Categories
যেদিন প্রথম আমি তোমার সাথে জীবন বেঁধেছিলাম, সেদিন বুঝি নাই আমার কতটা নিয়ে গেলে তুমি। একাই এসেছিলাম যেমন কেউ পালিয়ে যায় তার সেই চেনা শিশুকাল, চেনা শৈশব, আর চেনা সব ভালোবাসার জগত ছেড়ে। আমার সেই নতুন জগতে তোমাকে জুড়েই আমার সময় পেরিয়ে গেছে দিনগুলি একটা একটা মুহুর্ত করে, পেরিয়ে গেছে মাস একটা একটা সপ্তাহ শেষে। এরপর বছর পেরিয়ে গেছে মাস শেষে, আর যুগ পেরিয়ে গেছে বছরান্তে। তোমাকে কেন্দ্র করেই আমার জীবনের অনেক অভ্যাস, অনেক শখ আমুল বদলে গেছে চিরতরে, আমি বুঝতেই পারিনি কখন কবে কোন ক্ষন থেকে আমার প্রিয় সবুজ রংটা থেকে তোমার প্রিয় নীল রংটা আমার প্রিয় হয়ে গেছে। এভাবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমার অনেক অভ্যাস যা কখনোই আমার ছিলো না, ছিলো শুধু তোমার নিজের। আমি দিনে ঘুমাতে পছন্দ করতাম, আমি ঝাল খেতে পছন্দ করতাম, আমি মিষ্টি একেবারেই খেতে চাইতাম না, অবিরত টেলিভিশনের সামনে আমার পছন্দের সিরিয়ালগুলি দেখতেই থাকতাম। অথচ সেই আমি কত বদলে গিয়েছিলাম তোমার সংসারে এসে। আমাকে আর সেই ঝাল আর নেশা ধরায় না, টিভির সেই সিরিয়ালগুলি আমাকে হয়তো খুব মিস করে, দিনের শখের ঘুমটা যে কবে বিদায় নিয়েছে তার দিনক্ষনও আমার আর আজ মনে না। কবে যে তোমার মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাসটা আমার ঝাল খাওয়ার নেশাকে অতিক্রম করে আমাকেও মিষ্টি খাওয়ার নেশায় বদল করে ফেলেছে, আমি নিজেও জানি না। শীতের সকালে কাকডাকা ভোরে গরম আমেজের বিছানা ছেড়ে সেই কখন থেকে যে আমি অধীর আগ্রহে সেই পিঠাটাই বানাতে শুরু করেছিলাম যেটা তুমি খেতে ভালোবাসতে। আর এভাবেই পার হয়ে গেছে আমার সবকটি ঋতু। আমার সব আগ্রহ আর অভ্যাস যেনো গড়ে উঠেছিলো তোমাকে ঘিরেই।
আজ এতো বছর পর, আজ কেনো সব উলট পালট হয়ে গেলো? সূর্য ঠিক সময়মত উঠে আজও তো সকাল হয়েছে। মনেও পড়েছিলো তুমি অফিসে যাবে। কিন্তু আজ আমার কেনো তাড়া নাই তোমার জন্য নাস্তা বানানোর? সকালের হকার তো সেই আগের মতো পত্রিকাটাও দিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তো পত্রিকার ভাজটা পর্যন্ত খোলা হলো না! চকলেটের সিরিয়ালটা তো টেবিলের উপরেই আছে, অথচ আমি কেনো ব্যস্ত হই নাই গরম দুধে তোমার খাবারের জন্য সিরিয়ালতা বানানোর জন্য? অফিসে যাওয়ার আগে হাত মুখ ধুতে যাবার আগে কতবার শুনেছি তোমার ওই কন্ঠটা- ওই, রেডি হচ্ছি, নাস্তাটা বানাও, কিংবা বলতে ‘ড্রাইভারকে বলো ব্যাগটা নিয়ে যেতে’। খুব ধাক্কা দেয় বুকে। তুমি ছাড়া সকালটা কত আলাদা। রুমভর্তি তোমার সিগারেটের গন্ধটাও আজ নাই। রান্নাঘরের দিকে যেতেই তোমার ঘরটা চোখে পড়ে, ইশ, ওই খানে তুমি বসে থাকতে, পেপারটা পড়তে, সিগারেট টানতে, খালী পেটে কফি খেতে। কি অবাক। সেই সোফাটা আজো আছে, এস্ট্রেটা আগের জায়গাতেই আছে, শুধু তুমি ওখানে নাই। তুমি আজ নাই। আমি তোমাকে আজ ইচ্ছা করলেই সেই আগের মতো স্পর্শ করতে পারছি না।
অফিস শেষে সন্ধ্যায় বা রাতে ঘরে ঢোকে আমাকে না দেখতে পেলে সারাটা বাড়িতে তুমি আমাকে খুজতে। আর মেয়েদের জিজ্ঞেস করতে-আরে তোর মা কই? যেনো আমি হারিয়ে গেছি। রান্নাঘরে কাজে থাকলে তুমি রান্নাঘর পর্যন্ত চলে যেতে। বলতে-কি করো? হয়তো এটুকুই। অথচ আজ তুমিই হারিয়ে গেলে। আজ আর আমাকে কেউ বলে না-আরে কোথায় গেলা বা কি করো? রান্নাঘরে তোমার পছন্দের খুব ছোট স্টীলের পাতিলটা আজ আর কফির পানির জন্য গরম করার দরকার হয় না, ছোট কাপটাও আজ একেবারেই শুষ্ক। ওগুলি হাতে নিলেই খুব ভারী মনে হয়, মাটিতে বসে যাই, বুকের ভিতর কি যেনো কঠিন একটা চাপা ব্যথা অনুভব হয়। ছুটির দিনটা এতো লম্বা মনে হয় আজ। ছুটির দিনে তোমার পান্তা ভাত আর ডিম ভাজীর কথা মনে হলেই চোখ ভিজে আসে। তোমার বাগান আজ তোমাকে খুব মিস করে। বাগানের প্রতিটা গাছ যেনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তোমার অপেক্ষায়। ওরা হয়তো কথা বলতে পারে না কিন্তু ওদের হেলে দুলে ভালোবাসার প্রকাশটা যেনো আজ আর নাই। কি অদ্ভুত নিরবতা চারিদিকে।
আমি জানতাম, জীবনের কোনো না কোনো সময় এমন একটা সময় আসবেই। একমাত্র সহমরন আর দূর্ভাগ্যক্রমে কোনো দূর্ঘটনা ছাড়া কেউ কেউ সেই ভাগ্যবান হয় যখন একসাথে পৃথিবী-বিচ্ছেদ হয়। কি অদ্ভুত একটা জীবন, তাই না? একা বেচে থাকা যেমন কষ্টের, আবার তেমনি সাথী নিয়ে বেচে থাকার পর আবার একা হয়ে যাওয়া আরো অনেক বেদনাদায়ক। কেউ চলে যাবার পর বুঝা যায় সব কিছু আমার ছিলো না। এতোটা বছর ধরে একসাথে চলার মধ্যে কখনো একটু রাগ, একটু অভিমান, একটু গোস্যা আর বিস্তর জায়গা জুড়ে পরস্পরের নিঃশব্দে ভালোবাসাটাই একসময় মায়ায় পরিনত হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। তখন এই মায়াটাই ছিলো আমাদের পূর্ন ভালোবাসা। ভাবতেই পারি না, তোমার টয়লেট করে আসার পর যে গন্ধটা একদিন আমার কাছে দূর্গন্ধ মনে হতো, তোমার ঘামের গন্ধে ভরপুর যে গেঞ্জীটা একদিন নাকের কাছে নিলে একটা শুকনা বাজে গন্ধ বলে মনে হতো, একদিন সেই টয়লেটের গন্ধ, ঘামের দূর্গন্ধ আর দুর্গন্ধ তো মনে হয় নাই আমার, বরং বড্ড মায়ায় যেনো ঘামে ভিজা গন্ধতা আরো জড়িয়ে ধরতাম। খুব মায়া লাগতো, আহা, কত কষ্ট করো, ঘামে শরীর ভিজে যেতো, তার সেই সাক্ষী এই গন্ধওয়ালা গেঞ্জীটা। অনবরত মমতায় আমি সেটা ভালোবাসায় ধুয়ে দিতাম।
আমি জানি, আমার ঘুমের মধ্যে ডাকা নাকের শব্ধ যখন তোমার কাছে একদিন অসহ্য মনে হতো, বিরক্তিকর মনে হতো, চুলে আধাভেজা তেলের যে গন্ধ একদিন তোমার নাক বুঝে আসতো, সময়ের এতোটা পথ পেরিয়ে কোনো একদিন তুমিও সেই নাকডাকা, সেই তেলেভেজা চুলের সোদা গন্ধ তোমারও ভালোবাসার একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। যেমন আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো তোমার রাগ, তোমার অভিমান। আজ এইক্ষনে তোমার সেইসব রাগ অভিমান আমাকে কাদায়, আজ কেনো জানি মনে হয়, খুব মিস করছি সেই রাগ, অভিমান, আর মমতা। বড্ড একা লাগে এখন। সবাই চারিপাশেই আছে অথচ কি ভয়ংকর শুন্যতায় আমি দিন কাটাই যেনো আমি শক্তিহীন এক নির্জীব প্রানী। সবাই তোমাকে মিস করে, কাদে, কষ্ট পায়, কিন্তু আমি আমার কষ্টটা কাউকে বুঝাতে পারি না। চোখের জলের রঙ এক হলেও এই জলে ভেসে থাকা কষ্ট, ব্যাথা, বেদনা আর হাহাকারের রঙ হয়তো সবার এক নয়। আমার কষ্টের রঙ হয়তো আরো নীল।
আজ তোমা বিনে এই একটা কথাই বারবার মনে জাগে- তুমি ছিলে আমার ভরষা, ছিলে আমার নিরাপত্তা, আমার পরামর্শদাতা, বিপদে আপদে তুমিই আমার ডাক্তার কিংবা নার্স। তুমিই ছিলে আমার সব। ব্যস্ততম রাস্তায় যখন আমি রাস্তা পার হতে গিয়ে আমার বুক কেপে উঠতো, তোমার হাত ধরলেই আমার সব কাপুনী বন্ধ হয়ে যেতো। তুমি আমার মায়ার সংসার। বুকের সব পাজরে পাজরে তুমি গেথে ছিলে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আর চোখের প্রতিটি বিন্দুজলে। নীল আকাশের গাংচিলের মতো তুমি খেলা করতে আমার অন্তরের এমন এক কোটরে যেখান থেকে তোমাকে আলাদা করার কোনো ক্ষমতা আমার ছিলো না। অথচ দেখো, সেই তুমি কি অবলীলায় কোনো কিছু না বলেই আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেলে।
সেই কোনো এক সময় জেনেছিলাম, মানুষ ভালবেসে নাকি খিলখিল করে হাসে, মেঘলা আকাশ দেখে নীল আকাশের কথা ভাবে, কবিতা লিখে। আজ এই একা জীবনে এসে বুঝলাম, ভালোবাসায় অনেক বেদনাও থাকে, থাকে চাপা কান্না আর বিরহের অসহায়ত্ত। শরীর খারাপ হলে এখন বড্ড তোমার কথা মনে পড়ে, মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে গেলে তোমার কথা মনে পড়ে, সন্ধ্যা হলেই তোমার বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে। ছুটির দিনে কেমন যেনো পুরু ঘরটাই ফাকা লাগে। অদ্ভুত না জীবন? স্মৃতিগুলি আরো ভয়ংকর মনে হয় এখন।
আমি জানি, এ জীবনে আর কেউ আমাকে তোমার মতো আদর, ভালোবাসা, অভিমান কিংবা মমতা দিয়ে না মন ভরাতে পারবে, না ভরষা দিতে পারবে, না পারবে সেই যাদুকরী কথায় আমার অভিমানগুলি কোনো এক তপ্ত ললাশীর মতো হাস্যোজ্জল করাতে। আসলে যেদিন প্রথম আমি তোমার কাছে এসেছিলাম, তখন আমি ছিলাম একজন উচ্ছল মায়াবতী সবেমাত্র পা রাখা এক কুমারী আর তুমি ছিলে কিশোর থেকে পা দিয়ে সবেমাত্র যৌবনে পা রাখা টকবকে এক যুবক। সেই বয়সটা পার করে অর্ধ শত বছর পার করেও আমি যেনো সেই ষোড়শী যুবতীর মতই আর তুমি সেই টকবগে যুবকের মতোই সময়টা কাটিয়েছি। যেনো দিনগুলি শুধু রাত আর দিনের মধ্যেই পার হয়ে, মনের দিক থেকে নয়। আমি তো সারাটা জীবন তোমার সাথেই থাকতে এসেছিলাম। আমি কল্পনার কোনো রাজকুমারী ছিলাম না, তেমনি তুমিও আমার কাছে কোনো কল্পনার পুরুষ ছিলে না। যতোক্ষন অবধি একটা কাল্পনিক নাম অন্য কারো সাথে যুক্ত হয়, ততোক্ষন সেটা হয়তো হাওয়াই থাকে। কিন্তু তুমি আমার জীবনে কোনো কাল্পনিক নাম ছিলে না। আমি তোমাকে স্পর্শ করেছি, ভালোবেসেছি, সবই ছিলো প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য আর জাগতিক। অথচ আজ তুমি আমার সামনে দিয়ে এতো জোরে দৌড়ে চলে গেলে, আমি আর তোমাকে নাগালই পেলাম না। মনে হচ্ছে আজ, তুমি আমার কল্পনার কোনো সুপুরুষ আর আমি কল্পনার কোনো রাজমুকারী। জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা দেখে কখনো বুঝা যায় না বা মন বুঝতে চায় না কোনটা সত্যি আর কোনটা সত্যি নয়। আমাকে এই একা ফেলে চলে যাওয়ার ঘটনাটা আমার কাছে যদি মিথ্যা হতো, যদি এটা নিছক একটা সপ্ন হতো! কিন্তু এটাই সত্যি যে, ঘটনাটা সত্যি। তুমি নাই এই মিথ্যার পর্দাটা যখন আমি খুলে দেই, তখন তুমি আছো এটাই সত্যি হয়ে চারিদিকে প্রকাশিত হও আমার রক্ত নালির প্রতিটি ফোটায়, আমার নিশ্বাসের প্রতিটি শ্বাসে, আমার বিশ্বাসের প্রতিটি বিন্দুকনায়। তুমি আজ আসলেই আমার সামনে আর নাই। কিন্তু অন্তর, আত্তা আর মনে কোথাও তোমার অনুপস্থিতি আমি দেখি না। তুমি ছিলে, তুমি আছো আর সারা জীবন থাকবে আমার। তুমি মুক্তি পেলেও আমি মুক্তি পাইনি। হয়তো আমি জামিনের মতো একটা মুক্ত জীবন ভোগ করছি যেখানে প্রতিনিয়ত আমাকে তাড়া করে তোমার সেই আদর আর মমতা। এখন আমাকে শুধু কিছু অভ্যাস পাল্টাতে হবে যা তুমি আমাকে দিয়েছিলে।
আসলে এটার নামই জীবন যার উপলব্ধি শুরু হয় মৃত্যুর মতো কোনো এক অফেরতযোগ্য বিচ্ছেদের শুরুতে। আর শেষ হয় নিজের বিচ্ছেদের মুহুর্তে। আমি এখন বেচে আছি সেই মুহুর্তটির জন্য যার নাম ‘জীবন-বিচ্ছেদ’। আর সেটা শুধুই আমার জন্য বিচ্ছেদ।