রাজনীতি আগের মতো আর কেউ আদর্শের কারনে করে না। দেশপ্রেম, জনগনের দুঃখলাঘব, বৈদেশিক সম্পর্ক আরো দৃঢ়করনে দেশকে উচ্চতর আসিনে বসানো ইত্যাদি এখন আর রাজনীতিবিদদের স্লোগান নয়। প্রতিটা দেশেই এই চিত্র। হোক সেটা আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা বা এশিয়া অঞ্চল। এটা হয়ে গেছে এখন মুলত ব্যবসায়ীক প্লাটফর্ম, কারো কারো জন্য ঝড়ের রাতে একপ্রকার একটা ঘাটের আশ্রয়ের মতো, আবার কারো কারোর জন্য এটা নিছক একটা আইডেন্টি থাকা দরকার তারজন্য। যারা ব্যবসায়ীক মুটিভেশন নিয়ে রাজনীতি করেন, তাদের অর্থবৈভব থাকায় তাদের অবস্থান এক, যারা ঝড়ের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে শুধুমাত্র বেচে থাকার তাগিদে একটা ঘাট হইলেই হয় ভেবে ঢোকেন, তাদের অবস্থা অন্য। আর যারা শুধুমাত্র একটা আইডেন্টি থাকার জন্য রাজনীতিতে আসেন তাদের অবস্থান তো আরো ব্যতিক্রম। তবে যেভাবেই বলি না কেনো, এটা অনেকটা দাবা খেলার গুটির মতো। যার অর্থ আছে, সে বসে রানীর পাশে, রাজার পাশে, মন্ত্রীর পাশে, অথবা থাকে মন্ত্রীর পাশে ঘোড়া, কিংবা হাতী ইত্যাদি হয়ে। তারা অনেক দূরের কোনো গুটিকে আক্রমন যেমন করতে পারে তেমনি তাদের সুরক্ষার জন্যেও ঢাল তলোয়ার থাকে। কারন তাদের ভ্যালু আলাদা।
আর যারা ঝড়ের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে শুধুমাত্র বেচে থাকার তাগিদে একটা ঘাট হইলেই হয় ভেবে ঢোকেন, এদের অবস্থাটা এ রকম যে, গরম কড়াই থেকে উনুনে পড়ার মতো। রাজনীতিতে ঢোকলেও অরক্ষিত আবার না ঢোকলেও অরক্ষিত। ফলে দলে তাদের অবস্থানটা সেই রানী, রাজা মহারাজারা কিংবা মন্ত্রী, হাতীরা সেভাবেই দেখেন যেভাবে তারা দেখেন একটা এতিমকে। কখনো তারা তাদের মাথায় হাত বুলান, আবার কখনো তারা তাকে সামনের সুনামীতে পাহাড়াদার করেন, আবার এমনো হয় তারা কখনো কখনো তাদের পরিচয়টাও ভুলে যান।
আর তৃতীয় সম্ভাব্য স্তরের কথা তো আরো ভয়াবহ। তারা শুধু একটা আইডেন্টিই পান, তার না থাকে রাজা-রানীর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা, না পান তাদের কাছে কোনো আর্জি রাখার সরাসরি দরবার, না পারেন নিজের জন্য কিছু করতে। এই পক্ষটার সামনেই ঝুলে থাকে আরো দুটু শক্ত স্তরের দেয়াল। তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হয়না সেই প্রথম স্তরের মতো বিচরন করা বা সেই দেয়াল টপকিয়ে সামনে আসা। কারন এদের আবির্ভাবই হয়েছে শুধুমাত্র “আছি”র মতো একটা আইডেন্টি পাওয়ার জন্য। সেটা তো সে পেয়েছেই।
এই দুই পক্ষের যাদের অর্থবৈভব নাই, তারা হবেন প্রথম সারির সৈনিক। এই সৈনিকদেরকে হাতী খাবে, ঘোড়া খাবে, কিস্তিতে মাত করবে, আবার অপর পক্ষের সৈনিকেরাও এই আমজনতা সৈনিকদেরকে খাবে। এরা মরার জন্যই গুটির প্লেটে জন্ম নেয়। এদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা একপা এগুনোর, দুইপা হয়তো কখনো কখনো যেতে পারে কিন্তু সেটা খুবই কদাচিত। তবে কখনোই অনেক ঘর পেরিয়ে রানী-রাজার কাছে যেতে পারেন না।
রাজনীতির দোলাচলে যখন ক্ষমতার দন্দ বা পালাবদল হয়, তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পরবর্তী দুই স্তরের বাহিনীর। তারা এবং তাদের সাথে তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন অনেক কিছু হারায়, বন্ধু হারায়, নাগরীক সুবিধা হারায়, সমাজও হারায়, বঞ্চিত হয় অনেক মৌলিক অধিকার থেকে। তারসাথে যেটা যোগ হয় সেটা আরো করুনতর। কারন কোনো কিছু না করেই দাড়াতে হয় কাঠগড়ায়। আর সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বুঝা যায় পৃথিবীতে কোনো আদালত আজ পর্যন্ত স্বাধীন হয় নাই। কন্ঠের সর্বোচ্চ চিৎকারেও কেউ শুনতে চায় না, দুঃখের করুন কাহিনী কিংবা অবিচারের কষ্ট। তখন অনেক সহৃদয় বন্ধু, কাছের কিছু মানুষেরাও তাঁর সাহাজ্যে আসতে চাইলেও আসতে পারেন না। কারন তখন আক্রান্ত মানুষটি একটি ব্রান্ড। ব্রান্ডের যেমন আলাদা মুল্যায়ন, তেমনি অবমুল্যায়নও হয়। ব্রান্ড হওয়া খুব বিপদজনক।
মানুষের জীবনটা খুব ছোট। এই ছোট জীবনে প্রতিদিন আকাশ দেখলেও আকাশের মিষ্টি দৃশ্য দেখে শেষ করা সম্ভব না, বৃষ্টির দিনে ভিজলেও যে মজা সেই মজাটা এই ছোট জীবনেও উপলব্ধি করে শেষ করা যায় না। রাস্তার ধারে অবহেলিতভাবে যে লাল ফুলটা প্রস্ফুটিত হয়ে আছে, তাঁর রুপটাও কোনো এক শিশির ভেজা সকালে দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। এই ব্রান্ডেড রাজনীতির কারনে আমাদের ছোট এই জীবনের অনেকটা সময় ক্ষমতার দন্দে বা দোলাচলে এসব হয়তো অনেকের ভাগ্যেই আর জোটে না। তাদের পা দৌড়াতে দৌড়াতে যখন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন দিনের শেষ আলোটা প্রায় নিভু নিভু।