উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
১১
শরীরের কোনো কাটাছেড়া, কোনো বাহ্যিক জখম চোখে দেখা যায়, ক্ষুধা হলে খাবারের অভাবে পেট গুর গুর করে, কিংবা জ্বর সর্দি, কাশি কিংবা মাথা ব্যথা হলে তার সিম্পটম অনায়াসেই বুঝা যায় কিন্তু অন্তরের জখম কি কখনো চোখে পড়ে? অন্তরে কি কখনো জখম হয় আদৌ? আর এই অন্তরটাই বা শরীরের কোন অংগ? এটা কি এমন কোনো জিনিষ যা মাংশ বা হাড় কিংবা এমন কিছু দিয়ে এর গঠন কাঠামো?
সমস্তটা হৃদপিণ্ড তার স্টকে থাকা রক্ত যখন শরীরের সর্বত্র তার নিয়মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সেটাকে বলে সুস্থ্যতা। কিন্তু সেই একই রক্ত যখন তার নিয়মের বাইরে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেটাকে হয়তো বলে দূর্ঘটনা। কিন্তু একই ধমনী, একই শিরায় যখন সেই একই রক্ত একই নিয়মে প্রবাহ হয়, তারপরেও মনে হয় কোথায় যেনো একটা ক্ষরন হচ্ছে, তাহলে এটাকে কি বলে? হয়তো সাহিত্যিকরা বলবেন- এটাকে বলে কষ্ট, এটা হয়তো বেদনা কিংবা হয়তো কেউ বলবেন এটা একটা খারাপ অনুভুতি। তাহলে এই রক্তক্ষরন হয় কোথায়? শিরায়? ধমনীতে? শরীরের কোনো অংগে? আর এই ক্ষরণ হলে কি হয়? আসলে রক্তক্ষরনটা হয় অনুভুতির ভিতরে, ওই সেই অন্তরে যার উপস্থিতি আজো কেউ খুজে পায়নি, বা হাত দিয়ে ধরে দেখেনি। একেবারে ভিতরে, অদৃশ্য। অথচ অনুভুতির এই ভিতরটা কেউ দেখে না। বাইরের চোখে যা দেখা যায়, সেটা ভিতরের অবস্থা না। সত্যটা সবসময় থাকে ভিতরে। আর এই সত্যকে মানুষের কোনো অংগ, না তার হাত, না তার পা, না তার শরীর প্রকাশ করে। এই অদেখা রক্তক্ষরনে হাত অবশ হয়ে যায় না, পা নিস্তব্ধ হয়ে উঠেনা বা কান বধির হয় না। শুধু চোখ সেটাকে লুকাতে পারে না বলে অনবরত সেই নোনা জল দিয়েই হয়তো বলতে থাকে, কোথাও কিছু জ্বলছে, কোথাও কিছু পুড়ছে, কোথাও কিছু ক্ষরন হচ্ছে। না ঠান্দা জল, না কোনো বেদনানাশক ঔষধ না কোনো থেরাপি এই ক্ষরনকে থামাতে পারে। কিন্তু যার চোখ নাই, তারও কি এই ক্ষরন হয়? হ্যা, হয়। তারও এই রক্তক্ষরন হয়। হয়তো তার ভাষা একটু ভিন্ন, স্থিরচিত্তে ক্রয়াগত নীরবতা। তাহলে এই রক্তক্ষরনের সময়কালটা কত? বা কখন এর জন্ম আর কখন তার ইতি? বলা বড্ড মুষ্কিল।
যখন কোনো মানুষ কিছুই না বলে সে তার পরিবার থেকে হটাত করে উধাও হয়ে যায়, তখন ব্যাপারটা অনেক দুসচিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এটা আরো বেশী করে দুশ্চিন্তায় ভোগায় যখন এটা জানা যায় যে, যে মানুষটি চলে গেছে সে সবদিক থেকে অশান্তিতেই ছিলো। এমন অবস্থায় এমনটাই বারবার মনে প্রশ্ন আসে, যে, জীবনের কাছে হেরে যাওয়া মানুষটি আবার মনের কষ্টে কোনো ভুল পদক্ষেপ না নিয়ে বসে। শুরু হয় রক্ত ক্ষরনের প্রক্রিয়া। এই ক্ষরণ অজানা আতংকের।
আবার যখন কোনো মানুষ সবার সামনে থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে চিরতরে ভিন্ন জগতে চলে যায়, তখন দুসচিন্তার প্রকারটা হয়তো অন্য রকমের কিন্তু তারপরেও রক্তক্ষরন হয়। আর সেই ক্ষরণ কখনো ভরষার অভাবের অনুভুতি কিংবা মাথার উপরে থাকা কোনো বট বৃক্ষের অথবা কখনো এটা হয় নিঃসঙ্গতার।
কিন্তু জেনে শুনে, প্রকাশ্যে সবার সামনে দিয়ে যখন বড় কোনো সাফল্যের উদ্দেশ্যে নিজের অতীব প্রিয়জন জীবন্ত চলে যায়, হাসিখুশির অন্তরালে তখন যেনো চলতে থাকে মেঘ-বৃষ্টির খেলা। চলতে থাকে দোদুল্যমান এক অনুভুতি। হাসিখুশি চোখের পাতায়ও তখন দেখা যায় সেই রক্তক্ষরনের এক বেদনাময় কষ্টের অনুভুতি। এই রক্তক্ষরনের প্রধান কারন হয়তো শুন্যতা। তখন যেদিকে তাকাবেন, দেখবেন, সব কিছু ঠিক আগের মতোই আছে, শুধু নাই সেখানে যে বিচরন করতো সেই মানুষটা। তার ঘরের দিকে তাকালে মনে হয়, ওই তো মানুষতা গতকাল ও ওখানে বসেছিল, ওই যে কাপড় টা বাতাসে ঝুলছে, সেটা এখনো সেখানেই ঝুলছে, অথচ সেই মানুষতা আজ ঠিক ওইখানে নাই। আছে অন্য কোথাও, চোখের দৃষ্টির অনেক বাইরে। আর এই দোদুল্যমান অনুভুতি নিয়েই আমি বিদায় জানাতে এসেছি আমার অতীব আদরের ছোট মেয়েকে আজ। বুঝতে পারছি, কোথায় যেনো পূরছে আমার অন্তর, কোথায় যেনো জ্বলছে আমার অনুভুতির সমস্ত স্নায়ুগুলি।
আমি যুদ্ধ দেখেছি, যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি, আগুনে পূড়ে যাওয়া নগরী দেখেছি, ঘনকালো নির্জন রাতে কোনো পাহাড়ি রাস্তা ধরে একা একা হেটে পার হয়েছি। ভয় আমাকে কাবু করেনি। অথচ আজকে আমি এই শান্ত সুষ্ঠ পরিবেশে নির্মল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে যখন আমার ছোট মেয়েকে সুদুর আমেরিকায় যাওয়ার প্রাক্কালে বিদায় জানাচ্ছি, তখন সারাক্ষন রক্তক্ষরনের পাশাপাশি একটা ভয়, একটা আতংক, একটা শুন্যতার অনুভুতিতে ভোগছি। কেনো জানি মনে হয়, আমার ভয় লাগছে। অথচ আমার শরীর সুস্থ্য, আমার ক্ষুধা নাই, তারপরেও কেনো জানি মনে হচ্ছে- কি যেনো আমি ভালো নাই।
আমার মেয়েটা চলে গেলো আজ। বায়না ধরেছিলো-আমেরিকা ছাড়া সে আর কোথাও পড়াশুনা করবে না। সন্তানরা যখন বায়না করে, জেদ ধরে, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা বাবা সেটাকে পুর্ন করার জন্য দায়িত্ত পালন করেন। আমিও সেই বায়নাটা হয়তো পুরন করছি আজ। কিন্তু সেই জিদ বা বায়না আদৌ ঠিক কিনা বা বায়নাটা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা অনেক ক্ষেত্রে আমরা মা বাবা সেটা বিচার করি না। সন্তান কষ্টে থাকুক বা দুঃখ নিয়ে বড় হোক অথবা তার নির্দিষ্ট পথ থেকে হারিয়ে যাক, তাতে মা বাবা এক মুহুর্ত পর্যন্তও শান্তিতে থাকে না। মা বাবা সবসময় তার সন্তানদেরকে সবচেয়ে ভালোটাই দেয়ার স্বপ্ন দেখে। আসলে সন্তান যতো বড়ই হোক আর বৃদ্ধ, মা বাবার ভুমিকা থেকে আজ অবধি কোনো মা বাবা অবসর গ্রহন করেন নাই। কিন্তু তাদেরও কিছু আশা থাকে, স্বপ্ন থাকে এই সন্তানদের কাছে। আমরা বাবা মায়েরা সন্তানদের কাধে শুধু স্কুল ব্যাগ নয়, বরং মা বাবার অনেক আশা ইচ্ছাও ঝুলিয়ে দেই। হয়তো এটাও সেই রকমের একটা বায়না থেকে আমার দায়িত্ব পালনের পর্ব যেখানে একটা সফল, উজ্জ্বল আর সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য আমি অন্তরের রক্তক্ষরনের মতো বেদনাটাও ধারন করছি। আমি জানি, সব সাফল্যের একটা মুল্য থাকে যেটা কাছের মানুষকেই জোগাতে হয়। আর হয়তো এটা সেটাই।
তবে একটা কথা ঠিক যে, আজকের এই অদেখা কষ্টের রক্তক্ষরনের ইতি বা যবনিকা হয় তখন যখন যে মানুষটির জন্য রক্তক্ষরনের জন্ম, সে যখন জীবনের পাহাড় বেয়ে জয় করে সামনে দাঁড়ায়। তখন আজকের দিনের রক্তক্ষরনের সাথে মিশ্রিত হাসিটায় শুধু ভেসে থাকে হাসিটাই। যেমন পানি আর তেলের মিশ্রনে শুধু ভেসে থাকে পানির চেয়ে দামী সেই তেল। তখনো এই চোখ জলে ভিজে উঠে হয়তো কিন্তু তখন চোখ এটা জানান দেয় না, কোথায় যেনো কি পূরছে, কি যেনো জ্বলছে বরং প্রতিটি উচ্ছল হাসিতে ভরে উঠে আনন্দ ধারা।
আমি সেই প্রত্যাশা নিয়েই আজকের এই রক্তক্ষরনের অধ্যায় যাকে আমি যেই নামেই ডাকি না কেনো, বেদনা, শুন্যতা কিংবা আতংক তা শুধু নীরবে মেনে নিয়েই রক্ত ক্ষরনের সেই পোড়া যন্ত্রনাকে বরন করছি। তোমরা সব সময় ঈশ্বরকে মনে রেখো, নীতির পথে থেকে আর মানবতার থেকে বড় কোনো সম্পদ নাই এটা জেনে সর্বদা সেই মানবিক গুনেই যেনো থাকো, এই দোয়া রইলো।
শরতচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তিটাই আজ তোমাদেরকে বলি- ভালোবাসা শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। ‘যেতে নাহি দিবো’ মন বল্লেও বাধা দেয়ার কোনো শক্তি তখন থাকে না, না বাধা দিতে কোনো পথ আগলে রাখি, বরং মনের ভিতরের ‘যেতে নাহি দেবো জেনেও যাওয়ার সব পথ খুলে দেই সেই সাফল্যের জন্য, যা আমার চোখের মনির ভিতরে খেলা করে সারাক্ষন।