১২/১০/১৯৮৬-হিন্দুদের পুজায় একদিন

২৫ আশ্বিন, ১৩৯৩

গতকাল সন্ধ্যার পর  হিন্দুদের এক পুজা দেখতে গিয়েছিলাম। পুজা দেখাটা আমার শখের মধ্যে একটা।  হিন্দু সমাজে কাস্টভেদে অনেক প্রকারের রেওয়ায চালু আছে। পথে যেতে যেতে  দেখলাম, একটা ছোট বালিকা তার থেকে আরও বড় একজন বালিকার সামনে দাঁড়িয়ে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়ছে। আবার কেউ ভাইকে সামনে রেখে বোন, বোনকে সামনে রেখে ভাইও মন্ত্র পড়ছে। একটা সুতা পড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা খুব বড় কিছু না কিন্তু এটা একটা রেওয়াজ হয়তো।

প্রতিটি ধর্ম ভালো কথা বলে, প্রতিটি রেওয়াজ কোন না কোন মহৎ একটা উদ্যোগে তৈরী হয়। এইসব উদ্যোগ পরবর্তীতে কে কিভাবে পরিশোধন করে সমাজে কি অঘটন আর কি শুভ লক্ষন নিয়ে আসে, তা দেখার জন্য অনেকটা সময় পার করতে হয়। আজকে এই যে রেওয়াজ টা দেখছি, তার মাহাত্য হচ্ছে, এতে বড় আর ছোটর মধ্যে একটা ভালবাসার বন্ধন তৈরি করা, একটা শ্রদ্ধার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ছোতদের শিখিয়ে দেয়া যে, বড়দের সম্মান করতে হয়, আর বড়রা শিখে যে, ছোটদের ক্ষমাকরে দিতে হয়। এটা আজীবনকাল হয়তো চলবে আর এভাবেই বেঁচে থাকবে ওদের বন্ধন। হয়ত আজ সারদিন ওরা ঝগড়াও করেছিল, কিন্তু এখন সব ঝগড়া ভুলে পুজা করছে। একজন দিচ্ছে আর আরেকজন নিচ্ছে। দিনশেষে কারোর কোন  কষ্ট নাই আর। ছোট পুজার ছলে ক্ষমা চেয়ে নিলো আর বড় ভালবাসায় সিক্ত করে দিল ছোটকে। বড় সুন্দর  দৃশ্য। এই রকম আরো অনেক ছোট ছোট রেওয়াজ প্রায় সব ধর্মের মধ্যেই আছে।

পুজা মণ্ডপে পৌঁছে গেছি, গিয়ে দেখলাম দশহাতওয়ালা একটা মানব, সাথে একটা বাঘের মুখ। বাঘের মুখে মানবের ডান হাত কামড়ান। আরেক হাতে একটা তীর ছুড়ানো, অন্য হাতে ছায়া প্রদানের উৎস, প্রকৃত অর্থ প্রতিটি হাতে দাড় করানো হয়েছে। ওটা হচ্ছে দেবী। এই দেবীর আসে-পাশে আরও অনেক দেব-দেবি আছে। দেবীর পিছনে একটা মহাশূন্য আছে, তাতে কয়েকটা নক্ষত্রও জ্বলছে। পুরো জিনিষটা একটা ঘরের মধ্যে রাখা। ঘরের চারদিকে  মোমবাতি  জ্বালানো। আগরবাতিও আছে, কিছু সুগনধি আছে, পরিবেশটা ভাল লাগছে। একটু একটু ঠাণ্ডা আছে, কিন্তু শীত পড়েনি এখনো। দেবীর সামনে কিছু কুমারী, কিছু বৃদ্ধা, কিছু বিবাহিতা পুরুষ ও মহিলা  সজল নয়নে নতজানু হয়ে বসে আছে। আর তাদের এক পাঁশে একজন লোক বিভিন্ন ধরনের বাতি দিয়ে দেবতাকে বিভিন্ন ধরনের রঙে সাজিয়ে তুলছে। ঘরের বাইরে প্রচণ্ড জোরে জোরে ঢোল বাজতেছে, সঙ্গে পিলচি, এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক যুবক যুবতী নাচতেছে। পুরো জিনিসটা একটা পুজা। অনেকক্ষন পুজা মণ্ডপে থাকলাম, দেখলাম, কিছু খাওয়া হল এখানে। এটা ফ্রি। যে আসে সেই খেতে পারে। কে এখানে মুসলমান, আর কে এখানে খ্রিস্টান, তারা এটা ভাবে না। তারা ভগবানের জন্য পুজা করছে, এটাই বাস্তবতা।  রাজনীতির কোন আলাপ এখানে হয় না, মেয়ে মানুষ নিয়ে এখনে কোন আলাপ হয় না, এখানে যে যার মত করে ভাবে।

এখানে এখনো হিন্দুদের সাথে সব ধর্মের মানুষেরা তাদের পুজা মন্ডপে আসে। অনেকে আবার মূর্তি পুজা করে হিন্দু সমাজ এটা ভেবে পুজা মন্ডপের ধারে কাছেও আসেন না। আমি অনেকবার অনেকভাবে চিন্তা করে দেখেছি, কেনো এতো শু=ইক্ষিত হিন্দু মানুষগুলিও সাধারন একটা নিজের বানানো মাটির পুতুলের সামনে এই রকম করে নতজানু হয়ে পুজা করে? তারা কি বুঝে না যে, এটা একটা মূর্তি? এটার কোন ক্ষমতা নাই? এর কাছে চাওয়ার কিছুই নাই? জানে তারা। তাহলে তারপরেও কেনো করে? সম্ভবত ব্যাখ্যাটা এই রকম নয় যা খালি চোখে দেখা যায়।

ধরুন, আপনি একটা মেয়েকে বা কোনো এক ব্যক্তিকে অথবা কোনো এক ক্ষমতার উতসকে মন থেকে অনেক ভালোবাসেন, সম্মান করেন, অথবা এমন একটা ব্যাপার যে, আপনি তার জন্য নিজের জীবন ও বিপন্ন করতে দ্বিধা বোধ করবেন না। এই ভালো লাগার ব্যক্তিটি জীবন্ত একতা স্বত্বা। যখ সে আপনার সামনে থাকে, তার কারনে আপনি অনেক গর্হিত কাজ, অনেক অসদাচারন, কিংবা কোন অন্যায় কাহ করতে পারেন না। সে যদি আপনাকে কোনো কাজ করতে বারন করেন, আপনি বিনা দ্বিধায় তা পালন করেন। এটাই সেই স্বত্বার সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। সে আপনার ইন্দ্রিয় কন্ট্রোল করে, আপনার মনোভাব পরিবর্তন করে, অথবা সে আপনাকে পরিচালিত ও করে। এই অবস্থায় ধরুন যে, সে আর আপনার সামনে নেই। আপনি মনে মনে তাকে আগের মতো ভালবাসেন, শ্রধ্যা করেন, তার আদেশ নিষেধ পালন করেন, কিন্তু যতোটা ইফেক্ট তার উপস্থিতিতে করা হয়, তার অনুপস্থিতিতে এই ইফেক্ট অনেকাংশেই কমে আসে। বা কমে যায়। এটা ইচ্ছা কৃত নয়। এতা একতা প্রভাব। কিন্তু যদি সেই একই ব্যক্তির একটা প্রতিমা বা ছবি বা এমন কিছু আলামত সামনে রাখা যায় যাতে মনোযোগ অন্যত্র চলে না যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, একেবারে অনুপস্থিত অবস্থার থেকে প্রতিমা বা ছবি রাখলে মনোযোগের মাত্রাটা একটু বাড়ে। এজন্য বাড়ে যে, মনে হবে তিনি আমাকে দেখছেন বা আমি তার সামনেই আছি। আসল কথা হচ্ছে, পুজাকারী ব্যক্তি আসলেই এই প্রতিমাটাকে বা তার ছবিকে পুজা করছে না, করছে যার প্রতিমা বা ছবিটা সামনে আছে তাকে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি যখন এই পুরু জিনিষটা দেখে, মনে হবে সে আসলে নিজের তৈরী এই মাটির মুর্তিকেই পুজা করছে। এখানেই দেখার আর বুঝার পার্থক্য।

যাক, আমি ধর্ম নিয়ে অনেক কথা বলতে চাই না। যার যার ধর্ম সে সে পালন করুক। কারন কে ঈশ্বর আর কে ভগবান আর কে আল্লাহ, এর বিচার প্রতিটি ব্যক্তির নিজসস ব্যাপার। ঈসশরের বা আল্লাহর কাছে সে নিজে একা জবাব্দিহি করতে হবে। ফলে অন্তরে তার কে বাস করে, কিভাবে বাস করে এটা জানেন শুধু একজন। সেই মহাম স্রিষ্টিকর্তা।

আজকের পুজা মন্ডপে এসে যা বুঝেছি তা হলোঃ একটা  সময় আসবে যখন ধর্ম নিয়ে আরো অনেক বিড়ম্বনা আছে। এই ধর্ম একদিন সমাজের মানুষগুলিকে আলাদা করে ফেলবে। এই ধর্মের কারনে কেউ সমাজ হারাবে, কেউ তার পরিচয় হারাবে। আবার এই ধর্মের কারনেই মানুষ একে অপরের সাথে দন্দে জড়িয়ে পড়বে, শান্তি নষ্ট হবে।  

আমি যদি আমার কথা বলি- সেটা হচ্ছে, মানুষ গুলিই প্রধান। আমার মুসলমান বন্ধুরা যেমন আমার কাছে প্রিয়, ঠিক তেমনি হিন্দু বন্ধুরা ও আমার কাছে সমান প্রিয়। ওদের থালায় খাবার খেতে আমার কোনো আপত্তি থাকে না। আবার ওদের প্রয়োজনে আমার শরীরের রক্ত ডোনেশন করতেও আমার কোনো দ্বিধা নাই।