০৮/০৫/২০২০-সবকিছুতেই পোষাকশ্রমিক

এই করোনা পরিস্থিতিতে মিডিয়ায়, টকশো তে গার্মেন্টসের উপর পরিবেশিত খবরগুলি দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে একটা সন্দেহ জাগছে যে, ভাবখানা যেনো এ রকম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে তারা সরকারের বিধিনিষেধ থাকা সত্তেও সরকারের আদেশ উপেক্ষা করে ফ্যাক্টরীসমুহ খোলা রাখছেন। আর যেহেতু খোলা রাখছে, ফলে দূরদুরান্ত থেকে শ্রমিকগন কেউ চাকুরী রক্ষার কারনে, অথবা বেতন পাবেন না অনুপস্থিত থাকলে ইত্যাদি কারনে পায়ে হেটে হেটে সেই গ্রামগঞ্জ থেকে কারখানার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হয়ে গেছেন। এই ব্যাপারটা কি এইরকমই যে রকম করে বিভিন্ন মিডিয়া প্রকাশ করছে?

ব্যাপারটা অবশ্যই এই রকম না। ২৬ মার্চ ২০২০ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা মহামারী উপলক্ষ্যে দেশের উদ্দেশ্যে ভাষনের সময় কলকারখানা বন্ধ রাখার কথা কিছুই বলেন নাই। তবে প্রচুর বৈদেশিক আদেশ পর পর বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে এবং আরো অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়ার আশংকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী তথা দেশের অর্থনীতিতেও একটা আতংকের সৃষ্টি হয়। আবার অন্যদিকে সরকার সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিলেন যে, জরুরী কোনো কাজ না থাকলে যেন কেহ ঘরের বাইরে না যান। বিকেএমই এ সরাসরি সমস্ত কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ জারী করে কিন্তু বিজিএমইএ সে রকম সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন নাই। এমতাবস্থায় ২৮ মার্চ তারিখে বিজিএমইএ এর অধীনে  কলকারখানাগুলি খোলা থাকবে কি থাকবে না, এটা নিয়ে মালিকপক্ষের মধ্যে বিস্তর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। পরবর্তিতে ২৭ মার্চ ২০২০ তারিখেই সরকারের পক্ষ থেকে সরকারের কলকারখানা অধিদপ্তর থেকে সুস্পষ্ট একটি নির্দেশনা এলো। আর সেটি হচ্ছে, যে সমস্ত কলকারখানায় আন্তর্জাতিক এক্সপোর্ট অর্ডার আছে এবং যে সব কারখানায় করোনার প্রোটেকশনের নিমিত্তে পিপিই, মাস্ক ইত্যাদি বানানো হয়, সে সমস্ত ফ্যাক্টরির মালিকগন প্রয়োজনীয় করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থার গ্রহনের নিমিত্তে (যেমন শ্রমিকদের প্রবেশের সময় ১০০% সেনিটাইজার/সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, মাস্ক পড়িয়ে, থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে বডি টেম্পেরেচার মেপে ইত্যাদি) ই্ছে করলে কারখানা খোলা রাখতে পারবেন।

কিন্তু যে কোনো ভাবেই হোক ২৯ মার্চ ২০২০ তারিখে বিজিএমই এ সভাপতি  ডঃ রুবানা হক পুনরায় মালিকদেরকে কারখানা সমুহ বন্ধ রাখার অনুরঢ করেন। বাধ্য হয়েই আমরা সেটা পালন করি। এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে গেলো। যারা দূর দুরান্ত থেকে ঢাকায় এসেছিলেন, তারা আবার ঢাকার বাইরে চলে গেলেন। এই যে আসা এবং যাওয়ার মধ্যে প্রচুর লোক সমাগম হ ওয়াতে টক শো এর বিজ্ঞ এবং আদার বেপারী জাহাজের খবর নেবার মতো বিশেষজ্ঞরা একটা পরিচিতি লাভের আশায় সবার সাথে তাল মিলিয়ে একবাক্যে প্রচার করা শুরু করলেন, যতো দোষ, সব যেনো নন্দ ঘোষের। অর্থাৎ গার্মেন্টস মালিকদের। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এবারো কোনো দিক নির্দেশনা এলো না যে, কল কারখানা বন্ধ রাখা হোক। বরং কল কারখানা চালুর রাখার ব্যাপারে এবারো কল কারখানা অধিদপ্তর খোলা রাখা যাবে এই মর্মে আবারো আদেশ জারী করেই রাখলেন।

অথচ অন্য দিকে সরকার কাউকেই ঘরের বাইরে আসতে দিতে নারাজ। ফলে ব্যাপারটা এমন দেখাচ্ছে মিডিয়াগুলি যেনো, সব দোষ গার্মেন্টস মালিকদের, আর তাই অপবাদ যেনো গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের। এটা কেনো?

কিছু লোক আছে সবসময় সবকিছুতেই পোশাকশ্রমিক নিয়ে বেশি মাতামাতি করেন। এদের উদ্দেশ্য কি ?

বাংলাদেশে আজ ৮ মে পর্যন্ত ১৩০০০ করোনা রোগি, এর মধ্যে পোশাক শ্রমিক ১৯৬ জন, পুলিশ ১৫০০ জন। পোষাক শ্রমিক ৪০ লক্ষ, তাদের মধ্যে করোনা রোগি ১৯৬ জন। পুলিশ ২ লক্ষ, তাদের মধ্যে করোনা রোগি ১৫০০ জন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, তাদের মধ্যে করোনা রোগি ১৩০০০ জন। বাংলাদেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৬ কোটি, এর মধ্যে পোশাকশ্রমিক ৪০ লক্ষ।

তাহলে সবকিছুতেই পোষাকশ্রমিক হেডলাইন করে মাতামাতি করেন কেন? এটা একটা চক্রান্ত। 

যারা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, তারা কি করোনাকে ভয় পান না? তাদের কি পরিবার পরিজন নাই? যে কোনো মুহুর্তে তিনি নিজে আক্রান্ত হয়ে তার পরিবারকেও তো আক্রান্ত করতে পারেন, তার কি সেই ভয় নাই? তিনি কি এতোটাই গরীব যে, তার ঘরে খাবার নাই বলে তিনি রোজগারের জন্য কারখানা খোলা রেখেছেন? তিনি কি ঘরের মধ্যে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারেন না? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুব সহজ।

এই গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরাও করোনাকে ভয় পান, তারা নিজেরা আক্রান্ত হলে তার নিজের পরিবার পরিজনও বিপদের সুম্মুখিন সেটাও তারা জানেন। তিনি এতোটা গরীব নন যে, তাকে অন্তত কয়েক মাস ঘরে বন্দি হয়ে থাকলেও রোজগারের বাইরে যেতে হবে। তাহলে তারপরেও তারা কারখানা খোলা রাখছেন কেনো? এর প্রধান কারন, সরকার জানেন, যে, এই সেকটর খোলা রাখা জরুরী। আর জরুরী এই জন্য যে, দেশের জনগনকে সেবা দেওয়ার জন্য যে খরচ, যে ব্যয়, যে, অর্থ প্রয়োজন, তার একটা বড় উতস আসে এই সেকটর থেকে। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে যিনি বেশী ভেবেছেন তা হচ্ছে দেশের কর্নধার হিসাবে যিনি দেশ পরিচালনা করছেন তিনি, প্রধানমন্ত্রী। আমি কোনো দল করি না, আমি রাজনীতিও করি না। কিন্তু আমি একজন নিরপেক্ষভাবে কিছু মন্তব্য করে চাই।

সারাবিশ্ব এই মুহুর্তে প্রায় লক ডাউন। প্রতিটি নাগরীক প্রায় গৃহবন্দি। বিশ্ব বাজারের সবগুলি ষ্টোর, ওয়্যার হাউজ, বড় বড় শপিংমল সবকিছু বন্ধ থাকায় কোনো প্রকারের বেচাকেনা, বানিজ্য আদানপ্রদান একেবারেই নাই বললেই চলে। সারাবিশ্ব একেবারে স্থবির। এই অবস্থায়, ধনী দেশ গুলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নাগরীক ভাতা, ইত্যাদি দিয়ে কিন্তু তাদের জনগনকে মাসের পর মাস সাপর্ট দিতে বদ্ধপরকর। আর ওটা অই সব সরকারগুলি করতে পারেন কারন শান্তিকালীন সময়ে প্রতিটি নাগরীক তারা সরকারকে সঠিক ট্যাক্স দেন, তারা ব্ল্যাক মানি রাখেন না, কিংবা তারা দেশের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করেন। তাই সরকার আপদকালীন সময়ে ঠিক সাহায্য তা করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা কি তাদের মতো? আমাদের দেশের ৬০-৭০% মানুষই তো প্রায়  ট্যাক্স দেন না, হেলথ ইন্সুরেন্স করেন না, আবার দেশের সম্পদ যখন যেভাবে খুশী অপচয়, চুরি ডাকাতিতে এমন থাকেন যে, সরকার আপদকালীন সাহায্য করবে কি দুরের কথা প্রশাসনিক কর্মকান্ডই তো পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হয়।

এই অবস্থায় সরকারের পক্ষে কি কোনোভাবেই সম্ভব এই বিশাল জনগোষ্টিকে মাসের পর মাসে হাউজ কোয়ারেন্তাইনে রেখে ভরন পোষন করা? তার মধ্যে সরকার যেটুকু টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় লাভ করেন, রপ্তানী থেকে, রেমিট্যান্স থেকে সেগুলি যদি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে তো দেশের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠবে।