০৯/০৯/২০২১-১০০ বছর পর আগামীকাল

আজ থেকে ১০০ বছর পর ঠিক এই সময়ে যারা বেচে আছি আমরা, তাদের প্রায় শতভাগ মানুষ আর এই পৃথিবীতেই থাকবো না। হয়তো খুবই নগন্য কিছু সৌভাগ্যবান অথবা অন্য অর্থে দূর্ভাগ্যবানও বলা যেতে পারে, তারা বার্ধক্যের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্ষীনদৃষ্টি আর দূর্বল শরীর নিয়ে হয়তো এমন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন যা তিনি কখনো চান নাই। যার নাম ‘মৃত্যু’।

ক্যালেন্ডারের পাতা প্রতিদিন পালটে যাবে, তাঁর সাথে সাথে পালটে যাবে তারিখ, মাস, বছর এবং অতঃপর যুগ। কেউ এটাকে আমরা থামাতে পারি না, পারবোও না। আর কেউ পারেও নাই। হোক সে কোনো প্রতাপশালী সেনাপতি, হোক সে চৌকস কোনো রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক। শুধু তাই নয়, কোনো বিজ্ঞান কিংবা কোনো বিজ্ঞানিক, কোনো সর্বোচ্চ পদধারী ধার্মিক নেতা কিংবা দূধর্ষ সাহসী সন্ত্রাসী কেউ এই অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মটাকে উপেক্ষা করে অগোচরেও পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা রাখে না।

আজ যারা পথে ঘাটে আমার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে, তাদের কেউ হয়তো কোট টাই, কেউ হয়তো আধুনিক পোষাক আষাকে, কেউ আবার ফুটপাতে নোংরা চুলে আছেন, আমি তাদের অনেককেই হয়তো চিনিও না আবার হয়তো কাউকে কাউকে আমরা সর্বদাই দেখি, চিনি, এদের কেউও এই নিয়ম থেকে পরিত্রান পাবে না। মহাশ্মশানের সারিসারি পাথরে নাম লেখা কোনো এক নাম ফলকের মধ্যেই আমরা লুকিয়ে যাবো ঠিক সেইস্থানে যার কথা আমরা আজ ভাবতেও পারি না। সেখানে যেমন কোনো আধুনিক পোষাক বলতে কিছু থাকে না, আর না থাকে কোনো ধার্মিক ব্যক্তির আলখেল্লাটাও। অনেকের বেলায় হয়তো সেই নামফলকটাও থাকবে না। কোথায় আছেন তারা, কার জায়গায় আছেন তাঁরও কোনো হদিস হয়তো পাওয়া যাবে না। আজ যে শরীরটাকে প্রতিদিন নোংরা মনে করে দেশী বিদেশী সাবান শ্যাম্পু দিয়ে সুগন্ধী মাখছি, তখন এই শরীরের মধ্যে হাজারো পোকা মাকড়, কর্দমাক্ত মাটি, নোনা জল, অপরিষ্কার জলের সাথে ভেসে আসা দূর্গন্ধময় আবর্জনায় সারাটা শরীর ভেসে গেলেও তাকে আর সুগন্ধী কেনো, সরানোর মতোও আমাদের কোনো শক্তি থাকবে না। শরীরে মাংশ পচে গলে মিশে যাবে মাটির সাথে, হয়তো কোনো এক কুকুর কিংবা শিয়াল আমাদের শরীরের হাড্ডিটি নিয়ে দূরে কোথাও অবশিষ্ঠ মাংশটুকু খাওয়ার জন্য দৌড়ে চলে যাবে অন্যত্র। কার সেই কংকাল, কার সেই হাড্ডি, এই পৃথিবীর কোনো জীবন্ত মানুষের কাছে এর কোনো মুল্য নাই।

যে ঘরটায় আমি সারাদিনের ক্লান্তি শেষে অবসাদ শরীর নিয়ে মুলায়েম বিছানায় গা হেলিয়ে দিতাম, সেই ঘরটা হয়তো থাকবে অন্য কার দখলে। যে বাগানটায় আমি প্রায়ই পায়চারী করে করে আকাশ দেখতাম, গাছ গাছালীর মধ্যে উড়ে আসা ভ্রমর কিংবা পোকামাকড় দেখতাম, সেই বাগানের দখল হয়তো এখন কার দখলে কে জানে। বাগানের গাছ গাছালীর পরিচর্যার নামে যে পোকামাকড়গুলিকে আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করতাম, আমি আজ তাদের দখলে।

যে বাচ্চাদের মুখরীত কোলাহলে আমার ঘর ভরে থাকতো, যাদের আগমনে আমার মন পুলকিত হতো, আজ সেখানে অন্য কেউ মুখরীত হচ্ছে। কতই না সাবধানতায় আগলে রেখেছি সেই ঘর, সেই লন, কিংবা আমার যতো আয়েশী জিনিষ, আজ সেগুলি আমার কিছুই নয়। আমার সুন্দুরী স্ত্রী যখন তাঁর লাল শাড়িটা পরার পর কিংবা আমিই যখন নতুন কোনো একটা ড্রেস পড়ে বারবার আয়নার সামনে গিয়ে কতবার না দেখতে চেয়েছি-কেমন লাগে আমাকে, অথচ আজ সেই আমি বা আমার সেই সুন্দুরী স্ত্রী তাঁর চেহাড়া কেমন দেখায় কাফনের সেই ধবল পোষাকে সেটা দেখার কোনো পায়তারা নাই। সেই বৃহৎ আয়নাটার আর কোনো মুল্য নাই আমার কাছে। হয়তো সেখানে অন্য কেউ এখন তাঁর চেহাড়া দেখছে, হয়তো লাল শাড়ির পরিবর্তে নীল বা টাই কোট পড়া পোষাকের বদলে একটা ভেষ্ট পড়া ব্যাকব্রাস চুলের মহড়া দিচ্ছে। যে গাড়িটা প্রতিদিন আমাকে মাইলকে মাইল ঠান্ডা কিংবা শীততাপ হাওয়ায় বসিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি গান শুনিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে, সেটা আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই। না সে আমাকে আর খোজে।

কখন কোথায় কাকে কাকে নিয়ে অথবা আমার নায়নাতকুর আত্তীয় স্বজন স্ত্রী পোলাপান নিয়ে কবে কোথায় কি আনন্দে মেতেছিলাম, সেই ইতিহাস আর কেউ কখনো মনে রাখবে না। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কতটা পথ হেটেছিলাম, আর সেই হাটা পথে আমি কতটুকু ঘাম ঝরিয়ে চূড়ায় উঠে কি তৃপ্তি পেয়ে কি আনন্দে কতটুকু আত্তহারা হয়েছিলাম, সেই তথ্য না কেউ জানবে, না কেউ জানার কোনো আগ্রহ দেখাবে। কার সাথে কি নিয়ে আমার মনোমালিন্য হয়েছিলো, বা কে আমাকে কতটুকু ভালোবেসে কি অবদান দিয়েছিলো অথবা কার কোন আগ্রহে আমি কোথায় কি করেছিলাম, কার কারনে আমার অন্তরে জালা উঠেছিলো আর কার কারনে আমার দিন আর রাত একহয়ে গিয়েছিলো, সেই ইতিহাসের কোনো মুল্য আজ বেচে থাকা মানুষগুলির কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। না তাদের যাদের জন্য এসব ঘটনা ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম নতুন পরিবেশ, নতুন সব কাহিনীতে ভরে থাকবে বর্তমান আর আমাদের সেই পুরাতন প্রজন্ম, কিংবা সেই তাদের পুরাতন পরিবেশের কোনো স্থান থাকবে না আজকের এই পরিবর্তীত বন্ধুমহল পরিবেশে। হয়তো কোনো এক ছোট বালিকা আমাদের কথা শুনে, অথবা ভালোবেসে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়িয়ে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে পুষ্প স্তবক দিয়ে চলে যাবে। হয়তো সবার বেলায় এটা নাও হতে পারে। কিংবা জন্ম জন্মান্তরের শেষে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শেষে আমি এমন করে বিলীন হয়ে যাবো যে, সেই অবুজ বালিকার পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো আর একটা বাশী ফুলও নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়াবে না। কারন আমি তাদের কোনো ইতিহাসের মধ্যেই নাই। চিরতরেই বিলীন।

আজ যে সেলফীটা কত যত্ন করে তোলা হয়েছে, হাসি মাখা মুখ, চুলের বাহার, পোষাকের পরিপাটিতা সব কিছু ধীরে ধীরে সেই শতবর্ষ পরে এমন করে মলিন হয়ে যাবে, হয়তো দেখা যাবে, সেই ছবি পরে আছে এমন এক কোনায় যেখানে থাকে পরিত্যাক্ত কোনো কাগজ বা ময়লার বাক্স। কোনো একদিন সেটা হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়েই বেরিয়ে যাবে আমার সেই শখের ঘরের দরজা পেরিয়ে।

যে অর্থের জন্য আমি প্রতিদিন সারাটা সময় শুধু পরিশ্রমই করে গেছি, সেই অর্থ আজ আমার কোনো কাজেই আসবে না। শতবছর পরে তো আমার অর্থে গড়া কোনো এক ইমারতের কোনো একটা ইটের মধ্যেও আমার কোনো নাম বা অস্তিত্ব থাকবে না। হোক সেটা আমার পরিশ্রমে গড়া কিংবা আমার নিজের। সেখানে হাত বদলে বদলে আমার অস্তিত্তের শেষ পেরেগটুকু মেরে সেখানে হয়তো কোনো এক লোকের নাম লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। যেটা আজ আমার নামে পরিচিত, শত বছর পর সেটা আমার আর নাই, না সেটা আমার নামেও অহংকার করে।

কি অদ্ভুত না?

শত বছরের হিসাবে যেমন আমি আর নাই, হাজার বছরের হিসাবে তো আমি কখনো ছিলামই না। তারপরেও আজ আমি অনেক ব্যস্ততায় দিন কাটাই আগামিকালের জন্য। অথচ আগামিকালটাই আমার না। এই পৃথিবী আমাকে কখনোই মনে রাখবে না। কারন সে আমাকে ভালোই বাসে নাই। অথচ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম আমার জীবনের থেকেও বেশী। আর এটাই এই পৃথিবী। এই পৃথিবীর কোনো বর্ষাই আমার না, কোনো শরতই আমার না। এর গাছ পালা, এর নীলাকাশ, এর সুগভীর সমুদ্র কিংবা ঘনসবুজ পাহাড় কোনো কিছুই আমার না। আমার ঘরটাও।

শতবছর পরে, আমি এক অচেনা, নামহীন, অস্তিত্বহীন মানুষ যে আজকের দিনে বহু ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটিয়ে কিছুটা সময় এই নীল আকাশ, ঘন সবুজ পাহাড় অথবা পাখীদের কিচির মিচির শুনেছিলাম।