Categories
ট্র্যাবজনে যখন পৌছলাম, তখন রাত প্রায় দশটা। ছোট একটা এয়ারপোর্ট। একেবারেই নিস্তব্ধ। গুটি কতক লোক যেনো পুরু এয়ারপোর্ট টাকে আগলে রেখেছে। দোকান পাট যাও আছে, খদ্দরের অভাবে সে গুলিও প্রায় বন্ধের মতো। এয়ারপোর্ট যতোই নিস্তব্ধ হোক, এর ভিতরের একটা রুপ আছে। সুন্দর, পরিপাটি ফ্লোর, দোকান পাট বন্ধ থাকলেও এদের বাইরের সাইন বোর্ড আর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ার মত। এখানে যে সব দোকান পাট খোলা, তারা যেনো নিরাপত্তার মতো ব্যাপারটা মাথায়ই নাই, কোনো চোর ডাকাতের ভয় নাই। এটা একটা আরেক জগত।
এয়ারপোর্টের ভিতরেই টাকা ভাঙ্গানোর এক্সচেঞ্জ গুলি বসে আছে। সুদুর ঢাকা থেকে ডলার নিয়ে এসেছি কিছু। কোথাও কিছু খেতে গেলে বা কিনতে গেলেও লোকাল কারেন্সি লাগবে। তাই মেজর ইরশাদ বল্লো, স্যার, কিছু দলার চেঞ্জ করে নেই। খারাপ বলে নাই, ভাবলাম, শ পাছে ডলার ভাংগিয়ে নিয়ে যাই। আবার ভাবলাম, আগামী কালই তো চলে যাবো তুরস্ক ছেড়ে, এতো ডলার এক্সচেঞ্জ করা কি ঠিক হবে? যাই হোক, সিদ্ধান্ত নিলাম, তিনশত ডলার আপাতত এক্সচেঞ্জ করি। বাকিটা জর্জিয়া গেলে তো ওখানকার লোকাল কারেন্সি লাগবে।
এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটে গেলো যা আমার বা মেজর ইরশাদের অভিজ্ঞতার বাইরে। ডলার ভাঙ্গাতে গিয়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। এদের মুদ্রার নাম লীরা। আর এখানে এক ডলার দিয়ে প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার লিরা পাওয়া যায়। তার মানে আমি যদি এখন ৫০০ ডলার ভাঙ্গাই, তাহলে কত লীরা হবে বুঝতে পারছিলাম না। একি দেশ? তারপরেও, নিলাম। এখন কত পাইলাম, আর কত পাওয়া উচিত ছিলো, আদৌ সব ঠিক মতো পাইলাম কিনা এই অবেলায় ক্ষুধার্থ পেটে আর মাথা কাজ করছিলো না। সারাদিনের প্রচন্ড জার্নীতে শরীর প্রায় অবশ। এখন তাড়াতাড়ি কোনো একতা হোতেলে গিয়ে উঠতে পারলেই যেনো বাচি। প্রায় এক ব্যাগ লীরা নিয়ে এয়ারপোর্ট ছেড়ে ট্র্যাবজন শহরের দিকে ছুটলাম। তখন রাত প্রায় ১১ টার কাছাকাছি। শহরও প্রায় নির্জন হয়ে এসছে।
একটা ভাড়া করা গাড়িতে আমি আর মেজর ইরশাদ ট্র্যাবজন শহরে চলে এলাম, পথে ঘাটে লোকজন নাই বললেই চলে। গাড়ির ড্রাইভার আমাদেরকে একতা সাধারন হোটেলের সামনে এনে কাকে যেনো উচ্চস্বরে ডাক দিলো। যেহেতু আমরা ওদের ভাষা বুঝি না কিন্তু আকার ইংগিতে এটা বুঝলাম যে, সম্ভবত হোটেলের কোনো এক কর্মচারীকে নতুন খদ্দর নিয়া এসেছি এটা জানান দিলো।
একটু পর মধ্য বয়সী একজন লোক এসে তাদের মধ্যে কি কি কথাবার্তা জানি হলো, আমাদেরকে একতা ক্যাল্কুলেটরের মাধ্যমে বুঝাইলো যে, হোটেল ভাড়া এক রুম প্রতি দিনের জন্য প্রায় ৫০ ডলারের সমান। কিছু করার ছিলো না। কারন রাত অনেক, শরীরের উপর অনেক ধকল, এদিকে আবার অন্য কোথাও গিয়ে রুম পাই কিনা, পাইলেও এর থেকে ভালো এবং সস্তায় হবে কিনা জানি না, তাই রাজী হয়ে গেলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়াও কারেন্সীর হিসাব নিয়া বড় বেসামাল। একেকতা নোত এক লক্ষ লীরার সমান। নোটের মধ্যে এতো বড় বড় সংখ্যা যে, পড়তে গেলে এক দুই তিন করে করে খালী শুন্যই গুনতে হয়।
আমি আর ইরশাদ মালামাল নামিয়ে হোটেলে উঠে গেলাম। শীত টা ঝাকালো না কিন্তু আবার কম ও না। ল্যাপ কম্বল সব বুঝে নিলাম। আমরা হাত মুখ ধুয়ে বাইরে খাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলাম। পাশেই একতা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এমন একতা রেষ্টুরেন্ট আছে। আমরা বেশি ঘুরাঘুরি না করে পাশের রেষ্টুরেন্টেই খাওয়ার জন্য ঢোকে গেলাম।
রেষ্টুরেন্টের ভিতরে মাত্র দুজন মানুষ বসে আছে। একজন মহিলা আর আরেক জন পুরুষ। এ গুলি নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নাই। কিন্তু পরে অনুভব করলাম, আমাদের যদিও তাদের নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নাই, কিন্তু তাদের মাথা ব্যথা ছিলো আমাদের নিয়ে। তাদের মধ্যে পুরুষ ব্যক্তিটি আমাদের টেবিলে এসে বসলেন। ভালো ইংরেজী বলতে পারেন। সালাম দিয়ে আমাকেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছি।
এখানে একতা কথা বলে রাখা ভাল যে, মিশনে আসার আগে আমরা তুরস্ক নিয়েও একতা ফিডব্যাক নিয়ে এসছিলাম। এখানকার লোক গুলি নাকি অনেক ফ্রড, সুযোগ আর সময় পেলেই বিদেশি পর্যটকদের ঠকাইতে ছাড়ে না। আমাদের মাথায় এতা ছিলো। ফলে, খুব সহজেই কারো ট্র্যাপে পড়ে যাবো এতা ভাবি না। যাই হোক, লোকটার আমাদের টেবিলে বসার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার এবং মেজর ইরশাদের দুজনের মধ্যেই একই রকম সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিলো। আমরা মোটামুটি একতা সাধারন খাবারের অর্ডার দিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি, আর এই ফাকে ভদ্রলোক আমাদের বিনোদনের জন্য এমন কিছু লাগবে কিনা জানালেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝি নাই।
বললাম, সিগারেট দরকার। কোথায় পাই?
লোকটি হেসে দিয়ে বললেন, আরে সিগারেট পাওয়া যাবে, সাথে কোনো সাথী লাগবে কিনা, লাগলে বলেন।
বুঝলাম, এরা মেয়ে ঘটিত কোনো ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছে।
বললাম, না ভাই, আমরা মুসলমান, এসব ব্যাপারে আমরা আলাপ করতে চাই না। তারপর আগাইয়া এলেন সেই ভদ্র মহিলা। ব্যাপারটা ভালো ঠেকছিলো না। আর হোটেলটার মধ্যে লোক জন একেবারেই নাই। একটু নার্ভাস লাগছিলো যে, এরা আবার কোনো সংঘবদ্ধ গ্যাং কিনা কে জানে। ঠি এই সময়ে তৃতীয় একজন খদ্দর এলেন খাবারের জন্য। মনে হলো তিনীও আমাদের মতো এখানে নতুন।
আমাদের সালাম দিয়ে বললেন, আনারা কি এখানে আজই এসেছেন? বললাম, জী, আমরা জাতী সংঘের লোক। জর্জিয়ায় যাচ্ছি কাল ভোরে। কি মনে হলো, আর কি জানি হলো, আগের দুইজন লোক (মহিলা আর পুরুষটী০ এই নতুন লোকটিকে দেখার পর চলে গেলো।
আমরা মোটামুটি খেয়ে হোটেলে চলে এলাম।
আগামীকাল খুব ভোরে আমাদের ফ্লাইট, তাই কোনো বাক্সই আর খুললাম না। বাথ রুম করে শুয়ে পড়বো, কিন্তু বাথ রুমে গিয়ে দেখি পানি নাই। অনেক দাকাডাকি করেও কাউকে পেলাম না। ফোন আছে রুমে, কাউকে ফোন করেও পাওয়া গেলো না। রিসেপ্সন একটা আছে, কিন্তু কোনো লোক নাই। এয়ারপোর্ট থেকে দুই বোতল পানি কিনেছিলাম, আপাতত সেই পানি দিয়াই সব কাজ সারা হল। মেজাজ খারাপ করার কোনো উপায় নাই। একদিকে ভাষা বুঝি না। অন্যদিকে কেউ নাই যার সাথে রাগ দেখাতে পারি। ফলে আমি আর মেজর ইরশাদ তুরুষ্কের সরকারকে কিছুক্ষন গালাগালি করেই মনের শান্তি লাভ করিয়া ল্যাপ গায়ে দিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম।