১২/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব-৩

নিউ লংকার ক্যাম্প-পর্ব-৩ 

ক্যাম্প লাইফ ভীষন বোরিং। কতক্ষন একটা ছোট জায়গায় বন্দি হয়ে থাকা যায়? ভাবলাম, পাশের গ্রামগুলিতে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবো। ওদের সাথে একটা সামাজিক বন্ধন তৈরী করলে অসুবিধা কি? আমরা তো সমাজের বাইরে কেউ না। আর আমি তো এখানে আছিই এই সেতুবন্ধনের মতো একটা ভালো পরিবেশ তৈরী করে এই এলাকাকে নিরাপদ করা।  সে মোতাবেক, আমি একটা সিডিউল করলাম, কিভাবে কখন কি নিয়ে ওদের সাথে আলাপ করা যায়, কিভাবে ওদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়। যে যতো কিছুই বলুক, আর্মির উপস্থিতি কোনো উপজাতী পছন্দ করে না। এটা তারা মনে করে তাদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। অনেকে হয়তো সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু তাদের আকার ইংগিত আর চালচলনে এটা খুবই স্পষ্ট। ওরা আসলেই আমাদের আর্মিকে পছন্দ করে না। কিন্তু বন্দুকের নলের সামনে আর যাই হোক, বাহাদুরী চলে না। তাই ইচ্ছা না থাকলেও ভালো সম্পর্ক আছে এটাই প্রকাশ করতে হয় প্রতিটি উপজাতীকে। অথচ আমি হয়তো বুঝতে পারছি না, কোন আচরনটা তাদের শুদ্ধ আর কোন আচরনটা আসলে লোক দেখানো। সত্য এবং মিথ্যার বসতির এই সম্পর্কের মধ্যে না জানা যেমন অনেক কথা থাকে, তেমনি অনেক বিপদের গন্ধও থাকে। না বলা কথা না জানার চেয়ে বিপদের গন্ধটা আচ করতে পারাটা অনেক বেশী জরুরী। তাই আমিও সচেতন হয়েই কিছুকিছু সময় পাশে পাংখু এলাকায় গ্রাম বাসীদের সাথে মেলামেশার চেষ্টা করছি। কিন্তু চোখ কান খোলা আছে।

আমি ক্যাম্প লাইফটাকে আরো সহজ এবং আরামদায়ক করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তার মধ্যে একটা হচ্ছে- ক্যাম্পে মাটি কেটে কেটে মাটির উপরেই ম্যাপের মত বিভিন্ন স্থান তৈরী করা যা বর্তমান আমার এলাকায় আছে। যেমন কার বাড়ির পাশে কার বাড়ি, কোন গ্রামের পর কোন গ্রাম, কোন কোন রাস্তা আছে কোন কোন জায়গায় যেতে, কোথায় টংঘর, কোথায় রুট প্রোটেকশন ক্যাম্পগুলি আছে ইত্যাদি। ক্যাম্পের সৈনিকদের বেশ সারা পাওয়া গেলো। আমরা যার যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা মুটামুটি মাটির অপারেশন রুম বানিয়ে ফেললাম।

আমার ক্যাম্পটা খুব বেশী বড় না। মোট ৫টা ঘর। একটা আমার ঘর, একটা মসজিদ, একটা ছোট ওয়্যারলেস রুম কাম সৈনিকের থাকার জায়গা, একটা টিভি রুম। আরেকটা ঘর বেশ বড় সেখানে সৈনিকেরা থাকে, সাথে একটা ক্যান্টিন। রান্নাঘর, বাথরুম, এগুলি সব আলাদা। প্রচুর গাছপালা আছে। ক্যাম্পের অদূরেই আরেকটা হিলটপ আছে যেখানে আমরা হেলিপ্যাড বানিয়েছি। যখন হেলিসর্টি হয়, তখন এই হেলীপ্যাডেই হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে। আমাদের হেলিপ্যাডটা আমাদের সেন্ট্রিপোষ্ট এর অস্ত্র দ্বারা কাভার করা। এটা খুবই জরুরী। আমার রুমটা যেখানে, সেটা মেইন গেটের একদম সাথে। আমার ঘরটার পিছন দিয়ে ছোট একটা রাস্তা গেছে যাতে আমি অন্যান্য সেন্ট্রি পোষ্টগুলিতে অনায়াসেই যেতে পারি। ক্যাম্প সুরক্ষার জন্য আমি মোট তিনটা জায়গায় ইন্টারলক সিস্টেমে সেন্ট্রিপোষ্ট লাগিয়েছি। দিনের বেলায় সেন্ট্রি পোষ্টগুলিতে একজন আর রাতের বেলায় দুইজন করে ডিউটি করে। সবার কাছে একটা করে হুইসেল আর টর্চ লাইট দেয়া আছে। সেন্ট্রিপোষ্টের অস্ত্রটি একটি লোহার চেইন দিয়ে বাধা যাতে কোনো কারনে রাতের বেলায় সেন্ট্রি তার অগোচরে ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে শান্তিবাহিনী অস্ত্রটি তুলে নিয়ে যেতে না পারে।

আমি ক্যাম্পের তিনপাশেই তিনটা বেতের চেয়ারের মতো করে বাশের কঞ্চি দিয়ে দিয়ে চেয়ার বানিয়েছি যাতে আমি ওখানে বসতে পারি। পড়ন্ত বিকালে কিংবা খুব সকালে এই জায়গাগুলিতে বসে প্রাকৃতিক সউন্দর্য দেখতে বড্ড মিষ্টি মনে হয়। খুব ভোরের আকাশ আর সুর্যাস্তের আকাশে একটা বড্ড মিল আছে। দুটি সময়েই আকাশকে বড় নির্মল মনে হয়। লাল আভায় ফুটে উঠে চারিদিকের পাহাড়। সুর্যের প্রথম আলো যখন আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের উপর প্রতিফলিত হয়, তখন মেঘের রঙেও একটা শৈল্পিক রুপ ধারন করে।  দূরের পাহাড়ের গাছপালাগুলি আমার ক্যাম্প থেকে দেখলে এমন মনে হয় যেনো, আমি পুরু পাহাড়টার উপর থেকে নীচের বনরাজ্যকে দেখছি। আমার ক্যাম্প থেকে বঙ্গোপসাগরের পানি দেখা যায়। সেই সুদুর সাগর, নীল আকাশ আর পাশের পাহাড় একসাথে মিলে কি যে এক অদ্ভুদ নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ভাবাই যায় না।  

মাঝে মাঝে সারাদিন বৃষ্টি হয়। মুষল্ধারে যখন বৃষ্টি হয়, তখন কোথা থেকে যে কয়েকটি কাক আমার ঠিক ঘরের নীচে বেল্কনীর মতো একটা জায়গায় এসে আশ্রয় নেয় জানি না। হয়তো আশেপাশেই এর বাসা। ব্রিষ্টির কারনে আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থান্ডা ভাব থাকে, শীত শীত ভাব থাকে। আমি তখন কম্বল গায়ে দিয়ে ব্রিষ্টির পানি পড়তে দেখি। আমার গ্রামের কথা মনে পড়ে, আমার মায়ের কথা মনে পড়ে, আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে। 

এবার বলি আমি এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে কিভাবে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনাটা করলাম। পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষিত লোক নাই এটা বললে একেবারেই ভুল হবে। এদের সমাজের মধ্যেও এরা কাউকে মানে, কাউকে গুরু মনে করে আবার কাউকে শসাওন ও করে। এদের নিজস্ব একটা বলয় আছে যা আমাদের তথাকথিত সমাজের বাইরে। আমি এখানকার হেড ম্যানকে মাঝে মাঝে ডাকা শুরু করলাম। তাকে আমিও হেড ম্যান হিসাবে অথবা একটা গুরুজন হিসাবে দেখা শুরু করলাম। সে যখন ক্যাম্পে আসে, আমি তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। ওরা অনেক কষ্ট করে যে ফসল ফলায়, তার থেকে কিছু ফসল নিজেদের জন্য রেখে সেই বহুদূর বাকীটা বিক্রি করে। আমরা অবশ্য আমাদের সব খাবার দাবার হেলি সর্টির মাধ্যমে চিটাগাং থেকে আসে বিধায় আমরা ইচ্ছা করলেও আমরা পাহাড়ি উপজাতীর কাছ থেকে সব পন্য কিনতে পারি না। তারপরেও আমি দেখেছি আমার সৈনিকেরা মাঝে মাঝে কিছু পন্য ওদের থেকে কিনে থাকে। তাই ভাবলাম, আমরা পরিকল্পনা করে যদি কিছু জিনিষ পত্র কিনতে থাকি, তাহলে ওরাও আর কষ্ট করে এতোদূর হাটে গিয়ে পন্য বিক্রি করতে হয় না। যারা এই পন্য ক্যাম্পের পাশেই বিক্রি করতে পারবে, তারাও ধীরে ধীরে ক্যাম্পের মানুষ গুলির সাথে একটা বন্ধুত্ত তৈরী করবে। এছাড়া আরেকটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি যে, প্রায়ই ওরা কিছু না কিছু ট্রাইবাল অনুষ্ঠান করে। আমি ওদেরকে বলেছি যে, যখন কোনো সাহাজ্য লাগবে আমি কিছু কিছু সাহাজ্য করতে পারবো, যেমন রঙ্গিন বেলুন দেয়া, কিংবা কিছু টাকা পয়সা দেয়া ইত্যাদি। এসবের একটাই কারন ছিলো যাতে ওরা মনে করে আমরা ওদেরকে নিষ্পেষিত করতে এখানে আসি নাই, আমরা আর ওরা একই দেশের নাগরিক। আমরা একে অপরের জন্য। দেশটা আমার যেমন, এই দেশটা তাদেরও। আমার এই কর্মশালা ভীষন কাজে দিলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলাম যে, আমরা যখন ওদের গ্রামে পেট্রোল করতে যাই, তাদের আচরন পালটে গেছে, তাদের ব্যবহার আগের থেকে অনেক বেশী আন্তরীক।

ভালোবাসা কে বুঝে না? একটা অবুঝ শিশু ও ভালোবাসা বুঝে যে হয়তো কোনো ভাষাই জানে না। একটা বোবা পশু ও ভালোবাসা বুঝে যে কিনা আমাদের মানুষের সমাজের কোনো আইনের ধার ধারে না। কিন্তু ভালোবাসায় অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়। ক্যাম্প লাইফটা আগের থেকে অনেক ভালো লাগছিলো। এখন আর খুব একটা বোরিং লাগে না। কেউ না কেউ ক্যাম্পে আসেই। কখনো যুবক, কখনো মহিলা, কখনো বয়ষ্ক ব্যক্তিরা। মাঝে মাঝে কয়েক জন মিলেও ক্যাম্প দেখতে আসে। আমি নিরাপত্তার ব্যাপারটা মাথায় রেখে যতোটা সম্ভব তাদেরকে আপ্যায়ন করি। ওরা খুসি মনেই আবার ফেরত যায়। ওরা একটা জিনিষ বুঝে গেছে আমরা ওদের কোনো ক্ষতি করবো না। ওরাও আর আমার ক্ষতি করতে পারে এটার ঝুকিটাও কমে গেছে।