২২ আশ্বিন ১৩৯৩
আজ তোমার সেই চিঠি গুলো খুলে পড়লাম। একটি চিঠিতে তোমার লিপস্টিকে অনেকগুলো ছাপ তোমার ঠোটের। ইস, কি আনন্দে, কত ভরসা, কত আশা নিয়ে তুমি আমার কাছে এই চুমুগুলো সুদূর ১৪ হাজার মাইল দূর থেকে প্রতিদিন পাঠাতে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাঙলায় তুমি লিখতে, “ আমি তোমাকে ভালবাসি”। আমার মনে আছে, যেদিন তুমি প্রথম শাড়ি পড়ে আমাকে একটা ছবি পাঠালে, আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েছিলাম, কি সুন্দর তুমি। সাদা একজন বিদেশিনী, পড়নে বাঙলার শাড়ি, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি সুন্দর তোমার চুল, কালো নয়, সাদাটে, ঠোটে লিপস্টিক নেই কিন্তু লাল ঠোট, চোখে কাজল নেই কিন্তু মিষ্টি একটা চাহনি। আমার খুব তোমাকে ধরতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু তুমি তো ১৪ হাজার মাইল দূরে।
আচ্ছা, তোমার কি মনে পড়ে সেই প্রথম দিনের কথা? আমি তোমাকে কখনো দেখিনি, আমি তোমাকে কখনো জানতামও না। হটাত, একদিন আমার নামে এক চিঠি। ক্যাডেট কলেজে পড়ি, মাত্র ক্লাশ টেন এ পড়ি। আমরা দুপুরে খাবারের জন্য সবাই হাউজের সামনে একসঙ্গে দাড়াই। এই সময় চিঠি এলে দুপুরের খাবরের আগে হাউজ লিডার সবাইকে চিঠি গুলো যার যার হাতে দিয়ে দেন। অনেক সময় একই ক্যাডেট ঘন ঘন চিঠি পেলে FUN করার জন্য হাউজ লিডার ছোট খাটো মজা করেন সবার সামনে। আমি চিঠি না পেলেও আমার এই হাউজ লিডার এর ছোট খাটো মজা অনুভব করতাম। আমি কখনো কারো কাছ থেকে চিঠি পাবার আশা করি না কারন, আমাকে চিঠি লেখার মানুষ নাই। তবে মাঝে মাঝে আমার বড় ভাই আমেরিকা থেকে অনেক উপদেসশমুলক চিঠি লেখেন যা আমার পড়তে ভাল লাগে না। তবুও তো পাই। সেদিনও আমি একটা চিঠি পেলাম। নিশ্চয় আমার ভাইয়ের চিঠি। কি আর লিখবেন, ‘ভাল করে পড়াশুনা করিস, আমাকে চিঠি লিখিস। ইত্তাদি।‘ দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে এলাম, বিছানায় গেলাম, চিঠিটা খুললাম, ওমা! একি! আমার ভাইয়ের চিঠি নয়, আর হাতের লেখা এত জঘন্য !!
"আমার নাম কার্লা ডুরাইন উইলসন। আমার ড্যাড তোমার ভাইয়ের সাথে একইওফিসেকাজ করে। ফলে তারা একে অপরেরবন্ধু। ড্যাডের বন্ধু হিসাবে একদিন আমি তোমার ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। তোমার ভাইয়ের বাসার ওয়ালে চমৎকার একটা ছবি আমার নজরে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কে? তোমার ভাই আমাকে জানালো এটা তুমি, তার ছোট ভাই। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আমার খুব ইচ্ছে হলো তোমার সাথে আমি ফ্রেন্ডশীপ করি। আমি তোমার ভাইয়াকে ব্যাপারটা জানাইতেই তিনি আমাকে তোমার সাথে চিঠিতে যোগাযগ করতে বললেন। আমি লোভ সামলাতে পারি নাই। আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। তুমি কি আমার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করবে? তোমার চিঠির আশায় থাকবো। চিঠি লিখো।" - কার্লা
এই ছিলো তোমার প্রথম চিঠি।
তোমার প্রতি আমার কোন লোভ হল না, তোমাকে চিঠি লেখার ইচ্ছেও আমার হল না। এর অবশ্য অনেকগুলি কারন ছিলো। প্রথম কারন যে, আমি চিঠি লিখতে অভুস্থ নই। আর আমি মেয়েদের সাথে কিভাবে কি কথা বল্বো সে ব্যাপারে কোনোদিনই চেষ্টা করিনি। বলতে পারো, আমি একজন মেয়ে বিবর্জিত চরিত্র। ক্লাশ শেষে আমি সারাদিন মাঠে খেলা করি। খেলার প্রতি আমার অনেক বেশী ঝোক। আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। কিন্তু আমি ভুলে গেলে কি হবে, তুমি ভুলনি। পরদিন, আবারো আরও একখান চিঠি।
"আমি মনে হয় অস্থির হয়ে আছি। কখন তোমার চিঠি পাবো। মাত্র গতকাল চিঠি লিখেছি, আজকেই আমার উত্তর পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু কেনো যেনো বারবার মনে হচ্ছে, আমি যেনো তোমার সাথে কথা বলতে চাই। আমি তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে এসেছি। তোমার ভাই কেনো যেন হেসে দিয়েছিলো। আচ্ছা, তোমার ছবিটা চেয়ে নেওয়া কি আমার ঠিক হয়েছে? তুমি আমাকে অনেকগুলি ছবি পাঠাবে।--ইতি কার্লা"
ব্যাপারটা যেনো কেমন হয়ে দাড়াচ্ছে। তার চিঠির অর্থ পরে মনে হচ্ছে, আমি তার সাথে না জানি কত জনমের পরিচিত। পর পর দুটো চিঠি পেলাম। কিন্তু আমার কেনো যেনো ওর প্রতি না কোনো টান অনুভব করলাম, না আখাংকা। পরদিন আবারো একই ঘটনা। এবার, অনেকগুলো ছবি। পরপর তিনদিন তিনটা চিঠি আমাকে নাড়া দিল। মনে হলো, এটা মনে হয় ঠিক নয় যে, আমি তাকে গ্রহন করি আর নাইবা করি, আমার সৌজন্যবোধ থেকেও জানানো উচিত, আমার মানষিকতাটা।
আমি তোমাকে প্রথম চিঠি লিখতে বসলাম। আচছা, আমি কি তোমাকে প্রেমের চিঠি লিখেছিলাম? না, আমি তা করিনি কারন আমি তোমাকে ভালবেসে চিঠি লিখিনি। আমি নিতান্তই তোমাকে জানার জন্য চিঠি লিখেছিলাম। আমি তখন মাত্র ক্লাশ টেন এ পড়ি। আমার সেই চিঠিটি যা আমি তোমাকে লিখেছিলাম, সেটা ছিলো ঠিক এই রকমঃ
"আমি তোমার সবগুলি চিঠিই পেয়েছি। সময়ের কারনে বা ব্যস্ত আছি ক্লাশ নিয়ে এই কারনে আমি তোমার চিঠির উত্তর দিতে পারি নাই তা নয়। তোমার হাতের লেখা দেখে আমার একদম ভালো লাগে নাই। কিন্তু আজকে তোমার ছবি গুলি দেখে তোমাকেও আমার খুব ভালো লেগেছে। আজ মনে হয়েছে, সবার তো দেশে বন্ধু থাকে, কিন্তু আমার একজন বিদেশী বন্ধু থাকলে তো আরো ভাল। কিন্তু আমি তোমার মতো এতো ঘন ঘন চিঠি লিখতে পারবো না। আর আমার কাছে এখন অনেক ছবি নাই। যে কয়টা ছবি আছে, তার থেকে দুটো ছবি পাঠাইলাম। সামনে আমার পরীক্ষা।"
তুমি এক অদ্ভুত কাজ করে ফেলছিলে প্রতিদিন। প্রতিদিন আমি তোমার চিঠি পেতে শুরু করলাম। এর মানে তুমি প্রতিদিন চিঠি পোষ্ট করছ। আর আমিও এক নেশায় পড়ে গেলাম। তোমাকে চিঠি না লিখলে আমার যেন কি করা হল না মনে হয়। আর আমিও দেখলাম যে, তোমার চিঠি না পেলে আমারও আর ভাল লাগছে না। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, আমার এবং তোমার চিঠির ভাষা বদলে যেতে শুরু করছে। তোমার রোজকারের সব ঘটনা, কে তোমাকে কি বলল, কে তোমাকে আঘাত করল, তোমার টিচার, তোমার বন্ধুরা কে কিভাবে তোমার সাথে ব্যবহার করে, সব যেন আমাকে না লিখলে তোমার আর ভাল লাগে না। ম্যানডি নামের তোমার একজন খুব ভাল বন্ধু ছিল যার সাথে তুমি তোমার নিজের গোপন বিষয় গুলু শেয়ার করতে। তুমি আমাকে মেন্ডির ব্যাপারেও অনেক বিস্তারিত লিখেছিলে। হঠাত একদিন ঐ মেন্ডিও আমাকে খুব মজা করে একখান চিঠি লিখেছিল।
"তোমাকে আমি দেখি নাই কিন্তু প্রতিদিন কার্লার কাছ থেকে যা শুনছি আর জানছি তাতে দেখার থেকে কম কিছু নয়। তোমরা কি একে অপরকে ভালোবাসো? তুমি তো দারুন চিঠি লিখো। তোমার প্রতিটি চিঠি আমি পড়ি। কার্লা আমাকে পড়ে শুনায়। ইশ, আমারো যদি তোমার মতো একজন এমন ভালো চিঠি লিখার বন্ধু থাকতো!!"
মেন্ডিও আমার আরও একজন অদেখা বিদেশী বন্ধু বনে গেল। ওরা একই ক্লাশে পড়ে। আমেরিকার ক্লাশ গুলি কি রকম, ওরা কিভাবে পড়ে, ওরা অফ তাইমে কি করে। বাবা মায়ের সাথে ওরা কিভাবে বাসায় একত্রে খায়, ঘুমায়, সব যেনো আমার জানা হয়ে যাচ্ছে ওর চিঠি পড়ে পড়ে। আমেরিকার ছেলেমেয়েরা কম বয়সেই অনেক পাকামো করে, ওরা অনেক কিছুই আমাদের থেকে একটু আগে বুঝে। এমনকি ভালোবাসাটাও।
এমন করে প্রায় চার বছর কেটে গেল। এই চার বছরে কত যে তোমার চিঠি আমার বাক্স ভরে গেছে। জানো? বাক্সতার নাম কি রেখেছি? "আমেরিকার বেলুন"।
কি অদ্ভুত, আমাদের মধ্যে কোন ক্লান্তি, কোন থামাথামি নেই। আমরা ধীরে ধীরে একে অপরের জন্য শুধু যেন অপেক্ষা করছি কখন আমরা আমাদের দেখতে পাব, কাছে পাব। এটা এখন সত্যি সত্যি প্রেমে রুপান্তর হয়ে গিয়েছিল। মাত্র ক্লাশ টেনে পড়া একটি বাঙ্গালি ছেলে বিএমএ তে দুই বছর ট্রেনিং করে লেফটেন্যান্ট হয়ে গিয়েছি, তারপরেও আমার প্রেমের কোন ঘাটতি নেই। কে গো তুমি মানসী? কেন তুমি এত দূর থেকে আমাকে না দেখে ভালবাসতে শুরু করেছ? আমিও তো তোমাকে দেখিনি গো মেয়ে। কি হবে কখন যদি এই প্রশ্ন সামনে এসে হাজির হয়, আমাদের দেখা হওয়াটা কি ভুল হয়েছিল? যদি কখনো এই ধারণা হয়ও, আমি শুধু তোমাকে বলব, আমরা ভুল করিনি, আমাদের প্রেম সৎ এবং সত্যি ছিল। আমি তোমাকে ভুলব না। আমি এখনো এক অদেখা নারীর প্রেমেই আছি। এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি।