১০/১০/২০০২- জর্জিয়ায় আগমন

Categories

গত ৪ অক্টোবর ২০০২ তারিখে আমি দ্বিতীয় বারের মতো জাতীসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষা বাহিনীর অধীনে  মিশনে এলাম। এবার মিশন এককালে রাশিয়ার অধীনে থাকা জর্জিয়ায়। ইউরেশিয়ার ককেশিয়ান রিজিয়নের মধ্যে ওয়েষ্টার্ন এশিয়া আর ইষ্টার্ন ইউরোপের মধ্যে অবস্থিত এই দেশটি। পশ্চিমে ব্ল্যাক সি, উত্তরে রাশিয়া আর দক্ষিনে আছে তুরস্ক আর আর্মেনিয়া। দক্ষিন পূর্বে আছে আজারবাইজান।

৪ অক্টোবর ২০০২ এ ঢাকা থেকে সুদুর জর্জিয়ায় কিভাবে কিভাবে এলাম, এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। রোজার দিন। আমি আর মেজর ইরশাদ (আমার জুনিয়ার, ১৭ লং কোর্ষের) আমরা একসাথে মিশনের উদ্দেশে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম দুপুরের দিকে। আমি কর্মরত আছি আর্মি হেডকোয়ার্টারে এমটি পরিদপ্তরে আর মেজর ইরশাদ কর্মরত ছিলো এএফডি তে (আর্ম ফোর্সেস ডিভিশন)। দুটুই পাশাপাশি অফিস।

গত কয়েকদিনে মিশন এলাকার ব্যাপারে ওখানে থাকা মেজর আখতার শহীদের সাথে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। মিশন এলাকায় সিএমও (চীফ মিলিটারী অবজারভার) হিসাবে আছেন আমাদের বাংলাদেশের জেনারেল আশফাক। স্যারের সাথেও অনেকবার মেইলে চিঠি আদান প্রদান হয়েছে। একটা আভাষ পাওয়া গেছে মিশন এলাকার ব্যাপারে। সে মোতাবেক মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়ে বাক্স পেটরা গুছিয়ে নিয়েছি।

আমাদের ফ্লাইটটি ছিল ঢাকা থেকে ইস্তানবুল (তুরষ্ক) হয়ে, তুরষ্কেরই আরেকটি প্রদেশ ট্রাবজনে যাওয়া। সেই ট্রাবজনে আমাদের জন্য স্পেশাল ফ্লাইট থাকবে জাতীসংঘের। সেটা দিয়ে আমরা পরেরদিন জর্জিয়ার রাজধানী টিবলিসি শহরে পৌছব। টিবলিসি থেকে আরেকটি ফ্লাইটে আমরা পরের কয়েকদিন পর জর্জিয়ায় যাবো। এই পুরু ভ্রমনটা ঢাকা থেকে জর্জিয়ায় পৌঁছানোর সময় ছিলো মাত্র দুইদিন। অর্থাৎ ৬ তারিখের মধ্যেই আমাদেরকে আমাদের মিশন এরিয়াতে হাজির হইতে হবে।

আমরা যথারীতি রওয়ানা হয়ে গেলাম। পরিবারের সবার কাছ থেকে একটা আবেগঘন বিদায় হলো। আমার দুই মেয়ে ঊম্মিকা আর কনিকা। উম্মিকার বয়স সবেমাত্র ৮ বছর হয় নাই, আর কনিকার বয়স তো মাত্র ৩ ও হয় নাই। আমি জানি মিটুল দায়িত্তশীল মহিলা, সব সামাল দিতে পারবে। বাসা সেনানীবাসের ভিতরেই স্টাফ রোড ১৪৯/৪ নং বাসা। ফলে ওদের নিরাপত্তা নিয়া আমি চিন্তিত ছিলাম না। তারপরেও প্রায় এক বছরের জন্য যাচ্ছি, একটু তো মন খারাপ হবেই, তাইই হয়েছিলো আমার।

রোজা ছিলাম বলে প্লেনের ভিতরে কোনো কিছুই খেতে পারি নাই। প্লেন প্রায় ৫ ঘন্টা উরে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে নামলো। তুরুষ্কে এটাই আমার প্রথম পদার্পন। বিশাল একটা এয়ারপোর্ট। প্রুচুর লোকের আনাগোনা, কেউ ল্যান্ড করেছে, কেউ আবার ফিরে যাওয়ার জন্য লবিতে বসে আছে, ছোট বড় সব বয়সের মহিলা পুরুষের বিস্তর একতা ভদ্র মেলার মতো। কোনো কোনো সৌখিন মহিলারা ট্যাক্স ফ্রি পছন্দের সই কেনা কাটা করছে, কেউ আবার কেনার সামর্থ না থাকলেও দেখাদেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বার, মদের দোকান, সবই আছে। নেশাখোরদের জন্য এটা একতা ভালো ব্যবস্থা। প্রকাশ্যে নেশা করলেও কেউ কিছু বলবে না বিধায় পেটপুরে যতটুকু পানিয় খেলে কন্ট্রোলে থাকা যায় তাতেই বেশ আনন্দ সহকারে খেয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার ফ্লাইট দেরীর কারনে অলস ভাবে কোন এক লোহার চেয়ারে হেলান দিয়ে, কেউ আবার দুই পা তুলে সঠান হয়ে লম্বা একখান ঘুম দিয়ে নিচ্ছে। যারা পেটুক স্বভাবের, তারাও কম যায় না, পেটে জায়গার অভবে যেনো সব কিছু খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও খাওয়া যাচ্ছে না ভেবে আফসোস করছে। কেউ কেউ আবার কম্পিউতার যন্ত্রের সাথে এমনভাবে লেপ্টে আছে, যেনো ইহাইয়া তাহার একমাত্র সাথী আর সংগী। যাই হোক সব কিছু মিলে কিছু কোলাহল, কিছু নীরবতা মিলে বেশ সুন্দর। বাংলাদেশের এয়ারপর্ট দেখলে এয়ারপোর্ট সম্পর্কে যা ধারনা হয়, এই এয়ারপোর্ট দেখলে নিজের দেশের দুরাবস্থার কথা মনে হয়। অথচ দুটুই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে আমাদের একটা কানেক্টিং ফ্লাইট ছিলো সরাসরি ট্রাব্জন এয়ারপোর্টের জন্য। আমি আর ইরশাদ দ্রুত সেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য এখান থেকে সেখানে, লাগেজ নেওয়া ইত্যাদি করতে করতেই আর ইফতারির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ তখন রাত বাজে প্রায় নয়টা। এখানে একতা কথা জানিয়ে রাখা ভালো যে, আমরা সূর্যের অপোজিটে যাচ্ছিলাম বলে যদিও আমরা লোকাল টাইমে রাত নয়টা দেখছি কিন্তু বাংলাদেশ টাইমে আসলে ওটা ছিলো আরো বেশি। ফলে আমাদের রোজার সময়তা এতো বেশি বড় হয়ে গিয়েছিলো আর এতো ধকল যাচ্ছিলো যে, পেটের ক্ষুধায় মনে হচ্ছিলো আর পারছিলাম না। তারপরেও কাজের কারনে বিশেষ করে কানেক্টিং ফ্লাইটের কারনে আমাদের খাওয়া হয় নাই।

আমরা কানেক্টিং ফ্লাইটে উঠে গেলাম ট্রাবজনে যাবো। ছোট একটা তুর্কী বিমান। বেশ লোকজন আছে। একটা জিনিষ খুব খেয়াল করলাম যে, তুরষ্ক একটা মুসলমান দেশ, তার মধ্যে এখন রোজার মাস কিন্তু মেয়েদের কাপড় চোপরের স্টাইল একেবারেই ওয়েষ্টার্ন দেশের মতো। কিছুইতেই বুঝা যাচ্ছিলো না যে, এরা মুসল্মান কালচার ধারন করে।

কিছুক্ষন পর, আমাদের কানেক্টিং ফ্লাইট উড়ে চল্লো ট্রাবজনের উদ্দেশ্যে।