ওয়াকফ হচ্ছে নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে আল্লাহর মালিকানায় নিবেদিত করা। এর মাধ্যমে সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ ওয়াকফকৃত বস্তু কারো মালিকানায় প্রবেশ করা থেকে বেরিয়ে যাবে, শুধু বস্তুর উপকার যাদের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে তাদের জন্য নির্ধারিত হবে।
ওয়াকফ দুই ধরনের হয়ঃ
(ক) ওয়াকফ ই লিল্লাহ
(খ) ওয়াকফ আল আওলাদ
ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত সম্পত্তি। এই সম্পদ থেকে তিনি বা তার বংশধর কোনো মুনাফা ফিরে পেতে পারে না। অন্যদিকে কোনো সম্পত্তির মালিক তার সম্পত্তি নির্দিষ্ট অংশ ধর্মীয়, সৎকাজ বা জনহিতকর কাজের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশে দলিলের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি দান করলে তাকে ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ বলে।
যেভাবেই ওয়াকফ করা হোক, ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক ওয়াকফ প্রশাসক।
যিনি ওয়াকফ করলেন (যাকে বলা হয় ওয়াকিফ) তাঁর জীবদ্দশাতেও তিনি আর সেই ওয়াকফ করা সম্পত্তির মালিকানা থাকেন না। তিনিও আর ইচ্ছে করলে সেই ওয়াকফ করা সম্পত্তি কখনোই ফেরত নিতে পারেন না। একবার যদি কার্যকরীভাবে ওয়াকফ সম্পাদিত হয় তাহলে তা প্রত্যাহার কিংবা বাতিল করা যায় না, যাবেও না। উক্ত সম্পত্তির মালিক তখন ওয়াকফ প্রশাসক।
ওয়াকফ আল আওলাদের ব্যাপারে শুধুমাত্র যাদের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে, তারা ওয়াকিফের জীবদ্ধশায় এবং ওয়াকিফের মৃত্যুর পরেও ওয়াকফ দলিল মোতাবেক সম্পত্তিতে উপকার পেতে পারেন। আর সেটাও নিশ্চিত করেন এই ওয়াকফ প্রশাসক।
ওয়াকফ প্রশাসকের তত্তাবধানে এবং ওয়াকফ দলিলে উল্লেখিত ওয়াকিফের শর্ত অনুযায়ী ওয়াকফ প্রশাসন ‘মুতোয়াল্লী” নিয়োগ করেন যিনি ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনার জন্য নিযুক্ত। মুতাওয়ালি্ল কেবল সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওলাদ হলেও সম্পত্তির মালিক নন। তিনি শুধু ওয়াকফ দলিলে উল্লেখিত তার জন্য নির্ধারিত অংশের ভোগকারী।
ওয়াকফকৃত সম্পত্তি কারো নিকট বিক্রয়, কিংবা একে হেবা বা মিরাসের (ওয়ারিশি) বিষয়বস্তু করা যায় না। তবে ওয়াকফ প্রশাসন যদি ক্ষেত্র বিশেষে এরুপ কোনো পদক্ষেপ নিতে চান, তা শুধুমাত্র ওয়াকফ প্রশাসক আইনের মধ্যে তা করতে পারেন।
ওয়াকফ আল আওলাদের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি ব্যাপার জানা অবশ্যই প্রয়োজনঃ
১. ওয়াকফ দলিলে যে নিয়ম পদ্ধতি লেখা হয় তার কোনো প্রকার ব্যতিক্রম করা যাবে না।
২. দলিলে সৎ কাজের জন্য যে অংশ নির্দিষ্ট আছে সে অংশ ঐসব কাজে ব্যায় বা ব্যবহার করতে হবে।
৩. শরীকদের বা আওলাদদের জন্য "ওয়াকফ আল আওলাদ" দলিলে যেভাবে ভোগ দখলের নিয়ম উল্লেখ থাকবে শরীকগন/ আওলাদগন ঠিক সেভাবেই ভোগ দখলের অধিকারী হবে। কোনো আওলাদ কিংবা শরীক অন্য কোনো আওলাদ বা শরীকের ভোগ দখলে কোনো প্রকার বাধা দিতে পারবে না। তবে যদি কোনো আওলাদ তাঁর প্রাপ্য অংশের সুবিধা ভোগ করা থেকে অন্য কোনো আওলাদ বা শরীক দ্বারা প্রবঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন, তাহলে ভুক্তভোগী আওলাদ শুধুমাত্র ওয়াকফ প্রশাসনের কাছে তিনি তাঁর নালিশ পেশ করতে পারেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে, যেহেতু ওয়াকফ করা সম্পত্তির মালিক ওয়াকফ প্রশাসন নিজে এর মালিক কোনো আওলাদ নহেন, ফলে ওয়াকফ প্রশাসনের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে ধরে নেয়া যায়।
৪. ওয়াকফ আল আওলাদের ওয়াকফ সম্পত্তির মধ্যে ওয়াকিফের আওলাদ কিংবা আওলাদের আওলাদগন শুধুমাত্র তাদের জন্য নির্ধারিত অংশেই ভোগ করার ক্ষমতা রাখেন। অন্য আওলাদ কিংবা আওলাদের আওলাদগন কোনো অংশেই অন্য কোনো আওলাদ বা তাদের আওলাদগনের ভোগ দখলের কোনো সুযোগ নাই, কিংবা বাধা দেয়ারও কোনো সুযোগ নাই। যদি কোনো আওলাদ এরুপ কোনো কাজ করতে চান, তাহলে তিনি অন্যের সম্পত্তি দখলের পায়তারার মামলায় অপরাধী সাব্যস্থ্য হবেন। আর এখানে মামলা হবে দেশ (ওয়াকফ প্রশাসন) বনাম উক্ত অপরাধী।
৫. ওয়াকফ আল আওলাদ সম্পত্তিতে ওয়াকিফ কর্তৃক যদি কোনো জেনারেশন উল্লেখ করে সীমাবদ্ধ না করেন (যেমন ৩য় জেনারেশন অবধি কিংবা ৪র্থ জেনারেশন অবধি ওয়াকফ আল আওলাদ করা হলো ইত্যাদি), তাহলে আওলাদের বংশধরগন বংশ পরম্পায় ভোগ দখলের জন্য উপযুক্ত থাকবেন।
৬. সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য যেভাবে মোতাওয়াল্লী নিয়োগের বিধান রাখা হয় সেভাবে মোতায়াল্লী নিয়োগ হবে। কোনো কারনে যদি দলিলে উল্লেখিত শর্ত মোতাবেক মোতোয়াল্লী না পাওয়া যায়, তাহলে ওয়াকফ প্রশাসন তাঁর ইখতিয়ারে মোতোয়াল্লী নিয়োগ করতে পারবেন।
৭. ওয়াক্ফ কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে মোতাওয়ালী ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নতির জন্য আংশিক হস্তান্তর করতে পারবেন। অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর হলে গ্রহীতার অনুকূলে স্বত্ত সৃষ্টি হবে না।
৮ মোতোয়াল্লী ওয়াকফ সম্পত্তির সচীবের ন্যায় বা অনেক সময় মেজিষ্ট্রেটের ন্যায় দায়িত্ব পালন করেন। ওয়াকফ প্রশাসনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হচ্ছেন মোতোয়াল্লী। যে কোনো প্রকারের অভিযোগ, সমস্যা, পরামর্শ সরাসরি মোতোয়াল্লীর মাধ্যমে ওয়াকফ প্রশাসনের কাছে প্রেরন করতে হয়।
এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হচ্ছে-ওয়াকফ করা সম্পত্তিতে যে যাই কিছু করুক না কেনো, সেটা অবশ্যই ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতিতে করতে হবে, কারন ওয়াকফ করা সম্পত্তির মাটির উপরে এবং নীচে অবস্থিত প্রতিটি বস্তু, মাটি, গাছপালা, কিংবা অন্যান্য পদার্থ সব কিছু ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক হিসাবে ওয়াকফ প্রশাসনের । উদাহরন দেই-
ধরুন, ওয়াকফ আল আওলাদ হিসাবে কেউ তাদের অংশে বসবাসের জন্য যদিও অনুমোদিত কিন্তু তারাও ঐ সম্পদের উপর যে কোনো কিছু করার আগে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। যদি ওয়াকফ দলিলে আওলাদদের দ্বারা বিল্ডিং কিংবা ইমারত তৈরির অনুমতিও থাকে সেটাও ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমতিসমেত করা আবশ্যক। অনুমতি ছাড়া যদি তারা ওখানে গাছ পালা বা বৃক্ষরাজীও লাগান, কিংবা অস্থায়ী কোনো দেয়ালও দেন, সেটা তারা দিতেই পারেন, কিন্তু সেটাও তখন ওয়াকফ প্রশাসনের সম্পত্তি বলে গন্য হবে। ফলে কেউ যদি সেই আরোপিত গাছ/বৃক্ষ কিংবা দেয়াল নিজেদের ইচ্ছায় কেটে ফেলতে বা ভাংতে চান, তাহলে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি বাধ্যতামুলক। কারন ওয়াকফ করা সম্পত্তি ওয়াকফ প্রশাসনের। মালিক তারা। আওলাদগন কোনো অবস্থাতেই মালিক নন, তারা শুধু ভোগকারী। এখানে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করা বাঞ্চনীয় যে, ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি ব্যাতিত ওয়াকফ সম্পত্তিতে কোনো কিছু করা অন্যের জমিতে বিনা অনুমতিতে করার শামিল।
ব্যাপারটা এমন যে, কেউ রাস্তার ধারে কয়েক শত গাছ লাগালো , গাছগুলি বড় হলো, কিন্তু সেই ব্যক্তি সেই গাছগুলি আর নিজের ইচ্ছায় কাটতে পারে না, তখন রাস্তার ধারে লাগানো গাছগুলি সরকারের মালিকানায় চলে আসে। এটা যেইই লাগাক।