আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, আমাদের ব্যবসায়িক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা কি হতে যাচ্ছে। আমি কোনো অর্থনীতিবিদ নই। ফলে যেসব ফ্যাক্টর হিসাবের মধ্যে নিয়ে সার্বিক অর্থনীতির উপর মতামত দেয়া যেতে পারে তাঁর অনেক ফ্যাক্টরই আমার জানা নাই বা সেগুলি নিয়ে আমি কাজ করি না। কিন্তু দৃশ্যমান কিছু সিম্পটম বিবেচনা নিয়ে যে কোনো আমজনতাও অনেক কিছুর সঠিক একটা প্রেডিকশন দিতে পারে যা হয়তো খুব একটা অমুলিক নয়। সেই প্রেক্ষাপট থেকেই বলছি।
আমাদের অর্থনীতি মুলত কিছুটা কৃষিজ এবং অনেকাংশেই বৈদেশিক মুদ্রা (যেমন রেমিট্যান্স, রপ্তানী আয়, এফডিআই) ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। এই কয়েকটা ফ্যাক্টর যদি মামুলীভাবে আমরা চিন্তা করি, তাহলে দেখবো যে, খুব বেশী একটা ভালো প্রত্যাশা করার কিছু নাই।
রেমিট্যান্স বহুলাংশে কমে গেছে কারন যারা এই বৈদেশিক মুদ্রা দেশে রেমিট করবেন, তারাই বিদেশে প্রায় হয় বেকার অথবা আগের তুলনায় অনেক কম বেতনে চাকুরী করছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে ইউরোপের শিল্পবানিজ্যে প্রায় ধ্বস নেমে যাচ্ছে। প্রচুর ইন্ডাস্ট্রি শুধুমাত্র এনার্জি সংকটের কারনে বন্ধ এবং অনেকগুলি বন্ধের পথে। ফলে সেখানে কর্মী ছাটাই বা বিদেশীদের প্রাধান্য প্রায় নীচের দিকে। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা খুব একটা স্কীল নয় বিধায় তাদের ডিমান্ডও বেশ কমে যাচ্ছে। মাইগ্রেশন এখন ইউরোপের একটা চরম সংকট। তারা যে কোনো মাইগ্রেশনের বিপক্ষে এখন। ইউরোপের অবস্থা দিনের পর দিন এখন খারাপের দিকে যাওয়ায় সেখানকার নাগরিকগনও কৃচ্ছতা অবলম্বন করছেন। তাদের পারচেজ পাওয়ার কমে যাচ্ছে। লাক্সারী লাইফের কথা এখন তারা মাথা থেকেই বের করে দিচ্ছে। জীবনধারনের জন্য যতটুকু দরকার সেটাতেই এখন তারা অভ্যস্থ হবার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় রেমিট্যান্স ধীরে ধীরে কমবে।
অন্যদিকে ইউরোপ কিংবা পশ্চিমা দেশগুলিতে যেহেতু এখন নাগরিকদের পারচেজ পাওয়ার কমে যাচ্ছে, ফলে আগে যেখানে একজন একের অধিক পন্য কিনতেন, সেখানে তারা পন্য কেনার পরিমান কমিয়ে দিয়ে বাজেটের মধ্যে চলার চেষ্টা করছেন। তাতে যেটা হচ্ছে-আমাদের দেশ কিংবা অন্যান্য রপ্তানীকারকের রপ্তানী আদেশের পরিমানও কমে যাবে। যখনই রপ্তানী আদেশের পরিমান কমে যাবে, আমাদের দেশেও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রভাব পড়বে। অনেক মেশিনারিজ বন্ধ থাকবে, এতে কর্মী ছাটাইয়ের আশংকা হবে। শুধু তাইই নয়, এনার্জি সংকটের কারনে কিংবা জালানী সংকটের কারনে পরিবহন খাতে ব্যয় বাড়বে, বিদ্যুৎ খাতেও ব্যয় বাড়বে। প্রডাকশন খরচ বাড়ার কারনে এবং রপ্তানী আদেশের পরিমান কমার কারনে আমাদের দেশের ছোট ছোট ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান গুলি অস্তিত্ত টিকিয়ে রাখার হুমকিতে পড়বে।
এখানে আরো একটা বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে। সেটা হচ্ছে-ইউনিপোলারিটি থেকে মাল্টিপোলার ওয়ার্ডে আমাদের দেশ একটা সংকটের মধ্যে আছে। এই মুহুর্তে ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশগুলির সাথে আমাদেরও কিছুটা টানপোড়েনের চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিধায় কোনো কারনে যদি পশ্চিমারা নাখোশ হয়, তাহলে একইসুত্রে গাথা ইউরোপের বাজার আমাদের জন্য ছোট হয়ে আসবে। সেক্ষেত্রেও আমাদের রপ্তানী আদেশে তুমুল একটা নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে।
এখানে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে-যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর লোনের বোঝা আছে, তারা সময়মতো লোন পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাংকগুলিও যেমন তারল্য সংকটে পড়বে, তেমনি ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের ঋণ পরিশোধে চাপের কারনে মালিকপক্ষ হিমসিম খাবে। যখন মালিকপক্ষ এই লোনের কারনে চাপের মধ্যে থাকবে, তখন তারাও ধীরে ধীরে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করবেন। দেখা যাবে যে, ফ্যাক্টরী আছে, মেশিনারিজ আছে, কিন্তু কর্মি নাই, রপ্তানীর আদেশ নাই, এবং মেশিনারিজ অচল অবস্থায় পড়ে আছে।
এবার যদি কৃষিজ প্রেক্ষাপটে আসি, সেখানেও একই চিত্র ফুটে উঠবে। সার সংকটের কারনে, কিংবা পানি সেচের জন্য প্রয়োজনীয় এনার্জি সাপ্লাইয়ের সংকটের কারনে এবং এমন কি বীজের সংকটেও কৃষিজ সেক্টরে এর নেগেটিভ প্রভাব পড়বে। বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞার কারনে সময়মতো এসব সার, বীজ কিংবা আনুষঙ্গিক আইটেম পাওয়া যাবে না। শুধু তাইই নয়, এই যুদ্ধ আগামী কয়েক বছরের খাদ্য সংকটও তীব্র হতে পারে বলে আমার ধারনা।
আবার, সরকারকে রাষ্ট্রীয় খরচ যোগানের লক্ষ্যে তাঁর ঋণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হোক সেটা লোকাল ব্যংকা থেকে কিংবা বাইরের কোনো অর্থলগ্নি সংস্থা থেকে। ফলে, এমনো হতে পারে জে, ব্যাংকে জন সাধারনের গচ্ছিত টাকাও সময় মতো সাধারন জনগন উঠিয়ে অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থায় লগ্নি করতে পারে কিনা সেটারও একটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়।
আজ ঠিক এই মুহুর্তের পরিস্থিতি দেখে অনেকটাই বুঝার উপায় নাই, আগামি এক বছর পরের পরিস্থিতি কত ভয়ানক হতে পারে। আমেরিকাকে প্রতিদিন ২৭৫ বিলিয়ন ডলার লোন করতে হচ্ছে, ইউরোপের প্রায় সব কটি দেশে আগের তুলনায় ব্যাংক সুদ বেড়েছে প্রায় ১০ গুন। কমোডিটির ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩ গুন। কিন্তু সে তুলনায় সাধারন জনগনের আয় বাড়েনি।
এ অবস্থায় কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, আগামি কি হতে যাচ্ছে- কি করে বলা সম্ভব? এ অবস্থায় আমাদের মতো আমজনতার কিংবা ব্যবসায়ীর জন্য কি করনীয় হতে পারে?
আমিও জানি না আসলে কি হতে যাচ্ছে আগামীতে। তবে, আমার একটা কথা আছে, আমি ছোট মানুষ, বুঝি কম, তাও যেটা বুঝি সেটা হলো-যাদের ব্যাংক লোন বিদ্যমান, তাদের উচিত সেটা যতোটুকু সম্ভব কমিয়ে ফেলা, কারন মুল ক্যাপিটাল পরিশোধ না করা পর্যন্ত এর যে সুদ সেটা পরিশোধ করতেই যখন হিমশিম খেতে হবে, মুল ক্যাপিটাল দেয়াই হবে তখন চরম অসুবিধা। যাদের হাতে এখনো কিছু অর্থ আছে সেটাকে যতটুকু সম্ভব যৌক্তিক সেক্টরে ব্যবহার করা যাতে অন্তত মুল ক্যাপিটাল নষ্ট না হয়, এবং যতটুকু না হলেই নয় তাঁর মধ্যে বসবাস করা।
বাকীটা শুধু বলতে পারবে “সময়”।