আমি অফিসে বসে ছিলাম। কাজের চাপ ছিলো বটে কিন্তু তারপরেও কাজের চাপ কমে এসেছিলো দুপুরের দিকে। ফ্যাক্টরীর সেলারী দিতে হবে, কাজ প্রায় সম্পন্ন। কফি পান করছিলাম। এমন সময় বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে মিটুল (আমার স্ত্রী) ফোন করলো। ফোন ধরলাম, তার কন্ঠ উৎকণ্ঠায় ভরপুর।
-শুনছো?
-কি শুনবো?
-আরে, ফাতেমা আপার জামাই দুদু ভাই মারা গেছেন।
-বললাম, কখন?
-এইমাত্র ওনার মেয়ে খালেদা জানালো যে, ওর বাবা মারা গেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
খারাপ লাগলো। কারন গতকালও আমি ওনার সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম। বলেছিলো যে, ওনার শরীরটা বেশী ভালো নাই। অথচ আজকে ২৪ ঘন্টা পার হয় নাই, লোকটা আর এই প্রিথিবীতেই জীবন্ত নয়। এটাই জীবন। যার কোনো স্ট্যাবিলিটি নাই। কখন উনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সেতাও জানি না, আবার কেনো ভর্তি হয়েছিল সেতাও জানি না। দুদু ভাই হার্টের স্ট্রোকের কারনে মারা গেছেন বলে ডাক্তার জানিয়েছে।
দুদু ভাই আর ফাতেমার গল্পটা বলি।
১৯৭৬ সাল। আমি তখন গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই লেখাপড়া করি। দেশের অবস্থা বেশ খারাপ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ, কোনো আইন শৃঙ্খলা নাই, তার মধ্যে কয়েকদিন আগে শেখ মুজিব, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাকে সামরিক অভ্যুথানে খুন করা হয়েছে। গ্রামের অনেক লোক বেকার, যে যেভাবে পারে কোনো রকমে দিন চালাচ্ছে। আমরা ৫ বোন আর মা এবং আমি। আমাদের সংসার যার প্রধান মানুষ আমার বড় ভাই হাবীবুল্লাহ। তিনিও সাবলম্বি নন, স্টুডেন্ট থেকে সবেমাত্র ঢাকা ইউনিব্ররসিটিতে লেকচারার হিসাবে যোগ দিয়েছেন। কোনো রকমে আমাদের সংসার চলে। বাড়িতে এতোগুলি বোন আর আমি তো সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি, এরকম একটা থমথমে দেশের পরিবেশে ভাইয়ার উপর লোড কম নয়। একদিকে নিরাপত্তা, আরেকদিকে জীবন ধারনের যুদ্ধ। হাবীব ভাই নিজেও তার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বিদেশে যাবেন বলে পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু বোনদের বিয়ে না দেয়া পর্যন্ত তার এই পরিকল্পনায় অনেক কঠিন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছিলো।
এই সময় দুদু ভাই প্রেমে পড়লেন আমার ৪র্থ বোন ফাতেমার সাথে। গ্রামে ওই সময় প্রেম করা একটা যেমন জঘন্য ব্যাপার বলে মনে করা হতো, তেমনি যারা প্রেম করছেন, তারাও অনেক অসুবিধায় থাকতেন। মনের তীব্র ইচ্ছা দেখা করার কিন্তু না আছে সুযোগ না আছে কোনো অনুমতি। ফলে চিরকুট, চিঠি ইত্যাদি দিয়ে যতোটুকু রোমাঞ্চ করা যায় সেটাই ছিল একমাত্র ভরষা। আমার ৩য় বোন লায়লার বিয়ে হয়ে গেছে, ১ম বোন সাফিয়ার বিয়ে ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। তার প্রথম স্বামী গত হয়েছেন। আমার মা, ফাতেমা আর দুদু মিয়ার প্রেমের এই গল্পটা ভাইয়ার কাছে একেবারেই গোপন করে রাখলেন। মায়েরও অনেক চিন্তা ছিলো তার মেয়েরদের জন্য ভালো পাত্রের ব্যাপারে।
দুদু ভাই তখন ফুটন্ত যুবক। দেখতে খুবই সুদর্শন আর স্মার্ট। বেকার ছেলে কিন্তু তার বাবার একটা মনোহরী দোকান ছিলো। তিনি হাপানীতে ভোগেন প্রায়ই। ফলে সবসময় বাজারের দিনে তিনি ঠিকমতো বাজারে গিয়ে পসরা বসাতে পারেন না। এই সুযোগে দুদু ভাই তার বাবার ব্যবসাটা দেখভাল করেন।
সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। আমাদের গ্রামে বর্ষাকালে হাটে বাজারে যাওয়ার জন্য প্রতিটি গ্রাম থেকে নৌকা বা কোষা লাগতোই কারন বর্ষাকালে গ্রামের একদম কিনার পর্যন্ত পানিতে ভরপুর থাকতো। আমাদের নিজস্ব কোনো নৌকা বা কোষা নাই। ফলে যখনই কোনো নৌকা বা কোষা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া বাজারে যেতো, আমি ওইসব নৌকা বা কোষায় অনুরোধের ভিত্তিতে উঠে যেতাম। দুদু ভাইদের যেহেতু দোকানের অনেক মাল নিয়ে হাটে, বাজারে যেতে হয় পসরা সাজানোর জন্য, ফলে তাদের একটা নিজস্ব নৌকা ছিলো। ঘোষকান্দা থেকে বিবির বাজারে যেতে হলে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই যেতে হয়। ফলে দুদু ভাইদের নৌকা করেই আমি বেশীর ভাগ সময় হাটের দিন আমি হাটে যেতাম। আর দুদু ভাই যেহেতু ফাতেমার সাথে একটু ভাব আছে, তিনিও চাইতেন যেনো কোনো ছলেবলে তার নৌকা আমাদের ঘাটে ভিরুক। তাতে হয়তো কখনো কখনো ফাতেমার সাথে দুদু মিয়ার ক্ষনিকের জন্য হলেও চোখাচোখি হয়। এটাই প্রেম। এভাবে অনেকদিন চলে যায়।
মা একদিন হাবিব ভাইকে ব্যাপারটা খুলে বলেন। আমি ঠিক জানিনা কেনো বা কি কারনে হাবীব ভাই দুদু ভাইদের পরিবারটাকে পছন্দ করতেন না, সে রহস্য আজো আমার কাছে অজানা। হাবীব ভাই ফাতেমার সাথে দুদু মিয়ার বিয়েতে কিছুতেই রাজী ছিলেন না। কিন্তু মায়ের জোরাজোরিতে এবং ফাতেমার প্রবল ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত হাবীব ভাই এই বিয়েতে রাজী হলেন। আমার ধারনা, হাবীব ভাই আরেকটা কারনে তিনি রাজী হয়েছিলেন, আর সেটা হচ্ছে, যেহেতু হাবিব ভাই নিজেও ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে চান, এবং তার আগে সব বোনদের বিয়ের ব্যাপারটা নিসচিত করতে চান, ফলে যেমনই হোক, ফাতেমার একটা গতি হচ্ছে এটা ভেবেও দুদু মিয়ার সাথে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশী বাড়াবাড়ি করেন নাই। কিন্তু তিনি যে নিমরাজী এটা ভালভাবেই হাবিব ভাই প্রকাশ করতে পেরেছিলেন।
অন্যদিকে দুদু মিয়ার খুব একটা মনোযোগ ছিলো না কোনো কাজেই। না বাবার ব্যবসা, না অন্য কিছুতে। ফলে দুদু মিয়ার বাবাও এই মুহুর্তে সে বিয়ে করুক এটাও রাজী ছিলেন না। আরো একটা কারন ছিলো দুদু মিয়ার বাবার এই বিয়েতে রাজী না হবার। আর সেটা হচ্ছে যে, আমাদেরর গ্রামে সব সময়ই ছেলেরা যখন বিয়ে করে, তখন তারা নির্লজ্জের মতো কনে পক্ষ থেকে মোটা দাগে একটা যৌতুক দাবী করে এবং পায়ও। দুদুর বাবাও এ রকমের একটা পন আদায়ের লক্ষে ছিলেন কিন্তু হাবিব ভাইয়ের এক কথা, কোনো যৌতুক দিয়ে আমরা বোনের বিয়ে দেবো না। ফলে দুদু ভাইয়ের বাবারও এই বিয়েতে মতামত ছিলো না। অথচ শেষ পর্যন্ত বিয়েতা হয়েছিলো। দুদু মিয়ার এক্ষেত্রে আমি একটা ধন্যবাদ দেই যে, সে তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও অনড় ছিলো যে, যৌতুক বা পন বুঝি না, আমি ফাতেমাকেই বিয়ে করবো। গ্রামে এ ধরনের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্তের বড় অভাব। কিন্তু দুদুর মধ্যে এই সাহসটা ছিলো। ফলে ফাতেমার সাথে দুদুর বিয়ে হলো ঠিকই কিন্তু তার বাবা, বা মা, কিংবা অন্যান্য আত্তীয় সজনেরা এই বিয়েটায় তারা লস করেছে বলে ধরে নিয়েছে। আর এই লসের কারন ফাতেমা। এতে যা ঘটলো তা হচ্ছে, ফাতেমাকে শসুড়বাড়ির অনেক বিড়ম্বনার মুখুমুখি হতে হয়েছে। বিয়েটাকেই টিকিয়ে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো ফাতেমার। কিন্তু আমি আজ দুদু মিয়াকে অনেক ধন্যবাদ দেই যে, যদি দুদু মিয়া বলিষ্ঠ না হতো, তাহলে ফাতেমার পক্ষে ওই বাড়িতে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। একটা সময় ছিলো যে, দুদু মিয়া শুধুমাত্র ফাতেমার কারনে তাকে তার পৈত্রিক বাড়ি থেকে উৎখাত হতে হয়েছিলো। আর তখন ফাতেমা আর দুদু মিয়া আমাদের গ্রামের বাড়িতেই থাকা শুরু করেছিলো। এই থাকা অবস্থায় ফাতেমার সব সন্তানদের জন্ম হয়।
দেশের ক্রমবর্তমান খারাপের কারনে দেশে কোনো কাজ নাই। এদিকে দুদুর বাবার ব্যবসাটাও আর তার হাতে নাই। আমাদের গ্রামে তখন দলে দলে লোকজন দেশের বাইরে যাবার হিরিক পড়েছে। কেউ সৌদি, কেউ কুয়েত, কেউ লিবিয়া, কেউ ইতালি আবার কেউ কেউ যেখানে পারে সেখানে। দুদু ভাইও সে লাইনে পড়ে গেলো। বেশ টাকার প্রয়োজন, অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। দুদু ভাই নিজের বাবাকে পটিয়ে, কিছু আমাদের থেকে আবার কিছু লোন নিয়ে শেষ অবধি সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। পিছনে রেখে গেলো ফাতেমাকে, তার ছেলে ফরিদকে, মেয়ে সালেহা, খালেদা আর ছেলে কামাল এবং জামালকে।
কিন্তু যে লোক আরাম প্রিয়, ভারী কাজে অভ্যস্থ নয়, তার পক্ষে ওই সৌদি আরবের গরম বালুর জমিনে, গরু মহিষ চড়ানো কিছুতেই ভাল লাগার কথা নয়। তারমধ্যে এম্নিতেই সৌদি লোকজন ৩য় দেশের বিশেষ করে বাংলাদেশের শ্রমিকদেরকে মিসকিন হিসাবে ট্রিট করে। দুদু মিয়া স্বাধীনচেতা মানুষ, আরামপ্রিয় মানুষ, তার কত টাকা ক্ষতি হলো বা ক্ষতি হচ্ছে এসবের কোন বালাই ছিলো না। তিন মাস না যেতে যেতেই দুদু মিয়া পুনরায় বাংলাদেশে চলে এলেন। এই ঘটনায় দুদু মিয়ার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো। যেটুকু ভরশা তার বাবা তার উপর করেছিল এবং কিছু লাভের আশায় যে কয়টা টাকা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলো, পুরুটাই গচ্চা যাওয়ায় দুদু মিয়ার বাবা এবার তাকে মুটামুটি ত্যাজ্য করার মতো অবস্থায় চলে গেলো। দুদু মিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো, আর দুদু মিয়া কোথাও কোনো জায়গা না পাওয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়িতেই স্থায়িভাবে উঠে গেলো।
আমাদের বাড়িটা বড়ই ছিলো। আর যেহেতু মা থাকেন, ফলে আমরা আপাতত মাকে দেখভাল করার জন্য যে একজন লোকের দরকার ছিলো সেটা অন্তত পেলাম। ফাতেমাই মার দেখভাল করেন। মার খাওয়া দাওয়ার খরচ আমরাই দেই কিন্তু ফাতেমা আমাদের বাড়িতে থাকায় মার কখন কি লাগবে, সেটায় ফাতেমাই টেককেয়ার করে। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য তো ফাতেমার একটা স্থায়ী সোর্স থাকা দরকার। কখনো আমরা কিছু সাহাজ্য করি, কখনোও দুদু মিয়াও কোথা থেকে কিভাবে টাকা আনে আমরা জানিও না। শুনলাম, দুদু মিয়া একটা আদম ব্যবসা খুলেছে। মানে লোকজনকে বিদেশ পাঠানো। তার সাথে আমাদের গ্রামের একজন লোক পার্টনার হিসাবে আছে। প্রথম প্রথম মনে হলো ব্যবসাটা ভালোই চলছে। কিছু কিছু লোকজনকে তো দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে। আবার নতুন লোকের লাইন হচ্ছে, টাকা আসছে। কিন্তু সুখ তার বেশীদিন টিকে নাই। আদম ব্যবসা যারা করেছে, সব সময় এটায় কোনো না কোনো দুই নম্বরী কিছু ছিলোই। কেউ হয়তো সাফল্য পেয়ে তাদের মাধ্যমে বিদেশ চলে যেতে পারছে আবার কেউ মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও বিদেশ যেতে পারছিলো না অথচ টাকা পরিশোধ করা আছে। এ রকম করতে করতে প্রায় অনেক বছর কেটে গিয়েছিলো। পাওনাদাররা এসে ঝামেলা করে, থ্রেট দেয়, ফাতেমাকে পর্যন্ত শাসিয়ে যায়, মামলা করে, আবার কেমন করে যেনো এসব ঝামেলা থেকে দুদু মিয়া পারও পেয়ে যায়।
আমি তখন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। এ রকমের বহু কেস আমার কাছেও এসেছে। কিন্তু সমাধা করতে গিয়ে দেখেছি, দোষটা এই আদম ব্যবসা কোম্পানীর, সাথে দুদু ভাইদের। আমার পক্ষে আনইথিক্যাল করা কিছু সম্ভব হয় নাই বটে কিন্তু আমি সেনাবাহিনীতে আছি এই নাম ভাংগিয়ে দুদু ভাই এবং তার পার্টনার অনেক ফায়দা তো অবশ্যই নিয়েছেন। আমি কখনো এসব নিয়ে না মাথা ঘামিয়েছি না কেউ এলে আমি তার পক্ষে বিপক্ষে কোনো একসানে গিয়েছি।
দুদু ভাইয়ের সন্তানেরা ততোদিনে বড় হয়ে গেছে। বড় ছেলে ফরিদ খুব হিসেবি। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করছে কিন্তু খুটিতে জোর না থাকলে সব সন্তানের ভাগ্য অতোটা বেড়ে উঠে না যতোটা তার প্রাপ্য। কিন্তু আমি ফরিদের উপর অনেক সহানুভুতিশীল ছিলাম। আমারো ওই রকম ইনকাম নাই যে, যা লাগে সাপোর্ট করতে পারি। ফরিদের গল্পটা পড়ে লিখবো।
দুদু ভাই যতোটা কামাই করে নিজের পরিবারকে সাহাজ্য করতে চান, দেখা গেলো, তার থেকে বেশী ঝামেলায় পড়ে আরো বেশী ক্ষতিপুরন দিতে হচ্ছে। হাত খোলা লোক। যখন টাকা আসে, মনে হয় কতোক্ষনে টাকাটা খরচ করবে। কিন্তু যখন থাকে না, তখন গোল্ডলিফ বা বেনসন সিগারেটের পরিবর্তে স্টার সিগারেটও তিনি খেতে পারেন। লোকটার কথায় আশ্বাস পাওয়া যায় কিন্তু সেই আশ্বাস কতোটা নির্ভরযোগ্য, সেটা অনেকবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে দেখা গেছে। ফলে, একটা সময়ে, তার সন্তানেরা, তার স্ত্রী ফাতেমা সাফ বলে দিয়েছিলো যে, তার কোনো রোজগারের দরকার নাই, শুধু ঝামেলার কোনো কাজে না গেলেই হলো। এভাবেই দুদু ভাই সংসার দেখে, ফরিদ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, আরো এক ছেলে কামালও কুয়েতে থাকে, সেও পাঠায়। তারা ভালোই ছিলো। হজ্জ করেছে, গ্রামে তার একটা পজিশন তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলো শেষ বয়সে হলেও।
আসলে, মানুষ যখন একা একা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে নিজেকে বাচাতে হয়, তখন অনেক সময় কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা উচিত না, এই বিচারে আর যাই চলুক জীবন চলে না। কেউ নিজের থেকে খারাপ কিংবা বদনাম কুড়াতে চায় না। বেশীরভাগ মানুষ পরিস্থিতির শিকার। দুদু ভাই খারাপ লোক ছিলেন না। তার অন্তর বড় ছিলো, তার প্রতিভা ছিল। কিন্তু গরীবের ঘরে সবসময় প্রতিভা আলোকিত হয় না। এটা সেই ফুটন্ত ফুলের মতো, পরাগায়ন না হবার কারনে অকালেই ফল হয়ে না উঠে ঝরে যাওয়ার কাহিনী। এটা কার দোষ? দুদু ভাইয়ের নাকি তার পরিবারের নাকি আমাদের এই ভারসাম্যহীন সমাজের?
অনেক লম্বা একটা সময় দুদু ভাই ছিলো আমাদের সাথে। অনেক রাগ করেছি, বকা দিয়েছি, মাঝে মাঝে আবার ভালোবাসায় আগলেও রেখেছি। আজ প্রায় ৭০ বছর বয়সে এসে দুদু ভাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। উনার লাশটা যখন আমার ফ্যাক্টরীর সামনে এসে থামলো, একটা লাশবাহী গাড়িতে কাপড়ে মোড়ানো ছিল দুদু ভাই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ গ্রামে নিয়ে যাবার সময় আমি তার ছেলে জামাল এবং ভাতিজা আরশাদকে বলেছিলাম যেনো ফ্যাক্টরীর সামনে থামায়। কিছু খরচাপাতি ব্যাপার আছে, যাওয়ার সময় ওদের হাতে তুলে দেবো। কারন এই মুহুর্তে এটা খুব দরকার।
দুদু ভাই অনেকবার আমার এই ফ্যাক্টরিতে এসেছিলেন। খাওয়া দাওয়া করেছে আমার সাথে, হেটে হেটে ঘুরে ঘুরে দেখেছে আমার ফ্যাক্টরি। গত মার্চ মাসেও একবার আমার এই ফ্যাক্টরীতে এসেছিলো খালেদাকে নিয়ে, মিজান (খালেদার জামাই) ছিলো, মিজানের আব্বা, মিজানের চাচা এবং জেঠারা ছিলো। খালেদা ছিলো, জামাল ছিল। একসাথে খেয়েছি। অথচ আজ, দুদু ভাইয়ের কোনো ক্ষমতা নাই লাশবাহী গাড়ি থেকে নেমে আমার সাথে একবার দেখা করেন, তার কোনো শক্তি নাই আরো একবার আমার ফ্যাক্টরীর নতুন মেশিনগুলি হেটে হেটে ঘুরে ঘুরে দেখার। তার এই দুনিয়ার সাথে সমস্ত নেটওয়ার্ক ছিন্ন করা হয়েছে। এই পৃথিবীতে তারজন্য আর কোনো অক্সিজেন বরাদ্ধ নাই, তার পায়ের শক্তি রহিত করা হয়েছে, তিনি আর এই বাজ্যিক পৃথিবীর কেউ নন। উনাকে আমরাও আর আটকিয়ে রাখার কোনো ক্ষমতা নাই, রাখাও যাবে না। লাশবাহী গাড়িটার সামনে গিয়ে দাড়ালাম, দুদু ভাই সাদা একটা কাপড়ের ভিতর একটা জড়ো পদার্থের মতো শুয়ে আছেন গাড়ির সিটের নীচে। যে লোকের জীবন্ত অবস্থায় সিট বরাদ্ধ ছিলো, আজ তার স্থান গাড়ির সিটের নীচে। এটাই জীবন। লাশবাহী গাড়ি চলে গেলো গ্রামের পথে।
তার বড় ছেলে ফরিদের সাথে কথা হল। ফরিদ জাপানে থাকে। বর্তমানে করোনার মহামারী চলছে সারা দুনিয়াব্যাপি। জাপানের সাথে এই মুহুর্তে আমাদের দেশের বিমান চলাচল সাময়ীকভাবে বন্ধ আছে। কিন্তু যদি কেহ আসতে চায়, তাহলে ইন্ডিয়া হয়ে হয়তো আসা যাবে। ফরিদ তার বাবাকে দেখতে ঢাকায় আসতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হল, এটা ঠিক হবে না। কারন কোনো কারনে যদি ফরিদ ঢাকায় চলে আসতেও পারে, বলা যায় না, করোনার মহামারীর কারনে বাংলাদেশ সরকার বিদেশ ফেরত যাত্রী হিসাবে ফরিদকে ১৫ দিনের কোয়ারেন্টাইন করে ফেললে ফরিদের পক্ষে আরো ১৫ দিন গ্রামেই আসা হবে না। আর যদি লাশকে এখন আবার ঢাকায় কোনো হাসপাতালে মর্গে রাখতেও যায়, দেখা যাবে কোনো হাসপাতাল সেটা নাও রাখতে পারে। আবার যদি লাশ রাখাও যায়, ফরিদকে কোনোভাবে এয়ারপর্ট থেকে কোয়ারেন্টাইন ছারাও গ্রামে আনা যায়, তাহলে ফরিদের জাপানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারেও একটা করাকড়ি থাকতে পারে। আবার এই মুহুর্তে আগামী ৩ দিনের মধ্যে কোনো ফ্লাইটও নাই। সব মিলিয়ে আমি ফরিদকে ঢাকায় আসতে বারন করে দিলাম। ফরিদের না আসার সিদ্ধান্তটা যখন কনফার্ম করা হলো, আমি গ্রামের উদ্ধেশ্যে রওয়ানা হলাম দুদু ভাইকে কবর দেওয়ার জন্য। আমি যখন গ্রামে পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় পৌনে আটটা। গ্রামে ফাতেমাকে দেখলাম, ওর অন্যান্য সন্তানদের সাথে কথা বললাম। সবার মন খারাপ, কান্নাকাটি করছে। দুদু ভাইয়ের লাশ ঘিরে অনেক মানুষ উঠানে খাটিয়ার পাশে জড়ো হয়ে বসে আছে।
জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে একটা ভীষন মিল আছে। জন্মের সময়ে নতুন অতিথির চারিদিকে যেমন বাড়ির সবাই বসে হাসিমুখে বরন করে নেয়। এই নতুন অতিথির আগমনে যেমন সবাই বাড়িভর্তি মানুষের ভীড় লেগে যায়, ঠিক তেমনি মৃত্যুর সময়েও বাড়িভর্তি মানুষের ভীড় জমে যায়। কিন্তু এ সময়ে সবাই থাকে ভারাক্রান্ত আর শোক বিহব্বল।
আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন, রাত বেড়ে যাচ্ছে, কবর এখনো খোড়া শেষ হয় নাই। রাতে এশার নামাজের পর জানাজা হবে। এশার নামাজ হবে রাত নয়টায়। ফরিদের শ্বশুর মোল্লা কাকা বাকী সব সামলাচ্ছেন। গোসল, কাফন আর যাবতীয় সব। মাঝে মাঝেই কেউ কেউ উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করছে। কেউ কাদতেছে কাদতে হবে বলে। ফলে উচ্চস্বরেই সে তার সেই বিলাপ লোক সম্মুখে জাহির করার অভিনয়ে এটাই বুঝাতে চাইছে, দুদু মিয়ার শোকে সে এতোটাই বিহব্বল যে, তার বুক ফাটছে, তার অন্তর কাদছে ইত্যাদি। কিন্তু আমার চোখে এই মিথ্যা কান্নাটা ধরা পড়েছে। কিন্তু তারপরেও কাদুক। আবার কেউ নীরবে চোখের পানি ফেলছে, তার এই কান্না অন্তরের ভিতর থেকে। নিঃশব্দ কান্নার কষ্ট হাহাকার করে কান্নার থেকেও অধিক কষ্টের।
ফাতেমা কাদছে নিঃশব্দে, আমাকে দেখে একটু উচ্চস্বরে কান্নার উপক্রম হয়েছিলো, বুঝলাম আবেগ। হবেই তো। নিজের লাইফ পার্টনার চলে গেছে। খারাপ হোক ভালো হোক, একজন লোকতো ছিল যার সাথে অভিমান করা যায়, যার কাছে অভিযোগ করা যায়। আজ সে চলে গেছে। প্রায় ৪৪ বছরের পার্টনারশীপ লাইফে কত কথাই না লুকিয়ে আছে ফাতেমার জীবনে। এই সংসার গুছাইতে কতই না সময় ব্যয় করেছে ওরা।
বললাম ফাতেমাকে- আজ তুমি একা কিন্তু একা নও। আমরা তো আজীবনই ছিলাম, এখনো আছি। নিজের উপর যত্ন নিও, আর কখনো ভেবো না যে, তুমি একা হয়ে গেছো। ভাই আর বোনের সাথে তো নাড়ির সম্পর্ক। তুমি ভাল থাকবা, মনের জোর রাখো আর দোয়া করো এইমাত্র চলে যাওয়া মানুষটার জন্য যার সাথে তুমি নির্দিধায় অন্ধকারেও হাতে হাত ধরে রাস্তা পার হতে পেরেছিলা। আজ তোমার দোয়া তার জন্যে সবচেয়ে বেশী দরকার। মনটা আমারো খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো ফাতেমার চোখের জল দেখে। আজ অনেকদিন পর সেই কথাটা মনে পড়লো-
যদি কখনো তোমার কাদতে ইচ্ছে করে, আমাকে ডেকো,
আমি ওয়াদা করছি, আমি তোমাকে হাসাতে চেষ্টাও করবো না।
কিন্তু আমি তোমার সাথে কাদতে পারবো।
যদি কখনো তোমার কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, আমাকে ডেকো
আমি ওয়াদা করছি, আমি তোমাকে একটুও বাধা দেবো না
কিন্তু আমি তো তোমার সাথে হারিয়ে যেতে পারবো।
যদি কখনো তোমার কারো কথাই শুনতে ইচ্ছে না করে, আমাকে ডেকো
আমি ওয়াদা করছি, আমি তোমার সাথে কোনো কথা বল্বো না, নিসচুপ থাকবো।
কিন্তু কখনো যদি তুমি আমাকে ডেকেছো কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন সাড়া পাও নাই,
তুমি এসো
হয়তো সেদিন সত্যিই তোমাকে আমার প্রয়োজন।
ফিরে এলাম। জানাজায় শরীক হতে পারি নাই। অনেক রাত হয়ে যাবে। আর সারাটা বাড়িতে এতো বড় করোনার মহামারী সত্তেও কারো মুখে মাস্ক নাই। খুব অসস্থি বোধ করছিলাম।
গাড়িতে উঠে বারবার দুদু ভাইয়ের কথাই মনে পড়ছিল। আজ থেকে আমি ইচ্ছে করলেও তার মোবাইল নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে পারবো না। ইচ্ছে করলেও কোনো কারনে বকাও দিতে পারবো না। তিনি আজ সব কিছুর উর্ধে।
আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো যার কাছ থেকে এসেছিলাম। আজ থেকে ৫০ বছর কিংবা ১০০ বছর পর হয়তো কেউ জানবেও না, দুদু নামে কোনো একজন আজ তিরোধান হলো। এই তিরোধানের প্রাকটিস যুগে যুগে সব সময় হয়ে এসেছে, হবেও। আমরা সময়ের স্রোতে একে একে হারিয়ে যাবো। কারন আজ থেকে শত বর্ষ আগেও এখানে এমন দুদু, এমন আখতার, এমন ফাতেমারা এসেছিলো। আজ তারা কেহই নাই। তাদের কোনো ইতিসাহও কোথাও লিখা নাই। আর যেখানে লিখা আছে, তা ঈশ্বরের কাছে। সেখানে আমাদের কোনো পদচারনা নাই।
আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাত বরাদ্ধ করুন।