্যকে দেখে কোনো পাহাড়ি যেমন ভয় পায় না, তেমনি কোন সেনাবাহিনীর সদস্য ও কোনো পাহাড়িকে দেখে আতংকের মধ্যে থাকে না। ভালো লেগেছে দেখে ব্যাপারটা। ইতিহাস যখন বদলায়, মানুষ তখন ইতিহাসের সাথেই বদলায়। আমি এতো বছর পর এসে ইতিহাস বদলের পালাটা দেখলাম। হয়ত অনেকেই বিশ্বাস করবে না আজ থেকে ৩০ বছর আগের সেই পরিস্থিতি, সেই ইতিহাস। আলম গীর টিলা কেনো নাম হলো, লুকু পাহার কেনো নাম দেওয়া হলো, এই ইতিহাস এখন শুধু ইতিহাস। কিন্তু আমরা যারা ঐ সময় ছিলাম, তখন হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে কি পরিমান রক্ত ঝরেছিলো তার সাক্ষী কেবল আমরা। দেশ স্বাধীন হয়, অধিকার আদায় হয়, কিন্তু যারা এই স্বাধীনতার জন্য প্রান দেয়, এই অধিকারের জন্য রক্ত দেয়, তারা শুধু দিয়েই যায়। তাদেরকে কেউ মনে রাখে না। হয়ত বার্ষিকী পুজা হয় কিন্তু তার অবদানের কথা কেউ মনে রেখে তার ফেলে যাওয়া পরিবারকে কেউ বুকে টেনে নেয় না। এটাই ইতিহাস।  যাই হোক…

আমার মেয়েরা, আমার স্ত্রী পুরু ভ্রমনটা আনন্দ করেছে পাহাড়ের সুন্দরতম দৃশ্যগুলি দেখে দেখে। আর আমি আনন্দ করেছি সময়ের স্রোতে পেরিয়ে যাওয়া সময়ের সাথে বর্তমান হিলের সুন্দরতম দৃশ্যগুলি যা আগের মতোই হয়ত আছে কিন্তু এর যে সৌন্দর্যটা ছিলো যা কখনো আগে দেখার সুযোগ হয় নাই, সেটা দেখে দেখে। তুলনা করে করে। নস্টালজিক হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে। যে মেঘ একবার আমাকে আলিঙ্গন করেছিলো আজ থেকে ৩০ বছর আগে, হয়ত সেই মেঘ এতোদিন পর তার সেই পুরানো বাসিন্দাকে পেয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আমাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। আমার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে, আমার গায়ের গন্ধ শুকে নিয়েছে। যে পাহাড়ের পাশ দিয়ে আমি নিরবিক পথিকের মতো ধুরু ধুরু মন নিয়ে গোটা বিশেক জোয়ান নিয়ে রাতের কোনো এক আধারে হেটে গিয়েছি, ঘাম ঝরিয়েছি, হয়ত সেই ঝরানো ঘামের গন্ধে পাহাড় গুলি তার পুরানো সেই অতিথিকে চিনে নিতে পেরেছে। দুপাশের ভগ্ন পাহাড়ের পাথর গুলি হয়তো আমাকে স্থিত ভাবে দেখে দেখে চিৎকার করে বলেও থাকবে, “এতোদিন কোথায় ছিলেন”?।

বয়স হয়ে গেছে, তাই উঠতি বয়সের মেয়েদের সাথে আমার হাটাহাটি হয়ত অনেক ধীর গতি ছিলো কিন্তু চেষ্টা করেছি পুরু সময়টা ওদেরকে দিতে। ওরা কখনো এই পাহাড়তা বেশী সুন্দর, দৌড়ে চলে গেছে ক্যামেরা নিয়ে। ছবি তুল্বে। কখনো বলেছে, বাবা, দেখো, ঐ পাহাড়তা আরো সুন্দর। আমি শুধু হাসি। আর বলি, সব পাহাড় সুন্দর মা। সবগুলি পাহাড় আমার বন্ধুর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে যার যার জায়গায়। আজ এতো বছর পর মনে হলো, পাহাড়্গুলি আমাকে দেখছে আর আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে। অথচ এই পাহাড় গুলিই একদিন আমার কাছে কতই না বিরক্তিকর ছিলো। ভয়ানক আতংকের মতো ছিলো। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে, আমি ওদের অনেক আপন জন। পাহাড় আমাকে ডাকে, পাহাড় আমাকে শুভেচ্ছা দেয়। মেঘের আভায় আমার চোখ ভিজে যায়। কোনটা  জল আর কোনটা অশ্রু, সব এক হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি কোনো এক পাহাড়ের ঢালুতে, বড় আপন মনে হয়। 

আমার পরিবার বেশ আনন্দ করেছে। আর এই আনন্দের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছে আরো বেশী আমার খুব কাছের বন্ধু মেজর জেনারেল মাকসুদ। প্রথম দিন থেকেই মাকসুদ তার নিজের পাজেরো গাড়িটা আমাদের জন্য স্পেয়ার করে দিয়েছে যেনো যেখানে খুশী যেতে পারি, সাথে ছিলো সেনাবাহিনীর কিছু লোক। অসম্ভব আপ্যায়ন করেছে আমার দোস্ত। জেনারেল মাকসুদ বর্তমানে ১০ ডিভিশনের জিওসি। ওর এডিসি ক্যাপ্টেন গালিব খুব অমায়িক ছেলে। ভালো লেগেছে। মাক সুদের মতো জেনারেলের কাছে গালিবের অনেক কিছু শিখার যেমন আছে, তেমনি, গালিব একটা চৌকস জেনারেলের সাথে আছে বলে সে একটা গার্জিয়ানও পেয়েছে।

নীলগিরিতে গেলাম। ওখানে আকাশ আর পাহাড় এক সাথে খেলা করে। দিনের নীল গিড়ি আর রাতের নীল গিরি এক নয়। মেঘেরা শরীর ছুয়ে যায়, রঙ ধনুরা তার সব কটি রঙ মেলে ধরে ময়ুরের মতো পেখম মেলে অভিনন্দন জানায়। বড্ড মিষ্টি মনে হয় তখঞ্জীবন টাকে। মনে হয়, এতো অল্প সময় নিয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে? নীল গিরিতে একদিকে আকাশ, আরেকদিকে দূরে সাগরের প্রবাহমান দৃশ্য, আর তার উপরে বিশাল আকাশ যেনো ছাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় এই নীল গিরিতে আসার কথা মনে হলে মনে আতংক আর শারীরিক পরিশ্রমের কাস্টে মাথা ব্যথা করতো, অথচ আজ হাজার হাজার মানুষ কয়েক ঘন্তার জন্য সেই বান্দরবান থেকে গাড়িতে করে এসে আবার ফিরেও যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার রাত্রিজাপন ও করছে নিমিষেই।

এই নীল গিরিতে এসে দেখা হয়েছে একজন চমৎকার মানুষের সাথে। তার নাম আশ্রাফ ভাই। অনেক আলাপ করলাম, মজা করলাম। তিনি আর্মির কন্সট্রাক্সন কাজগুলি করেন। খুব ক্রিয়েটিভ মানুষ এবং অনেক মিশুক মানুষ। সমাজ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলো তার সাথে, সাথে সাথে এই হিলের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলাপ হলো। আমাদের থাকার জায়গা ছিলো নীল গিরিতে, কিন্তু আল তাফ সাহেব যিনি অনেক পুরানো সৈনিক, কিছুতেই আমাকে অন্য কোনো রুমে থাকতে দেবেন না। খুব পরিস্কার মানুষ মনের দিক থেকে। এরাই সেনাবাহিনীর সেই প্রাথমিক সময়ের সব কিছুর সাক্ষী। তিনি আমাকে এবং আমার পরিবার কে ভি আই পি রুম, “মেঘদূত” বরাদ্দ করে দিলেন। অত্যান্ত ভালো একটা কটেজ। মাঝে মাঝে প্রধান মন্ত্রি, প্রেসিডেন্ট সাহেব এই কটেজে থাকেন। রাত ভরে পরিবারকে নিয়ে নীল গিরির সেই মেঘ, আলোছায়া, আর শীতল বাতাস আমাদের সবাইকে বড্ড আপন করে নিলো। আমার ছোত মেয়ের কত যে আবিস্কারের পালা। মেঘের মধ্যে তার ছায়া পড়া, লাইটের মধ্যে তার রঙ ধনুর মেলা, সব কিছুই যেনো তার কাছে নতুন নতুন আবিস্কার।

আমার পরিবারকে নিয়ে থানছি এবং ডিম পাহাড়, মুন পাহাড় দেখার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সময়ের অভাবে আর ওইদিকে যাওয়া হলো না। থানচিতে জোন কমান্দার হিসাবে আছেন লেঃ কঃ হাবিব। থানচি শব্দের অর্থ হচ্ছে ডোন্ট গো। আর যেও না। অর্থাৎ এটাই বাংলাদেশের শেষ উপজেলা এবং শেষ গ্রাম। জোন কমান্দার লেঃ কঃ হাবীব আমাদের মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছেলে। শেষমেস নীলগিরি থেকে ব্যাক করে বান্দরবানে এসে রাতের বেলায় সোজা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।