০৯/০৪/২০২১-তুমি ছাড়া আমি

সকালটা আমার খারাপ ছিলো না। প্রতিদিনের মতোই আমার সকাল হয় অন্যসব দিনের মতো একই রুটিনে-ভোরে নামাজ, তারপর কোরআন তেলওয়াত অতঃপর কিছু নাস্তা। নাস্তার পর আমি দীর্ঘ একটা সময় অপেক্ষা করি অতি আখাংকিত এবং জীবনের চেয়েও প্রিয় একটা  ফোন কলের জন্য। আর সেটা প্রতিদিনই আসে, কখনো আধা ঘন্টা পর কিংবা কখনো আধা ঘন্টা আগে। কোনো ঋতুতেই এর কোনো ব্যত্যয় হয় নাই। শীতের সকালে আমি যখন একা গরম লেপের ভিতরে জেগে থাকি তখনো আসে, আবার চৈত্রের দাব্দাহনেও আসে। বর্ষার ঘন বৃষ্টিতেও আমার এই প্রিয় ফোন কলটা আসেই। মাঝে মাঝে এমনো হয় আমার সেই কাংগখিত ফোনটা হয়ত দিবসের মধ্যভাগেও আসে, কখনো অতি ভোরেও আসে, তবে আসেই। কোনো উত্তাপ নেই, নাই কোনো তারাহুড়া আমার। আজো সেভাবেই আমি অপেক্ষায় ছিলাম। জানি ফোন আসবে। কারন এটা কোনো মানুষের সাথে আমার দৈব পরিচয় নয় যে আমার জন্য ভাবে না, কিংবা এমন নয় যে, স্রোতে ভাসা কোনো প্রানহীন মাছ যার না আছে এই জগতের প্রতি টান বা কোনো হিসাব-কিতাব। এই ফোন কলটা সব সময় ‘ওয়ান ওয়ে ফোন”।

সে আমার জীবনের সব কিছু। প্রকাশ্য জীবনে তাঁকে আমি চিনি না, কখনো দেখি নাই, এটাই তার সাথে আমার চুক্তি। যখন সে আসে, সে আসে অন্য কোনো নামে বা অন্য কোনো পরিচয়ে। তারপরেও সে আমার দেবতার মতো এক অসীম শক্তি আর বল। আমি জানি এই জীবনে আমি তাঁকে কখনো আমার মতো করে পাবো না, না সে আমাকে স্পর্শ করতে পারে প্রকাশ্য রীতিতে অথচ সেই আমার প্রথম মানুষ যার স্পর্শে আমি হয়ে উঠেছি এক সুখী রমণী। একজন অন্য মানুষ, অন্য জগতের সংসারী। আমার সংসারে সব আছে কিন্তু আমার সমস্ত রমনীকুলের ক্ষমতা থাকা সত্তেও আমি একা, আমি মা নই। সেই আমার সন্তান, আমিই তার মা, আমিই তার মায়া, আমিই তার সহধর্মিনী অথবা আমিই তার এক মাত্র সৈনিক যে কমান্দারের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে প্রতিটি নিসশাসে এবং ভালোবাসায়। আমার এই সংসারে সুখ আছে, আনন্দ আছে, আমার জীবনের নিশ্চয়তা আছে, তার সাথে আছে অদম্য এক মায়া।

কিছু সম্পর্ক আছে দেবতা তৈরী করেন, কিছু সম্পর্ক আছে সমাজ তৈরী করে আর কিছু সম্পর্ক আছে আমরা মানুষেরা অন্তরে অন্তরে তৈরী করি যার না আছে প্রকাশ্য কোনো স্বীকৃতি, না আছে সামাজিক কোনো গ্রহণযোগ্যতা। তারপরেও এই সম্পর্কের চেয়ে বড় কোনো সম্পর্ক হয় না। আমি একাই ঘুমাই, একাই জাগি, একাই খেলি, একাই কথা বলি শুধু তার সাথে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ গুলি যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন আমি তার সাথে কথা বলি শত সহস্র দূর থেকে। তাঁকে আমি দেখতে পাই, কিন্তু ছুতে পারি না। তার সাথে আমি কথা বলি কিন্তু স্পর্শ করতে পারি না। তাঁকে আমি সারাক্ষন দেখতে পাই কিন্তু হাত দিয়ে তার হাত ধরে আমি অই রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যেতে পারি না। অথচ আমি সারাক্ষন তার সাথেই আছি।

আজ যেনো অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার সেই ফোন কলটা আসার। মন একটু একটু অসহিষনু হচ্ছে, বুকের ভিতর কেমন যেনো ধরফড় করছে। বেলা পড়ে যাচ্ছে, খেতে ইচ্ছে করছে না, কখন গোসলের সময় পেরিয়ে গেছে মনেও নাই। রান্নাটা করা হয় নাই, বারবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি-এই বুঝি ফোনটা এলো।

-হ্যা, ফোনটা বেজে উঠেছে। দৌড়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি আমার মা। হ্যালো বলছি, মাকে ডাকছি, মা কোনো কথা বলেন না। মায়ের গলা বড্ড ভেজা।

-সে নাই। কিছুক্ষন আগে সে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। হু হু করে কাদতে কাদতে মা আমাকে এই সংবাদটাই জানালেন। এই প্রিথিবীতে এই এক মাত্র মানুষ যিনি জানেন আমার জীবনের সব কাহিনী আর আমার সুখের ভাণ্ডারের গোপন রহস্য।

আমি ধপ করে বসে গেলাম মাটিতে। কি হলো? আমার মনে হতে লাগলো আমার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বিন্ধু এক ফোটা এক ফোটা করে মাটিতে ঝরে পড়ছে, আমার নিসশাস এক টা একটা করে কমতে শুরু করেছে, ঘরটা যেনো চারিদিকে দুলছে, ফ্যানটা যেনো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আবোল তাবোল শব্দ করছে, আমি বুঝতে পারছি আমার পায়ের নীচের সব কিছু ফস্কে যাচ্ছে, দ্রিষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আমি জ্ঞান হারাইলাম।

কখন জ্ঞান ফিরেছে আমি জানি না, যখন চোখ খুলেছি, দেখেছি পাশে আমার মা বসে। (Cont....)